Rabindranath Tagore

Classics Drama

0  

Rabindranath Tagore

Classics Drama

গোরা ৬

গোরা ৬

118 mins
3.8K


যখন বিনয়ের বাসায় হারানবাবুর আবির্ভাব হইয়াছে সেই সময়েই অবিনাশ আনন্দময়ীর কাছে গিয়া খবর দিয়াছে যে, বিনয়ের সঙ্গে ললিতার বিবাহ স্থির হইয়া গেছে।

আনন্দময়ী কহিলেন, “এ কথা কখনোই সত্য নয়।”

অবিনাশ কহিল, “কেন সত্য নয়? বিনয়ের পক্ষে এ কি অসম্ভব?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “সে আমি জানি নে, কিন্তু এত বড়ো কথাটা বিনয় কখনোই আমার কাছে লুকিয়ে রাখত না।”

অবিনাশ যে ব্রাহ্মসমাজের লোকের কাছেই এই সংবাদ শুনিয়াছে, এবং ইহা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য তাহা সে বার বার করিয়া বলিল। বিনয়ের যে এইরূপ শোচনীয় পরিণাম ঘটিবেই অবিনাশ তাহা বহু পূর্বেই জানিত, এমন-কি, গোরাকে এ সম্বন্ধে সে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল ইহাই আনন্দময়ীর নিকট ঘোষণা করিয়া সে মহা আনন্দে নীচের তলায় মহিমের কাছে এই সংবাদ দিয়া গেল।

আজ বিনয় যখন আসিল তাহার মুখ দেখিয়াই আনন্দময়ী বুঝিলেন যে, তাহার অন্তঃকরণের মধ্যে বিশেষ একটা ক্ষোভ জন্মিয়াছে। তাহাকে আহার করাইয়া নিজের ঘরের মধ্যে ডাকিয়া আনিয়া বসাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনয়, কী হয়েছে তোর বল্‌ তো।”

বিনয় কহিল, “মা, এই চিঠিখানা পড়ে দেখো।”

আনন্দময়ীর চিঠি পড়া হইলে বিনয় কহিল, “আজ সকালে পানুবাবু আমার বাসায় এসেছিলেন– তিনি আমাকে খুব ভর্ৎসনা করে গেলেন।”

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”

বিনয় কহিল, “তিনি বলেন, আমার আচরণে তাঁদের সমাজে পরেশবাবুর মেয়েদের সম্বন্ধে নিন্দার কারণ ঘটেছে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “লোকে বলছে ললিতার সঙ্গে তোর বিবাহ স্থির হয়ে গেছে, এতে আমি তো নিন্দার কোনো বিষয় দেখছি নে।”

বিনয় কহিল, “বিবাহ হবার জো থাকলে নিন্দার কোনো বিষয় থাকত না। কিন্তু যেখানে তার কোনো সম্ভাবনা নেই সেখানে এরকম গুজব রটানো কত বড়ো অন্যায়! বিশেষত ললিতার সম্বন্ধে এরকম রটনা করা অত্যন্ত কাপুরুষতা।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর যদি কিছুমাত্র পৌরুষ থাকে বিনু, তা হলে এই কাপুরুষতার হাত থেকে তুই অনায়াসেই ললিতাকে রক্ষা করতে পারিস।”

বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেমন করে মা?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কেমন করে কী! ললিতাকে বিয়ে করে!”

বিনয় কহিল, “কী বল মা! তোমার বিনয়কে তুমি কী যে মনে কর তা তো বুঝতে পারি নে। তুমি ভাবছ বিনয় যদি একবার কেবল বলে যে “আমি বিয়ে করব’ তা হলে জগতে তার উপরে আর কোনো কথাই উঠতে পারে না; কেবল আমার ইশারার অপেক্ষাতেই সমস্ত তাকিয়ে বসে আছে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর তো অতশত কথা ভাববার দরকার দেখি নে। তোর তরফ থেকে তুই যেটুকু করতে পারিস সেইটুকু করলেই চুকে গেল। তুই বলতে পারিস “আমি বিবাহ করতে প্রস্তুত আছি’।”

বিনয় কহিল, “আমি এমন অসংগত কথা বললে সেটা ললিতার পক্ষে কি অপমানকর হবে না?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “অসংগত কেন বলছিস? তোদের বিবাহের গুজব যখন উঠে পড়েছে তখন নিশ্চয়ই সেটা সংগত বলেই উঠেছে। আমি তোকে বলছি তোর কিছু সংকোচ করতে হবে না।”

বিনয় কহিল, “কিন্তু মা, গোরার কথাও তো ভাবতে হয়।”

আনন্দময়ী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “না বাছা, এর মধ্যে গোরার কথা ভাববার কথাই নয়। আমি জানি সে রাগ করবে– আমি চাই নে যে সে তোর উপরে রাগ করে। কিন্তু কী করবি, ললিতার প্রতি যদি তোর শ্রদ্ধা থাকে তবে তার সম্বন্ধে চিরকাল সমাজে একটা অপমান থেকে যাবে এ তো তুই ঘটতে দিতে পারিস নে।”

কিন্তু এ যে বড়ো শক্ত কথা। কারাদণ্ডে দণ্ডিত যে গোরার প্রতি বিনয়ের প্রেম আরো যেন দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হইতেছে তাহার জন্য সে এত বড়ো একটা আঘাত প্রস্তুত করিয়া রাখিতে পারে কি? তা ছাড়া সংস্কার। সমাজকে বুদ্ধিতে লঙ্ঘন করা সহজ– কিন্তু কাজে লঙ্ঘন করিবার বেলায় ছোটোবড়ো কত জায়গায় টান পড়ে। একটা অপরিচিতের আতঙ্ক, একটা অনভ্যস্তের প্রত্যাখ্যান বিনা যুক্তিতে কেবলই পিছনের দিকে ঠেলিতে থাকে।

বিনয় কহিল, “মা, তোমাকে যতই দেখছি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। তোমার মন একেবারে এমন সাফ হল কী করে! তোমাকে কি পায়ে চলতে হয় না– ঈশ্বর তোমাকে কি পাখা দি|য়ছেন? তোমার কোনো জায়গায় কিছু ঠেকে না?”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “ঈশ্বর আমার ঠেকবার মতো কিছুই রাখেন নি। সমস্ত একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন।”

বিনয় কহিল, “কিন্তু, মা, আমি মুখে যাই বলি মনটাতে ঠেকে যে। এত যে বুঝিসুঝি, পড়ি শুনি, তর্ক করি, হঠাৎ দেখতে পাই মনটা নিতান্ত মূর্খই রয়ে গেছে।”

এমন সময় মহিম ঘরে ঢুকিয়াই বিনয়কে ললিতা সম্বন্ধে এমন নিতান্ত রূঢ় রকম করিয়া প্রশ্ন করিলেন যে, তাহার হৃদয় সংকোচে পীড়িত হইয়া উঠিল। সে আত্মদমন করিয়া মুখ নিচু করিয়া নিরুত্তরে বসিয়া রহিল। তখন মহিম সকল পক্ষের প্রতি তীক্ষ্ণ খোঁজা দিয়া নিতান্ত অপমানকর কথা কতকগুলা বলিয়া চলিয়া গেলেন। তিনি বুঝাইয়া গেলেন, বিনয়কে এইরূপ ফাঁদে ফেলিয়া সর্বনাশ করিবার জন্যই পরেশবাবুর ঘরে একটা নির্লজ্জ আয়োজন চলিতেছিল, বিনয় নির্বোধ বলিয়াই এমন ফাঁদে সে আটকা পড়িয়াছে, ভোলাক দেখি ওরা গোরাকে, তবে তো বুঝি। সে বড়ো শক্ত জায়গা।

বিনয় চারি দিকেই এইরূপ লাঞ্ছনার মূর্তি দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “জানিস, বিনয়, তোর কী কর্তব্য?”

বিনয় মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর উচিত একবার পরেশবাবুর কাছে যাওয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হলেই সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

সুচরিতা হঠাৎ আনন্দময়ীকে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, “আমি যে এখনই আপনার ওখানে যাব বলে প্রস্তুত হচ্ছিলুম।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “তুমি যে প্রস্তুত হচ্ছিলে তা আমি জানতুম না, কিন্তু যেজন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলে সেই খবরটা পেয়ে আমি থাকতে পারলুম না, চলে এলুম।”

আনন্দময়ী খবর পাইয়াছেন শুনিয়া সুচরিতা আশ্চর্য হইয়া গেল। আনন্দময়ী কহিলেন, “মা, বিনয়কে আমি আমার আপন ছেলের মতোই জানি। সেই বিনয়ের সম্পর্ক থেকেই তোমাদের যখন নাও জেনেছি তখনই তোমাদের মনে মনে কত আশীর্বাদ করেছি। তোমাদের প্রতি কোনো অন্যায় হচ্ছে এ কথা শুনে আমি স্থির থাকতে পারি কই? আমার দ্বারা তোমাদের কোনো উপকার হতে পারবে কি না তা তো জানি নে– কিন্তু মনটা কেমন করে উঠল, তাই তোমাদের কাছে ছুটে এলুম। মা, বিনয়ের তরফে কি কোনো অন্যায় ঘটেছে?”

সুচরিতা কহিল, “কিছুমাত্র না। যে কথাটা নিয়ে খুব বেশি আন্দোলন হচ্ছে ললিতাই তার জন্যে দায়ী। ললিতা যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে স্টীমারে চলে যাবে বিনয়বাবু তা কখনো কল্পনাও করেন নি। লোকে এমনভাবে কথা কচ্ছে যেন ওদের দুজনের মধ্যে গোপনে পরামর্শ হয়ে গিয়েছিল। আবার ললিতা এমনি তেজস্বিনী মেয়ে, সে যে প্রতিবাদ করবে কিংবা কোনোরকমে বুঝিয়ে বলবে আসল ঘটনাটা কী ঘটেছিল, সে তার দ্বারা কোনোমতেই হবার জো নেই।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “এর তো একটা উপায় করতে হচ্ছে। এই-সব কথা শুনে অবধি বিনয়ের মনে তো কিছুমাত্র শান্তি নেই– সে তো নিজেকেই অপরাধী বলে ঠাউরে বসে আছে।”

সুচরিতা তাহার আরক্তিম মুখ একটুখানি নিচু করিয়া কহিল, “আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন বিনয়বাবু।”

আনন্দময়ী সংকোচপীড়িতা সুচরিতাকে তাহার কথা শেষ করিতে না দিয়া কহিলেন, “দেখো বাছা, আমি তোমাকে বলছি ললিতার জন্যে বিনয়কে যা করতে বলবে সে তাই করবে। বিনয়কে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। ও যদি একবার আত্মসমর্পণ করল, তবে ও আর কিছু হাতে রাখতে পারে না। সেইজন্যে আমাকে বড়ো ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়, ওর পাছে এমন জায়গায় মন যায় যেখানে থেকে ওর কিছুই ফিরে পাবার কোনো আশা নেই।”

সুচরিতার মন হইতে একটা বোঝা নামিয়া গেল। সে কহিল, “ললিতার সম্মতির জন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমি তার মন জানি। কিন্তু বিনয়বাবু কি তাঁর সমাজ পরিত্যাগ করতে রাজি হবেন?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “সমাজ হয়তো তাকে পরিত্যাগ করতে পারে, কিন্তু সে আগেভাগে গায়ে পড়ে সমাজ পরিত্যাগ করতে যাবে কেন মা? তার কি কোনো প্রয়োজন আছে?”

সুচরিতা কহিল, “বলেন কী মা? বিনয়বাবু হিন্দুসমাজে থেকে ব্রাহ্মঘরের মেয়ে বিয়ে করবেন?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “সে যদি করতে রাজি হয় তাতে তোমাদের আপত্তি কী?”

সুচরিতার অত্যন্ত গোল ঠেকিল; সে কহিল, “সে কেমন করে সম্ভব হবে আমি তো বুঝতে পারছি নে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার কাছে এ তো খুবই সহজ ঠেকছে মা! দেখো আমার বাড়িতে যে নিয়ম চলে সে নিয়মে আমি চলতে পারি নে– সেইজন্য আমাকে কত লোকে খৃস্টান বলে। কোনো ক্রিয়াকর্মের সময়ে আমি ইচ্ছা করেই তফাত হয়ে থাকি। তুমি শুনে হাসবে মা, গোরা আমার ঘরে জল খায় না। কিন্তু তাই বলে আমি কেন বলতে যাব, এ ঘর আমার ঘর নয়, এ সমাজ আমার সমাজ নয়। আমি তো বলতে পারি নে। সমস্ত গালমন্দ মাথায় করে নিয়েই আমি এই ঘর এই সমাজ নিয়ে আছি। তাতে তো আমার এমন কিছু বাধছে না। যদি এমন বাধে যে আর চলে না তবে ঈশ্বর যে পথ দেখাবেন সেই পথ ধরব। কিন্তু শেষ পর্যন্তই যা আমার তাকে আমারই বলব– তারা যদি আমাকে স্বীকার না করে তবে সে তারা বুঝুক।”

সুচরিতার কাছে এখনো পরিষ্কার হইল না; সে কহিল, “কিন্তু, দেখুন, ব্রাহ্ম-সমাজের যা মত বিনয়বাবুর যদি–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তার মতও তো সেইরকমই। ব্রাহ্মসমাজের মত তো একটা সৃষ্টিছাড়া মত নয়। তোমাদের কাগজে যে-সব উপদেশ বেরোয়, ও তো আমাকে প্রায়ই সেগুলি পড়ে শোনায়– কোন্‌খানে তফাত বুঝতে তো পারি নে।”

এমন সময় “সুচিদিদি” বলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াই আনন্দময়ীকে দেখিয়া ললিতা লজ্জায় লাল হইয়া উঠিল। সে সুচরিতার মুখ দেখিয়াই বুঝিল এতক্ষণ তাহারই কথা হইতেছিল। ঘর হইতে পালাইতে পারিলেই সে যেন রক্ষা পাইত, কিন্তু তখন আর পালাইবার উপায় ছিল না।

আনন্দময়ী বলিয়া উঠিলেন, “এসো ললিতা, মা এসো।”

বলিয়া ললিতার হাত ধরিয়া তাহাকে একটু বিশেষ কাছে টানিয়া লইয়া বসাইলেন, যেন ললিতা তাঁহার একটু বিশেষ আপন হইয়া উঠিয়াছে।

তাঁহার পূর্বকথার অনুবৃত্তিস্বরূপ আনন্দময়ী সুচরিতাকে কহিলেন, “দেখো মা, ভালোর সঙ্গে মন্দ মেলাই সব চেয়ে কঠিন– কিন্তু তবু পৃথিবীতে তাও মিলছে– আর তাতেও সুখে দুঃখে চলে যাচ্ছে– সব সময়ে তাতে মন্দই হয় তাও নয়, ভালোও হয়। এও যদি সম্ভব হল, তবে কেবল মতের একটুখানি অমিল নিয়ে দুজন মানুষ যে কেন মিলতে পারবে না আমি তো তা বুঝতেই পারি নে। মানুষের আসল মিল কি মতে?”

সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমাদের ব্রাহ্মসমাজও কি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এইজন্যেই হয়েছে?”

আনন্দময়ী যে এই বিষয়টি লইয়া এত আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন সে কি কেবল ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহের বাধা দূর করিবার জন্যই? সুচরিতার মনে এ সম্বন্ধে একটু দ্বিধার ভাব অনুভব করিয়া সেই দ্বিধাটুকু ভাঙিয়া দিবার জন্য তাঁহার সমস্ত মন যে উদ্যত হইয়া উঠিল ইহার মধ্যে আর-একটা উদ্দেশ্য কি ছিল না? সুচরিতা যদি এমন সংস্কারে জড়িত থাকে তবে সে যে কোনোমতেই চলিবে না। বিনয় ব্রাহ্ম না হইলে বিবাহ ঘটিতে পারিবে না এই যদি সিদ্ধান্ত হয় তবে বড়ো দুঃখের সময়েও এই কয়দিন আনন্দময়ী যে আশা গড়িয়া তুলিতেছিলেন সে যে ধূলিসাৎ হয়। আজই বিনয় এ প্রশ্ন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল; বলিয়াছিল, “মা, ব্রাহ্মসমাজে কি নাম লেখাতে হবে? সেও স্বীকার করব?”

আনন্দময়ী বলিয়াছিলেন, “না না, তার তো কোনো দরকার দেখি নে।”

বিনয় বলিল, “যদি তাঁরা পীড়াপীড়ি করেন?”

আনন্দময়ী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিয়াছিলেন, “না, এখানে পীড়াপীড়ি খাটবে না।”

সুচরিতা আনন্দময়ীর আলোচনায় যোগ দিল না, সে চুপ করিয়াই রহিল। তিনি বুঝিলেন, সুচরিতার মন এখনো সায় দিতেছে না।

আনন্দময়ী মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “আমার মন যে সমাজের সমস্ত সংস্কার কাটাইয়াছে সে তো কেবল ঐ গোরার স্নেহে। তবে কি গোরার ‘পরে সুচরিতার মন পড়ে নাই? যদি পড়িত তবে তো এই ছোটো কথাটাই এত বড়ো হইয়া উঠিত না।’

আনন্দময়ীর মন একটুখানি বিমর্ষ হইয়া গেল। কারাগার হইতে গোরার বাহির হইতে আর দিন দুয়েক বাকি আছে মাত্র। তিনি মনে ভাবিতেছিলেন, তাহার জন্য একটা সুখের ক্ষেত্র প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। এবারে যেমন করিয়া হোক গোরাকে বাঁধিতেই হইবে, নহিলে সে যে কোথায় কী বিপদে পড়িবে তাহার ঠিকানা নাই। কিন্তু গোরাকে বাঁধিয়া ফেলা তো যে সে মেয়ের কর্ম নয়। এ দিকে, কোনো হিন্দুসমাজের মেয়ের সঙ্গে গোরার বিবাহ দেওয়া অন্যায় হইবে– সেইজন্য এতদিন নানা কন্যাদায়গ্রস্তের দরখাস্ত একেবারে নামঞ্জুর করিয়াছেন। গোরা বলে “আমি বিবাহ করিব না’– তিনি মা হইয়া একদিনের জন্য প্রতিবাদ করেন নাই ইহাতে লোকে আশ্চর্য হইয়া যাইত। এবারে গোরার দু-একটা লক্ষণ দেখিয়া তিনি মনে মনে উৎফুল্ল হইয়াছিলেন। সেইজন্যই সুচরিতার নীরব বিরুদ্ধতা তাঁহাকে অত্যন্ত আঘাত করিল। কিন্তু তিনি সহজে হাল ছাড়িবার পাত্রী নন; মনে মনে কহিলেন, “আচ্ছা, দেখা যাক।’

পরেশবাবু কহিলেন, “বিনয়, তুমি ললিতাকে একটা সংকট থেকে উদ্ধার করবার জন্যে একটা দুঃসাহসিক কাজ করবে এরকম আমি ইচ্ছা করি নে। সমাজের আলোচনার বেশি মূল্য নেই, আজ যা নিয়ে গোলমাল চলছে দুদিন বাদে তা কারো মনেও থাকবে না।”

ললিতার প্রতি কর্তব্য করিবার জন্যই যে বিনয় কোমর বাঁধিয়া আসিয়াছিল সে বিষয়ে বিনয়ের মনে সন্দেহমাত্র ছিল না। সে জানিত এরূপ বিবাহে সমাজে অসুবিধা ঘটিবে, এবং তাহার চেয়েও বেশি– গোরা বড়োই রাগ করিবে– কিন্তু কেবল কর্তব্যবুদ্ধির দোহাই দিয়া এই-সকল অপ্রিয় কল্পনাকে সে মন হইতে খেদাইয়া রাখিয়াছিল। এমন সময় পরেশবাবু হঠাৎ যখন কর্তব্যবুদ্ধিকে একেবারে বরখাস্ত করিতে চাহিলেন তখন বিনয় তাহাকে ছাড়িতে চাহিল না।

সে কহিল, “আপনাদের স্নেহ-ঋণ আমি কোনাদিন শোধ করতে পারব না। আমাকে উপলক্ষ করে আপনাদের পরিবারে দুদিনের জন্যেও যদি লেশমাত্র অশান্তি ঘটে তবে সেও আমার পক্ষে অসহ্য।”

পরেশবাবু কহিলেন, “বিনয়, তুমি আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমাদের প্রতি তোমার যে শ্রদ্ধা আছে তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি, কিন্তু সেই শ্রদ্ধার কর্তব্য শোধ করবার জন্যেই যে তুমি আমার কন্যাকে বিবাহ করতে প্রস্তুত হয়েছ এটা আমার কন্যার পক্ষে শ্রদ্ধেয় নয়। সেইজন্যেই আমি তোমাকে বলছিলুম যে, সংকট এমন গুরুতর নয় যে এর জন্যে তোমার কিছুমাত্র ত্যাগ স্বীকার করার প্রয়োজন আছে।”

যাক্‌, বিনয় কর্তব্যদায় হইতে মুক্তি পাইল– কিন্তু খাঁচার দ্বার খোলা পাইলে পাখি যেমন ঝট্‌পট্‌ করিয়া উড়িয়া যায় তেমন করিয়া তাহার মন তো নিষ্কৃতির অবারিত পথে দৌড় দিল না। এখনো সে যে নড়িতে চায় না। কর্তব্যবুদ্ধিকে উপলক্ষ করিয়া সে যে অনেক দিনের সংযমের বাঁধকে অনাবশ্যক বলিয়া ভাঙিয়া দিয়া বসিয়া আছে। মন আগে যেখানে ভয়ে ভয়ে পা বাড়াইত এবং অপরাধীর মতো সসংকোচে ফিরিয়া আসিত সেখানে সে যে ঘর জুড়িয়া বসিয়া লঙ্কাভাগ করিয়া লইয়াছে– এখন তাহাকে ফেরানো কঠিন। যে কর্তব্যবুদ্ধি তাহাকে হাতে ধরিয়া এ জায়গাটাতে আনিয়াছে সে যখন বলিতেছে “আর দরকার নাই, চলো ভাই, ফিরি’– মন বলে, “তোমার দরকার না থাকে তুমি ফেরো, আমি এইখানেই রহিয়া গেলাম।’

পরেশ যখন কোথাও কোনো আড়াল রাখিতে দিলেন না তখন বিনয় বলিয়া উঠিল, “আমি যে কর্তব্যের অনুরোধে একটা কষ্ট স্বীকার করতে যাচ্ছি এমন কথা মনেও করবেন না। আপনারা যদি সম্মতি দেন তবে আমার পক্ষে এমন সৌভাগ্য আর-কিছুই হতে পারে না– কেবল আমার ভয় হয় পাছে –”

সত্যপ্রিয় পরেশবাবু অসংকোচে কহিলেন, “তুমি যা ভয় করছ তার কোনো হেতু নেই। আমি সুচরিতার কাছ থেকে শুনেছি ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নয়।”

বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আনন্দের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। ললিতার মনের একটি গূঢ় কথা সুচরিতার কাছে ব্যক্ত হইয়াছে। কবে ব্যক্ত হইল, কেমন করিয়া ব্যক্ত হইল? দুই সখীর কাছে এই-যে আভাসে অনুমানে একটা জানাজানি হইয়াছে ইহার সুতীব্র রহস্যময় সুখ বিনয়কে যেন বিদ্ধ করিতে লাগিল।

বিনয় বলিয়া উঠিল, “আমাকে যদি আপনারা যোগ্য মনে করেন তবে তার চেয়ে আনন্দের কথা আমার পক্ষে আর-কিছুই হতে পারে না।”

পরেশবাবু কহিলেন, “তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি একবার উপর থেকে আসি।”

তিনি বরদাসুন্দরীর মত লইতে গেলেন। বরদাসুন্দরী কহিলেন, “বিনয়কে তো দীক্ষা নিতে হবে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “তা নিতে হবে বৈকি।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সেটা আগে ঠিক করো। বিনয়কে এইখানেই ডাকাও-না।”

বিনয় উপরে আসিলে বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে দীক্ষার দিন তো একটা ঠিক করতে হয়।”

বিনয় কহিল, “দীক্ষার কি দরকার আছে?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “দরকার নেই! বল কী! নইলে ব্রাহ্মসমাজে তোমার বিবাহ হবে কী করে?”

বিনয় চুপ করিয়া মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয় তাঁহার ঘরে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে শুনিয়াই পরেশবাবু ধরিয়া লইয়াছিলেন যে, সে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে।

বিনয় কহিল, “ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমতের প্রতি আমার তো শ্রদ্ধা আছে এবং এপর্যন্ত আমার ব্যবহারেও তার অন্যথাচরণ হয় নি। তবে কি বিশেষভাবে দীক্ষা নেওয়ার দরকার আছে?

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “যদি মতেই মিল থাকে তবে দীক্ষা নিতেই বা ক্ষতি কী?”

বিনয় কহিল, “আমি যে হিন্দুসমাজের কেউ নই এ কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে এ কথা নিয়ে আলোচনা করাই আপনার অন্যায় হয়েছে। আপনি কি আমাদের উপকার করবার জন্যে দয়া করে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন?”

বিনয় অত্যন্ত আঘাত পাইল; দেখিল তাহার প্রস্তাবটা ইঁহাদের পক্ষে সত্যই অপমানজনক হইয়া উঠিয়াছে।

কিছুকাল হইল সিভিল বিবাহের আইন পাস হইয়া গেছে। সে সময়ে গোরা ও বিনয় কাগজে ঐ আইনের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আলোচনা করিয়াছে। আজ সেই সিভিল বিবাহ স্বীকার করিয়া বিনয় নিজেকে “হিন্দু নয়’ বলিয়া ঘোষণা করিবে এও তো বড়ো শক্ত কথা।

বিনয় হিন্দুসমাজে থাকিয়া ললিতাকে বিবাহ করিবে এ প্রস্তাব পরেশ মনের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিলেন না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইল এবং উভয়কে নমস্কার করিয়া কহিল, “আমাকে মাপ করবেন, আমি আর অপরাধ বাড়াব না।”

বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সিঁড়ির কাছে আসিয়া দেখিল সম্মুখের বারান্দায় এক কোণে একটি ছোটো ডেস্ক্‌ লইয়া ললিতা একলা বসিয়া চিঠি লিখিতেছে। পায়ের শব্দে চোখ তুলিয়া ললিতা বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। সেই তাহার ক্ষণকালের দৃষ্টিটুকু বিনয়ের সমস্ত চিত্তকে এক মুহূর্তে মথিত করিয়া তুলিল। বিনয়ের সঙ্গে তো ললিতার নূতন পরিচয় নয়– কতবার সে তাহার মুখের দিকে চোখ তুলিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার দৃষ্টির মধ্যে কী রহস্য প্রকাশ হইল? সুচরিতা ললিতার একটি মনের কথা জানিয়াছে– সেই মনের কথাটি আজ ললিতার কালো চোখের পল্লবের ছায়ায় করুণায় ভরিয়া উঠিয়া একখানি সজল স্নিগ্ধ মেঘের মতো বিনয়ের চোখে দেখা দিল। বিনয়েরও এক মুহূর্তের চাহনিতে তাহার হৃদয়ের বেদনা বিদ্যুতের মতো ছুটিয়া গেল; সে ললিতাকে নমস্কার করিয়া বিনা সম্ভাষণে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেল।

গোরা জেল হইতে বাহির হইয়াই দেখিল পরেশবাবু এবং বিনয় দ্বারের বাহিরে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।

এক মাস কিছু দীর্ঘকাল নহে। এক মাসের চেয়ে বেশিদিন গোরা আত্মীয়বন্ধুদের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ভ্রমণ করিয়াছে, কিন্তু জেলের এক মাস বিচ্ছেদ হইতে বাহির হইয়াই সে যখন পরেশ ও বিনয়কে দেখিল তখন তাহার মনে হইল যেন পুরাতন বান্ধবদের পরিচিত সংসারে সে পুনর্জন্ম লাভ করিল। সেই রাজপথে খোলা আকাশের নীচে প্রভাতের আলোকে পরেশের শান্ত স্নেহপূর্ণ স্বভাবসৌম্য মুখ দেখিয়া সে যেমন ভক্তির আনন্দে তাঁহার পায়ের ধুলা লইল এমন আর কোনোদিন করে নাই। পরেশ তাহার সঙ্গে কোলাকুলি করিলেন।

বিনয়ের হাত ধরিয়া গোরা হাসিয়া কহিল, “বিনয়, ইস্কুল থেকে আরম্ভ করে একসঙ্গেই তোমার সঙ্গে সমস্ত শিক্ষা লাভ করে এসেছি, কিন্তু এই বিদ্যালয়টাতে তোমার চেয়ে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে নিয়েছি।”

বিনয় হাসিতেও পারিল না, কোনো কথাও বলিতে পারিল না। জেলখানার দুঃখরহস্যের ভিতর দিয়া তাহার বন্ধু তাহার কাছে বন্ধুর চেয়ে আরো যেন অনেক বড়ো হইয়া বাহির হইয়াছে। গভীর সম্ভ্রমে সে চুপ করিয়া রহিল। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “মা কেমন আছেন?’

বিনয় কহিল, “মা ভালোই আছেন।”

পরেশবাবু কহিলেন, “এসো বাবা, তোমার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করে আছে।”

তিনজনে যখন গাড়িতে উঠিতে যাইবেন এমন সময় হাঁপাইতে হাঁপাইতে অবিনাশ আসিয়া উপস্থিত। তাহার পিছনে ছেলের দল।

অবিনাশকে দেখিয়াই গোরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠিয়া পড়িবার উপক্রম করিল, কিন্তু তৎপূর্বেই সে আসিয়া পথরোধ করিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু, একটু দাঁড়ান।”

বলিতে বলিতেই ছেলেরা চীৎকার-শব্দে গান ধরিল–

দুখনিশীথিনী হল আজি ভোর।

কাটিল কাটিল অধীনতা ডোর।

গোরার মুখ লাল হইয়া উঠিল; সে তাহার বজ্রস্বরে গর্জন করিয়া কহিল, “চুপ করো।”

ছেলেরা বিস্মিত হইয়া চুপ করিল। গোরা কহিল, “অবিনাশ, এ-সমস্ত ব্যাপার কী!”

অবিনাশ তাহার শালের ভিতর হইতে কলাপাতায় মোড়া একটা কুন্দ ফুলের মোটা গোড়ে মালা বাহির করিল এবং তাহার অনুবর্তী একটি অল্পবয়স্ক ছেলে একখানি সোনার জলে ছাপানো কাগজ হইতে মিহি সুরে দম-দেওয়া আর্গিনের মতো দ্রুতবেগে কারামুক্তির অভিনন্দন পড়িয়া যাইতে আরম্ভ করিল।

অবিনাশের মালা সবলে প্রত্যাখ্যান করিয়া গোরা অবরুদ্ধ ক্রোধের কণ্ঠে কহিল, “এখন বুঝি তোমাদের অভিনয় শুরু হল? আজ রাস্তার ধারে আমাকে তোমাদের যাত্রার দলে সঙ সাজাবার জন্যে বুঝি এই এক মাস ধরে মহলা দিচ্ছিলে?”

অনেক দিন হইতে অবিনাশ এই প্ল্যান করিয়াছিল–সে ভাবিয়াছিল, ভারি একটা তাক লাগাইয়া দিবে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন এরূপ উপদ্রব প্রচলিত ছিল না। অবিনাশ বিনয়কেও মন্ত্রণার মধ্যে লয় নাই, এই অপূর্ব ব্যাপারের সমস্ত বাহাদুরি সে নিজেই লইবে বলিয়া লুব্ধ হইয়াছিল। এমন-কি, খবরের কাগজের জন্য ইহার বিবরণ সে নিজেই লিখিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, ফিরিয়া গিয়াই তাহার দুই-একটা ফাঁক পূরণ করিয়া পাঠাইয়া দিবে স্থির ছিল।

গোরার তিরস্কারে অবিনাশ ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, “আপনি অন্যায় বলছেন। আপনি কারাবাসে যে দুঃখ ভোগ করেছেন আমরা তার চেয়ে কিছুমাত্র কম সহ্য করি নি। এই এক-মাস-কাল প্রতিমুহূর্ত তুষানলে আমাদের বক্ষের পঞ্জর দগ্ধ হয়েছে।”

গোরা কহিল, “ভুল করছ অবিনাশ, একটু তাকিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে তুষগুলো এখনো সমস্তই গোটা আছে, বক্ষের পঞ্জরেও মারাত্মক রকম লোকসান হয় নি।”

অবিনাশ দমিল না; কহিল, “রাজপুরুষ আপনার অপমান করেছে, কিন্তু আজ সমস্ত ভারতভূমির মুখপাত্র হয়ে আমরা এই সম্মানের মাল্য–”

গোরা বলিয়া উঠিল, “আর তো সহ্য হয় না।”

অবিনাশ ও তাহার দলকে এক পাশে সরাইয়া দিয়া গোরা কহিল, “পরেশবাবু, গাড়িতে উঠুন।”

পরেশবাবু গাড়িতে উঠিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। গোরা ও বিনয় তাঁহার অনুসরণ করিল।

স্টীমারযোগে যাত্রা করিয়া পরদিন প্রাতঃকালে গোরা বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। দেখিল বাহির-বাড়িতে তাহার দলের বিস্তর লোক জটলা করিয়াছে। কোনোক্রমে তাহাদের হাত হইতে নিষ্কৃতি লইয়া গোরা অন্তঃপুরে আনন্দময়ীর কাছে গিয়া উপস্থিত হইল; তিনি আজ সকাল-সকাল স্নান সারিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া ছিলেন। গোরা আসিয়া তাঁহার পায়ে পড়িয়া প্রণাম করিতেই আনন্দময়ীর দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। এতদিন যে অশ্রু তিনি অবরুদ্ধ রাখিয়াছিলেন আজ আর কোনোমতেই তাহা বাধা মানিল না।

কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিয়া আসিতেই গোরা তাঁহার সহিত দেখা করিল। দূর হইতেই তাঁহাকে প্রণাম করিল, তাঁহার পাদস্পর্শ করিল না। কৃষ্ণদয়াল সসংকোচে দূরে আসনে বসিলেন। গোরা কহিল, “বাবা, আমি একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তার তো কোনো প্রয়োজন দেখি নে।”

গোরা কহিল, “জেলে আমি আর-কোনো কষ্ট গণ্যই করি নি, কেবল নিজেকে অত্যন্ত অশুচি বলে মনে হত, সেই গ্লানি এখনো আমার যায় নি–প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”

কৃষ্ণদয়াল ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “না না, তোমার অত বাড়াবাড়ি করতে হবে না। আমি তো ওতে মত দিতে পারছি নে।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা, আমি নাহয় এ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মত নেব।”

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কোনো পণ্ডিতের মত নিতে হবে না। আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি, তোমার প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন নেই।”

কৃষ্ণদয়ালের মতো অমন আচারশুচিবায়ুগ্রস্ত লোক গোরার পক্ষে কোনোপ্রকার নিয়মসংযম যে কেন স্বীকার করিতে চান না–শুধু স্বীকার করেন না তা নয়, একেবারে তাহার বিরুদ্ধে জেদ ধরিয়া বসেন, আজ পর্যন্ত গোরা তাহার কোনো অর্থই বুঝিতে পারে নাই।

আনন্দময়ী আজ ভোজনস্থলে গোরার পাশেই বিনয়ের পাত করিয়াছিলেন। গোরা কহিল, “মা, বিনয়ের আসনটা একটু তফাত করে দাও।”

আনন্দময়ী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কেন, বিনয়ের অপরাধ কী হল?”

গোরা কহিল, “বিনয়ের কিছু হয় নি, আমারই হয়েছে। আমি অশুদ্ধ আছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হোক, বিনয় অত শুদ্ধাশুদ্ধ মানে না।”

গোরা কহিল, “বিনয় মানে না, আমি মানি।”

আহারের পর দুই বন্ধু যখন তাহাদের উপরের তলের নিভৃত ঘরে গিয়া বসিল তখন তাহারা কেহ কোনো কথা খুঁজিয়া পাইল না। এই এক মাসের মধ্যে বিনয়ের কাছে যে একটিমাত্র কথা সকলের চেয়ে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সেটা আজ কেমন করিয়া যে গোরার কাছে পাড়িবে তাহা সে ভাবিয়াই পাইতেছিল না। পরেশবাবুর বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে গোরার মনেও একটা জিজ্ঞাসা জাগিতেছিল, কিন্তু সে কিছুই বলিল না। বিনয় কথাটা পাড়িবে বলিয়া সে অপেক্ষা করিতেছিল। অবশ্য বাড়ির মেয়েরা সকলে কেমন আছেন সে কথা গোরা পরেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কিন্তু সে তো কেবল ভদ্রতার প্রশ্ন। তাহারা সকলে ভালো আছে এইটুকু খবরের চেয়েও আরো বিস্তারিত বিবরণ জানিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে ঔৎসুক্য ছিল।

এমন সময় মহিম ঘরের মধ্যে আসিয়া আসন গ্রহণ করিয়া সিঁড়ি উঠার শ্রমে কিছুক্ষণ হাঁপাইয়া লইলেন। তাহার পরে কহিলেন, “বিনয়, এতদিন তো গোরার জন্যে অপেক্ষা করা গেল। এখন আর তো কোনো কথা নেই। এবার দিন ক্ষণ ঠিক করে ফেলা যাক। কী বল গোরা? বুঝেছ তো কী কথাটা হচ্ছে?”

গোরা কোনো কথা না বলিয়া একটুখানি হাসিল।

মহিম কহিলেন, “হাসছ যে! তুমি ভাবছ আজও দাদা সে কথাটা ভোলে নি। কিন্তু কন্যাটি তো স্বপ্ন নয়, স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি সে একটি সত্য পদার্থ–ভোলবার জো কী! হাসি নয় গোরা, এবারে যা হয় ঠিক করে ফেলো।”

গোরা কহিল, “ঠিক করবার কর্তা যিনি তিনি তো স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন।”

মহিম কহিলেন, “সর্বনাশ! ওঁর নিজের ঠিক নেই, উনি ঠিক করবেন! তুমি এসেছ, এখন তোমার উপরেই সমস্ত ভার।”

আজ বিনয় গম্ভীর হইয়া চুপ করিয়া রহিল, তাহার স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসের ছলেও সে কোনো কথা বলিবার চেষ্টা করিল না।

গোরা বুঝিল, একটা গোল আছে। সে কহিল, “নিমন্ত্রণ করতে যাবার ভার নিতে পারি, মিঠাই ফরমাশ দেবারও ভার নেওয়া যায়, পরিবেশন করতেও রাজি আছি, কিন্তু বিনয় যে তোমার মেয়েকে বিয়ে করবেনই সে ভার আমি নিতে পারব না। যাঁর নির্বন্ধে সংসারে এই-সমস্ত কাজ হয় তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ চেনাশোনা নেই–বরাবর আমি তাঁকে দূর থেকেই নমস্কার করেছি।”

মহিম কহিলেন, “তুমি দূরে থাকলেই যে তিনিও দূরে থাকেন তা মনেও কোরো না। হঠাৎ কবে চমক লাগাবেন কিছু বলা যায় না। তোমার সম্বন্ধে তাঁর মতলব কী তা ঠিক বলতে পারছি নে, কিন্তু এঁর সম্বন্ধে ভারি গোল ঠেকছে। একলা প্রজাপতি ঠাকুরের উপরেই সব বরাত না দিয়ে তুমি যদি নিজেও উদ্‌্‌যোগী না হও তা হলে হয়তো অনুতাপ করতে হবে, এ আমি বলে রাখছি।”

গোরা কহিল, “যে ভার আমার নয় সে ভার না নিয়ে অনুতাপ করতে রাজি আছি, কিন্তু নিয়ে অনুতাপ করা আরো শক্ত! সেইটে থেকে রক্ষা পেতে চাই।”

মহিম কহিলেন, “ব্রাহ্মণের ছেলে জাত কুল মান সমস্ত খোওয়াবে, আর তুমি বসে থেকে দেখবে? দেশের লোকের হিঁদুয়ানি রক্ষার জন্যে তোমার আহার নিদ্রা বন্ধ, এ দিকে নিজের পরম বন্ধুই যদি জাত ভাসিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মর ঘরে বিয়ে করে বসে তা হলে মানুষের কাছে যে মুখ দেখাতে পারবে না। বিনয়, তুমি বোধ হয় রাগ করছ, কিন্তু ঢের লোক তোমার অসাক্ষাতেই এই-সব কথা গোরাকে বলত–তারা বলবার জন্যে ছট্‌ফট্‌ করছে–আমি সামনেই বলে গেলুম, তাতে সকল পক্ষে ভালোই হবে। গুজবটা যদি মিথ্যাই হয় তা হলে সে কথা বললেই চুকে যাবে, যদি সত্যি হয় তা হলে বোঝাপড়া করে নাও।”

মহিম চলিয়া গেলেন, বিনয় তখনো কোনো কথা কহিল না। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিনয়, ব্যাপারটা কী?”

বিনয় কহিল, “শুধু কেবল গোটাকতক খবর দিয়ে অবস্থাটা ঠিক বোঝানো ভারি শক্ত, তাই মনে করেছিলুম আস্তে আস্তে তোমাকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব–কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের সুবিধামত ধীরে-সুস্থে কিছুই ঘটতে চায় না–ঘটনাগুলোও শিকারি বাঘের মতো প্রথমটা গুঁড়ি মেরে মেরে নিঃশব্দে চলে, তার পরে হঠাৎ এক সময় ঘাড়ের উপরে লাফ দিয়ে এসে পড়ে। আবার তার সংবাদও আগুনের মতো প্রথমটা চাপা থাকে, তার পরে হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন তাকে আর সামলানো যায় না। সেইজন্যেই এক এক সময় মনে হয়, কর্মমাত্রই ত্যাগ করে একেবারে স্থাণু হয়ে বসে থাকাই মানুষের পক্ষে মুক্তি।”

গোরা হাসিয়া কহিল, “তুমি একলা স্থাণু হয়ে বসে থাকলেই বা মুক্তি কোথায়? সেইসঙ্গে জগৎ-সুদ্ধ যদি স্থাণু হয়ে না ওঠে তা হলে তোমাকে স্থির থাকতে দেবে কেন? সে আরো উলটো বিপদ হবে। জগৎ যখন কাজ করছে তখন তুমি যদি কাজ না কর তা হলে যে কেবলই ঠকবে। সেইজন্যে এইটে দেখতে হবে ঘটনা যেন তোমার সতর্কতাকে ডিঙিয়ে না যায়–এটা না হয় যে, আর-সমস্তই চলছে, কেবল তুমিই প্রস্তুত নেই।”

বিনয় কহিল, “ঐ কথাটাই ঠিক। আমিই প্রস্তুত থাকি নে। এবারেও আমি প্রস্তুত ছিলুম না। কোন্‌ দিক দিয়ে কী ঘটছে তা বুঝতেই পারি নি। কিন্তু যখন ঘটে উঠল তখন তার দায়িত্ব তো গ্রহণ করতেই হবে। যেটা গোড়াতে না ঘটলেই ভালো ছিল সেটাকে আজ অপ্রিয় হলেও তো অস্বীকার করা যায় না।”

গোরা কহিল, “ঘটনাটা কী, না জেনে সেটার সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনায় যোগ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন।”

বিনয় খাড়া হইয়া বসিয়া বলিয়া ফেলিল, “অনিবার্য ঘটনাক্রমে ললিতার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তাকে যদি আমি বিবাহ না করি তবে চিরজীবন সমাজে তাকে অন্যায় এবং অমূলক অপমান সহ্য করতে হবে।”

গোরা কহিল, “কী রকমটা দাঁড়িয়েছে শুনি।”

বিনয় কহিল, “সে অনেক কথা। সে ক্রমে তোমাকে বলব, কিন্তু ওটুকু তুমি মেনেই নাও।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা, মেনেই নিচ্ছি। ও সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, ঘটনা যদি অনিবার্য হয় তার দুঃখও অনিবার্য। সমাজে যদি ললিতাকে অপমান ভোগ করতেই হয় তো তার উপায় নেই।”

বিনয় কহিল, “কিন্তু সেটা নিবারণ করা তো আমার হাতে আছে।”

গোরা কহিল, “যদি থাকে তো ভালোই। কিন্তু গায়ের জোরে সে কথা বললে তো হবে না। অভাবে পড়লে চুরি করা, খুন করাও তো মানুষের হাতে আছে, কিন্তু সেটা কি সত্যি আছে? ললিতাকে বিবাহ করে তুমি ললিতার প্রতি কর্তব্য করতে চাও, কিন্তু সেইটেই কি তোমার চরম কর্তব্য? সমাজের প্রতি কর্তব্য নেই?”

সমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করিয়াই বিনয় ব্রাহ্মবিবাহে সম্মত হয় নাই সে কথা সে বলিল না, তাহার তর্ক চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, “ঐ জায়গায় তোমার সঙ্গে বোধ হয় আমার মিল হবে না। আমি তো ব্যক্তির দিকে টেনে সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলছি নে। আমি বলছি, ব্যক্তি এবং সমাজ দুইয়ের উপরেই একটি ধর্ম আছে– সেইটের উপরে দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। যেমন ব্যক্তিকে বাঁচানোই আমার চরম কর্তব্য নয় তেমনি সমাজকে বাঁচানোও আমার চরম কর্তব্য নয়, একমাত্র ধর্মকে বাঁচানোই আমার চরম শ্রেয়।”

গোরা কহিল, “ব্যক্তিও নেই সমাজও নেই, অথচ ধর্ম আছে, এমন ধর্মকে আমি মানি নে।”

বিনয়ের রোখ চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, “আমি মানি। ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজ যেটাকে চায় সেইটেকেই যদি ধর্ম বলে মানতে হয় তা হলে সমাজেরই মাথা খাওয়া হয়। সমাজ যদি আমার কোনো ন্যায়সংগত ধর্মসংগত স্বাধীনতায় বাধা দেয় তা হলে সেই অসংগত বাধা লঙ্ঘন করলেই সমাজের প্রতি কর্তব্য করা হয়। ললিতাকে বিবাহ করা যদি আমার অন্যায় না হয়, এমন-কি, উচিত হয়, তবে সমাজ প্রতিকূল বলেই তার থেকে নিরস্ত হওয়া আমার পক্ষে অধর্ম হবে।”

গোরা কহিল, “ন্যায় অন্যায় কি একলা তোমার মধ্যেই বদ্ধ? এই বিবাহের দ্বারা তোমার ভাবী সন্তানদের তুমি কোথায় দাঁড় করাচ্ছ সে কথা ভাববে না?”

বিনয় কহিল, “সেইরকম করে ভাবতে গিয়েই তো মানুষ সামাজিক অন্যায়কে চিরস্থায়ী করে তোলে। সাহেব-মনিবের লাথি খেয়ে যে কেরানি অপমান চিরদিন বহন করে তাকে তুমি দোষ দাও কেন? সেও তো তার সন্তানদের কথাই ভাবে।”

গোরার সঙ্গে তর্কে বিনয় যে জায়গায় আসিয়া পৌঁছিল পূর্বে সেখানে সে ছিল না। একটু আগেই সমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাতেই তাহার সমস্ত চিত্ত সংকুচিত হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে সে নিজের সঙ্গে কোনোপ্রকার তর্কই করে নাই এবং গোরার সঙ্গে তর্ক যদি উঠিয়া না পড়িত তবে বিনয়ের মন আপন চিরন্তন সংস্কার অনুসারে উপস্থিত প্রবৃত্তির উলটা দিকেই চলিত। কিন্তু তর্ক করিতে করিতে তাহার প্রবৃত্তি, কর্তব্যবুদ্ধিকে আপনার সহায় করিয়া লইয়া প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল।

গোরার সঙ্গে খুব তর্ক বাধিয়া গেল। এইরূপ আলোচনায় গোরা প্রায়ই যুক্তি-প্রয়োগের দিকে যায় না–সে খুব জোরের সঙ্গে আপনার মত বলে। তেমন জোর অল্প লোকেরই দেখা যায়। এই জোরের দ্বারাই আজ সে বিনয়ের সব কথা ঠেলিয়া ভূমিসাৎ করিয়া চলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু আজ সে বাধা পাইতে লাগিল। যতদিন এক দিকে গোরা আর-এক দিকে বিনয়ের মত মাত্র ছিল ততদিন বিনয় হার মানিয়াছে, কিন্তু আজ দুই দিকেই দুই বাস্তব মানুষ–গোরা আজ বায়ুবাণের দ্বারা বায়ুবাণকে ঠেকাইতেছিল না, আজ বাণ যেখানে আসিয়া বাজিতেছিল সেখানে বেদনাপূর্ণ মানুষের হৃদয়।

শেষকালে গোরা কহিল, “আমি তোমার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করতে চাই নে। এর মধ্যে তর্কের কথা বেশি কিছু নেই, এর মধ্যে হৃদয় দিয়ে একটি বোঝবার কথা আছে। ব্রাহ্ম মেয়েকে বিয়ে করে তুমি দেশের সর্বসাধারণের সঙ্গে নিজেকে যে পৃথক করে ফেলতে চাও সেইটেই আমার কাছে অত্যন্ত বেদনার বিষয়। এ কাজ তুমি পার, আমি কিছুতেই পারি নে, এইখানেই তোমাতে আমাতে প্রভেদ– জ্ঞানে নয়, বুদ্ধিতে নয়। আমার প্রেম যেখানে তোমার প্রেম সেখানে নেই। তুমি যেখানে ছুরি মেরে নিজেকে মুক্ত করতে চাচ্ছ সেখানে তোমার দরদ কিছুই নেই। আমার সেখানে নাড়ির টান। আমি আমার ভারতবর্ষকে চাই–তাকে তুমি যত দোষ দাও, যত গাল দাও, আমি তাকেই চাই; তার চেয়ে বড়ো করে আমি আপনাকে কি অন্য কোনো মানুষকেই চাই নে। আমি লেশমাত্র এমন কোনো কাজ করতে চাই নে যাতে আমার ভারতবর্ষের সঙ্গে চুলমাত্র বিচ্ছেদ ঘটে।”

বিনয় কী একটা উত্তর দিবার উপক্রম করিতেই গোরা কহিল, “না বিনয়, তুমি বৃথা আমার সঙ্গে তর্ক করছ। সমস্ত পৃথিবী যে ভারতবর্ষকে ত্যাগ করেছে, যাকে অপমান করছে, আমি তারই সঙ্গে এক অপমানের আসনে স্থান নিতে চাই–আমার এই জাতিভেদের ভারতবর্ষ, আমার এই কুসংস্কারের ভারতবর্ষ, আমার এই পৌত্তলিক ভারতবর্ষ। তুমি এর সঙ্গে যদি ভিন্ন হতে চাও তবে আমার সঙ্গেও ভিন্ন হবে।”

এই বলিয়া গোরা উঠিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বেহারা আসিয়া গোরাকে খবর দিল, অনেকগুলি বাবু তাহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে। পলায়নের একটা উপলক্ষ পাইয়া গোরা আরাম বোধ করিল, সে চলিয়া গেল।

বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্যান্য নানা লোকের মধ্যে অবিনাশও আসিয়াছে। গোরা স্থির করিয়াছিল অবিনাশ রাগ করিয়াছে। কিন্তু রাগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। সে আরো উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্যে তাহার গতকল্যকার প্রত্যাখ্যান-ব্যাপার সকলের কাছে বর্ণনা করিতেছিল। সে কহিল, “গৌরমোহনবাবুর প্রতি আমার ভক্তি অনেক বেড়ে গেছে; এতদিন আমি জানতুম উনি অসামান্য লোক, কিন্তু কাল জানতে পেরেছি উনি মহাপুরুষ। আমরা কাল ওঁকে সম্মান দেখাতে গিয়েছিলুম–উনি যেরকম প্রকাশ্যভাবে সেই সম্মানকে উপেক্ষা করলেন সেরকম আজকালকার দিনে কজন লোক পারে! এ কি সাধারণ কথা!”

একে গোরার মন বিকল হইয়া ছিল, তাহার উপরে অবিনাশের এই উচ্ছ্বাসে তাহার গা জ্বলিতে লাগিল; সে অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “দেখো অবিনাশ, তোমরা ভক্তির দ্বারাই মানুষকে অপমান কর–রাস্তার ধারে আমাকে নিয়ে তোমরা সঙের নাচন নাচাতে চাও সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি, এতটুকু লজ্জাশরম তোমরা আমার কাছে প্রত্যাশা কর না! একেই তোমরা বল মহাপুরুষের লক্ষণ! আমাদের এই দেশটাকে কি তোমরা কেবলমাত্র একটা যাত্রার দল বলে ঠিক করে রেখেছে? সকলেই প্যালা নেবার জন্যে কেবল নেচে বেড়াচ্ছে! কেউ এতটুকু সত্যকাজ করছে না! সঙ্গে যোগ দিতে চাও ভালো, ঝগড়া করতে চাও সেও ভালো, কিন্তু দোহাই তোমাদের–অমন করে বাহবা দিয়ো না।”

অবিনাশের ভক্তি আরো চড়িতে লাগিল। সে সহাস্যমুখে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মুখের দিকে চাহিয়া গোরার বাক্যগুলির চমৎকারিতার প্রতি সকলের মন আকর্ষণ করিবার ভাব দেখাইল। কহিল, “আশীর্বাদ করুন, আপনার মতো ঐরকম নিষ্কামভাবে ভারতবর্ষের সনাতম গৌরব-রক্ষার জন্যে আমরা জীবন সমর্পণ করতে পারি।”

এই বলিয়া পায়ের ধুলা লইবার জন্য অবিনাশ হস্ত প্রসারণ করিতেই গোরা সরিয়া গেল।

অবিনাশ কহিল, “গৌরমোহনবাবু, আপনি তো আমাদের কাছ থেকে কোনো সম্মান নেবেন না। কিন্তু আমাদের আনন্দ দিতে বিমুখ হলেও চলবে না। আপনাকে নিয়ে একদিন আমরা সকলে মিলে আহার করব এই আমরা পরামর্শ করেছি–এটিতে আপনাকে সম্মতি দিতেই হবে।”

গোরা কহিল, “আমি প্রায়শ্চিত্ত না করে তোমাদের সকলের সঙ্গে খেতে বসতে পারব না।”

প্রায়শ্চিত্ত! অবিনাশের দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “এ কথা আমাদের কারো মনেও উদয় হয় নি, কিন্তু হিন্দুধর্মের কোনো বিধান গৌরমোহনবাবুকে কিছুতে এড়াতে পারবে না।”

সকলে কহিল–তা বেশ কথা। প্রায়শ্চিত্ত উপলক্ষেই সকলে একত্রে আহার করা যাইবে। সেদিন দেশের বড়ো বড়ো অধ্যাপক-পণ্ডিতদের নিমন্ত্রণ করিতে হইবে; হিন্দুধর্ম যে আজও কিরূপ সজীব আছে তাহা গৌরমোহনবাবুর এই প্রায়শ্চিত্তের নিমন্ত্রণে প্রচার হইবে।

প্রায়শ্চিত্তসভা কবে কোথায় আহূত হইবে সে প্রশ্নও উঠিল। গোরা কহিল, এ বাড়িতে সুবিধা হইবে না। একজন ভক্ত তাহার গঙ্গার ধারের বাগানে এই ক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তাব করিল। ইহার খরচও দলের লোকে সকলে মিলিয়া বহন করিবে স্থির হইয়া গেল।

বিদায়গ্রহণের সময় অবিনাশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বক্তৃতার ছাঁদে হাত নাড়িয়া সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু বিরক্ত হতে পারেন–কিন্তু আজ আমার হৃদয় যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তখন এ কথা না বলেও আমি থাকতে পারছি নে, বেদ-উদ্ধারের জন্যে আমাদের এই পূণ্যভূমিতে অবতার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তেমনি হিন্দুধর্মকে উদ্ধার করবার জন্যেই আজ আমরা এই অবতারকে পেয়েছি। পৃথিবীতে কেবল আমাদের দেশেই ষড়্‌ঋতু আছে, আমাদের এই দেশেই কালে কালে অবতার জন্মেছেন এবং আরো জন্মাবেন। আমরা ধন্য যে এই সত্য আমাদের কাছে প্রমাণ হয়ে গেল। বলো ভাই, গৌরমোহনের জয়।”

অবিনাশের বাগ্মিতায় বিচলিত হইয়া সকলে মিলিয়া গৌরমোহনের জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। গোরা মর্মান্তিক পীড়া পাইয়া সেখান হইতে ছুটিয়া চলিয়া গেল।

আজ জেলখানা হইতে মুক্তির দিনে প্রবল একটা অবসাদ গোরার মনকে আক্রমণ করিল। নূতন উৎসাহে দেশের জন্য কাজ করিবে বলিয়া গোরা জেলের অবরোধে অনেক দিন কল্পনা করিয়াছে। আজ সে নিজেকে কেবল এই প্রশ্ন করিতে লাগিল–”হায়, আমার দেশ কোথায়! দেশ কি কেবল আমার একলার কাছে! আমার জীবনের সমস্ত সংকল্প যাহার সঙ্গে আলোচনা করিলাম সেই আমার আশৈশবের বন্ধু আজ এতদিন পরে কেবল একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করিবার উপলক্ষে তাহার দেশের সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এক মুহূর্তে এমন নির্মমভাবে পৃথক হইতে প্রস্তুত হইল। আর যাহাদিগকে সকলে আমার দলের লোক বলে, এতদিন তাহাদিগকে এত বুঝানোর পরও তাহারা আজ এই স্থির করিল যে, আমি কেবল হিঁদুয়ানি উদ্ধার করিবার জন্যে অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি! আমি কেবল মূর্তিমান শাস্ত্রের বচন! আর, ভারতবর্ষ কোনোখানে স্থান পাইল না! ষড়্‌ঋতু! ভারতবর্ষে ষড়্‌ঋতু আছে! সেই ষড়্‌ঋতুর ষড়যন্ত্রে যদি অবিনাশের মতো এমন ফল ফলিয়া থাকে তবে দুই-চারিটা ঋতু কম থাকিলে ক্ষতি ছিল না।’

বেহারা আসিয়া খবর দিল, মা গোরাকে ডাকিতেছেন। গোরা যেন হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে আপনার মনে বলিয়া উঠিল, “মা ডাকিতেছেন!’ এই খবরটাকে সে যেন একটা নূতন অর্থ দিয়া শুনিল। সে কহিল, “আর যাই হউক, আমার মা আছেন। এবং তিনিই আমাকে ডাকিতেছেন। তিনিই আমাকে সকলের সঙ্গে মিলাইয়া দিবেন, কাহারো সঙ্গে তিনি কোনো বিচ্ছেদ রাখিবেন না। আমি দেখিব যাহারা আমার আপন তাহারা তাঁহার ঘরে বসিয়া আছে। জেলের মধ্যেও মা আমাকে ডাকিয়াছিলেন, সেখানে তাঁহার দেখা পাইয়াছি। জেলের বাহিরেও মা আমাকে ডাকিতেছেন, সেখানে আমি তাঁহাকে দেখিতে যাত্রা করিলাম।’ এই বলিয়া গোরা সেই শীতমধ্যাহ্নের আকাশের দিকে বাহিরে চাহিয়া দেখিল। এক দিকে বিনয় ও আর-এক দিকে অবিনাশের তরফ হইতে যে বিরোধের সুর উঠিয়াছিল তাহা যৎসামান্য হইয়া কাটিয়া গেল। এই মধ্যাহ্নসূর্যের আলোকে ভারতবর্ষ যেন তাহার বাহু উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিল। তাহার আসমুদ্রবিস্তৃত নদীপর্বত লোকালয় গোরার চক্ষের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল। অনন্তের দিক হইতে একটি মুক্ত নির্মল আলোক আসিয়া এই ভারতবর্ষকে সর্বত্র যেন জ্যোতির্ময় করিয়া দেখাইল। গোরার বক্ষ ভরিয়া উঠিল, তাহার দুই চক্ষু জ্বলিতে লাগিল, তাহার মনের কোথাও লেশমাত্র নৈরাশ্য রহিল না। ভারতবর্ষের যে কাজ অন্তহীন, যে কাজের ফল বহুদূরে তাহার জন্য তাহার প্রকৃতি আনন্দের সহিত প্রস্তুত হইল–ভারতবর্ষের যে মহিমা সে ধ্যানে দেখিয়াছে তাহাকে নিজের চক্ষে দেখিয়া যাইতে পারিবে না বলিয়া তাহার কিছুমাত্র ক্ষোভ রহিল না। সে মনে মনে বার বার করিয়া বলিল, “মা আমাকে ডাকিতেছেন–চলিলাম যেখানে অন্নপূর্ণা, যেখানে জগদ্ধাত্রী বসিয়া আছেন সেই সুদূরকালেই অথচ এই নিমেষেই, সেই মৃত্যুর পরপ্রান্তেই অথচ এই জীবনের মধ্যেই, সেই-যে মহামহিমান্বিত ভবিষ্যৎ আজ আমার এই দীনহীন বর্তমানকে সম্পূর্ণ সার্থক করিয়া উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছে–আমি চলিলাম সেইখানেই–সেই অতিদূরে সেই অতিনিকটে মা আমাকে ডাকিতেছেন।’ এই আনন্দের মধ্যে গোরা যেন বিনয় এবং অবিনাশের সঙ্গ পাইল, তাহারাও তাহার পর হইয়া রহিল না–অদ্যকার সমস্ত বিরোধগুলি একটা প্রকাণ্ড চরিতার্থতায় কোথায় মিলাইয়া গেল।

গোরা যখন আনন্দময়ীর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন তাহার মুখ আনন্দের আভায় দীপ্যমান, তখন তাহার চক্ষু যেন সম্মুখস্থিত সমস্ত পদার্থের পশ্চাতে আর-একটি কোন্‌ অপরূপ মূর্তি দেখিতেছে। প্রথমেই হঠাৎ আসিয়া সে যেন ভালো করিয়া চিনিতে পারিল না, ঘরে তাহার মার কাছে কে বসিয়া আছে।

সুচরিতা উঠিয়া দাঁড়াইয়া গোরাকে নমস্কার করিল। গোরা কহিল, “এই-যে, আপনি এসেছেন–বসুন।”

গোরা এমন করিয়া বলিল “আপনি এসেছেন’, যেন সুচরিতার আসা একটা সাধারণ ঘটনার মধ্যে নয়, এ যেন একটা বিশেষ আবির্ভাব।

একদিন সুচরিতার সংস্রব হইতে গোরা পলায়ন করিয়াছিল। যত দিন পর্যন্ত সে নানা কষ্ট এবং কাজ লইয়া ভ্রমণ করিতেছিল ততদিন সুচরিতার কথা মন থেকে অনেকটা দূরে রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু জেলের অবরোধের মধ্যে সুচরিতার স্মৃতিকে সে কোনোমতেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এমন একদিন ছিল যখন ভারতবর্ষে যে স্ত্রীলোক আছে সে কথা গোরার মনে উদয়ই হয় নাই। এই সত্যটি এতকাল পরে সে সুচরিতার মধ্যে নূতন আবিষ্কার করিল। একেবারে এক মুহূর্তে এতবড়ো একটা পুরাতন এবং প্রকাণ্ড কথাটাকে হঠাৎ গ্রহণ করিয়া তাহার সমগ্র বলিষ্ঠ প্রকৃতি ইহার আঘাতে কম্পিত হইয়া উঠিল। জেলের মধ্যে বাহিরের সূর্যালোক এবং মুক্ত বাতাসের জগৎ যখন তাহার মনের মধ্যে বেদনা সঞ্চার করিত তখন সেই জগৎটিকে কেবল সে নিজের কর্মক্ষেত্র এবং কেবল সেটাকে পুরুষসমাজ বলিয়া দেখিত না; যেমন করিয়াই সে ধ্যান করিত বাহিরের এই সুন্দর জগৎসংসারে সে কেবল দুটি অধিষ্ঠাত্রী দেবতার মুখ দেখিতে পাইত, সূর্য চন্দ্র তারার আলোক বিশেষ করিয়া তাহাদেরই মুখের উপর পড়িত, স্নিগ্ধ নীলিমামণ্ডিত আকাশ তাহাদেরই মুখকে বেষ্টন করিয়া থাকিত–একটি মুখ তাহার আজন্মপরিচিত মাতার, বুদ্ধিতে উদ্‌ভাসিত আর-একটি নম্র সুন্দর মুখের সঙ্গে তাহার নূতন পরিচয়।

জেলের নিরানন্দ সংকীর্ণতার মধ্যে গোরা এই মুখের স্মৃতির সঙ্গে বিরোধ করিতে পারে নাই। এই ধ্যানের পুলকটুকু তাহার জেলখানার মধ্যে একটি গভীরতর মুক্তিকে আনিয়া দিত। জেলখানার কঠিন বন্ধন তাহার কাছে যেন ছায়াময় মিথ্যা স্বপ্নের মতো হইয়া যাইত। স্পন্দিত হৃদয়ের অতীন্দ্রিয় তরঙ্গগুলি জেলের সমস্ত প্রাচীর অবাধে ভেদ করিয়া আকাশে মিশিয়া সেখানকার পুষ্পপল্লবে হিল্লোলিত এবং সংসারকর্মক্ষেত্রে লীলায়িত হইতে থাকিত।

গোরা মনে করিয়াছিল, কল্পনামূর্তিকে ভয় করিবার কোনো কারণ নাই। এইজন্য এক মাস কাল ইহাকে একেবারেই সে পথ ছড়িয়া দিয়াছিল। গোরা জানিত, ভয় করিবার বিষয় কেবলমাত্র বাস্তব পদার্থ।

জেল হইতে বাহির হইবামাত্র গোরা যখন পরেশবাবুকে দেখিল তখন তাহার মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল। সে যে কেবল পরেশবাবুকে দেখার আনন্দ তাহা নহে; তাহার সঙ্গে গোরার এই কয়দিনের সঙ্গিনী কল্পনাও যে কতটা নিজের মায়া মিশ্রিত করিয়াছিল তাহা প্রথমটা গোরা বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু ক্রমেই বুঝিল। ষ্টীমারে আসিতে আসিতে সে স্পষ্টই অনুভব করিল, পরেশবাবু যে তাহাকে আকর্ষণ করিতেছেন সে কেবল তাঁহার নিজগুণে নহে।

এতদিন পরে গোরা আবার কোমর বাঁধিল। বলিল, “হার মানিব না।’ ষ্টীমারে বসিয়া বসিয়া, আবার দূরে যাইবে, কোনোপ্রকার সূক্ষ্ণ বন্ধনে সে নিজের মনকে বাঁধিতে দিবে না, এই সংকল্প আঁটিল।

এমন সময় বিনয়ের সঙ্গে তাহার তর্ক বাধিয়া গেল। বিচ্ছেদের পর বন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম মিলনেই তর্ক এমন প্রবল হইত না। কিন্তু আজ এই তর্কের মধ্যে তাহার নিজের সঙ্গেও তর্ক ছিল। এই তর্ক উপলক্ষে নিজের প্রতিষ্ঠাভূমিকে গোরা নিজের কাছেও স্পষ্ট করিয়া লইতেছিল। এইজন্যই গোরা আজ এত বিশেষ জোর দিয়া কথা বলিতেছিল–সেই জোরটুকুতে তার নিজেরই বিশেষ প্রয়োজন ছিল। যখন তাহার আজিকার এই জোর বিনয়ের মনে বিরুদ্ধ জোরকেই উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিল, যখন সে মনে মনে গোরার কথাকে কেবলই খণ্ডন করিতেছিল এবং গোরার নির্বন্ধকে অন্যায় গোঁড়ামি বলিয়া যখন তাহার সমস্ত চিত্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল তখন বিনয় কল্পনাও করে নাই যে, গোরা নিজেকেই যদি আঘাত না করিত তবে আজ তাহার আঘাত হয়তো এত প্রবল হইত না।

বিনয়ের সঙ্গে তর্কের পর গোরা ঠিক করিল, যুদ্ধক্ষেত্রের বাহিরে গেলে চলিবে না। আমি যদি নিজের প্রাণের ভয়ে বিনয়কে ফেলিয়া যাই, তবে বিনয় রক্ষা পাইবে না।

গোরার মন তখন ভাবে আবিষ্ট ছিল–সুচরিতাকে সে তখন একটি ব্যক্তিবিশেষ বলিয়া দেখিতেছিল না, তাহাকে একটি ভাব বলিয়া দেখিতেছিল। ভারতের নারীপ্রকৃতি সুচরিতা-মূর্তিতে তাহার সম্মুখে প্রকাশিত হইল। ভারতের গৃহকে পূণ্যে সৌন্দর্যে ও প্রেমে মধুর ও পবিত্র করিবার জন্যই ইঁহার আবির্ভাব। যে লক্ষ্ণী ভারতের শিশুকে মানুষ করেন, রোগীকে সেবা করেন, তাপীকে সান্ত্বনা দেন, তুচ্ছকেও প্রেমের গৌরবে প্রতিষ্ঠা দান করেন, যিনি দুঃখে দুর্গতিতেও আমাদের দীনতমকেও ত্যাগ করেন নাই, অবজ্ঞা করেন নাই, যিনি আমাদের পূজার্হা হইয়াও আমাদের অযোগ্যতমকেও একমনে পূজা করিয়া আসিয়াছেন, যাঁহার নিপুণ সুন্দর হাত দুইখানি আমাদের কাজে উৎসর্গ করা এবং যাঁহার চিরসহিষ্ণু ক্ষমাপূর্ণ প্রেম অক্ষয় দানরূপে আমরা ঈশ্বরের কাছ হইতে লাভ করিয়াছি, সেই লক্ষ্ণীরই একটি প্রকাশকে গোরা তাহার মাতার পার্শ্বে প্রত্যক্ষ আসীন দেখিয়া গভীর আনন্দে ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, এই লক্ষ্ণীর দিকে আমরা তাকাই নাই, ইহাকেই আমরা সকলের পিছনে ঠেলিয়া রাখিয়াছিলাম–আমাদের এমন দুর্গতির লক্ষণ আর কিছুই নাই। গোরার তখন মনে হইল–দেশ বলিতেই ইনি, সমস্ত ভারতের মর্মস্থানে প্রাণের নিকেতনে শতদল পদ্মের উপর ইনি বসিয়া আছেন, আমরাই ইঁহার সেবক। দেশের দুর্গতিতে ইঁহারই অবমাননা, সেই অবমাননায় উদাসীন আছি বলিয়াই আমাদের পৌরুষও আজ লজ্জিত।

গোরা নিজের মনে নিজে আশ্চর্য হইয়া গেছে। যতদিন ভারতবর্ষের নারী তাহার অনুভবগোচর ছিল না ততদিন ভারতবর্ষকে সে যে কিরূপ অসম্পূর্ণ করিয়া উপলব্ধি করিতেছিল ইতিপূর্বে তাহা সে জানিতই না। গোরার কাছে নারী যখন অত্যন্ত ছায়াময় ছিল তখন দেশ সম্বন্ধে তাহার যে কর্তব্যবোধ ছিল তাহাতে কী একটা অভাব ছিল। যেন শক্তি ছিল, কিন্তু তাহাতে প্রাণ ছিল না। যেন পেশী ছিল, কিন্তু স্নায়ু ছিল না। গোরা এক মুহূর্তেই বুঝিতে পারিল যে, নারীকে যতই আমরা দূর করিয়া ক্ষুদ্র করিয়া জানিয়াছি আমাদের পৌরুষও ততই শীর্ণ হইয়া মরিয়াছে।

তাই গোরা যখন সুচরিতাকে কহিল “আপনি এসেছেন”, তখন সেটা কেবল একটা প্রচলিত শিষ্টসম্ভাষণরূপে তাহার মুখ হইতে বাহির হয় নাই–তাহার জীবনে একটি নূতনলব্ধ আনন্দ ও বিস্ময় এই অভিবাদনের মধ্যে পূর্ণ হইয়া ছিল।

কারাবাসের কিছু কিছু চিহ্ন গোরার শরীরে ছিল। পূর্বের চেয়ে সে অনেকটা রোগা হইয়া গেছে। জেলের অন্নে তাহার অশ্রদ্ধা ও অরুচি থাকাতে এই এক মাস কাল সে প্রায় উপবাস করিয়া ছিল। তাহার উজ্জ্বল শুভ্র বর্ণও পূর্বের চেয়ে কিছু ম্লান হইয়াছে। তাহার চুল অত্যন্ত ছোটো করিয়া ছাঁটা হওয়াতে মুখের কৃশতা আরো বেশি করিয়া দেখা যাইতেছে।

গোরার দেহের শীর্ণতাই সুচরিতার মনে বিশেষ করিয়া একটি বেদনাপূর্ণ সম্ভ্রম জাগাইয়া দিল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল প্রণাম করিয়া গোরার পায়ের ধুলা গ্রহণ করে। যে উদ্দীপ্ত আগুনের ধোঁওয়া এবং কাঠ আর দেখা যায় না গোরা সেই বিশুদ্ধ অগ্নিশিখাটির মতো তাহার কাছে প্রকাশ পাইল। একটি করুণামিশ্রিত ভক্তির আবেগে সুচরিতার বুকের ভিতরটা কাঁপিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না।

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার মেয়ে থাকলে যে কী সুখ হত এবার তা বুঝতে পেরেছি গোরা! তুই যে কটা দিন ছিলি নে, সুচরিতা যে আমাকে কত সান্ত্বনা দিয়েছে সে আর আমি কী বলব। আমার সঙ্গে তো এঁদের পূর্বে পরিচয় ছিল না। কিন্তু দুঃখের সময় পৃথিবীর অনেক বড়ো জিনিস, অনেক ভালো জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, দুঃখের এই একটি গৌরব এবার বুঝেছি। দুঃখের সান্ত্বনা যে ঈশ্বর কোথায় কত জায়গায় রেখেছেন তা সব সময় জানতে পারি নে বলেই আমরা কষ্ট পাই। মা, তুমি লজ্জা করছ, কিন্তু তুমি আমার দুঃসময়ে আমাকে কত সুখ দিয়েছ সে কথা আমি তোমার সামনে না বলেই বা বাঁচি কী করে!”

গোরা গভীর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে সুচরিতার লজ্জিত মুখের দিকে একবার চাহিয়া আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, তোমার দুঃখের দিনে উনি তোমার দুঃখের ভাগ নিতে এসেছিলেন, আবার আজ তোমার সুখের দিনেও তোমার সুখকে বাড়াবার জন্যে এসেছেন– হৃদয় যাঁদের বড়ো তাঁদেরই এইরকম অকারণ সৌহৃদ্য।”

বিনয় সুচরিতার সংকোচ দেখিয়া কহিল, “দিদি, চোর ধরা পড়ে গেলে চতুর্দিক থেকে শাস্তি পায়। আজ তুমি এঁদের সকলের কাছেই ধরা পড়ে গেছ, তারই ফলভোগ করছ। এখন পালাবে কোথায়? আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই চিনি, কিন্তু কারো কাছে কিছু ফাঁস করি নি, চুপ করে বসে আছি–মনে মনে জানি বেশিদিন কিছুই চাপা থাকে না।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “তুমি চুপ করে আছ বৈকি। তুমি চুপ করে থাকবার ছেলে কিনা! যেদিন থেকে ও তোমাদের জেনেছে সেইদিন থেকে তোমাদের গুণগান করে ওর আর আশ কিছুতেই মিটছে না।”

বিনয় কহিল, “শুনে রাখো দিদি! আমি যে গুণগ্রাহী এবং আমি যে অকৃতজ্ঞ নই তার সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির।”

সুচরিতা কহিল, “ওতে কেবল আপনারই গুণের পরিচয় দিচ্ছেন।”

বিনয় কহিল, “আমার গুণের পরিচয় কিন্তু আমার কাছে কিছু পাবেন না। পেতে চান তো মার কাছে আসবেন–স্তম্ভিত হয়ে যাবেন, ওঁর মুখে যখন শুনি আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। মা যদি আমার জীবনচরিত লেখেন তা হলে আমি সকাল সকাল মরতে রাজি আছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “শুনছ একবার ছেলের কথা!”

গোরা কহিল, “বিনয়, তোমার বাপ-মা সার্থক তোমার নাম রেখেছিলেন।”

বিনয় কহিল, “আমার কাছে বোধ হয় তাঁরা আর কোনো গুণ প্রত্যাশা করেন নি বলেই বিনয় গুণটির জন্যে দোহাই পেড়ে গিয়েছেন, নইলে সংসারে হাস্যাস্পদ হতে হত।”

এমনি করিয়া প্রথম আলাপের সংকোচ কাটিয়া গেল।

বিদায় লইবার সময় সুচরিতা বিনয়কে বলিল, “আপনি একবার আমাদের ও দিকে যাবেন না?”

সুচরিতা বিনয়কে যাইতে বলিল, গোরাকে বলিতে পারিল না। গোরা তাহার ঠিক অর্থটা বুঝিল না, তাহার মনের মধ্যে একটা আঘাত বাজিল। বিনয় যে সহজেই সকলের মাঝখানে আপনার স্থান করিয়া লইতে পারে আর গোরা তাহা পারে না, এজন্য গোরা ইতিপূর্বে কোনোদিন কিছুমাত্র খেদ অনুভব করে নাই– আজ নিজের প্রকৃতির এই অভাবকে অভাব বলিয়া বুঝিল।

ললিতার সঙ্গে তাহার বিবাহ-প্রসঙ্গ আলোচনা করিবার জন্যই যে সুচরিতা বিনয়কে ডাকিয়া গেল, বিনয় তাহা বুঝিয়াছিল। এই প্রস্তাবটিকে সে শেষ করিয়া দিয়াছে বলিয়াই তো ব্যাপারটা শেষ হইয়া যায় নাই। তাহার যতক্ষণ আয়ু আছে ততক্ষণ কোনো পক্ষের নিষ্কৃতি থাকিতে পারে না।

এতদিন বিনয়ের সকলের চেয়ে বড়ো ভাবনা ছিল, গোরাকে আঘাত দিব কী করিয়া। গোরা বলিতে শুধু যে গোরা মানুষটি তাহা নহে; গোরা যে ভাব, যে বিশ্বাস, যে জীবনকে আশ্রয় করিয়া আছে সেটাও বটে। ইহারই সঙ্গে বরাবর নিজেকে মিলাইয়া চলাই বিনয়ের অভ্যাসের এবং আনন্দের বিষয় ছিল; ইহার সঙ্গে কোনোপ্রকার বিরোধ যেন তাহার নিজেরই সঙ্গে বিরোধ।

কিন্তু সেই আঘাতের প্রথম সংকোচটা কাটিয়া গেছে; ললিতার প্রসঙ্গ লইয়া গোরার সঙ্গে একটা স্পষ্ট কথা হইয়া যাওয়াতে বিনয় জোর পাইল। ফোড়া কাটাইবার পূর্বে রোগীর ভয় ও ভাবনার অবধি ছিল না; কিন্তু অস্ত্র যখন পড়িল তখন রোগী দেখিল বেদনা আছে বটে, কিন্তু আরামও আছে, এবং জিনিসটাকে কল্পনায় যত সাংঘাতিক বলিয়া মনে হইয়াছিল ততটাও নহে।

এতক্ষণ বিনয় নিজের মনের সঙ্গে তর্কও করিতে পারিতেছিল না, এখন তাহার তর্কের দ্বারও খুলিয়া গেল। এখন মনে মনে গোরার সঙ্গে তাহার উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতে লাগিল। গোরার দিক হইতে যে-সকল যুক্তিপ্রয়োগ সম্ভব সেইগুলি মনের মধ্যে উত্থাপিত করিয়া তাহাদিগকে নানা দিক হইতে খণ্ডন করিতে লাগিল। যদি গোরার সঙ্গে মুখে মুখে সমস্ত তর্ক চলিতে পারিত তাহা হইলে উত্তেজনা যেমন জাগিত তেমনি নিবৃত্ত হইয়াও যাইত; কিন্তু বিনয় দেখিল, এ বিষয়ে গোরা শেষ পর্যন্ত তর্ক করিবে না। ইহাতেও বিনয়ের মনে একটা উত্তাপ জাগিল; সে ভাবিল– গোরা বুঝিবে না, বুঝাইবে না, কেবলই জোর করিবে। “জোর! জোরের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারিব না।’ বিনয় কহিল, “যাহাই ঘটুক আমি সত্যের পক্ষে।’ এই বলিয়া “সত্য’ বলিয়া একটি শব্দকে দুই হাতে সে বুকের মধ্যে আঁকড়িয়া ধরিল। গোরার প্রতিকূলে একটি খুব প্রবল পক্ষকে দাঁড় করানো দরকার– এইজন্য, সত্যই যে বিনয়ের চরম অবলম্বন ইহাই সে বার বার করিয়া নিজের মনকে বলিতে লাগিল। এমন-কি, সত্যকেই সে যে আশ্রয় করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া নিজের প্রতি তাহার ভারি একটা শ্রদ্ধা জন্মিল। এইজন্য বিনয় অপরাহ্নে সুচরিতার বাড়ির দিকে যখন গেল তখন বেশ একটু মাথা তুলিয়া গেল। সত্যের দিকেই ঝুঁকিয়াছে বলিয়া তাহার এত জোর, না, ঝোঁকটা আর-কিছুর দিকে সে কথা বিনয়ের বুঝিবার অবস্থা ছিল না।

হরিমোহিনী তখন রন্ধনের উদ্‌যোগ করিতেছিলেন। বিনয় সেখানে রন্ধনশালার দ্বারে ব্রাহ্মণতনয়ের মধ্যাহ্নভোজনের দাবি মঞ্জুর করাইয়া উপরে চলিয়া গেল।

সুচরিতা একটা সেলাইয়ের কাজ লইয়া সেই দিকে চোখ নামাইয়া অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে আলোচ্য কথাটা পাড়িল। কহিল, “দেখুন বিনয়বাবু, ভিতরকার বাধা যেখানে নেই সেখানে বাইরের প্রতিকূলতাকে কি মেনে চলতে হবে?”

গোরার সঙ্গে যখন তর্ক হইয়াছিল তখন বিনয় বিরুদ্ধ যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আবার সুচরিতার সঙ্গে যখন আলোচনা হইতে লাগিল তখনো সে উলটা পক্ষের যুক্তি প্রয়োগ করিল। তখন গোরার সঙ্গে তাহার যে কোনো মতবিরোধ আছে এমন কথা কে মনে করিতে পারিবে!

বিনয় কহিল, “দিদি, বাইরের বাধাকে তোমরাও তো খাটো করে দেখছ না!”

সুচরিতা কহিল, “তার কারণ আছে বিনয়বাবু! আমাদের বাধাটা ঠিক বাইরের বাধা নয়। আমাদের সমাজ যে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আপনি যে সমাজে আছেন সেখানে আপনার বন্ধন কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন। এইজন্যে যদি ললিতাকে ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করে যেতে হয় তার সেটাতে যত গুরুতর ক্ষতি, আপনার সমাজত্যাগে আপনার ততটা ক্ষতি নয়।”

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাহাকে কোনো সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত নহে এই বলিয়া বিনয় তর্ক করিতে লাগিল।

এমন সময় সতীশ একখানি চিঠি ও একটি ইংরাজি কাগজ লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বিনয়কে দেখিয়া সে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিল– শুক্রবারকে কোনো উপায়ে রবিবার করিয়া তুলিবার জন্য তাহার মন ব্যস্ত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিনয়ে এবং সতীশে মিলিয়া সভা জমিয়া গেল। এ দিকে ললিতার চিঠি এবং তৎসহ প্রেরিত কাগজখানি সুচরিতা পড়িতে লাগিল।

এই ব্রাহ্ম কাগজটিতে একটি খবর ছিল যে, কোনো বিখ্যাত ব্রাহ্মপরিবারে হিন্দু- সমাজের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটিবার যে আশঙ্কা হইয়াছিল তাহা হিন্দুযুবকের অসম্মতিবশত কাটিয়া গিয়াছে। এই উপলক্ষে উক্ত হিন্দুযুবকের নিষ্ঠার সহিত তুলনা করিয়া ব্রাহ্মপরিবারের শোচনীয় দুর্বলতা সম্বন্ধে আক্ষেপ প্রকাশ করা হইয়াছে।

সুচরিতা মনে মনে কহিল, যেমন করিয়া হউক, বিনয়ের সহিত ললিতার বিবাহ ঘটাইতেই হইবে। কিন্তু সে তো এই যুবকের সঙ্গে তর্ক করিয়া হইবে না। ললিতাকে সুচরিতা তাহার বাড়িতে আসিবার জন্য চিঠি লিখিয়া দিল, তাহাতে বলিল না যে, বিনয় এখানে আছে।

কোনো পঞ্জিকাতেই কোনো গ্রহনক্ষত্রের সমাবেশে শুক্রবারে রবিবার পড়িবার ব্যবস্থা না থাকায় সতীশকে ইস্কুলে যাইতে প্রস্তুত হইবার জন্য উঠিতে হইল। সুচরিতাও স্নান করিতে যাইতে হইবে বলিয়া কিছুক্ষণের জন্য অবকাশ প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল।

তর্কের উত্তেজনা যখন কাটিয়া গেল তখন সুচরিতার সেই একলা ঘরটিতে বসিয়া বিনয়ের ভিতরকার যুবাপুরুষটি জাগিয়া উঠিল। বেলা তখন নয়টা সাড়ে-নয়টা। গলির ভিতরে জনকোলাহল নাই। সুচরিতার লিখিবার টেবিলের উপর একটি ছোটো ঘড়ি টিক্‌ টিক্‌ করিয়া চলিতেছে। ঘরের একটি প্রভাব বিনয়কে আবিষ্ট করিয়া ধরিতে লাগিল। চারি দিকের ছোটোখাটো গৃহসজ্জাগুলি বিনয়ের সঙ্গে যেন আলাপ জুড়িয়া দিল। টেবিলের উপরকার পারিপাট্য, সেলাইয়ের কাজ-করা চৌকি-ঢাকাটি, চৌকির নীচে পাদস্থানের কাছে বিছানো একটা হরিণের চামড়া, দেয়ালে ঝোলানো দুটি-চারটি ছবি, পশ্চাতে লাল সালু দিয়া মোড়া বই-সাজানো বইয়ের ছোটো শেল্‌ফ্‌টি, সমস্তই বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি গভীরতর সুর বাজাইয়া তুলিতে লাগিল। এই ঘরের ভিতরটিতে একটি কী সুন্দর রহস্য সঞ্চিত হইয়া আছে। এই ঘরে নির্জন মধ্যাহ্নে সখীতে সখীতে যে-সকল মনের কথা আলোচনা হইয়া গেছে তাহাদের সলজ্জ সুন্দর সত্তা এখনো যেন ইতস্তত প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে; কথা আলোচনা করিবার সময় কোন্‌খানে কে বসিয়াছিল, কেমন করিয়া বসিয়াছিল, তাহা বিনয় কল্পনায় দেখিতে লাগিল। ঐ-যে সেদিন বিনয় পরেশবাবুর কাছে শুনিয়াছিল “আমি সুচরিতার কাছে শুনিয়াছি ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নহে’, এই কথাটিকে সে নানাভাবে নানারূপে নানাপ্রকার ছবির মতো করিয়া দেখিতে পাইল। একটা অনির্বচনীয় আবেগ বিনয়ের মনের মধ্যে অত্যন্ত করুণ উদাস রাগিণীর মতো বাজিতে লাগিল। যে-সব জিনিসকে এমনতরো নিবিড় গভীররূপে মনের গোপনতার মধ্যে ভাষাহীন আভাসের মতো পাওয়া যায় তাহাদিগকে কোনোমতে প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিবার ক্ষমতা নাই বলিয়া, অর্থাৎ বিনয় কবি নয়, চিত্রকর নয় বলিয়া, তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে যেন কী একটা করিতে পারিলে বাঁচে, অথচ সেটা করিবার কোনো উপায় নাই, এমনি তাহার মনে হইতে লাগিল। যে-একটা পর্দা তাহার সম্মুখে ঝুলিতেছে, যাহা অতি নিকটে তাহাকে নিরতিশয় দূর করিয়া রাখিয়াছে, সেই পর্দাটাকে কি এই মুহূর্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া জোর করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবার শক্তি বিনয়ের নাই!

হরিমোহিনী ঘরে প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, বিনয়, এখন কিছু জল খাইবে কি না। বিনয় কহিল, “না।” তখন হরিমোহিনী আসিয়া ঘরে বসিলেন।

হরিমোহিনী যতদিন পরেশবাবুর বাড়িতে ছিলেন ততদিন বিনয়ের প্রতি তাঁহার খুব একটা আকর্ষণ ছিল। কিন্তু যখন হইতে সুচরিতাকে লইয়া তাঁহার স্বতন্ত্র ঘরকন্না হইয়াছে তখন হইতে ইহাদের যাতায়াত তাঁহার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হইয়া উঠিয়াছিল। আজকাল আচারে বিচারে সুচরিতা যে সম্পূর্ণ তাঁহাকে মানিয়া চলে না এই-সকল লোকের সঙ্গদোষকেই তিনি তাহার কারণ বলিয়া ঠিক করিয়াছিলেন। যদিও তিনি জানিতেন, বিনয় ব্রাহ্ম নহে, তবু বিনয়ের মনের মধ্যে যে কোনো হিন্দু-সংস্কারের দৃঢ়তা নাই তাহা তিনি স্পষ্ট অনুভব করিতেন। তাই এখন তিনি পূর্বের ন্যায় উৎসাহের সহিত এই ব্রাহ্মণতনয়কে ডাকিয়া লইয়া ঠাকুরের প্রসাদের অপব্যয় করিতেন না।

আজ প্রসঙ্গক্রমে হরিমোহিনী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা বাবা, তুমি তো ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু সন্ধ্যা-অর্চনা কিছুই কর না?”

বিনয় কহিল, “মাসি, দিনরাত্রি পড়া মুখস্থ করে করে গায়ত্রী সন্ধ্যা সমস্তই ভুলে গেছি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “পরেশবাবুও তো লেখাপড়া শিখেছেন। উনি তো নিজের ধর্ম মেনে সকালে সন্ধ্যায় একটা-কিছু করেন।”

বিনয় কহিল, “মাসি, উনি যা করেন তা কেবল মন্ত্র মুখস্থ করে করা যায় না। ওঁর মতো যদি কখনো হই তবে ওঁর মতো চলব।”

হরিমোহিনী কিছু তীব্রস্বরে কহিলেন, “ততদিন নাহয় বাপ-পিতামহর মতোই চলো-না। না এ দিক না ও দিক কি ভালো? মানুষের একটা তো ধর্মের পরিচয় আছে। না রাম না গঙ্গা, মা গো, এ কেমনতরো!”

এমন সময় ললিতা ঘরে প্রবেশ করিয়াই বিনয়কে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। হরিমোহিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি কোথায়?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানী নাইতে গেছে।”

ললিতা অনাবশ্যক জবাবদিহির স্বরূপ কহিল, “দিদি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “ততক্ষণ বোসো-না, এখনই এল বলে।”

ললিতার প্রতিও হরিমোহিনীর মন অনুকূল ছিল না। হরিমোহিনী এখন সুচরিতাকে তাহার পূর্বের সমস্ত পরিবেষ্টন হইতে ছাড়াইয়া লইয়া সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্ত করিতে চান। পরেশবাবুর অন্য মেয়েরা এখানে তেমন ঘন ঘন আসে না, একমাত্র ললিতাই যখন-তখন আসিয়া সুচরিতাকে লইয়া আলাপ-আলোচনা করিয়া থাকে, সেটা হরিমোহিনীর ভালো লাগে না। প্রায় তিনি উভয়ের আলাপে ভঙ্গ দিয়া সুচরিতাকে কোনো-একটা কাজে ডাকিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করেন, অথবা, আজকাল পূর্বের মতো সুচরিতার পড়াশুনা অব্যাঘাতে চলিতেছে না বলিয়া আক্ষেপ প্রকাশ করেন। অথচ, সুচরিতা যখন পড়াশুনায় মন দেয় তখন অধিক পড়াশুনা যে মেয়েদের পক্ষে অনাবশ্যক এবং অনিষ্টকর সে কথাও বলিতে ছাড়েন না। আসল কথা, তিনি যেমন করিয়া সুচরিতাকে অত্যন্ত ঘিরিয়া লইতে চান কিছুতেই তাহা পারিতেছেন না বলিয়া কখনো বা সুচরিতার সঙ্গীদের প্রতি, কখনো বা তাহার শিক্ষার প্রতি কেবলই দোষারোপ করিতেছেন।

ললিতা ও বিনয়কে লইয়া বসিয়া থাকা যে হরিমোহিনীর পক্ষে সুখকর তাহা নহে, তথাপি তাহাদের উভয়ের প্রতি রাগ করিয়াই তিনি বসিয়া রহিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, বিনয় ও ললিতার মাঝখানে একটি রহস্যময় সম্বন্ধ ছিল। তাই তিনি মনে মনে কহিলেন, “তোমাদের সমাজে যেমন বিধিই থাক্‌, আমার এ বাড়িতে এই-সমস্ত নির্লজ্জ মেলামেশা, এই-সব খৃস্টানি কাণ্ড ঘটিতে দিব না।’

এ দিকে ললিতার মনেও একটা বিরোধের ভাব কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছিল। কাল সুচরিতার সঙ্গে আনন্দময়ীর বাড়িতে যাইতে সেও সংকল্প করিয়াছিল কিন্তু কিছুতেই যাইতে পারিল না। গোরার প্রতি ললিতার প্রচুর শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু বিরুদ্ধতাও অত্যন্ত তীব্র। গোরা যে সর্বপ্রকারেই তাহার প্রতিকূল এ কথা সে কিছুতেই মন হইতে তাড়াইতে পারে না। এমন-কি, যেদিন গোরা কারামুক্ত হইয়াছে সেইদিন হইতে বিনয়ের প্রতিও তাহার মনোভাবের একটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে। কয়েক দিন পূর্বেও, বিনয়ের প্রতি যে তাহার একটা জোর দখল আছে এ কথা সে খুব স্পর্ধা করিয়াই মনে করিয়াছিল। কিন্তু গোরার প্রভাবকে বিনয় কোনোমতেই কাটাইয়া উঠিতে পারিবে না, ইহা কল্পনামাত্র করিয়াই সে বিনয়ের বিরুদ্ধে কোমর বাঁধিয়া দাঁড়াইল।

ললিতাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিবামাত্র বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ললিতা সম্বন্ধে বিনয় কোনোমতেই সহজ ভাব রক্ষা করিতে পারে না। যখন হইতে তাহাদের দুইজনের বিবাহ-সম্ভাবনার জনশ্রুতি সমাজে রটিয়া গেছে তখন হইতে ললিতাকে দেখিবামাত্র বিনয়ের মন বৈদ্যুতচঞ্চল চুম্বকশলার মতো স্পন্দিত হইতে থাকে।

ঘরে বিনয়কে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সুচরিতার প্রতি ললিতার রাগ হইল। সে বুঝিল, অনিচ্ছুক বিনয়ের মনকে অনুকূল করিবার জন্যই সুচরিতা তাহাকে লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে এবং এই বাঁকাকে সোজা করিবার জন্যই ললিতাকে আজ ডাক পড়িয়াছে।

সে হরিমোহিনীর দিকে চাহিয়া কহিল, “দিদিকে বোলো, এখন আমি থাকতে পারছি নে। আর-এক সময় আমি আসব।”

এই বলিয়া বিনয়ের প্রতি কটাক্ষপাত মাত্র না করিয়া দ্রুতবেগে সে চলিয়া গেল। তখন বিনয়ের কাছে হরিমোহিনীর আর বসিয়া থাকা অনাবশ্যক হওয়াতে তিনিও গৃহকার্য উপলক্ষে উঠিয়া গেলেন।

ললিতার এই চাপা আগুনের মতো মুখের ভাব বিনয়ের কাছে অপরিচিত ছিল না। কিন্তু অনেক দিন এমন চেহারা সে দেখে নাই। সেই-যে এক সময়ে বিনয়ের সম্বন্ধে ললিতা তাহার অগ্নিবাণ উদ্যত করিয়াই ছিল, সেই দুর্দিন একেবারে কাটিয়া গিয়াছে বলিয়াই বিনয় নিশ্চিন্ত হইয়াছিল, আজ দেখিল সেই পুরাতন বাণ অস্ত্রশালা হইতে আবার বাহির হইয়াছে। তাহাতে একটুও মরিচার চিহ্ন পড়ে নাই। রাগ সহ্য করা যায়, কিন্তু ঘৃণা সহ্য করা বিনয়ের মতো লোকের পক্ষে বড়ো কঠিন। ললিতা একদিন তাহাকে গোরাগ্রহের উপগ্রহমাত্র মনে করিয়া তাহার প্রতি কিরূপ তীব্র অবজ্ঞা অনুভব করিয়াছিল তাহা বিনয়ের মনে পড়িল। আজও বিনয়ের দ্বিধায় বিনয় ললিতার কাছে যে কাপুরুষ বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে, এই কল্পনায় তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। তাহার কর্তব্যবুদ্ধির সংকোচকে ললিতা ভীরুতা বলিয়া মনে করিবে, অথচ এ সম্বন্ধে নিজের হইয়া দুটো কথা বলিবারও সুযোগ তাহার ঘটিবে না, ইহা বিনয়ের কাছে অসহ্য বোধ হইল। বিনয়কে তর্ক করিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিলে বিনয়ের পক্ষে গুরুতর শাস্তি হয়। কারণ, বিনয় জানে সে তর্ক করিতে পারে, কথা গুছাইয়া বলিতে এবং কোনো-একটা পক্ষ সমর্থন করিতে তাহার অসামান্য ক্ষমতা। কিন্তু ললিতা যখন তাহার সঙ্গে লড়াই করিয়াছে তখন তাহাকে কোনোদিন যুক্তি প্রয়োগ করিবার অবকাশ দেয় নাই, আজও সে অবকাশ তাহার ঘটিবে না।

সেই খবরের কাগজখানা পড়িয়া ছিল। বিনয় চঞ্চলতার আক্ষেপে সেটা টানিয়া লইয়া হঠাৎ দেখিল এক জায়গায় পেন্‌সিলের দাগ দিয়া চিহ্নিত। পড়িল, এবং বুঝিল এই আলোচনা এবং নীতি-উপদেশ তাহাদের দুইজনকেই উপলক্ষ করিয়া। ললিতা তাহার সমাজের লোকের কাছে প্রতিদিন যে কিরূপ অপমানিত হইতেছে তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল। অথচ এই অবমাননা হইতে বিনয় তাহাকে রক্ষা করিবার কোনো চেষ্টা করিতেছে না, কেবল সমাজতত্ত্ব লইয়া সূক্ষ্ণ তর্ক করিতে উদ্যত হইয়াছে, ইহাতে ললিতার মতো তেজস্বিনী রমণীর কাছে সে যে অবজ্ঞাভাজন হইবে তাহা বিনয়ের কাছে সমুচিত বলিয়াই বোধ হইল। সমাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতে ললিতার যে কিরূপ সাহস তাহা স্মরণ করিয়া এবং এই দৃপ্ত নারীর সঙ্গে নিজের তুলনা করিয়া সে লজ্জা অনুভব করিতে লাগিল।

স্নান সারিয়া এবং সতীশকে আহার করাইয়া ইস্কুলে পাঠাইয়া সুচরিতা যখন বিনয়ের কাছে আসিল তখন বিনয় নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে। সুচরিতা পূর্বপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিল না। বিনয় অন্ন আহার করিতে বসিল, কিন্তু তৎপূর্বে গণ্ডূষ করিল না।

হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা বাছা, তুমি তো হিঁদুয়ানির কিছুই মান না– তা হলে তুমি ব্রাহ্ম হলেই বা দোষ কী ছিল?”

বিনয় মনে মনে কিছু আহত হইয়া কহিল, “হিঁদুয়ানিকে যেদিন কেবল ছোঁওয়া-খাওয়ার নিরর্থক নিয়ম বলেই জানব সেদিন ব্রাহ্ম বলো, খৃস্টান বলো, মুসলমান বলো, যা হয় একটা-কিছু হব। এখনো হিঁদুয়ানির উপর তত অশ্রদ্ধা হয় নি।”

বিনয় যখন সুচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল তখন তাহার মন অত্যন্ত বিকল হইয়া ছিল। সে যেন চারি দিক হইতেই ধাক্কা খাইয়া একটা আশ্রয়হীন শূন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। গোরার পাশে সে আপনার পুরাতন স্থানটি অধিকার করিতে পারিতেছে না, ললিতাও তাহাকে দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে– এমন-কি, হরিমোহিনীর সঙ্গেও তাহার হৃদ্যতার সম্বন্ধ অতি অল্প সময়েই মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হইবার উপক্রম হইয়াছে; এক সময় বরদাসুন্দরী তাহাকে আন্তরিক স্নেহ করিয়াছেন, পরেশবাবু এখনো তাহাকে স্নেহ করেন, কিন্তু স্নেহের পরিবর্তে সে তাহাদের ঘরে এমন অশান্তি আনিয়াছে যে সেখানেও তাহার আজ আর স্থান নাই। যাহাদিগকে ভালোবাসে তাহাদের শ্রদ্ধা ও আদরের জন্য বিনয় চিরদিন কাঙাল, নানাপ্রকারে তাহাদের সৌহৃদ্য আকর্ষণ করিবার শক্তিও তাহার যথেষ্ট আছে। সেই বিনয় আজ অকস্মাৎ তাহার স্নেহপ্রীতির চিরাভ্যস্ত কক্ষপথ হইতে এমন করিয়া বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল কেন, এই কথাই সে নিজের মনে চিন্তা করিতে লাগিল। এই-যে সুচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল এখন কোথায় যাইবে তাহা ভাবিয়া পাইতেছে না। এক সময় ছিল যখন কোনো চিন্তা না করিয়া সহজেই সে গোরার বাড়ির পথে চলিয়া যাইত, কিন্তু আজ সেখানে যাওয়া তাহার পক্ষে পূর্বের ন্যায় তেমন স্বাভাবিক নহে; যদি যায় তবে গোরার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইবে– সে নীরবতা অত্যন্ত দুঃসহ। এ দিকে পরেশবাবুর বাড়িও তাহার পক্ষে সুগম নহে।

“কেন যে এমন একটা অস্বাভাবিক স্থানে আসিয়া পৌঁছিলাম’ ইহাই চিন্তা করিতে করিতে মাথা হেঁট করিয়া বিনয় ধীরপদে রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিল। হেদুয়া পুষ্করিণীর কাছে আসিয়া সেখানে একটা গাছের তলায় সে বসিয়া পড়িল। এ পর্যন্ত তাহার জীবনে ছোটবড়ো যে-কোনো সমস্যা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করিয়া তর্ক করিয়া, তাহার মীমাংসা করিয়া লইয়াছে। আজ সে পন্থা নাই, আজ তাহাকে একলাই ভাবিতে হইবে।

বিনয়ের আত্মবিশ্লেষণশক্তির অভাব নাই। বাহিরের ঘটনার উপরেই সমস্ত দোষ চাপাইয়া নিজে নিষ্কৃতি লওয়া তাহার পক্ষে সহজ নহে। তাই সে একলা বসিয়া বসিয়া নিজেকেই দায়িক করিল। বিনয় মনে মনে কহিল– “জিনিসটিও রাখিব মূল্যটিও দিব না’ এমন চতুরতা পৃথিবীতে খাটে না। একটা-কিছু বাছিয়া লইতে গেলেই অন্যটাকে ত্যাগ করিতেই হয়। যে লোক কোনোটাকেই মন স্থির করিয়া ছাড়িতে পারে না, তাহারই আমার দশা হয়, সমস্তই তাহাকে খেদাইয়া দেয়! পৃথিবীতে যাহারা নিজের জীবনের পথ জোরের সঙ্গে বাছিয়া লইতে পারিয়াছে তাহারাই নিশ্চিন্ত হইয়াছে। যে হতভাগা এ পথও ভালোবাসে ও পথও ভালোবাসে, কোনোটা হইতেই নিজেকে বঞ্চিত করিতে পারে না, সে গম্যস্থান হইতেই বঞ্চিত হয়– সে কেবল পথের কুকুরের মতোই ঘুরিয়া বেড়ায়।

ব্যাধি নিরূপণ করা কঠিন, কিন্তু নিরূপণ হইলেই যে তাহার প্রতিকার করা সহজ হয় তাহা নহে। বিনয়ের বুঝিবার শক্তি খুব তীক্ষ্ণ করিবার শক্তিরই অভাব; এইজন্য এ পর্যন্ত সে নিজের চেয়ে প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বন্ধুর প্রতিই নির্ভর করিয়া আসিয়াছে। অবশেষে অত্যন্ত সংকটের সময় আজ সে হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছে ইচ্ছাশক্তি নিজের না থাকিলেও ছোটোখাটো প্রয়োজনে ধারে-বরাতে কাজ চালাইয়া লওয়া যায়,কিন্তু আসল দরকারের বেলায় পরের তহবিল লইয়া কোনোমতেই কারবার চলে না।

সূর্য হেলিয়া পড়িতেই যেখানে ছায়া ছিল সেখানে রৌদ্র আসিয়া পড়িল। তখন তরুতল ছাড়িয়া আবার রাস্তায় বাহির হইল। কিছু দূরে যাইতেই হঠাৎ শুনিল, “বিনয়বাবু! বিনয়বাবু!” পরক্ষণেই সতীশ আসিয়া তাহার হাত ধরিল। বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করিয়া সতীশ তখন বাড়ি ফিরিতেছিল।

সতীশ কহিল, “চলুন, বিনয়বাবু, আমার সঙ্গে বাড়ি চলুন।”

বিনয় কহিল, “সে কি হয় সতীশবাবু?”

সতীশ কহিল, “কেন হবে না?”

বিনয় কহিল, “এতে ঘন ঘন গেলে তোমার বাড়ির লোকে আমাকে সহ্য করতে পারবে কেন?”

সতীশ বিনয়ের এই যুক্তিকে একেবারে প্রতিবাদের অযোগ্য জ্ঞান করিয়া কেবল কহিল, “না, চলুন।”

তাহাদের পরিবারের সঙ্গে বিনয়ের যে সম্বন্ধ আছে সেই সম্বন্ধে যে কতবড়ো একটা বিপ্লব ঘটিয়াছে তাহা বালক কিছুই জানে না, সে কেবল বিনয়কে ভালোবাসে, এই কথা মনে করিয়া বিনয়ের হৃদয় অত্যন্ত বিচলিত হইল। পরেশবাবুর পরিবার তাহার কাছে যে-একটি স্বর্গলোক সৃষ্টি করিয়াছিল তাহার মধ্যে কেবল এই বালকটিতেই আনন্দের সম্পূর্ণতা অক্ষুণ্ন আছে; এই প্রলয়ের দিনে তাহার চিত্তে কোনো সংশয়ের মেঘ ছায়া ফেলে নাই, কোনো সমাজের আঘাত ভাঙন ধরাইতে চেষ্টা করে নাই। সতীশের গলা ধরিয়া বিনয় কহিল, “চলো ভাই, তোমাকে তোমাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিই।”

সতীশের জীবনে শিশুকাল হইতে সুচরিতা ও ললিতার যে স্নেহ ও আদর সঞ্চিত হইয়া আছে সতীশকে বাহুদ্বারা বেষ্টন করিয়া বিনয় যেন সেই মাধুর্যের স্পর্শ লাভ করিল। সমস্ত পথ সতীশ যে বহুতর অপ্রাসঙ্গিক কথা অনর্গল বকিয়া গেল তাহা বিনয়ের কানে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। বালকের চিত্তের সরলতার সংস্রবে তাহার নিজের জীবনের জটিল সমস্যাকে কিছুক্ষণের জন্য সে একেবারে ভুলিয়া থাকিতে পারিল।

পরেশবাবুর বাড়ির সম্মুখ দিয়াই সুচরিতার বাড়ি যাইতে হয়। পরেশবাবুর একতলার বসিবার ঘর রাস্তা হইতেই দেখিতে পাওয়া যায়। সেই ঘরের সম্মুখে আসিতেই বিনয় সে দিকে একবার মুখ না তুলিয়া থাকিতে পারিল না। দেখিল তাঁহার টেবিলের সম্মুখে পরেশবাবু বসিয়া আছেন– কোনো কথা কহিতেছেন কি না বুঝা গেল না; আর ললিতা রাস্তার দিকে পিঠ করিয়া পরেশবাবুর চৌকির কাছে একটি ছোটো বেতের মোড়ার উপর ছাত্রীটির মতো নিস্তব্ধ হইয়া আছে।

সুচরিতার বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে ক্ষোভে ললিতার হৃদয়কে অসহ্যরূপে অশান্ত করিয়া তুলিয়াছিল সে তাহা নিবৃত্ত করিবার আর-কোনো উপায়ই জানিত না, সে তাই আস্তে আস্তে পরেশবাবুর কাছে আসিয়া বসিয়াছিল। পরেশবাবুর মধ্যে এমনি একটি শান্তির আদর্শ ছিল যে অসহিষ্ণু ললিতা নিজের চাঞ্চল্য দমন করিবার জন্য মাঝে মাঝে তাঁহার কাছে আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত। পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিতেন, “কী ললিতা?’ ললিতা কহিত, “কিছু নয় বাবা! তোমার এই ঘরটি বেশ ঠাণ্ডা।’

আজ ললিতা আহত হৃদয়টি লইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছে তাহা পরেশবাবু স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন। তাঁহার নিজের মধ্যেও একটি বেদনা প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল। তাই তিনি ধীরে ধীরে এমন একটি কথা পাড়িয়াছিলেন যাহাতে ব্যক্তিগত জীবনের তুচ্ছ সুখ-দুঃখের ভারকে একেবারে হালকা করিয়া দিতে পারে।

পিতা ও কন্যার এই বিশ্রব্ধ আলোচনার দৃশ্যটি দেখিয়া মুহূর্তের জন্য বিনয়ের গতিরোধ হইয়া গেল– সতীশ কী বলিতেছিল তাহা তাহার কানে গেল না। সতীশ তখন তাহাকে যুদ্ধবিদ্যা সম্বন্ধে একটা অত্যন্ত দুরূহ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। এক দল বাঘকে অনেক দিন ধরিয়া শিক্ষা দিয়া স্বপক্ষের সৈন্যদলের প্রথম সারে রাখিয়া যুদ্ধ করিলে তাহাতে জয়ের সম্ভাবনা কিরূপ ইহাই তাহার প্রশ্ন ছিল। এতক্ষণ তাহাদের প্রশ্নোত্তর অবাধে চলিয়া আসিতেছিল, হঠাৎ এইবার বাধা পাইয়া সতীশ বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল, তাহার পরে বিনয়ের দৃষ্টি লক্ষ করিয়া পরেশবাবুর ঘরের দিকে চাহিয়াই সে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “ললিতাদিদি, ললিতাদিদি, এই দেখো আমি বিনয়বাবুকে রাস্তা থেকে ধরে এনেছি।”

বিনয় লজ্জায় ঘামিয়া উঠিল; ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তে ললিতা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল– পরেশবাবু রাস্তার দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন– সবসুদ্ধ একটা কাণ্ড হইয়া গেল।

তখন বিনয় সতীশকে বিদায় করিয়া পরেশবাবুর বাড়িতে উঠিল। তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ললিতা চলিয়া গেছে। তাহাকে সকলেই শান্তিভঙ্গকারী দস্যুর মতো দেখিতেছে এই মনে করিয়া সে সংকুচিত হইয়া চৌকিতে বসিল।

শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে সাধারণ শিষ্টালাপ শেষ হইতেই বিনয় একেবারেই আরম্ভ করিল, “আমি যখন হিন্দুসমাজের আচার-বিচারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মানিনে এবং প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করে থাকি, তখন ব্রাহ্মসমাজে আশ্রয় গ্রহণ করাই আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। আপনার কাছ থেকেই দীক্ষা গ্রহণ করি এই আমার বাসনা।”

এই বাসনা, এই সংকল্প আর পনেরো মিনিট পূর্বেও বিনয়ের মনে স্পষ্ট আকারে ছিল না। পরেশবাবু ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিলেন, “ভালো করে সকল কথা চিন্তা করে দেখেছ তো?”

বিনয় কহিল, “এর মধ্যে আর তো কিছু চিন্তা করবার নেই, কেবল ন্যায়-অন্যায়টাই ভেবে দেখবার বিষয়। সেটা খুব সাদা কথা। আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে কেবল আচার-বিচারকেই অলঙ্ঘনীয় ধর্ম বলে আমি কোনোমতেই অকপটচিত্তে মানতে পারি নে। সেইজন্যেই আমার ব্যবহারে পদে পদে নানা অসংগতি প্রকাশ পায়, যারা শ্রদ্ধার সঙ্গে হিঁদুয়ানিকে আশ্রয় করে আছে তাদের সঙ্গে জড়িত থেকে আমি তাদের কেবল আঘাতই দিই। এটা যে আমার পক্ষে নিতান্ত অন্যায় হচ্ছে তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এমন স্থলে আর-কোনো কথা চিন্তা না করে এই অন্যায় পরিহার করবার জন্যেই আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। নইলে নিজের প্রতি সম্মান রাখতে পারব না।”

পরেশবাবুকে বুঝাইবার জন্য এত কথার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এ-সব কথা নিজেকেই জোর দিবার জন্য। সে যে একটা ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধের মধ্যেই পড়িয়া গেছে এবং এই যুদ্ধে সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া ন্যায়ের পক্ষেই তাহাকে জয়ী হইতে হইবে, এই কথা বলিয়া তাহার বক্ষ প্রসারিত হইয়া উঠিল। মনুষ্যত্বের মর্যাদা তো রাখিতে হইবে।

পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তোমার মতের ঐক্য আছে তো?”

বিনয় একটুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য কথা বলি, আগে মনে করতুম আমার বুঝি একটা কিছু ধর্মবিশ্বাস আছে; তা নিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি, কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জেনেছি ধর্মবিশ্বাস আমার জীবনের মধ্যে পরিণতি লাভ করে নি। এটুকু যে বুঝেছি সে আপনাকে দেখে। ধর্মে আমার জীবনের কোনো সত্য প্রয়োজন ঘটে নি এবং তার প্রতি আমার সত্য বিশ্বাস জন্মে নি বলেই আমি কল্পনা এবং যুক্তিকৌশল দিয়ে এতদিন আমাদের সমাজের প্রচলিত ধর্মকে নানাপ্রকার সূক্ষ্ণ ব্যাখ্যা-দ্বারা কেবলমাত্র তর্কনৈপুণ্যে পরিণত করেছি। কোন্‌ ধর্ম যে সত্য তা ভাববার আমার কোনো দরকারই হয় না; যে ধর্মকে সত্য বললে আমার জিত হয় আমি তাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে বেড়িয়েছি। যতই প্রমাণ করা শক্ত হয়েছে ততই প্রমাণ করে অহংকার বোধ করেছি। কোনোদিন আমার মনে ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কি না তা আজও আমি বলতে পারি নে কিন্তু অনুকূল অবস্থা এবং দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়লে সে দিকে আমার অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে এ কথা নিশ্চিত। অন্তত যে জিনিস ভিতরে ভিতরে আমার বুদ্ধিকে পীড়িত করে চিরজীবন তারই জয়পতাকা বহন করে বেড়াবার হীনতা থেকে উদ্ধার পাব।”

পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতেই বিনয় নিজের বর্তমান অবস্থার অনুকূল যুক্তিগুলিকে আকার দান করিয়া তুলিতে লাগিল। এমনি উৎসাহের সঙ্গে করিতে লাগিল যেন অনেক দিনের তর্কবিতর্কের পর সে এই স্থির সিদ্ধান্তে আসিয়া দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে।

তবু পরেশবাবু তাহাকে আরো কিছুদিনের সময় লইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। তাহাতে বিনয় ভাবিল তাহার দৃঢ়তার উপর পরেশবাবুর বুঝি সংশয় আছে। সুতরাং তাহার জেদ ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তাহার মন যে একটি নিঃসন্দিগ্ধ ক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, কিছুতেই তাহার আর কিছুমাত্র হেলিবার টলিবার সম্ভাবনা নাই, ইহাই বার বার করিয়া জানাইল। উভয় পক্ষ হইতেই ললিতার সঙ্গে বিবাহের কোনো প্রসঙ্গই উঠিল না।

এমন সময় গৃহকর্ম-উপলক্ষে বরদাসুন্দরী সেখানে প্রবেশ করিলেন। যেন বিনয় ঘরে নাই এমনি ভাবে কাজ সারিয়া তিনি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। বিনয় মনে করিয়াছিল, পরেশবাবু এখনই বরদাসুন্দরীকে ডাকিয়া বিনয়ের নূতন খবরটি তাঁহাকে জানাইবেন। কিন্তু পরেশবাবু কিছুই বলিলেন না। বস্তুত এখনো বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়া তিনি মনেই করেন নাই। এ কথাটি সকলের কাছেই গোপন রাখিতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু বরদাসুন্দরী বিনয়ের প্রতি যখন সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও ক্রোধ প্রকাশ করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, তখন বিনয় আর থাকিতে পারিল না। সে গমনোন্মুখ বরদাসুন্দরীর পায়ের কাছে মাথা নত করিয়া প্রণাম করিল এবং কহিল, “আমি ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেবার প্রস্তাব নিয়ে আজ আপনাদের কাছে এসেছি। আমি অযোগ্য, কিন্তু আপনারা আমাকে যোগ্য করে নেবেন এই আমার ভরসা।”

শুনিয়া বিস্মিত বরদাসুন্দরী ফিরিয়া দাঁড়াইলেন এবং ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিয়া বসিলেন। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পরেশবাবুর মুখের দিকে চাহিলেন।

পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্রহণ করবার জন্যে অনুরোধ করছেন।”

শুনিয়া বরদাসুন্দরীর মনে একটা জয়লাভের গর্ব উপস্থিত হইলে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ আনন্দ হইল না কেন? তাঁহার ভিতরে ভিতরে ভারি একটা ইচ্ছা হইয়াছিল, এবার যেন পরেশবাবুর রীতিমত একটা শিক্ষা হয়। তাঁহার স্বামীকে প্রচুর অনুতাপ করিতে হইবে এই ভবিষ্যদ্‌বাণী তিনি খুব জোরের সঙ্গে বার বার ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেইজন্য সামাজিক আন্দোলনে পরেশবাবু যথেষ্ট বিচলিত হইতেছিলেন না দেখিয়া বরদাসুন্দরী মনে মনে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিলেন। হেনকালে সমস্ত সংকটের এমন সুচারুরূপে মীমাংসা হইয়া যাইবে ইহা বরদাসুন্দরীর কাছে বিরুদ্ধপ্রীতিকর হয় নাই। তিনি মুখ গম্ভীর করিয়া কহিলেন, “এই দীক্ষার প্রস্তাবটা আর কিছুদিন আগে যদি হত তা হলে আমাদের এত অপমান এত দুঃখ পেতে হত না।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমাদের দুঃখকষ্ট-অপমানের তো কোনো কথা হচ্ছে না, বিনয় দীক্ষা নিতে চাচ্ছেন।”

বরদাসুন্দরী বলিয়া উঠিলেন, “শুধু দীক্ষা?”

বিনয় কহিলেন, “অন্তর্যামী জানেন আপনাদের দুঃখ-অপমান সমস্তই আমার।”

পরেশ কহিলেন, “দেখো বিনয়, তুমি ধর্মে দীক্ষা নিতে যে চাচ্ছ সেটাকে একটা অবান্তর বিষয় কোরো না। আমি তোমাকে পূর্বেও একদিন বলেছি, আমরা একটা কোনো সামাজিক সংকটে পড়েছি কল্পনা করে তুমি কোনো গুরুতর ব্যাপারে প্রবৃত্ত হোয়ো না।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু তাও বলি, আমাদের সকলকে জালে জড়িয়ে ফেলে চুপ করে বসে থাকাও ওঁর কর্তব্য নয়।”

পরেশবাবু কহিলেন, “চুপ করে না থেকে চঞ্চল হয়ে উঠলে জালে আরো বেশি করে গ্রন্থি পড়ে। কিছু একটা করাকেই যে কর্তব্য বলে তা নয়, অনেক সময় কিছু না করাই হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়ো কর্তব্য।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হবে, আমি মূর্খ মানুষ, সব কথা ভালো বুঝতে পারি নে। এখন কী স্থির হল সেই কথাটা জেনে যেতে চাই– আমার অনেক কাজ আছে।”

বিনয় কহিল, “পরশু রবিবারেই আমি দীক্ষা গ্রহণ করব। আমার ইচ্ছা যদি পরেশবাবু–”

পরেশবাবু কহিলেন, “যে দীক্ষার কোনো ফল আমার পরিবার আশা করতে পারে সে দীক্ষা আমার দ্বারা হতে পারবে না। ব্রাহ্মসমাজে তোমাকে আবেদন করতে হবে।”

বিনয়ের মন তৎক্ষণাৎ সংকুচিত হইয়া গেল। ব্রাহ্মসমাজে দস্তুরমত দীক্ষার জন্য আবেদন করার মতো মনের অবস্থা তো তাহার নহে– বিশেষত ললিতাকে লইয়া যে ব্রাহ্মসমাজে তাহার সম্বন্ধে এত আলোচনা হইয়া গেছে। কোন্‌ লজ্জায় কী ভাষায় সে চিঠি লিখিবে? সে চিঠি যখন ব্রাহ্ম-পত্রিকায় প্রকাশিত হইবে তখন সে কেমন করিয়া মাথা তুলিবে? সে চিঠি গোরা পড়িবে, আনন্দময়ী পড়িবেন। সে চিঠির সঙ্গে আর তো কোনো ইতিহাস থাকিবে না– তাহাতে কেবল এই কথাটুকুই প্রকাশ পাইবে যে, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করিবার জন্য বিনয়ের চিত্ত অকস্মাৎ পিপাসু হইয়া উঠিয়াছে। কথাটা তো এতখানি সত্য নহে– তাহাকে আরো-কিছুর সঙ্গে জড়িত করিয়া না দেখিলে তাহার তো লজ্জারক্ষার আবরণটুকু থাকে না।

বিনয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বরদাসুন্দরী ভয় পাইলেন। তিনি কহিলেন, “উনি ব্রাহ্মসমাজের তো কাউকে চেনেন না, আমরাই সব বন্দোবস্ত করে দেব। আমি আজ এখনই পানুবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আর তো সময় নেই– পরশু যে রবিবার।”

এমন সময় দেখা গেল সুধীর ঘরের সামনে দিয়া উপরের তলায় যাইতেছে। বরদাসুন্দরী তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “সুধীর, বিনয় পরশু আমাদের সমাজে দীক্ষা নেবেন।”

সুধীর অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল। সুধীর মনে মনে বিনয়ের একজন বিশেষ ভক্ত ছিল; বিনয়কে ব্রাহ্মসমাজে পাওয়া যাইবে শুনিয়া তাহার ভারি উৎসাহ হইল। বিনয় যেরকম চমৎকার ইংরেজি লিখিতে পারে, তাহার যেরকম বিদ্যাবুদ্ধি, তাহাতে ব্রাহ্মসমাজে যোগ না দেওয়াই তাহার পক্ষে অত্যন্ত অসংগত বলিয়া সুধীরের বোধ হইত। বিনয়ের মতো লোক যে কোনোমতেই ব্রাহ্মসমাজের বাহিরে থাকিতে পারে না ইহারই প্রমাণ পাইয়া তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “কিন্তু পরশু রবিবারের মধ্যেই কি হয়ে উঠবে? অনেকেই খবর জানতে পারবে না।”

সুধীরের ইচ্ছা, বিনয়ের এই দীক্ষাকে একটা দৃষ্টান্তের মতো সর্বসাধারণের সম্মুখে ঘোষণা করা হয়।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, এই রবিবারেই হয়ে যাবে। সুধীর, তুমি দৌড়ে যাও, পানুবাবুকে শীঘ্র ডেকে আনো।”

যে হতভাগ্যের দৃষ্টান্তের দ্বারা সুধীর ব্রাহ্মসমাজকে অজেয়শক্তিশালী বলিয়া সর্বত্র প্রচার করিবার কল্পনায় উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার চিত্ত তখন সংকুচিত হইয়া একেবারে বিন্দুবৎ হইয়া আসিয়াছিল। যে জিনিসটা মনে মনে কেবল তর্কে যুক্তিতে বিশেষ কিছুই নহে, তাহারই বাহ্য চেহারাটা দেখিয়া বিনয় ব্যাকুল হইয়া পড়িল।

পানুবাবুকে ডাক পড়িতেই বিনয় উঠিয়া পড়িল। বরদাসুন্দরী কহিলেন, “একটু বোসো, পানুবাবু এখনই আসবেন, দেরি হবে না।”

বিনয় কহিল, “না। আমাকে মাপ করবেন।”

সে এই বেষ্টন হইতে দূরে সরিয়া গিয়া ফাঁকায় সকল কথা ভালো করিয়া চিন্তা করিবার অবসর পাইলে বাঁচে।

বিনয় উঠিতেই পরেশবাবু উঠিলেন এবং তাহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়, তাড়াতাড়ি কিছু কোরো না– শান্ত হয়ে স্থির হয়ে সকল কথা চিন্তা করে দেখো। নিজের মন সম্পূর্ণ না বুঝে জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে প্রবৃত্ত হোয়ো না।”

বরদাসুন্দরী তাঁহার স্বামীর প্রতি মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “গোড়ায় কেউ ভেবে চিন্তে কাজ করে না, অনর্থ বাধিয়ে বসে, তার পরে যখন একেবারে দম আটকে আসে তখন বলেন, বসে বসে ভাবো। তোমরা স্থির হয়ে বসে ভাবতে পার, কিন্তু আমাদের যে প্রাণ বেরিয়ে গেল।”

বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুধীর রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। রীতিমত আহারে বসিয়া খাইবার পূর্বেই চাখিবার ইচ্ছা যেমন, সুধীরের সেইরূপ চঞ্চলতা উপস্থিত হইয়াছে। তাহার ইচ্ছা এখনই বিনয়কে বন্ধুসমাজে ধরিয়া লইয়া গিয়া সুসংবাদ দিয়া আনন্দ-উৎসব আরম্ভ করিয়া দেয়, কিন্তু সুধীরের এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অভিঘাতে বিনয়ের মন আরো দমিয়া যাইতে লাগিল। সুধীর যখন প্রস্তাব করিল “বিনয়বাবু, আসুন-না আমরা দুজনে মিলেই পানুবাবুর কাছে যাই”, তখন সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া জোর করিয়া তাহার হাত ছাড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল।

কিছু দূরে যাইতেই দেখিল, অবিনাশ তাহার দলের দুই-একজন লোকের সঙ্গে হন হন করিয়া কোথায় চলিয়াছে। বিনয়কে দেখিয়াই অবিনাশ কহিল, “এই-যে বিনয়বাবু, বেশ হয়েছে। চলুন আমাদের সঙ্গে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাচ্ছ?”

অবিনাশ কহিল, “কাশীপুরের বাগান ঠিক করতে যাচ্ছি। সেইখানে গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তের সভা বসবে।”

বিনয় কহিল, “না, আমার এখন যাবার জো নেই।”

অবিনাশ কহিল, “সে কী কথা! আপনারা কি বুঝতে পারছেন এটা কত বড়ো একটা ব্যাপার হচ্ছে! নইলে গৌরমোহনবাবু কি এমন একটা অনাবশ্যক প্রস্তাব করতেন? এখনকার দিনে হিন্দুসমাজকে নিজের জোর প্রকাশ করতে হবে। এই গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তে দেশের লোকের মনে কি একটা কম আন্দোলন হবে। আমরা দেশ বিদেশ থেকে বড়ো বড়ো ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আনব। এতে সমস্ত হিন্দুসমাজের উপরে খুব একটা কাজ হবে। লোকে বুঝতে পারবে এখনো আমরা বেঁচে আছি। বুঝতে পারবে হিন্দুসমাজ মরবার নয়।”

অবিনাশের আকর্ষণ এড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল।

হারানবাবুকে যখন বরদাসুন্দরী ডাকিয়া সকল কথা বলিলেন তখন তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন এবং কহিলেন, “এ সম্বন্ধে একবার ললিতার সঙ্গে আলোচনা করে দেখা কর্তব্য।”

ললিতা আসিলে হারানবাবু তাঁহার গাম্ভীর্যের মাত্রা শেষ সপ্তক পর্যন্ত চড়াইয়া কহিলেন, “দেখো ললিতা, তোমার জীবনে খুব একটা দায়িত্বের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। এক দিকে তোমার ধর্ম আর-এক দিকে তোমার প্রবৃত্তি, এর মধ্যে তোমাকে পথ নির্বাচন করে নিতে হবে।”

এই বলিয়া একটু থামিয়া হারানবাবু ললিতার মুখের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করিলেন। হারানবাবু জানিতেন তাঁহার এই ন্যায়াগ্নিদীপ্ত দৃষ্টির সম্মুখে ভীরুতা কম্পিত হয়, কপটতা ভস্মীভূত হইয়া যায়– তাঁহার এই তেজোময় আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ব্রাহ্মসমাজের একটি মূল্যবান সম্পত্তি।

ললিতা কোনো কথা বলিল না, চুপ করিয়া রহিল।

হারানবাবু কহিলেন, “তুমি বোধ হয় শুনেছ, তোমার অবস্থার প্রতি দৃষ্টি করে অথবা যে কারণেই হোক বিনয়বাবু অবশেষে আমাদের সমাজে দীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন।”

ললিতা এ সংবাদ পূর্বে শুনে নাই, শুনিয়া তাহার মনে কী ভাব হইল তাহাও প্রকাশ করিল না; তাহার দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল– সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

হারানবাবু কহিলেন, “নিশ্চয়ই পরেশবাবু বিনয়ের এই বাধ্যতায় খুবই খুশি হয়েছেন। কিন্তু এতে যথার্থ খুশি হবার কোনো বিষয় আছে কি না সে কথা তোমাকেই স্থির করতে হবে। সেইজন্য আজ আমি তোমাকে ব্রাহ্মসমাজের নামে অনুরোধ করছি নিজের উন্মত্ত প্রবৃত্তিকে একপাশে সরিয়ে রাখো এবং কেবলমাত্র ধর্মের দিকে দৃষ্টিরক্ষা করে নিজের হৃদয়কে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো, এতে খুশি হবার কি যথার্থ কারণ আছে?

ললিতা এখনো চুপ করিয়া রহিল। হারানবাবু মনে করিলেন, খুব কাজ হইতেছে। দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত বলিলেন, “দীক্ষা! দীক্ষা যে জীবনের কী পবিত্র মুহূর্ত সে কি আজ আমাকে বলতে হবে! সেই দীক্ষাকে কলুষিত করবে। সুখ সুবিধা বা আসক্তির আকর্ষণে আমরা ব্রাহ্মসমাজে অসত্যকে পথ ছেড়ে দেব– কপটতাকে আদর করে আহ্বান করে আনব! বলো ললিতা, তোমার জীবনের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের এই দুর্গতির ইতিহাস কি চিরদিনের জন্যে জড়িত হয়ে থাকবে?”

এখনো ললিতা কোনো কথা বলিল না, চৌকির হাতটা মুঠা দিয়া চাপিয়া ধরিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। হারানবাবু কহিলেন, “আসক্তির ছিদ্র দিয়ে দুর্বলতা যে মানুষকে কিরকম দুর্নিবারভাবে আক্রমণ করে তা অনেক দেখেছি এবং মানুষের দুর্বলতাকে যে কিরকম করে ক্ষমা করতে হয় তাও আমি জানি, কিন্তু যে দুর্বলতা কেবল নিজের জীবনকে নয়, শতসহস্র লোকের জীবনের আশ্রয়কে একেবারে ভিত্তিতে গিয়ে আঘাত করে, তুমিই বলো, ললিতা, তাকে কি এক মুহূর্তের জন্য ক্ষমা করা যায়? তাকে ক্ষমা করবার অধিকার কি ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন?”

ললিতা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, “না না, পানুবাবু, আপনি ক্ষমা করবেন না। আপনার আক্রমণই পৃথিবীসুদ্ধ লোকের অভ্যাস হয়ে গেছে– আপনার ক্ষমা বোধ হয় সকলের পক্ষে একেবারে অসহ্য হবে।”

এই বলিয়া ঘর ছাড়িয়া ললিতা চলিয়া গেল।

বরদাসুন্দরী হারানবাবুর কথায় উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি কোনোমতেই এখন বিনয়কে ছাড়িয়া দিতে পারেন না। তিনি হারানবাবুর কাছে অনেক ব্যর্থ অনুনয় বিনয় করিয়া, অবশেষে ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে বিদায় দিলেন। তাঁহার মুশকিল হইল এই যে, পরেশবাবুকেও তিনি নিজের পক্ষে পাইলেন না, আবার হারানবাবুকেও না। এমন অভাবনীয় অবস্থা কেহ কখনো কল্পনাও করিতে পারিত না। হারানবাবুর সম্বন্ধে পুনরায় বরদাসুন্দরীর মত পরিবর্তন করিবার সময় আসিল।

যতক্ষণ দীক্ষাগ্রহণের ব্যাপারটা বিনয় ঝাপসা করিয়া দেখিতেছিল ততক্ষণ খুব জোরের সঙ্গেই সে আপনার সংকল্প প্রকাশ করিতেছিল। কিন্তু যখন দেখিল এজন্য ব্রাহ্মসমাজে তাহাকে আবেদন করিতে হইবে এবং হারানবাবুর সঙ্গে এ লইয়া পরামর্শ চলিবে তখন এই অনাবৃত প্রকাশ্যতার বিভীষিকা তাহাকে একান্ত কুণ্ঠিত করিয়া তুলিল। কোথায় গিয়া কাহার সঙ্গে সে যে পরামর্শ করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না, এমন-কি, আনন্দময়ীর কাছে যাওয়াও তাহার পক্ষে অসম্ভব হইল। রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইবার মতো শক্তিও তাহার ছিল না। তাই সে আপনার জনহীন বাসার মধ্যে গিয়া উপরের ঘরে তক্তপোশের উপর শুইয়া পড়িল।

সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। অন্ধকার ঘরে চাকর বাতি আনিলেই তাহাকে বারণ করিবে মনে করিতেছে, এমন সময়ে বিনয় নীচে হইতে আহ্বান শুনিল, “বিনয়বাবু! বিনয়বাবু!”

বিনয় যেন বাঁচিয়া গেল। সে যেন মরুভূমিতে তৃষ্ণার জল পাইল। এই মুহূর্তে একমাত্র সতীশ ছাড়া আর কেহই তাহাকে আরাম দিতে পারিত না। বিনয়ের নির্জীবতা ছুটিয়া গেল। “কী ভাই সতীশ” বলিয়া সে বিছানা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া জুতা পায়ে না দিয়াই দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল।

দেখিল, তাহার ছোটো উঠানটিতে সিঁড়ির সামনেই সতীশের সঙ্গে বরদাসুন্দরী দাঁড়াইয়া আছেন। আবার সেই সমস্যা, সেই লড়াই! শশব্যস্ত হইয়া বিনয় সতীশ ও বরদাসুন্দরীকে উপরের ঘরে লইয়া গেল।

বরদাসুন্দরী সতীশকে কহিলেন, “সতীশ, যা তুই ঐ বারান্দায় গিয়ে একটু বোস্‌ গে যা।”

সতীশের এই নিরানন্দ নির্বাসনদণ্ডে ব্যথিত হইয়া বিনয় তাহাকে কতকগুলা ছবির বই বাহির করিয়া দিয়া পাশের ঘরে আলো জ্বালিয়া বসাইয়া দিল।

বরদাসুন্দরী যখন বলিলেন “বিনয়, তুমি তো ব্রাহ্মসমাজের কাউকে জান না– আমার হাতে একখানা চিঠি লিখে দাও, আমি কাল সকালেই নিজে গিয়ে সম্পাদক মহাশয়কে দিয়ে সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেব, যাতে পরশু রবিবারেই তোমার দীক্ষা হয়ে যায়। তোমাকে আর কিছুই ভাবতে হবে না’– তখন বিনয় কোনো কথাই বলিতে পারিল না। সে তাঁহার আদেশ অনুসারে একখানি চিঠি লিখিয়া বরদাসুন্দরীর হাতে দিয়া দিল। যাহা হউক, একটা কোনো পথে এমন করিয়া বাহির হইয়া পড়া তাহার দরকার হইয়াছিল যে, ফিরিবার বা দ্বিধা করিবার কোনো উপায়মাত্র না থাকে।

ললিতার সঙ্গে বিবাহের কথাটাও বরদাসুন্দরী একটুখানি পাড়িয়া রাখিলেন।

বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে বিনয়ের মনে ভারি একটা যেন বিতৃষ্ণা বোধ হইতে লাগিল। এমন-কি, ললিতার স্মৃতিও তাহার মনের মধ্যে কেমন একটু বেসুরে বাজিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল যেন বরদাসুন্দরীর এই অশোভন ব্যস্ততার সঙ্গে ললিতারও একটা কোথাও যোগ আছে। নিজের প্রতি শ্রদ্ধাহ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে সকলেরই প্রতি তাহার শ্রদ্ধা যেন নামিয়া পড়িতে লাগিল।

বরদাসুন্দরী বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াই মনে করিলেন, ললিতাকে তিনি আজ খুশি করিয়া দিবেন। ললিতা যে বিনয়কে ভালোবাসে তাহা তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন। সেইজন্যই তাহাদের বিবাহ লইয়া সমাজে যখন গোল বাধিয়াছিল, তখন তিনি নিজে ছাড়া আর সকলকেই এজন্য অপরাধী করিয়াছিলেন। ললিতার সঙ্গে কয়দিন তিনি কথাবার্তা একরকম বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আজ যখন একটা কিনারা হইল সেটা যে অনেকটা তাঁহার জন্যই হইল এই গৌরবটুকু ললিতার কাছে প্রকাশ করিয়া তাহার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করিতে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। ললিতার বাপ তো সমস্ত মাটি করিয়াই দিয়াছিলেন। ললিতা নিজেও তো বিনয়কে সিধা করিতে পারে নাই। পানুবাবুর কাছ হইতেও তো কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না। একলা বরদাসুন্দরী সমস্ত গ্রন্থি ছেদন করিয়াছেন। হাঁ হাঁ, একজন মেয়েমানুষ যাহা পারে পাঁচজন পুরুষে তাহা পারে না।

বরদাসুন্দরী বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া শুনিলেন, ললিতা আজ সকাল-সকাল শুইতে গেছে, তাহার শরীর তেমন ভালো নাই। তিনি মনে মনে হাসিয়া কহিলেন, “শরীর ভালো করিয়া দিতেছি।’

একটা বাতি হাতে করিয়া তাহার অন্ধকার শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ললিতা বিছানায় এখনো শোয় নাই, একটা কেদারায় হেলান দিয়া পড়িয়া আছে!

ললিতা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

তাহার স্বরের মধ্যে একটা তীব্রতা ছিল। সে খবর পাইয়াছিল তিনি সতীশকে লইয়া বিনয়ের বাসায় গিয়াছিলেন।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আমি বিনয়ের ওখানে গিয়েছিলেম।”

“কেন?”

কেন! বরদাসুন্দরীর মনে মনে একটু রাগ হইল। “ললিতা মনে করে আমি কেবল ওর শত্রুতাই করিতেছি! অকৃতজ্ঞ!’

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “এই দেখো কেন।” বলিয়া বিনয়ের সেই চিঠিখানা ললিতার চোখের সামনে মেলিয়া ধরিলেন। সে চিঠি পড়িয়া ললিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল। বরদাসুন্দরী নিজের কৃতিত্ব-প্রচারের জন্য কিছু অত্যুক্তি করিয়াই জানাইলেন যে, এ চিঠি কি বিনয়ের হাত হইতে সহজে বাহির হইতে পারিত। তিনি জাঁক করিয়া বলিতে পারেন এ কাজ আর-কোনো লোকেরই সাধ্যের মধ্যেই ছিল না।

ললিতা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া তাহার কেদারায় শুইয়া পড়িল। বরদাসুন্দরী মনে করিলেন, তাঁহার সম্মুখে প্রবল হৃদয়াবেগ প্রকাশ করিতে ললিতা লজ্জা করিতেছে। ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

পরদিন সকালবেলায় চিঠিখানি লইয়া ব্রাহ্মসমাজে যাইবার সময় দেখিলেন যে চিঠি কে টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া রাখিয়াছে।

অপরাহ্নে সুচরিতা পরেশবাবুর কাছে যাইবে বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিল এমন সময় বেহারা আসিয়া খবর দিল একজন বাবু আসিয়াছেন।

“কে বাবু? বিনয়বাবু?”

বেহারা কহিল, “না, খুব গৌরবর্ণ, লম্বা একটি বাবু।”

সুচরিতা চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “বাবুকে উপরের ঘরে এনে বসাও।”

আজ সুচরিতা কী কাপড় পরিয়াছে ও কেমন করিয়া পরিয়াছে এতক্ষণ তাহা চিন্তাও করে নাই। এখন আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কাপড়খানা কিছুতেই তাহার পছন্দ হইল না। তখন বদলাইবার সময় ছিল না। কম্পিত হস্তে কাপড়ের আঁচলে, চুলে, একটু-আধটু পারিপাট্য সাধন করিয়া স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড লইয়া সুচরিতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তাহার টেবিলের উপর গোরার রচনাবলী পড়িয়া ছিল সে কথা তাহার মনেই ছিল না। ঠিক সেই টেবিলের সম্মুখেই চৌকিতে গোরা বসিয়া আছে। বইগুলি নির্লজ্জভাবে ঠিক গোরার চোখের উপরে পড়িয়া আছে– সেগুলি ঢাকা দিবার বা সরাইবার কোনো উপায়মাত্র নাই।

“মাসিমা আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে অনেক দিন থেকে ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন, তাঁকে খবর দিই গে” বলিয়া সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়াই চলিয়া গেল– সে একলা গোরার সঙ্গে আলাপ করিবার মতো জোর পাইল না।

কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা হরিমোহিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল। কিছুকাল হইতে হরিমোহিনী বিনয়ের কাছ হইতে গোরার মত বিশ্বাস ও নিষ্ঠা এবং তাহার জীবনের কথা শুনিয়া আসিতেছেন। প্রায় মাঝে মাঝে তাঁহার অনুরোধে সুচরিতা মধ্যাহ্নে তাঁহাকে গোরার লেখা পড়িয়া শুনাইয়াছে। যদিও সে-সব লেখা তিনি যে সমস্তই ঠিক বুঝিতে পারিতেন তাহা নহে এবং তাহাতে তাঁহার নিদ্রাকর্ষণেরই সুবিধা করিয়া দিত তবু এটুকু মোটামুটি বুঝিতে পারিতেন যে, শাস্ত্র ও লোকাচারের পক্ষ লইয়া গোরা এখনকার কালের আচারহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। আধুনিক ইংরেজি-শেখা ছেলের পক্ষে ইহা অপেক্ষা আশ্চর্য এবং ইহা অপেক্ষা গুণের কথা আর কী হইতে পারে! ব্রাহ্মপরিবারের মধ্যে প্রথম যখন বিনয়কে দেখিয়াছিলেন তখন বিনয়ই তাঁহাকে যথেষ্ট তৃপ্তিদান করিয়াছিল। কিন্তু ক্রমে সেটুকু অভ্যাস হইয়া যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে যখন তিনি বিনয়কে দেখিতে লাগিলেন তখন তাহার আচারের ছিদ্রগুলিই তাঁহাকে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল। বিনয়ের উপর তিনি অনেকটা নির্ভর স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়াই, তাহার প্রতি ধিক্কার তাঁহার প্রতিদিন বাড়িয়া উঠিতেছে। সেইজন্যই অত্যন্ত উৎসুকচিত্তে তিনি গোরার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।

গোরার দিকে নেত্রপাত করিয়াই হরিমোহিনী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। এই তো ব্রাহ্মণ বটে! যেন একেবারে হোমের আগুন। যেন শুভ্রকায় মহাদেব। তাঁহার মনে এমন একটি ভক্তির সঞ্চার হইল যে, গোরা যখন তাঁহাকে প্রণাম করিল তখন সে প্রণাম গ্রহণ করিতে হরিমোহিনী কুণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন।

হরিমোহিনী কহিলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা! তুমিই গৌর? গৌরই বটে! ঐ-যে কীর্তনের গান শুনেছি–

চাঁদের অমিয়া-সনে চন্দন বাঁটিয়া গো কে মাজিল গোরার দেহখানি–

আজ তাই চক্ষে দেখলুম। কোন্‌ প্রাণে তোমাকে জেলে দিয়েছিল আমি সেই কথাই ভাবি।”

গোরা হাসিয়া কহিল, “আপনারা যদি ম্যাজিস্ট্রেট হতেন তা হলে জেলখানায় ইঁদুর বাদুড়ের বাসা হত।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “না বাবা, পৃথিবীতে চোর-জুয়াচোরের অভাব কী? ম্যাজিস্ট্রেটের কি চোখ ছিল না? তুমি যে যে-সে কেউ নও, তুমি যে ভগবানের লোক, সে তো মুখের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। জেলখানা আছে বলেই কি জেলে দিতে হবে! বাপ রে! এ কেমন বিচার!”

গোরা কহিল, “মানুষের মুখের দিকে তাকালে পাছে ভগবানের রূপ চোখে পড়ে তাই ম্যাজিস্ট্রেট কেবল আইনের বইয়ের দিকে তাকিয়ে কাজ করে। নইলে মানুষকে চাবুক জেল দ্বীপান্তর ফাঁসি দিয়ে কি তাদের চোখে ঘুম থাকত, না মুখে ভাত রুচত?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “যখনই ফুরসত পাই রাধারানীর কাছ থেকে তোমার বই পড়িয়ে শুনি। কবে তোমার নিজের মুখ থেকে ভালো ভালো সব কথা শুনতে পাব মনে এই প্রত্যাশা করে এতদিন ছিলুম। আমি মূর্খ মেয়েমানুষ, আর বড়ো দুঃখিনী, সব কথা বুঝিও নে, আবার সব কথায় মনও দিতে পারি নে। কিন্তু বাবা, তোমার কাছ থেকে কিছু জ্ঞান পাব এ আমার খুব বিশ্বাস হয়েছে।”

গোরা বিনয়সহকারে এ কথার কোনো প্রতিবাদ না করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, তোমাকে কিছু খেয়ে যেতে হবে। তেমার মতো ব্রাহ্মণের ছেলেকে আমি অনেক দিন খাওয়াই নি। আজকের যা আছে তাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করে যাও, কিন্তু আর-এক দিন আমার ঘরে তোমার নিমন্ত্রণ রইল।”

এই বলিয়া হরিমোহিনী যখন আহারের ব্যবস্থা করিতে গেলেন তখন সুচরিতার বুকের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল।

গোরা একেবারে আরম্ভ করিয়া দিল, “বিনয় আজ আপনার এখানে এসেছিল?”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ।”

গোরা কহিল, “তার পরে বিনয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, কিন্তু আমি জানি কেন সে এসেছিল।”

গোরা একটু থামিল, সুচরিতাও চুপ করিয়া রহিল।

গোরা কহিল, “আপনারা ব্রাহ্মমতে বিনয়ের বিবাহ দেবার চেষ্টা করছেন। এটা কি ভালো করছেন?”

এই খোঁচাটুকু খাইয়া সুচরিতার মন হইতে লজ্জা-সংকোচের জড়তা একেবারে দূর হইয়া গেল। সে গোরার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া কহিল, “ব্রাহ্মমতে বিবাহকে ভালো কাজ বলে মনে করব না এই কি আপনি আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন?”

গোরা কহিল, “আপনার কাছে আমি কোনোরকম ছোটো প্রত্যাশা করি নে, এ আপনি নিশ্চয় জানবেন। সম্প্রদায়ের লোকের কাছ থেকে মানুষ যেটুকু প্রত্যাশা করতে পারে আমি আপনার কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি করি। কোনো একটা দলকে সংখ্যায় বড়ো করে তোলাই যে-সমস্ত কুলির সর্দারের কাজ আপনি সে শ্রেণীর নন, এ আমি খুব জোর করে বলতে পারি। আপনি নিজেও যাতে নিজেকে ঠিকমত বুঝতে পারেন এইটে আমার ইচ্ছা। অন্য পাঁচজনের কথায় ভুলে আপনি নিজেকে ছোটো বলে জানবেন না। আপনি কোনো একটি দলের লোকমাত্র নন, এ কথাটা আপনাকে নিজের মনের মধ্যে থেকে নিজে স্পষ্ট বুঝতে হবে।”

সুচরিতা মনের সমস্ত শক্তিকে জাগাইয়া সতর্ক হইয়া শক্ত হইয়া বসিল। কহিল, “আপনিও কি কোনো দলের লোক নন?”

গোরা কহিল, “আমি হিন্দু। হিন্দু তো কোনে দল নয়। হিন্দু একটা জাতি। এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না। সমুদ্র যেমন ঢেউ নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।”

সুচরিতা কহিল, “হিন্দু যদি দল নয় তবে দলাদলি করে কেন?”

গোরা কহিল, “মানুষকে মারতে গেলে সে ঠেকাতে যায় কেন? তার প্রাণ আছে বলে। পাথরই সকল রকম আঘাতে চুপ করে পড়ে থাকে।”

সুচরিতা কহিল, “আমি যাকে ধর্ম বলে জ্ঞান করছি হিন্দু যদি তাকে আঘাত বলে গণ্য করে, তবে সে স্থলে আমাকে আপনি কী করতে বলেন?”

গোরা কহিল, “তখন আমি আপনাকে বলব যে, যেটাকে আপনি কর্তব্য মনে করছেন সেটা যখন হিন্দুজাতি বলে এতবড়ো একটি বিরাট সত্তার পক্ষে বেদনাকর আঘাত তখন আপনাকে খুব চিন্তা করে দেখতে হবে আপনার মধ্যে কোনো ভ্রম, কোনো অন্ধতা আছে কি না– আপনি সব দিক সকল রকম করে চিন্তা করে দেখেছেন কি না। দলের লোকের সংস্কারকে কেবলমাত্র অভ্যাস বা আলস্য-বশত সত্য বলে ধরে নিয়ে এতবড়ো একটা উৎপাত করতে প্রবৃত্ত হওয়া ঠিক নয়। ইঁদুর যখন জাহাজের খোল কাটতে থাকে তখন ইঁদুরের সুবিধা ও প্রবৃত্তির হিসাব থেকেই সে কাজ করে, দেখে না এতবড়ো একটা আশ্রয়ে ছিদ্র করলে তার যেটুকু সুবিধা তার চেয়ে সকলের কতবড়ো ক্ষতি। আপনাকেও তেমনি ভেবে দেখতে হবে আপনি কি কেবল আপনার দলটির কথা ভাবছেন, না সমস্ত মানুষের কথা ভাবছেন? সমস্ত মানুষ বললে কতটা বোঝায় তা জানেন? তার কতরকমের প্রকৃতি, কতরকমের প্রবৃত্তি, কতরকমের প্রয়োজন? সব মানুষ এক পথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই– কারো সামনে পাহাড়, কারো সামনে সমুদ্র, কারো সামনে প্রান্তর। অথচ কারো বসে থাকবার জো নেই, সকলকেই চলতে হবে। আপনি কেবল আপনার দলের শাসনটিকেই সকলের উপর খাটাতে চান? চোখ বুজে মনে করতে চান মানুষের মধ্যে কোনো বৈচিত্র৻ই নেই, কেবল ব্রাহ্মসমাজের খাতায় নাম লেখাবার জন্যেই সকলে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে? যে-সকল দস্যুজাতি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেই যুদ্ধে জয় করে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব বিস্তার করাকেই পৃথিবীর একমাত্র কল্যাণ বলে কল্পনা করে, অন্যান্য জাতির বিশেষত্ব যে বিশ্বহিতের পক্ষে বহুমূল্য বিধান নিজের বলগর্বে তা যারা স্বীকার করে না এবং পৃথিবীতে কেবল দাসত্ব বিস্তার করে, তাদের সঙ্গে আপনাদের প্রভেদ কোন্‌খানে?”

সুচরিতা ক্ষণকালের জন্য তর্কযুক্তি সমস্তই ভুলিয়া গেল। গোরার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর একটি আশ্চর্য প্রবলতাদ্বারা তাহার সমস্ত অন্তঃকরণকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল। গোরা যে কোনো-একটা বিষয় লইয়া তর্ক করিতেছে তাহা সুচরিতার মনে রহিল না, তাহার কাছে কেবল এই সত্যটুকু জাগিতে লাগিল যে, গোরা বলিতেছে।

গোরা কহিল, “আপনাদের সমাজই ভারতের বিশ কোটি লোককে সৃষ্টি করে নি; কোন্‌ পন্থা এই বিশ কোটি লোকের পক্ষে উপযোগী, কোন্‌ বিশ্বাস কোন্‌ আচার এদের সকলকে খাদ্য দেবে, শক্তি দেবে, তা বেঁধে দেবার ভার জোর করে নিজের উপর নিয়ে এতবড়ো ভারতবর্ষকে একেবারে একাকার সমতল করে দিতে চান কী বলে? এই অসাধ্যসাধনে যতই বাধা পাচ্ছেন ততই দেশের উপর আপনাদের রাগ হচ্ছে, অশ্রদ্ধা হচ্ছে, ততই যাদের হিত করতে চান তাদের ঘৃণা করে পর করে তুলছেন। অথচ যে ঈশ্বর মানুষকে বিচিত্র করে সৃষ্টি করেছেন এবং বিচিত্রই রাখতে চান তাঁকেই আপনারা পুজা করেন এই কথা কল্পনা করেন। যদি সত্যই আপনারা তাঁকে মানেন তবে তাঁর বিধানকে আপনারা স্পষ্ট করে দেখতে পান না কেন, নিজের বুদ্ধির এবং দলের অহংকারে কেন এর তাৎপর্যটি গ্রহণ করছেন না?”

সুচরিতা কিছুমাত্র উত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া চুপ করিয়া গোরার কথা শুনিয়া যাইতেছে দেখিয়া গোরার মনে করুণার সঞ্চার হইল। সে একটুখানি থামিয়া গলা নামাইয়া কহিল, “আমার কথাগুলো আপনার কাছে হয়তো কঠোর শোনাচ্ছে, কিন্তু আমাকে একটা বিরুদ্ধপক্ষের মানুষ বলে মনে কোনো বিদ্রোহ রাখবেন না। আমি যদি আপনাকে বিরুদ্ধপক্ষ বলে মনে করতুম তা হলে কোনো কথাই বলতুম না। আপনার মনে যে একটি স্বাভাবিক উদার শক্তি আছে সেটা দলের মধ্যে সংকুচিত হচ্ছে বলে আমি কষ্ট বোধ করছি।”

সুচরিতার মুখ আরক্তিম হইল; সে কহিল, “না না, আমার কথা আপনি কিছু ভাববেন না। আপনি বলে যান, আমি বোঝবার চেষ্টা করছি।”

গোরা কহিল, “আমার আর-কিছুই বলবার নেই– ভারতবর্ষকে আপনি আপনার সহজ বুদ্ধি সহজ হৃদয় দিয়ে দেখুন, একে আপনি ভালোবাসুন। ভারতবর্ষের লোককে যদি আপনি অব্রাহ্ম বলে দেখেন তা হলে তাদের বিকৃত করে দেখবেন এবং তাদের অবজ্ঞা করবেন– তা হলে তাদের কেবলই ভুল বুঝতে থাকবেন– যেখান থেকে দেখলে তাদের সম্পূর্ণ দেখা যায় সেখান থেকে তাদের দেখাই হবে না। ঈশ্বর এদের মানুষ করে সৃষ্টি করেছেন; এরা নানারকম করে ভাবে, নানারকম করে চলে, এদের বিশ্বাস এদের সংস্কার নানারকম; কিন্তু সমস্তেরই ভিত্তিতে একটি মনুষ্যত্ব আছে; সমস্তেরই ভিতরে এমন একটি জিনিস আছে যা আমার জিনিস, যা আমার এই ভারতবর্ষের জিনিস; যার প্রতি ঠিক সত্যদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তার সমস্ত ক্ষুদ্রতা-অসম্পূর্ণতার আবরণ ভেদ করে একটি আশ্চর্য মহৎসত্তা চোখের উপরে পড়ে– অনেক দিনের অনেক সাধনা তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন দেখা যায়, দেখতে পাই অনেক কালের হোমের অগ্নি ভস্মের মধ্যে এখনো জ্বলছে, এবং সেই অগ্নি একদিন আপনার ক্ষুদ্র দেশকালকে ছাড়িয়ে উঠে পৃথিবীর মাঝখানে তার শিখাকে জাগিয়ে তুলবে তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকে না। এই ভারতবর্ষের মানুষ অনেক দিন থেকে অনেক বড়ো কথা বলেছে,অনেক বড়ো কাজ করেছে, সে-সমস্তই একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে এ কথা কল্পনা করাও সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা– সেই তো নাস্তিকতা।”

সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া শুনিতেছিল। সে মুখ তুলিয়া কহিল, “আপনি আমাকে কী করতে বলেন?”

গোরা কহিল, “আর-কিছু বলি নে–আমি কেবল বলি আপনাকে এই কথাটা বুঝে দেখতে হবে যে হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানা ভাবের নানা মতের লোককে কোল দেবার চেষ্টা করেছে; অর্থাৎ কেবল হিন্দুধর্মই জগতে মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করেছে, দলের লোক বলে গণ্য করে নি। হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে; এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের এক মূর্তিকেই মানে না, জ্ঞানের বহুপ্রকার বিকাশকে মানে। খৃস্টানরা বৈচিত্র৻কে স্বীকার করতে চায় না; তারা বলে এক পারে খৃস্টানধর্ম আর-এক পারে অনন্ত বিনাশ, এর মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই। আমরা সেই খৃস্টানদের কাছ থেকেই পাঠ নিয়েছি, তাই হিন্দুধর্মের বৈচিত্র৻ের জন্য লজ্জা পাই। এই বৈচিত্র৻ের ভিতর দিয়েই হিন্দুধর্ম যে এককে দেখবার জন্যে সাধনা করছে সেটা আমরা দেখতে পাই নে। এই খৃস্টানি শিক্ষার পাক মনে চারি দিক থেকে খুলে ফেলে মুক্তিলাভ না করলে আমরা হিন্দুধর্মের সত্যপরিচয় পেয়ে গৌরবের অধিকারী হব না।”

কেবল গোরার কথা শোনা নহে, সুচরিতা যেন গোরার কথা সম্মুখে দেখিতেছিল, গোরার চোখের মধ্যে দূর-ভবিষ্যৎ-নিবন্ধ যে-একটি ধ্যানদৃষ্টি ছিল সেই দৃষ্টি এবং বাক্য সুচরিতার কাছে এক হইয়া দেখা দিল। লজ্জা ভুলিয়া, আপনাকে ভুলিয়া, ভাবের উৎসাহে উদ্দীপ্ত গোরার মুখের দিকে সুচরিতা চোখ তুলিয়া চাহিয়া রহিল। এই মুখের মধ্যে সুচরিতা এমন একটি শক্তি দেখিল যে শক্তি পৃথিবীতে বড়ো বড়ো সংকল্পকে যেন যোগবলে সত্য করিয়া তোলে। সুচরিতা তাহার সমাজের অনেক বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকের কাছে অনেক তত্ত্বালোচনা শুনিয়াছে, কিন্তু গোরার এ তো আলোচনা নহে, এ যেন সৃষ্টি। ইহা এমন একটা প্রত্যক্ষ ব্যাপার যাহা এক কালে সমস্ত শরীর মনকে অধিকার করিয়া বসে। সুচরিতা আজ বজ্রপাণি ইন্দ্রকে দেখিতেছিল–বাক্য যখন প্রবলমন্দ্রে কর্ণে আঘাত করিয়া তাহার বক্ষঃকপাটকে স্পন্দিত করিতেছিল সেইসঙ্গে বিদ্যুতের তীব্রচ্ছটা তাহার রক্তের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে নৃত্য করিয়া উঠিতেছিল। গোরার মতের সঙ্গে তাহার মতের কোথায় কী পরিমাণ মিল আছে বা মিল নাই তাহা স্পষ্ট করিয়া দেখিবার শক্তি সুচরিতার রহিল না।

এমন সময় সতীশ ঘরে প্রবেশ করিল। গোরাকে সে ভয় করিত–তাই তাহাকে এড়াইয়া সে তাহার দিদির পাশ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল এবং আস্তে আস্তে বলিল, “পানুবাবু এসেছেন।” সুচরিতা চমকিয়া উঠিল–তাহাকে কে যেন মারিল। পানুবাবুর আসাটাকে সে কোনোপ্রকারে ঠেলিয়া, সরাইয়া, চাপা দিয়া একেবারে বিলুপ্ত করিয়া দিতে পারিলে বাঁচে এমনি তাহার অবস্থা হইল। সতীশের মৃদু কণ্ঠস্বর গোরা শুনিতে পায় নাই মনে করিয়া সুচরিতা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। সে একেবারে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া হারানবাবুর সম্মুখে উপস্থিত হইয়াই কহিল, “আমাকে মাপ করবেন–আজ আপনার সঙ্গে কথাবার্তার সুবিধা হবে না।”

হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন সুবিধা হবে না?”

সুচরিতা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়া কহিল, “কাল সকালে আপনি যদি বাবার ওখানে আসেন তা হলে আমার সঙ্গে দেখা হবে।”

হারানবাবু কহিলেন, “আজ বুঝি তোমার ঘরে লোক আছে?”

এ প্রশ্নও এড়াইয়া সুচরিতা কহিল, “আজ আমার অবসর হবে না, আজ আপনি দয়া করে মাপ করবেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “কিন্তু রাস্তা থেকে গৌরমোহনবাবুর গলার স্বর শুনলুম যে, তিনি আছেন বুঝি?”

এ প্রশ্নকে সুচরিতা আর চাপা দিতে পারিল না, মুখ লাল করিয়া বলিল, “হাঁ, আছেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “ভালোই হয়েছে তাঁর সঙ্গে আমার কথা ছিল। তোমার হাতে যদি বিশেষ কোনো কাজ থাকে তা হলে আমি ততক্ষণ গৌরমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ করব।”

বলিয়া সুচরিতার কাছ হইতে কোনো সম্মতির প্রতীক্ষা না করিয়া তিনি সিঁড়ি দিয়া উঠিতে লাগিলেন। সুচরিতা পার্শ্ববর্তী হারানবাবুর প্রতি কোনো লক্ষ না করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া গোরাকে কহিল, “মাসি আপনার জন্যে খাবার তৈরি করতে গেছেন, আমি তাঁকে এক বার দেখে আসি।” এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল এবং হারানবাবু গম্ভীর মুখে একটা চৌকি অধিকার করিয়া বসিলেন।

হারানবাবু কহিলেন, “কিছু রোগা দেখছি যেন।”

গোরা কহিল, “আজ্ঞা হাঁ, কিছুদিন রোগা হবার চিকিৎসাই চলছিল।”

হারানবাবু কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ করিয়া কহিলেন, “তাই তো, আপনাকে খুব কষ্ট পেতে হয়েছে।”

গোরা কহিল, “যেরকম আশা করা যায় তার চেয়ে বেশি কিছুই নয়।”

হারানবাবু কহিলেন, “বিনয়বাবু সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে। আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আগামী রবিবারে ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেবার জন্যে তিনি আয়োজন করেছেন।”

গোরা কহিল, “না, আমি শুনি নি।”

হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার এতে সম্মতি আছে?”

গোরা কহিল, “বিনয় তো আমার সম্মতি চায় নি।”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনি কি মনে করেন বিনয়বাবু যথার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে এই দীক্ষা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছেন?”

গোরা কহিল, “যখন তিনি দীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন তখন আপনার এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।”

হারানবাবু কহিলেন, “প্রবৃত্তি যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন আমরা কী বিশ্বাস করি আর কী করি নে তা চিন্তা করে দেখবার অবসর পাই নে। আপনি তো মানবচরিত্র জানেন।”

গোরা কহিল, “না। মানবচরিত্র নিয়ে আমি অনাবশ্যক আলোচনা করি নে।”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনার সঙ্গে আমার মতের এবং সমাজের মিল নেই, কিন্তু আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি নিশ্চয় জানি আপনার যা বিশ্বাস, সেটা সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, কোনো প্রলোভনে তার থেকে আপনাকে টলাতে পারবে না। কিন্তু–”

গোরা বাধা দিয়া কহিল, “আমার প্রতি আপনার ঐ-যে একটুখানি শ্রদ্ধা বাঁচিয়ে রেখেছেন তার এমনি কী মূল্য যে তার থেকে বঞ্চিত হওয়া বিনয়ের পক্ষে ভারি একটা ক্ষতি! সংসারে ভালো মন্দ বলে জিনিস অবশ্যই আছে, কিন্তু আপনার শ্রদ্ধা ও অশ্রদ্ধার দ্বারা যদি তার মূল্য নিরূপণ করেন তো করুন, তবে কিনা পৃথিবীর লোককে সেটা গ্রহণ করতে বলবেন না।”

হারানবাবু কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, ও কথাটার মীমাংসা এখন না হলেও চলবে। কিন্তু আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, বিনয় যে পরেশবাবুর ঘরে বিবাহ করবার চেষ্টা করছেন আপনি কি তাতে বাধা দেবেন না?”

গোরা লাল হইয়া উঠিয়া কহিল, “হারানবাবু, বিনয়ের সম্বন্ধে এ-সমস্ত আলোচনা কি আমি আপনার সঙ্গে করতে পারি? আপনি সর্বদাই যখন মানবচরিত্র নিয়ে আছেন তখন এটাও আপনার বোঝা উচিত ছিল যে, বিনয় আমার বন্ধু এবং সে আপনার বন্ধু নয়।”

হারানবাবু কহিলেন, “এই ব্যাপারের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগ আছে বলেই আমি এ কথা তুলেছি, নইলে–”

গোরা কহিল, “কিন্তু আমি তো ব্রাহ্মসমাজের কেউ নই, আমার কাছে আপনার এই দুশ্চিন্তার মূল্য কী আছে?”

এমন সময় সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিল। হারানবাবু তাহাকে কহিলেন, “সুচরিতা, তোমার সঙ্গে আমার একটু বিশেষ কথা আছে।”

এটুকু বলিবার যে কোনো আবশ্যক ছিল তাহা নহে। গোরার কাছে সুচরিতার সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করিবার জন্যই হারানবাবু গায়ে পড়িয়া কথাটা বলিলেন। সুচরিতা তাহার কোনো উত্তরই করিল না–গোরা নিজের আসনে অটল হইয়া বসিয়া রহিল, হারানবাবুকে বিশ্রম্ভালাপের অবকাশ দিবার জন্য সে উঠিবার কোনোপ্রকার লক্ষণ দেখাইল না।

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, একবার ও ঘরে চলো তো, একটা কথা বলে নিই।”

সুচিরতা তাহার উত্তর না দিয়া গোরার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা কহিল, “আপনার মা ভালো আছেন?”

গোরা কহিল, “মা ভালো নেই এমন তো কখনো দেখি নি।”

সুচরিতা কহিল, “ভালো থাকবার শক্তি যে তাঁর পক্ষে কত সহজ তা আমি দেখেছি।”

গোরা যখন জেলে ছিল তখন আনন্দময়ীকে সুচরিতা দেখিয়াছিল সেই কথা স্মরণ করিল।

এমন সময় হারানবাবু হঠাৎ উপর হইতে একটা বই তুলিয়া লইলেন এবং সেটা খুলিয়া প্রথমে লেখকের নাম দেখিয়া লইলেন, তাহার পরে বইখানা যেখানে-সেখানে খুলিয়া চোখ বুলাইতে লাগিলেন।

সুচরিতা লাল হইয়া উঠিল। বইখানি কী তাহা গোরা জানিত, তাই গোরা মনে মনে একটু হাসিল।

হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “গৌরমোহনবাবু, আপনার এ বুঝি ছেলেবেলাকার লেখা?”

গোরা হাসিয়া কহিল, “সে ছেলেবেলা এখনো চলছে। কোনো কোনো প্রাণীর ছেলেবেলা অতি অল্প দিনেই ফুরিয়ে যায়, কারো ছেলেবেলা কিছু দীর্ঘকালস্থায়ী হয়।”

সুচরিতা চৌকি হইতে উঠিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু, আপনার খাবার এতক্ষণে তৈরি হয়েছে। আপনি তা হলে ও ঘরে একবার চলুন। মাসি আবার পানুবাবুর কাছে বের হবেন না, তিনি হয়তো আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।”

এই শেষ কথাটা সুচরিতা হারানবাবুকে বিশেষ করিয়া আঘাত করিবার জন্যই বলিল। সে আজ অনেক সহিয়াছে, কিছু ফিরাইয়া না দিয়া থাকিতে পারিল না।

গোরা উঠিল। অপরাজিত হারানবাবু কহিলেন, “আমি তবে অপেক্ষা করি।”

সুচরিতা কহিল, “কেন মিথ্যা অপেক্ষা করবেন, আজ আর সময় হয়ে উঠবে না।”

কিন্তু হারানবাবু উঠিলেন না। সুচরিতা ও গোরা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

গোরাকে এ বাড়িতে দেখিয়া ও তাহার প্রতি সুচরিতার ব্যবহার লক্ষ করিয়া হারানবাবুর মন সশস্ত্র জাগিয়া উঠিল। ব্রাহ্মসমাজ হইতে সুচরিতা কি এমন করিয়া স্থলিত হইয়া যাইবে? তাহাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই? যেমন করিয়া হোক ইহার প্রতিরোধ করিতেই হইবে।

হারানবাবু একখানা কাগজ টানিয়া লইয়া সুচরিতাকে পত্র লিখিতে বসিলেন। হারানবাবুর কতকগুলি বাঁধা বিশ্বাস ছিল। তাহার মধ্যে এও একটি যে, সত্যের দোহাই দিয়া যখন তিনি ভর্ৎসনা প্রয়োগ করেন তখন তাঁহার তেজস্বী বাক্য নিষ্ফল হইতে পারে না। শুধু বাক্যই একমাত্র জিনিস নহে, মানুষের মন বলিয়া একটা পদার্থ আছে সে কথা তিনি চিন্তাই করেন না।

আহারান্তে হরিমোহিনীর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করিয়া গোরা তাহার লাঠি লইবার জন্য যখন সুচরিতার ঘরে আসিল তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। সুচরিতার ডেস্কের উপরে বাতি জ্বলিতেছে। হারানবাবু চলিয়া গেছেন। সুচরিতার-নাম-লেখা একখানি চিঠি টেবিলের উপর শয়ান রহিয়াছে, সেখানি ঘরে প্রবেশ করিলেই চোখে পড়ে।

সেই চিঠি দেখিয়াই গোরার বুকের ভিতরটা অত্যন্ত শক্ত হইয়া উঠিল। চিঠি যে হারানবাবুর লেখা তাহাতে সন্দেহ ছিল না। সুচরিতার প্রতি হারানবাবুর যে একটা বিশেষ অধিকার আছে তাহা গোরা জানিত, সেই অধিকারের যে কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়াছে তাহা সে জানিত না। আজ যখন সতীশ সুচরিতার কানে কানে হারানবাবুর আগমনবার্তা জ্ঞাপন করিল এবং সুচরিতা সচকিত হইয়া দ্রুতপদে নীচে চলিয়া গেল ও অল্পকাল পরেই নিজে তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া উপরে লইয়া আসিল তখন গোরা মনে খুব একটা বেসুর বাজিয়াছিল। তাহার পরে হারানবাবুকে যখন ঘরে একলা ফেলিয়া সুচরিতা গোরাকে খাইতে লইয়া গেল তখন সে ব্যবহারটা কড়া ঠেকিয়াছিল বটে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার স্থলে এরূপ রূঢ় ব্যবহার চলিতে পারে মনে করিয়া গোরা সেটাকে আত্মীয়তার লক্ষণ বলিয়াই স্থির করিয়াছিল। তাহার পরে টেবিলের উপর এই চিঠিখানা দেখিয়া গোরা খুব একটা ধাক্কা পাইল। চিঠি বড়ো একটা রহস্যময় পদার্থ। বাহিরে কেবল নামটুকু দেখাইয়া সব কথাই সে ভিতরে রাখিয়া দেয় বলিয়া সে মানুষকে নিতান্ত অকারণে নাকাল করিতে পারে।

গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি কাল আসব।”

সুচরিতা আনতনেত্রে কহিল, “আচ্ছা।”

গোরা বিদায় লইতে উন্মুখ হইয়া হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল, “ভারতবর্ষের সৌরমণ্ডলের মধ্যেই তোমার স্থান–তুমি আমার আপন দেশের–কোনো ধূমকেতু এসে তোমাকে যে তার পুচ্ছ দিয়ে ঝেঁটিয়ে নিয়ে শূন্যের মধ্যে চলে যাবে সে কোনোমতেই হতে পারবে না। যেখানে তোমার প্রতিষ্ঠা সেইখানেই তোমাকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করব তবে আমি ছাড়ব। সে জায়গায় তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমাকে পরিত্যাগ করবে এই কথা এরা তোমাকে বুঝিয়েছে–আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব তোমার সত্য–তোমার ধর্ম–কেবল তোমার কিংবা আর দু-চার জনের মত বা বাক্য নয়; সে চারি দিকের সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের সূত্রে জড়িত–তাকে ইচ্ছা করলেই বন থেকে উপড়ে নিয়ে টবের মধ্যে পোঁতা যায় না–যদি তাকে উজ্জ্বল করে সজীব করে রাখতে চাও, যদি তাকে সর্বাঙ্গীণরূপে সার্থক করে তুলতে চাও, তবে তোমার জন্মের বহু পূর্বে যে লোকসমাজের হৃদয়ের মধ্যে তোমার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে সেইখানে তোমাকে আসন নিতেই হবে–কোনোমতেই বলতে পারবে না, আমি ওর পর, ও আমার কেউ নয়। এ কথা যদি বল তবে তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমার শক্তি একেবারে ছায়ার মতো ম্লান হবে যাবে। ভগবান তোমাকে যে জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছেন সে জায়গা যেমনি হোক তোমার মত যদি সেখানে থেকে তোমাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় তবে তাতে করে কখনোই তোমার মতের জয় হবে না, এই কথাটা আমি তোমাকে নিশ্চয় বুঝিয়ে দেব। আমি কাল আসব।”

এই বলিয়া গোরা চলিয়া গেল। ঘরের ভিতরকার বাতাস যেন অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁপিতে লাগিল। সুচরিতা মূর্তির মতো নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

বিনয় আনন্দময়ীকে কহিল, “দেখো মা, আমি তোমাকে সত্য বলছি, যতবার আমি ঠাকুরকে প্রণাম করেছি আমার মনের ভিতরে কেমন লজ্জা বোধ হয়েছে। সে লজ্জা আমি চেপে দিয়েছি–উল্‌্‌টে আরো ঠাকুরপূজার পক্ষ নিয়ে ভালো ভালো প্রবন্ধ লিখেছি। কিন্তু সত্য তোমাকে বলছি, আমি যখন প্রণাম করেছি আমার মনের ভিতরটা তখন সায় দেয় নি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর মন কি সহজ মন! তুই তো মোটামুটি করে কিছুই দেখতে পারিস নে। সব তাতেই একটা-কিছু সূক্ষ্ণ কথা ভাবিস। সেইজন্যেই তোর মন থেকে খুঁতখুঁত আর ঘোচে না।”

বিনয় কহিল, “ঐ কথাই তো ঠিক। অধিক সূক্ষ্ণ বুদ্ধি বলেই আমি যা বিশ্বাস না করি তাও চুল-চেরা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পারি। সুবিধামত নিজেকে এবং অন্যকে ভোলাই। এতদিন আমি ধর্মসম্বন্ধে যে-সমস্ত তর্ক করেছি সে ধর্মের দিক থেকে করি নি, দলের দিক থেকে করেছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “ধর্মের দিকে যখন সত্যকার টান না থাকে তখন ঐরকমই ঘটে। তখন ধর্মটাও বংশ মান টাকাকড়ির মতোই অহংকার করবার সামগ্রী হয়ে দাঁড়ায়।”

বিনয়। হাঁ, তখন এটা যে ধর্ম সে কথা ভাবি নে, এটা আমাদের ধর্ম এই কথা মনে নিয়েই যুদ্ধ করে বেড়াই। আমিও এতকাল তাই করেছি। তবুও আমি নিজেকে যে নিঃশেষে ভোলাতে পেরেছি তা নয়; যেখানে আমার বিশ্বাস পৌঁচচ্ছে না সেখানে আমি ভক্তির ভান করছি বলে বরাবর আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়েছি।

আনন্দময়ী কহিলেন, সে কি আর আমি বুঝি নে। তোরা যে সাধারণ লোকের চেয়ে ঢের বেশি বাড়াবাড়ি করিস তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মনের ভিতরটাতে ফাঁক আছে বলে সেইটে বোজাতে তোদের অনেক মসলা খরচ করতে হয়। ভক্তি সহজ হলে অত দরকার করে না।”

বিনয় কহিল, “তাই তো আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছি যা আমি বিশ্বাস করি নে তাকে বিশ্বাস করবার ভান করা কি ভালো?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “শোনো একবার! এমন কথাও জিজ্ঞাসা করতে হয় নাকি?”

বিনয় কহিল, “মা, আমি পরশু দিন ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেব।”

আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেকি কথা বিনয়? দীক্ষা নেবার কী এমন দরকার হয়েছে?”

বিনয় কহিল, “কী দরকার হয়েছে সেই কথাই তো এতক্ষণ বলছিলুম মা!”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর যা বিশ্বাস তা নিয়ে কি তুই আমাদের সমাজে থাকতে পারিস নে?”

বিনয় কহিল, “থাকতে গেলে কপটতা করতে হয়।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কপটতা না করে থাকবার সাহস নেই? সমাজের লোকে কষ্ট দেবে–তা, কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারবি নে?”

বিনয় কহিল, “মা, আমি যদি হিন্দুসমাজের মতে না চলি তা হলে–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “হিন্দুসমাজে যদি তিন শো তেত্রিশ কোটি মত চলতে পারে তবে তোমার মতই বা চলবে না কেন?”

বিনয় কহিল, “কিন্তু, মা, আমাদের সমাজের লোক যদি বলে তুমি হিন্দু নও তা হলে আমি কি জোর করে বললেই হল আমি হিন্দু?”

আনন্দয়মী কহিলেন, “আমাকে তো আমাদের সমাজের লোকে বলে খৃস্টান–আমি তো কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে একত্রে বসে খাই নে। তবুও তারা আমাকে খৃস্টান বললেই সে কথা আমাকে মেনে নিতে হবে এমন তো আমি বুঝি নে। যেটাকে উচিত বলে জানি সেটার জন্যে কোথাও পালিয়ে বসে থাকা আমি অন্যায় মনে করি।”

বিনয় ইহার উত্তর দিতে যাইতেছিল। আনন্দময়ী তাহাকে কিছু বলিতে না দিয়াই কহিলেন, “বিনয়, তোকে আমি তর্ক করতে দেব না, এ তর্কের কথা নয়। তুই আমার কাছে কি কিছু ঢাকতে পারিস? আমি যে দেখতে পাচ্ছি তুই আমার সঙ্গে তর্ক করবার ছুতো ধরে জোর করে আপনাকে ভোলাবার চেষ্টা করছিস। কিন্তু এতবড়ো গুরুতর ব্যাপারে ওরকম ফাঁকি চালাবার মতলব করিস নে।”

বিনয় মাথা নিচু করিয়া কহিল, “কিন্তু, মা, আমি তো চিঠি লিখে কথা দিয়ে এসেছি কাল আমি দীক্ষা নেব।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “সে হতে পারবে না। পরেশবাবুকে যদি বুঝিয়ে বলিস তিনি কখনোই পীড়াপীড়ি করবেন না।”

বিনয় কহিল, “পরেশবাবুর এ দীক্ষায় কোনো উৎসাহ নেই–তিনি এ অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তবে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।”

বিনয় কহিল, “না মা, কথা ঠিক হয়ে গেছে, এখন আর ফেরানো যাবে না। কোনোমতেই না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরাকে বলেছিস?”

বিনয় কহিল, “গোরার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।”

আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, গোরা এখন বাড়িতে নেই?”

বিনয় কহিল, “না, খবর পেলুম সে সুচরিতার বাড়িতে গেছে।’

আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেখানে তো সে কাল গিয়েছিল।”

বিনয় কহিল, “আজও গেছে।”

এমন সময় প্রাঙ্গণে পালকির বেহারার আওয়াজ পাওয়া গেল। আনন্দময়ীর কোনো কুটুম্ব স্ত্রীলোকের আগমন কল্পনা করিয়া বিনয় বাহিরে চলিয়া গেল।

ললিতা আসিয়া আনন্দময়ীকে প্রণাম করিল। আজ আনন্দময়ী কোনোমতেই ললিতার আগমন প্রত্যাশা করেন নাই। তিনি বিস্মিত হইয়া ললিতার মুখের দিকে চাহিতেই বুঝিলেন, বিনয়ের দীক্ষা প্রভৃতি ব্যাপার লইয়া ললিতার একটা কোথাও সংকট উপস্থিত হইয়াছে, তাই সে তাঁহার কাছে আসিয়াছে।

তিনি কথা পাড়িবার সুবিধা করিয়া দিবার জন্য কহিলেন, “মা, তুমি এসেছ বড়ো খুশি হলুম। এইমাত্র বিনয় এখানে ছিলেন–কাল তিনি তোমাদের সমাজে দীক্ষা নেবেন আমার সঙ্গে সেই কথাই হচ্ছিল।”

ললিতা কহিল, “কেন তিনি দীক্ষা নিতে যাচ্ছেন? তার কি কোনো প্রয়োজন আছে?”

আনন্দময়ী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “প্রয়োজন নেই মা?”

ললিতা কহিল, “আমি তো কিছু ভেবে পাই নে।”

আনন্দময়ী ললিতার অভিপ্রায় বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

ললিতা মুখ নিচু করিয়া কহিল, “হঠাৎ এরকম ভাবে দীক্ষা নিতে আসা তাঁর পক্ষে অপমানকর। এ অপমান তিনি কিসের জন্যে স্বীকার করতে যাচ্ছেন?’

“কিসের জন্যে?’ সে কথা কি ললিতা জানে না? ইহার মধ্যে ললিতার পক্ষে কি আনন্দের কথা কিছুই নাই?

আনন্দময়ী কহিলেন, “কাল দীক্ষার দিন, সে পাকা কথা দিয়েছে–এখন আর পরিবর্তন করবার জো নেই, বিনয় তো এইরকম বলছিল।”

ললিতা আনন্দময়ীর মুখের দিকে তাহার দীপ্ত দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “এ-সব বিষয়ে পাকা কথার কোনো মানে নেই, যদি পরিবর্তন আবশ্যক হয় তা হলে করতেই হবে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “মা, তুমি আমার কাছে লজ্জা কোরো না, সব কথা তোমাকে খুলে বলি। এই এতক্ষণ আমি বিনয়কে বোঝাচ্ছিলুম তার ধর্মবিশ্বাস যেমনই থাক্‌ সমাজকে ত্যাগ করা তার উচিতও না, দরকারও না। মুখে যাই বলুক সেও যে সে কথা বোঝে না তাও বলতে পারি নে। কিন্তু, মা, তার মনের ভাব তোমার কাছে তো অগোচর নেই। সে নিশ্চয় জানে সমাজ পরিত্যাগ না করলে তোমাদের সঙ্গে তার যোগ হতে পারবে না। লজ্জা কোরো না মা, ঠিক করে বলো দেখি এ কথাটা কি সত্য না?”

ললিতা আনন্দময়ী মুখের দিকে মুখ তুলিয়াই কহিল, “মা, তোমার কাছে আমি কিছুই লজ্জা করব না–আমি তোমাকে বলছি, আমি এ-সব মানি নে। আমি খুব ভালো করেই ভেবে দেখেছি, মানুষের ধর্মবিশ্বাস সমাজ যাই থাক্‌-না, সে-সমস্ত লোপ করে দিয়েই তবে মানুষের পরস্পরের সঙ্গে যোগ হবে এ কখনো হতেই পারে না। তা হলে তো হিন্দুতে খৃস্টানে বন্ধুত্বও হতে পারে না। তা হলে তো বড়ো বড়ো পাঁচিল তুলে দিয়ে এক-এক সম্প্রদায়কে এক-এক বেড়ার মধ্যেই রেখে দেওয়া উচিত।”

আনন্দময়ী মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিলেন, “আহা, তোমার কথা শুনে বড়ো আনন্দ হল। আমি তো ঐ কথাই বলি। এক মানুষের সঙ্গে আর-এক-মানুষের রূপ গুণ স্বভাব কিছুই মেলে না, তবু তো সেজন্যে দুই মানুষের মিলনে বাধে না–আর মত বিশ্বাস নিয়েই বা বাধবে কেন? মা, তুমি আমাকে বাঁচালে, আমি বিনয়ের জন্যে বড়ো ভাবছিলুম। ওর মন ও সমস্তই তোমাদের দিয়েছে সে জানি জানি– তোমাদের সঙ্গে সম্বন্ধে যদি ওর কোথাও কিছু ঘা লাগে সে তো বিনয় কোনোমতেই সইতে পারবে না। তাই ওকে বাধা দিতে আমার মনে যে কী রকম বাজছিল সে অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু, ওর কী সৌভাগ্য! ওর মন সংকট এমন সহজে কাটিয়ে দিলে, এ কি কম কথা! একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, পরেশবাবুর সঙ্গে কি এ কথা কিছু হয়েছে?”

ললিতা লজ্জা চাপিয়া কহিল, “না, হয় নি। কিন্তু আমি জানি, তিনি সব কথা ঠিক বুঝবেন।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তাই যদি না বুঝবেন তবে এমন বুদ্ধি এমন মনের জোর তুমি পেলে কোথা থেকে? মা, আমি বিনয়কে ডেকে আনি, তার সঙ্গে নিজের মুখে তোমার বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। এইবেলা আমি একটা কথা তোমাকে বলে নিই মা! বিনয়কে আমি এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি–ও ছেলে এমন ছেলে যে, ওর জন্যে যত দুঃখই তোমরা স্বীকার করে নাও সে-সমস্ত দুঃখকেই ও সার্থক করবে এ আমি জোর করে বলছি। আমি কতদিন ভেবেছি বিনয়কে সে লাভ করবে এমন ভাগ্যবতী কে আছে। মাঝে মাঝে সম্বন্ধ এসেছে, কাউকে আমার পছন্দ হয় নি। আজ দেখতে পাচ্ছি ওরও ভাগ্য বড়ো কম নয়।”

এই বলিয়া আনন্দময়ী ললিতার চিবুক হইতে চুম্বন গ্রহণ করিয়া লইলেন ও বিনয়কে ডাকিয়া আনিলেন। কৌশলে লছমিয়াকে ঘরের মধ্যে বসাইয়া তিনি ললিতার আহারের আয়োজন উপলক্ষ করিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন।

আজ আর ললিতা ও বিনয়ের মধ্যে সংকোচের অবকাশ ছিল না। তাহাদের উভয়ের জীবনে যে-একটি কঠিন সংকটের আবির্ভাব হইয়াছে তাহারই আহ্বানে তাহারা পরস্পরের সম্বন্ধকে সহজ করিয়া ও বড়ো করিয়া দেখিল–তাহাদের মাঝখানে কোনো আবেশের বাষ্প আসিয়া রঙিন আবরণ ফেলিয়া দিল না। তাহাদের দুইজনের হৃদয় যে মিলিয়াছে এবং তাহাদের দুই জীবনের ধারা গঙ্গাযমুনার মতো একটি পুণ্যতীর্থে এক হইবার জন্য আসন্ন হইয়াছে এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনামাত্র না করিয়া এ কথাটি তাহারা বিনীত গম্ভীর ভাবে নীরবে অকুষ্ঠিতচিত্তে মানিয়া লইল। সমাজ তাহাদের দুইজনকে ডাকে নাই, কোনো মত তাহাদের দুইজনকে মেলায় নাই, তাহাদের বন্ধন কোনো কৃত্রিম বন্ধন নহে, এই কথা স্মরণ করিয়া তাহারা নিজেদের মিলনকে এমন একটি ধর্মের মিলন বলিয়া অনুভব করিল, যে ধর্ম অত্যন্ত বৃহৎ ভাবে সরল, যাহা কোনো ছোটো কথা লইয়া বিবাদ করে না, যাহাকে কোনো পঞ্চায়েতের পণ্ডিত বাধা দিতে পারে না। ললিতা তাহার মুখ-চক্ষু দীপ্তিমান করিয়া কহিল, “আপনি যে হেঁট হইয়া নিজেকে খাটো করিয়া আমাকে গ্রহণ করিতে আসিবেন এ অগৌরব আমি সহ্য করিতে পারিব না। আপনি যেখানে আছেন সেইখানেই অবিচলিত হইয়া থাকিবেন এই আমি চাই।’

বিনয় কহিল, “আপনার যেখানে প্রতিষ্ঠা আপনিও সেখানে স্থির থাকিবেন, কিছুমাত্র আপনাকে নড়িতে হইবে না। প্রীতি যদি প্রভেদকে স্বীকার করিতে না পারে, তবে জগতে কোনো প্রভেদ কোথাও আছে কেন?”

উভয়ে প্রায় বিশ মিনিট ধরিয়া যে কথাবার্তা কহিয়াছিল তাহার সারমর্মটকু এই দাঁড়ায়। তাহারা হিন্দু কি ব্রাহ্ম এ কথা তাহারা ভুলিল, তাহারা যে দুই মানবাত্মা এই কথাই তাহাদের মধ্যে নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো জ্বলিতে লাগিল।

পরেশবাবু উপাসনার পর তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিলেন। সূর্য সদ্য অস্ত গিয়াছে।

এমন সময় ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় সেখানে প্রবেশ করিল ও ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া পরেশের পদধূলি লইল।

পরেশ উভয়কে এভাবে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন। কাছে বসিতে দিবার চৌকি ছিল না, তাই বলিলেন, “চলো, ঘরে চলো।”

বিনয় কহিল, “না আপনি উঠবেন না।”

বলিয়া সেইখানে ভুমিতলেই বসিল। ললিতাও একটু সরিয়া পরেশের পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল। বিনয় কহিল, “আমরা দুজনে একত্রে আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি|। সেই আমাদের জীবনের সত্যদীক্ষা হবে।”

পরেশবাবু বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

বিনয় কহিল, “বাঁধা নিয়মে বাঁধা কথায় সমাজে প্রতিজ্ঞাগ্রহণ আমি করব না। যে দীক্ষায় আমাদের দুজনের জীবন নত হয়ে সত্যবন্ধনে বদ্ধ হবে সেই দীক্ষা আপনার আশীর্বাদ। আমাদের দুজনেরই হৃদয় ভক্তিকে আপনারই পায়ের কাছে প্রণত হয়েছে–আমাদের যা মঙ্গল তা ঈশ্বর আপনার হাত দিয়েই দেবেন।”

পরেশবাবু কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া রহিলেন। পরে কহিলেন, “বিনয়, তুমি তা হলে ব্রাহ্ম হবে না?”

বিনয় কহিল, “না।”

পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি হিন্দুসমাজেই থাকতে চাও?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

পরেশবাবু ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন। ললিতা তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “বাবা, আমার যা ধর্ম তা আমার কাছে এবং বরাবর থাকবে। আমার অসুবিধা হতে পারে কষ্টও হতে পারে; কিন্তু যাদের সঙ্গে আমার মতের, এমন-কি আচরণের অমিল আছে, তাদের পর করে দিয়ে তফাতে না সরিয়ে রাখলে আমার ধর্মে বাধবে এ কথা আমি কোনোমতেই মনে করতে পারি নে।”

পরেশবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। ললিতা কহিল, “আগে আমার মনে হত ব্রাহ্মসমাজই যেন একমাত্র জগৎ, এর বাইরে যেন সব ছায়া। ব্রাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছেদ যেন সমস্ত সত্য থেকে বিচ্ছেদ। কিন্তু এই কয় দিনে সে ভাব আমার একেবারে চলে গেছে।”

পরেশবাবু ম্লানভাবে একটু হাসিলেন।

ললিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে জানাতে পারি নে আমার কতোবড়ো একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে আমি যে-সব লোক দেখছি তাদের অনেকের সঙ্গে আমার ধর্মমত এক হলেও তাদের সঙ্গে তো আমি কোনোমতেই এক নই– তবু ব্রাহ্মসমাজ বলে একটা নামের আশ্রয় নিয়ে তাদেরই আমি বিশেষ করে আপন বলব, আর পৃথিবীর অন্য সব লোককেই দূরে রেখে দেব, আজকাল আমি এর কোনো মানে বুঝতে পারি নে।”

পরেশবাবু তাঁহার বিদ্রোহী কন্যার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “ব্যক্তিগত কারণে মন যখন উত্তেজিত থাকে তখন কি বিচার ঠিক হয়? পূর্বপুরুষ থেকে সন্তানসন্ততি পর্যন্ত মানুষের যে একটা পূর্বাপরতা আছে তার মঙ্গল দেখতে গেলে সমাজের প্রয়োজন হয়– সে প্রয়োজন তো কৃত্রিম প্রয়োজন নয়। তোমাদের ভাবী বংশের মধ্যে যে দূরব্যাপী ভবিষ্যৎ রয়েছে তার ভার যার উপরে স্থাপিত, সেই তোমাদের সমাজ– তার কথা কি ভাববে না?”

বিনয় কহিল, “হিন্দুসমাজ তো আছে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “হিন্দুসমাজ তোমাদের ভার যদি না নেয়, যদি না স্বীকার করে?”

বিনয় আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিয়া কহিল, “তাকে স্বীকার করাবার ভার আমাদের নিতে হবে। হিন্দুসমাজ তো বরাবরই নূতন নূতন সম্প্রদায়কে আশ্রয় দিয়েছে, হিন্দুসমাজ সকল ধর্মসম্প্রদায়েরই সমাজ হতে পারে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “মুখের তর্কে একটা জিনিসকে একরকম করে দেখানো যেতে পারে, কিন্তু কাজে সেরকমটি পাওয়া যায় না। নইলে কেউ ইচ্ছা করে কি পুরাতন সমাজকে ছাড়তে পারে? যে সমাজ মানুষের ধর্মবোধকে বাহ্য আচারের বেড়ি দিয়ে একই জায়গায় বন্দী করে বসিয়ে রাখতে চায় তাকে মানতে গেলে নিজেদের চিরদিনের মতো কাঠের পুতুল করে রাখতে হয়।”

বিনয় কহিল, “হিন্দুসমাজের যদি সেই সংকীর্ণ অবস্থাই হয়ে থাকে তবে সেটা থেকে মুক্তি দেবার ভার আমাদের নিতে হবে; যেখানে ঘরের জানলা-দরজা বাড়িয়ে দিলেই ঘরে আলো-বাতাস আসে সেখানে কেউ রাগ করে পাকা বাড়ি ভূমিসাৎ করতে চায় না।”

ললিতা বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি এ-সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। কোনো সমাজের উন্নতির ভার নেবার জন্যে আমার কোনো সংকল্প নেই। কিন্তু চারি দিক থেকে এমন একটা অন্যায় আমাকে ঠেলা দিচ্ছে যে আমার প্রাণ যেন হাঁপিয়ে উঠছে। কোনো কারণেই এ-সমস্ত সহ্য করে মাথা নিচু করে থাকা আমার উচিত নয়। উচিত অনুচিতও আমি ভালো বুঝি নে– কিন্তু, বাবা, আমি পারব না।”

পরেশবাবু স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “আরো কিছু সময় নিলে ভালো হয় না? এখন তোমার মন চঞ্চল আছে।”

ললিতা কহিল, “সময় নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, অসত্য কথা ও অন্যায় অত্যাচার বেড়ে উঠতেই থাকবে। তাই আমার ভারি ভয় হয়, অসহ্য হয়ে পাছে হঠাৎ এমন কিছু করে ফেলি যাতে তুমিও কষ্ট পাও। তুমি এ কথা মনে কোরো না বাবা, আমি কিছুই ভাবি নি। আমি বেশ করে চিন্তা করে দেখেছি যে, আমার যেরকম সংস্কার ও শিক্ষা তাতে ব্রাহ্মসমাজের বাইরে হয়তো আমাকে অনেক সংকোচ ও কষ্ট স্বীকার করতে হবে; কিন্তু আমার মন কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হচ্ছে না, বরঞ্চ মনের ভিতরে একটা জোর উঠছে, একটা আনন্দ হচ্ছে। আমার একটিমাত্র ভাবনা, বাবা, পাছে আমার কোনো কাজে তোমাকে কিছুমাত্র কষ্ট দেয়।”

এই বলিয়া ললিতা আস্তে আস্তে পরেশবাবুর পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল।

পরেশবাবু ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “মা, নিজের বুদ্ধির উপরেই যদি আমি একমাত্র নির্ভর করতুম তা হলে আমার ইচ্ছা ও মতের বিরোধে কোনো কাজ হলে দুঃখ পেতুম। তোমাদের মনে যে আবেগ উপস্থিত হয়েছে সেটা যে সম্পূর্ণ অমঙ্গল সে আমি জোর করে বলতে পারি নে। আমিও একদিন বিদ্রোহ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলুম, কোনো সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তাই করি নি। সমাজের উপর আজকাল এই-যে ক্রমাগত ঘাত প্রতিঘাত চলছে এতে বোঝা যাচ্ছে তাঁরই শক্তির কাজ চলছে। তিনি যে নানা দিক থেকে ভেঙে-গ’ড়ে শোধন করে কোন্‌ জিনিসটাকে কী ভাবে দাঁড় করিয়ে তুলবেন আমি তার কী জানি! ব্রাহ্মসমাজই কি আর হিন্দুসমাজই কি, তিনি দেখছেন মানুষকে।”

এই বলিয়া পরেশবাবু মুহূর্তকালের জন্য চোখ বুজিয়া নিজের অন্তঃকরণের নিভৃতের মধ্যে নিজেকে যেন স্থির করিয়া লইলেন।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া পরেশবাবু কহিলেন, “দেখো বিনয়, ধর্মমতের সঙ্গে আমাদের দেশে সমাজ সম্পূর্ণ জড়িত হয়ে আছে, এইজন্যে আমাদের সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ধর্মানুষ্ঠানের যোগ আছে। ধর্মমতের গণ্ডির বাইরের লোককে সমাজের গণ্ডির মধ্যে কোনোমতে নেওয়া হবে না বলেই তার দ্বার রাখা হয় নি, সেটা তোমরা কেমন করে এড়াবে আমি তো ভেবে পাচ্ছি নে।”

ললিতা কথাটা ভালো বুঝিতে পারিল না, কারণ অন্য সমাজের প্রথার সহিত তাহাদের সমাজের প্রভেদ সে কোনোদিন প্রত্যক্ষ করে নাই। তাহার ধারণা ছিল মোটের উপর আচার-অনুষ্ঠানে পরস্পরে খুব বেশি পার্থক্য নাই। বিনয়ের সঙ্গে তাহাদের অনৈক্য যেমন অনুভবগোচর নয়, সমাজে সমাজেও যেন সেইরূপ। বস্তুত হিন্দুবিবাহ-অনুষ্ঠানের মধ্যে তাহার পক্ষে যে বিশেষ কোনো বাধা আছে তাহা সে জানিতই না।

বিনয় কহিল, “শালগ্রাম রেখে আমাদের বিবাহ হয়, আপনি সেই কথা বলছেন?”

পরেশবাবু ললিতার দিকে একবার চাহিয়া কহিলেন, “হাঁ, ললিতা কি সেটা স্বীকার করতে পারবে?”

বিনয় ললিতার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। বুঝিতে পারিল, ললিতার সমস্ত অন্তঃকরণ সংকুচিত হইয়া উঠিয়াছে।

ললিতা হৃদয়ের আবেগে এমন একটি স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও সংকটময়। ইহাতে বিনয়ের মনে অত্যন্ত একটি করুণা উপস্থিত হইল। সমস্ত আঘাত নিজের উপর লইয়া ইহাকে বাঁচাইতে হইবে। এত বড়ো তেজ পরাভূত হইয়া ফিরিয়া যাইবে সেও যেমন অসহ্য, জয়ী হইবার দুর্গম উৎসাহে এ যে মৃত্যুবাণ বুক পাতিয়া লইবে সেও তেমনি নিদারুণ। ইহাকে জয়ীও করিতে হইবে, ইহাকে রক্ষাও করিতে হইবে।

ললিতা মাথা নিচু করিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার পর একবার মুখ তুলিয়া করুণচক্ষে বিনয়ের দিকে চাহিয়া কহিল, “আপনি কি সত্য-সত্য মনের সঙ্গে শালগ্রাম মানেন?”

বিনয় তৎক্ষণাৎ কহিল, “না, মানি নে। শালগ্রাম আমার পক্ষে দেবতা নয়, আমার পক্ষে একটা সামাজিক চিহ্নমাত্র।”

ললিতা কহিল, “মনে মনে যাকে চিহ্ন বলে জানেন, বাইরে তাকে তো দেবতা বলে স্বীকার করতে হয়?”

বিনয় পরেশের দিকে চাহিয়া কহিল, “শালগ্রাম আমি রাখব না।”

পরেশ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিনয়, তোমরা সব কথা পরিষ্কার করে চিন্তা করে দেখছ না। তোমার একলার বা আর-কারো মতামত নিয়ে কথা হচ্ছে না। বিবাহ তো কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটা একটা সামাজিক কার্য, সে কথা ভুললে চলবে কেন? তোমরা কিছুদিন সময় নিয়ে ভেবে দেখো, এখনই মত স্থির করে ফেলো না।”

এই বলিয়া পরেশ ঘর ছাড়িয়া বাগানে বাহির হইয়া গেলেন এবং সেখানে একলা পায়চারি করিতে লাগিলেন।

ললিতাও ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিয়া একটু থামিল এবং বিনয়ের দিকে পশ্চাৎ করিয়া কহিল, “আমাদের ইচ্ছা যদি অন্যায় ইচ্ছা না হয় এবং সে ইচ্ছা যদি কোনো-একটা সমাজের বিধানের সঙ্গে আগাগোড়া না মিলে যায় তা হলেই আমাদের মাথা হেঁট করে ফিরে যেতে হবে এ আমি কোনোমতেই বুঝতে পারি নে। সমাজে মিথ্যা ব্যবহারের স্থান আছে আর স্থান নেই ন্যায়সংগত আচরণের?”

বিনয় ধীরে ধীরে ললিতার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি কোনো সমাজকেই ভয় করি নে, আমরা দুজনে মিলে যদি সত্যকে আশ্রয় করি তা হলে আমাদের সমাজের তুল্য এতবড়ো সমাজ আর কোথায় পাওয়া যাবে?”

বরদাসুন্দরী ঝড়ের মতো তাহাদের দুইজনার সম্মুখে আসিয়া কহিলেন, “বিনয়, শুনলুম নাকি তুমি দীক্ষা নেবে না?”

বিনয় কহিল, “দীক্ষা আমি উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে নেব, কোনো সমাজের কাছ থেকে নেব না।”

বরদাসুন্দরী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “তোমাদের এ-সব ষড়যন্ত্র, এ-সব প্রবঞ্চনার মানে কী? “দীক্ষা নেব’ ভান করে এই দুদিন আমাকে আর ব্রাহ্মসমাজ-সুদ্ধ লোককে ভুলিয়ে কাণ্ডটা কী করলে বলো দেখি! ললিতার তুমি কী সর্বনাশ করতে বসেছ সে কথা একবার ভেবে দেখলে না!”

ললিতা কহিল, “বিনয়বাবুর দীক্ষায় তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের সকলের তো সম্মতি নেই। কাগজে তো পড়ে দেখেছ। এমন দীক্ষা নেবার দরকার কী?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “দীক্ষা না নিলে বিবাহ হবে কী করে?”

ললিতা কহিল, “কেন হবে না?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “হিন্দুমতে হবে নাকি?”

বিনয় কহিল, “তা হতে পারে। যেটুকু বাধা আছে সে আমি দূর করে দেব।”

বরদাসুন্দরীর মুখ দিয়া কিছুক্ষণ কথা বাহির হইল না। তাহার পরে রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “বিনয়, যাও, তুমি যাও! এ বাড়িতে তুমি এসো না।”

গোরা যে আজ আসিবে সুচরিতা তাহা নিশ্চয় জানিত। ভোরবেলা হইতে তাহার বুকের ভিতরটা কাঁপিয়া উঠিতেছিল। সুচরিতার মনে গোরার আগমন-প্রত্যাশার আনন্দের সঙ্গে যেন একটা ভয় জড়িত ছিল। কেননা গোরা তাহাকে যে দিকে টানিতেছিল এবং আশৈশব তাহার জীবন আপনার শিকড় ও সমস্ত ডালপালা লইয়া যে দিকে বাড়িয়া উঠিয়াছে দুয়ের মধ্যে পদে পদে সংগ্রাম তাহাকে অস্থির করিয়াছিল।

তাই, কাল যখন মাসির ঘরে গোরা ঠাকুরকে প্রণাম করিল তখন সুচরিতার মনে যেন ছুরি বিঁধিল। না হয় গোরা প্রণামই করিল, না হয় গোরার এইরূপই বিশ্বাস, এ কথা বলিয়া সে কোনোমতেই নিজের মনকে শান্ত করিতে পারিল না।

গোরার আাচরণে যখন সে এমন কিছু দেখে যাহার সঙ্গে তাহার ধর্মবিশ্বাসের মূলগত বিরোধ, তখন সুচরিতার মন ভয়ে কাঁপিতে থাকে। ঈশ্বর এ কী লড়াইয়ের মধ্যে তাহাকে ফেলিয়াছেন!

হরিমোহিনী নব্যমতাভিমানী সুচরিতাকে সুদৃষ্টান্ত দেখাইবার জন্য আজও গোরাকে তাঁহার ঠাকুরঘরে লইয়া গেলেন এবং আজও গোরা ঠাকুরকে প্রণাম করিল।

সুচরিতার বসিবার ঘরে গোরা নামিয়া আাসিবামাত্রই সুচরিতা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি এই ঠাকুরকে ভক্তি করেন?”

গোরা একটু যেন আস্বাভাবিক জোরের সঙ্গে কহিল, “হাঁ, ভক্তি করি বৈকি।”

শুনিয়া সুচরিতা মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সুচরিতার সেই নম্র নীরব বেদনায় গোরার মনে মধ্যে একটা আঘাত পাইল। সে তাড়াতাড়ি কহিল, “দেখো, আমি তোমাকে সত্য কথা বলব। আমি ঠাকুরকে ভক্তি করি কি না ঠিক বলতে পারি নে, কিন্তু আমি আমার দেশের ভক্তিকে ভক্তি করি। এতকাল ধরে সমস্ত দেশের পূজা যেখানে পৌঁচেছে আমার কাছে সে পূজনীয়। আমি কোনোমতেই খৃষ্টান মিশনারির মতো সেখানে বিষদৃষ্টিপাত করতে পারি নে।”

সুচরিতা মনে মনে কী চিন্তা করিতে করিতে গোরার মুরে দিকে চাহিয়া রহিল। গোরা কহিল, “আামার কথা ঠিকমত বোঝা তোমার পক্ষে খুব কঠিন সে আামি জানি। কেননা সম্প্রদায়ের ভিতরে মানুষ হয়ে এ-সব জিনিসের প্রতি সহজ দৃষ্টিপাত করবার শক্তি তোমাদের চলে গিয়েছে। তুমি যখন তোমার মাসির ঘরে ঠাকুরকে দেখ তুমি কেবল পাথরকেই দেখ, আামি তোমার মাসির ভক্তিপূর্ণ করুণ হৃদয়কেই দেখি। সে দেখে কি আর রাগ করতে পারি, অবজ্ঞা করতে পারি! তুমি কি মনে কর ঐ হৃদয়ের দেবতা পাথরের দেবতা!”

সুচরিতা কহিল, “ভক্তি কি করলেই হল? কাকে ভক্তি করছি কিছুই বিচার করতে হবে না?”

গোরা মনের মধ্যে একটু উত্তেজিত হইয়া কহিল, “অর্থাৎ, তুমি মনে করছ একটা সীমাবদ্ধ পদার্থকে ঈশ্বর বলে পূজা করা ভ্রম। কিন্তু কেবল দেশকালের দিক থেকেই কি সীমা নির্ণয় করতে হবে? মনে করো ঈশ্বরের সম্বন্ধে কোনো একটি শাস্ত্রের বাক্য স্মরণ করলে তোমার খুব ভক্তি হয়; সেই বাক্যটি যে পাতায় লেখা আছে সেই পাতাটা মেপে, তার অক্ষর কয়টা গুনেই কি তুমি সেই বাক্যের মহত্ত্ব স্থির করবে? ভাবের আসীমতা বিস্তৃতির আসীমতার চেয়ে যে ঢের বড়ো জিনিস। চন্দ্রসূর্যতারাখচিত অনন্ত আকাশের চেয়ে ঐ এতটুকু ঠাকুরটি যে তোমার মাসির কাছে যথার্থ অসীম। পরিমাণগত আসীমকে তুমি অসীম বল, সেইজন্যেই চোখ বুজে তোমাকে অসীমের কথা ভাবতে হয়, জানি নে তাতে কোনো ফল পাও কি না। কিন্তু হৃদয়ের অসীমকে চোখ মেলে এতটুকু পদার্থের মধ্যেও পাওয়া যায়। তাই যদি না পাওয়া যেত তবে তোমার মাসির যখন সংসারের সমস্ত সুখ নষ্ট হয়ে গেল তখন তিনি ঐ ঠাকুরটিকে এমন করে আঁকড়ে ধরতে পারতেন কি? হৃদয়ের অত বড়ো শূন্যতা কি খেলাচ্ছলে এক টুকরো পাথর দিয়ে ভরানো যায়? ভাবের অসীমতা না হলে মানুষের হৃদয়ের ফাঁকা ভরে না।”

এমন-সকল সূক্ষ্ণ তর্কের উত্তর দেওয়া সুচরিতার আসাধ্য অথচ সত্য বলিয়া মানিয়া যাওয়াও তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। এইজন্যই কেবল ভাষাহীন প্রতিকারহীন বেদনা তাহার মনে বাজিতে থাকে।

বিরুদ্ধপক্ষের সহিত তর্ক করিবার সময় গোরার মনে কোনদিন এতটুকু দয়ার সঞ্চার হয় নাই। বরঞ্চ এ সম্বন্ধে শিকারি জন্তুর মতো তাহার মনে একটা কঠোর হিংস্রতা ছিল। কিন্তু সুচরিতার নিরুত্তর পরাভবে আজ তাহার মন কেমন ব্যথিত হইতে লাগিল। সে কণ্ঠস্বরকে কোমল করিয়া কহিল, “তোমাদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে আামি কোনো কথা বলতে চাই নে। আমার কথাটুকু কেবল এই, তুমি যাকে ঠাকুর বলে নিন্দা করছ সেই ঠাকুরটি যে কী তা শুধু চোখে দেখে জানাই যায় না; তাতে যার মন স্থির হয়েছে, হৃদয় তৃপ্ত হয়েছে, যার চরিত্র আশ্রয় পেয়েছে, সেই জানে সে ঠাকুর মৃন্ময় কি চিন্ময়, সমীম কি অসীম। আমি তোমাকে বলছি, আমাদের দেশের কোনো ভক্তই সসীমের পূজা করে না–সীমার মধ্যে সীমাকে হারিয়ে ফেলা ঐ তো তাদের ভক্তির আনন্দ।”

সুচরতা কহিল, “কিন্তু সবাই তো ভক্ত নয়।”

গোরা কহিল, “যে ভক্ত নয় সে কিসের পূজা করে তাতে কার কী আসে যায়? ব্রাহ্মসমাজে যে লোক ভক্তিহীন সে কী করে? তার সমস্ত পূজা অতলস্পর্শ শূন্যতার মধ্যে গিয়ে পড়ে। না, শূন্যতার চেয়ে ভয়ানক– দলাদলিই তার দেবতা, অহংকারই তার পুরোহিত। এই রক্তপিপাসু দেবতার পূজা তোমাদের সমাজে কি কখনো দেখ নি?”

এই কথার কোনো উত্তর না দিয়া সুচরতা গোরাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ধর্মসম্বন্ধে আপনি এই যা-সব বলছেন এ কি আপনি নিজের অভিজ্ঞতার থেকে বলছেন?”

গোরা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “অর্থাৎ, তুমি জানতে চাও, আমি কোনোদিনই ঈশ্বরকে চেয়েছি কি না। না, আমার মন ও দিকেই যায় নি।”

সুচরিতার পক্ষে এ কথা খুশি হইবার কথা নহে, কিন্তু তবু তাহার মন যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। এইখানে জোর করিয়া কোনো কথা বলিবার অধিকার যে গোরার নাই ইহাতে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইল।

গোরা কহিল, “কাউকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারি এমন দাবি আামার নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লোকের ভক্তিকে তোমার যে উপহাস করবে এও আমি কোনোদিন সহ্য করতে পারব না। তুমি তোমার দেশের লোককে ডেকে বলছ–তোমরা মূঢ়, তোমরা পৌত্তলিক। আমি তাদের সবাইকে আহ্বান করে জানাতে চাই–না, তোমরা মূঢ় নও, তোমরা পৌত্তলিক নও, তোমরা জ্ঞানী, তোমরা ভক্ত। আমাদের ধর্মতত্ত্বে যে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধাপ্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমি জাগ্রত করতে চাই। যেখানে তার সম্পদ আছে সেইখানে তার অভিমানকে আমি উদ্যত করে তুলতে চাই। আমি তার মাথা হেঁট করে দেব না ; নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলব না, এই আমার পণ। তোমার কাছেও আজ আমি এইজন্যেই এসেছি। তোমাকে দেখে অবধি একটি নূতন কথা দিনরাত্রি আমার মাথায় ঘুরছে। এতদিন সে কথা আমি ভাবি নি। কেবলই আমার মনে হচ্ছে–কেবল পুরুষের দৃষ্টিতেই তো ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হবেন না। আমাদের মেয়েদের চোখের সামনে যেদিন আবির্ভূত হবেন সেইদিনই তাঁর প্রকাশ পূর্ণ হবে। তোমার সঙ্গে একসঙ্গে একদৃষ্টিতে আমি আমার দেশকে সন্মুখে দেখব এই একটি আকাঙক্ষা যেন আমাকে দগ্ধ করছে। আমার ভারতবর্ষের জন্য আমি পুরুষ তো কেবলমাত্র খেটে মরতে পারি–কিন্তু তুমি না হলে প্রদীপ জ্বেলে তাঁকে বরণ করবে কে? ভারতবর্ষের সেবা সুন্দর হবে না, তুমি যদি তাঁর কাছ থেকে দূরে থাক।”

হায়, কোথায় ছিল ভারতবর্ষ! কোন্‌ সুদূরে ছিল সুচরিতা! কোথা হইতে আসিল ভারতবর্ষের এই সাধক, এই ভাবে-ভোলা তাপস! সকলকে ঠেলিয়া কেন সে তাহারই পাশে আসিয়া দাঁড়াইল! সকলকে ছাড়িয়া কেন সে তাহাকেই আহ্বান করিল! কোনো সংশয় করিল না, বাধা মানিল না। বলিল–”তোমাকে নহিলে চলিবে না, তোমাকে লইবার জন্য আসিয়াছি, তুমি নির্বাসিত হইয়া থাকিলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হইবে না।’ সুচরিতার দুই চক্ষু দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল পড়িতে লাগিল, কেন তাহা সে বুঝিতে পারিল না।

গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিল। সেই দৃষ্টির সন্মুখে সুচরিতা তাহার আশ্রুবিগলিত দুই চক্ষু নত করিল না। চিন্তাবিহীন শিশিরমণ্ডিত ফুলের মতো তাহা নিতান্ত আত্মবিস্মৃতভাবে গোরার মুখের দিকে ফুটিয়া রহিল।

সুচরিতার সেই সংকোচবিহীন অশ্রুধারাপ্লাবিত দুই চক্ষুর সন্মুখে, ভূমিকম্পে পাথরের রাজপ্রাসাদ যেমন টলে তেমনি করিয়া গোরার সমস্ত প্রকৃতি যেন টলিতে লাগিল। গোরা প্রাণপণ বলে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইবার জন্য মুখ ফিরাইয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। গলির রেখা সংকীর্ণ হইয়া যেখানে বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে সেখানে খোলা আাকাশে কালো পাথরের মতো অন্ধকারের উপর তারা দেখা যাইতেছে। সেই আকাশখণ্ড, সেই ক’টি তারা গোরার মনকে আজ কোথায় বহন করিয়া লইয়া গেল–সংসারের সমস্ত দাবি হইতে, এই অভ্যস্ত পৃথিবীর প্রতিদিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি হইতে কত দূরে! রাজ্যসাম্রাজ্যের কত উত্থানপতন, যুগযুগান্তরের কত প্রয়াস ও প্রার্থনাকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া ঐটুকু আকাশ এবং ঐ ক’টি তারা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে; অথচ, অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্য হইতে এক হৃদয় যখন আর-এক হৃদয়কে আহ্বান করে তখন নিভৃত জগৎপ্রান্তের সেই বাক্যহীন ব্যাকুলতা যেন ঐ দূর আকাশ এবং দূর তারাকে স্পন্দিত করিতে থাকে। কর্মরত কলিকাতার পথে গাড়িঘোড়া ও পথিকের চলাচল এই মুহূর্তে গোরার চক্ষে ছায়াছবির মতো বস্তুহীন হইয়া গেল– নগরের কোলাহল কিছুই তাহার কাছে আর পৌঁছিল না। নিজের হৃদয়ের দিকে চাহিয়া দেখিল–সেও ঐ আকাশের মতো নিস্তব্ধ, নিভৃত, অন্ধকার, এবং সেখানে জলে-ভরা দুইটি সরল সকরুণ চক্ষু নিমেষ হারাইয়া যেন অনাদিকাল হইতে অনন্তকালের দিকে তাকাইয়া আছে।

হরিমোহিনীর কণ্ঠ শুনিয়া গোরা চমকিয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল।

“বাবা, কিছু মিষ্টিমুখ করে যাও।”

গোরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ কিন্তু নয়। আজ আমাকে মাপ করতে হবে–আমি এখনই যাচ্ছি।”

বলিয়া গোরা আর-কোনো কথার অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।

হরিমোহিনী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন। সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হরিমোহিনী মাথা নাড়িয়া ভাবিতে লাগিলেন– এ আাবার কী কাণ্ড!

অনতিকাল পরেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুচরিতার ঘরে সুচরিতাকে দেখিতে না পাইয়া হরিমোহিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী কোথায়?”

হরিমোহিনী বিরক্তির কণ্ঠে কহিলেন, “কি জানি, এতক্ষণ তো গৌরমোহনের সঙ্গে বসবার ঘরে আলাপ চলছিল, তার পরে এখন বোধ হয় ছাতে একলা পায়চারি হচ্ছে।”

পরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এই ঠাণ্ডায় এত রাত্রে ছাতে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “একটু ঠাণ্ডা হয়েই নিক। এখনকার মেয়েদের ঠাণ্ডায় অপকার হবে না।”

হরিমোহিনীর মন আজ খারাপ হইয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সুচরিতাকে খাইতে ডাকেন নাই। সুচরিতারও আজ সময়ের জ্ঞান ছিল না।

হঠাৎ স্বয়ং পরেশবাবুকে ছাতে আসিতে দেখিয়া সুচরিতা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিল। কহিল, “বাবা, চলো, নীচে চলো, তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।”

ঘরে আসিয়া প্রদীপের আালোকে পরেশের উদ্‌বিগ্ন মুখ দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা ঘা লাগিল। এতদিন যিনি পিতৃহীনার পিতা এবং গুরু ছিলেন, আশৈশবের সমস্ত বন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া তাঁহার কাছ হইতে কে আজ সুচরিতাকে দূরে টানিয়া লইয়া যাইতেছে? সুচরিতা কিছুতেই যেন নিজেকে ক্ষমা করিতে পারিল না। পরেশ ক্লান্তভাবে চৌকিতে বসিলে পর দুর্নিবার অশ্রুকে গোপন করিবার জন্য সুচরিতা তাঁহার চৌকির পশ্চাতে দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে তাঁহার পক্ককেশের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিয়া দিতে লাগিল।

পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্রহণ করতে অসম্মত হয়েছেন।”

সুচরিতা কোনো উত্তর করিল না। পরেশ কহিলেন, “বিনয়ের দীক্ষাগ্রহণের প্রস্তাবে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল, সেইজন্যে আমি এতে বিশেষ ক্ষূণ্ন হই নি–কিন্তু ললিতার কথার ভাবে বুঝতে পারছি দীক্ষা না হলেও বিনয়ের সঙ্গে বিবাহে সে কোনো বাধা অনুভব করছে না।”

সুচরিতা হঠাৎ খুব জোরের সহিত বলিয়া উঠিল, “না বাবা, সে কখনোই হতে পারবে না। কিছুতেই না।”

সুচরিতা সচরাচর এমন অনাবশ্যক ব্যগ্রতা প্রকাশ করিয়া কথা কয় না, সেইজন্য তাহার কণ্ঠস্বরে এই আকস্মিক আবেগের প্রবলতায় পরেশ মনে মনে একটু আশ্চর্য হইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হতে পারবে না?”

সুচরিতা কহিল, “বিনয় ব্রাহ্ম না হলে কোন্‌ মতে বিয়ে হবে?”

পরেশ কহিলেন, “হিন্দুমতে।”

সুচরিতা সবেগে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, ” না না, আজকাল এ-সব কী কথা হচ্ছে? এমন কথা মনেও আনা উচিত নয়। শেষকালে ঠাকুরপুজো করে ললিতার বিয়ে হবে! এ কিছুতেই হতে দিতে পারব না!”

গোরা নাকি সুচরিতার মন টানিয়া লইয়াছে, তাই সে আজ হিন্দুমতে বিবাহের কথায় এমন একটা অস্বাভাবিক আক্ষেপ প্রকাশ করিতেছে। এই আক্ষেপের ভিতরকার আসল কথাটা এই যে, পরেশকে সুচরিতা এক জায়গায় দৃঢ় করিয়া ধরিয়া বলেতেছে–”তোমাকে ছাড়িব না, আমি এখনো তোমার সমাজের, তোমার মতের, তোমার শিক্ষার বন্ধন কোনোমতেই ছিঁড়িতে দিব না।’

পরেশ কহিলেন, “বিবাহ-অনুষ্ঠানে শালগ্রামের সংস্রব বাদ দিতে বিনয় রাজি হয়েছে।”

সুচরিতা চৌকির পিছন হইতে আসিয়া পরেশের সম্মুখে চৌকি লইয়া বসিল। পরেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতে তুমি কী বল?”

সুচরিতা একটু চুপ করিয়া কহিল, “আমাদের সমাজ থেকে ললিতাকে তা হলে বেরিয়ে যেতে হবে।”

পরেশ কহিলেন, “এই কথা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছে। কোনো মানুষের সঙ্গে সমাজের যখন বিরোধ বাধে তখন দুটো কথা ভেবে দেখবার আাছে, দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায় কোন্‌ দিকে এবং প্রবল কে? সমাজ প্রবল তাতে সন্দেহ নেই, অতএব বিদ্রোহীকে দুঃখ পেতে হবে। ললিতা বাবংবার আমাকে বলছে, দুঃখ স্বীকার করতে সে যে শুধু প্রস্তুত তা নয়, এতে সে আনন্দ বোধ করছে। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে অন্যায় না দেখলে আমি তাকে বাধা দেব কী করে?”

সুচরিতা কহিল, “কিন্তু বাবা, এ কী রকম হবে!”

পরেশ কহিলেন, “জানি এতে একটা সংকট উপস্থিত হবে। কিন্তু ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহে যখন দোষ কিছু নেই, এমন-কি, সেটা উচিত, তখন সমাজে যদি বাধে তবে সে বাধা মানা কর্তব্য নয় বলে আমার মন বলছে। মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয়–সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে। সেজন্যে যারা দুঃখ স্বীকার করতে রাজি আছে আমি তো তাদের নিন্দা করতে পারব না।”

সুচরিতা কহিল, “বাবা, এতে তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেতে হবে।”

পরেশ কহিলেন, ” সে কথা ভাবার কথাই নয়।”

সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি সম্মতি দিয়েছ?”

পরেশ কহিলেন, ” না, এখনো দিই নি। কিন্তু দিতেই হবে। ললিতা যে পথে যাচ্ছে সে পথে আমি ছাড়া কে তাকে আশীর্বাদ করবে আর ঈশ্বর ছাড়া কে তার সহায় আছেন?”

পরেশবাবু যখন চলিয়া গেলেন তখন সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে জানিত পরেশ ললিতাকে মনে মনে কত ভালোবাসেন, সেই ললিতা বাঁধা পথ ছাড়িয়া দিয়া এতবড়ো একটা অনির্দেশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে, ইহাতে তাঁহার মন যে কত উদ্‌বিগ্ন তাহা তাহার বুঝিতে বাকি ছিল না–তৎসত্ত্বে এই বয়সে তিনি এমন একটা বিপ্লবে সহায়তা করিতে চলিয়াছেন, অথচ ইহার মধ্যে বিক্ষোভ কতই অল্প! নিজের জোর তিনি কোথাও কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তাঁর মধ্যে কতবড়ো একটা জোর অনায়াসেই আত্মগোপন করিয়া আছে!

পূর্বে হইলে পরেশের প্রকৃতির এই পরিচয় তাহার কাছে বিচিত্র বলিয়া ঠেকিত না, কেননা পরেশকে শিশুকাল হইতেই তো সে দেখিয়া আসিতেছে। কিন্তু আজই কিছুক্ষণ পূর্বেই নাকি সুচরিতার সমস্ত অন্তঃকরণ গোরার অভিঘাত সহ্য করিয়াছে, সেইজন্য এই দুই শ্রেণীর স্বভাবের সম্পূর্ণ পার্থক্য সে মনে মনে সুস্পষ্ট অনুভব না করিয়া থাকিতে পারিল না। গোরার কাছে তাহার নিজের ইচ্ছা কী প্রচণ্ড! এবং সেই ইচ্ছাকে সবেগে প্রয়োগ করিয়া সে অন্যকে কেমন করিয়া অভিভূত করিয়া ফেলে! গোরার সহিত যে- কেহ যে-কোনো সম্বন্ধ স্বীকার করিবে গোরার ইচ্ছার কাছে তাহাকে নত হইতে হইবে। সুচরিতা আজ নত হইয়াছে এবং নত হইয়া আনন্দও পাইয়াছে, আপনাকে বিসর্জন করিয়া একটা বড়ো জিনিস পাইয়াছে বলিয়া অনুভব করিয়াছে, কিন্তু তবু আজ পরেশ যখন তাহার ঘরের দীপালোক হইতে ধীরপদে চিন্তানত মস্তকে বাহিরের অন্ধকারে চলিয়া গেলেন তখন যৌবনতেজোদীপ্ত গোরার সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনা করিয়াই সুচরিতা অন্তরের ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি বিশেষ করিয়া পরেশের চরণে সমর্পণ করিল এবং কোলের উপর দুই করতল জুড়িয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হইয়া চিত্রার্পিতের মতো বসিয়া রহিল।

আজ সকাল হইতে গোরার ঘরে খুব একটা আন্দোলন উঠিয়াছে। প্রথমে মহিম তাঁহার হুঁকা টানিতে টানিতে আসিয়া গোরাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা হলে, এতদিন পরে বিনয় শিকলি কাটল বুঝি?”

গোরা কথাটা বুঝিতে পারিল না, মহিমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মহিম কহিলেন, “আমাদের কাছে আর ভাঁড়িয়ে কী হবে বল? তোমার বন্ধুর খবর তো আর চাপা রইল না–ঢাক বেজে উঠেছে। এই দেখো-না।”

বলিয়া মহিম গোরার হাতে একখানা বাংলা খবরের কাগজ দিলেন। তাহাতে অদ্য রবিবারে বিনয়ের ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষাগ্রহণের সংবাদ উপলক্ষ করিয়া এক তীব্র প্রবন্ধ বাহির হইয়াছেন। গোরা যখন জেলে ছিল সেই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের কন্যাদায়গ্রস্ত কোনো কোনো বিশিষ্ট সভ্য এই দুর্বলচিত্ত যুবককে গোপন প্রলোভনে বশ করিয়া সনাতন হিন্দুসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছে বলিয়া লেখক তাঁহার রচনায় বিস্তর কটু ভাষা বিস্তার করিয়াছেন।

গোরা যখন বলিল সে এ সংবাদ জানে না তখন মহিম প্রথমে বিশ্বাস করিলেন না, তার পরে বিনয়ের এই গভীর ছদ্মব্যবহারে বার বার বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এবং বলিয়া গেলেন, স্পষ্টবাক্যে শশিমুখীকে বিবাহে সম্মতি দিয়া তাহার পরেও যখন বিনয় কথা নড়চড় করিতে লাগিল তখনই আমাদের বোঝা উচিত ছিল তাহার সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে।

অবিনাশ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু, এ কী কাণ্ড! এ যে আমাদের স্বপ্নের আগোচর! বিনয়বাবুর শেষকালে–”

অবিনাশ কথা শেষ করিতেই পারিল না। বিনয়ের এই লাঞ্ছনায় তাহার মনে এত আনন্দ বোধ হইতেছিল যে, দুশ্চিন্তার ভান করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছিল।

দেখিতে দেখিতে গোরার দলের প্রধান প্রধান সকল লোকই আসিয়া জুটিল। বিনয়কে লইয়া তাহাদের মধ্যে খুব একটা উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলিতে লাগিল। অধিকাংশ লোকই একবাক্যে বলিল–বর্তমান ঘটনায় বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই, কারণ বিনয়ের ব্যবহারে তাহারা বরাবরই একটা দ্বিধা এবং দুর্বলতার লক্ষণ দেখিয়া আসিয়াছে, বস্তুত তাহাদের দলের মধ্যে বিনয় কোনোদিনই কায়মনোবাক্যে আত্মসমর্পণ করে নাই। অনেকেই কহিল –বিনয় গোড়া হইতেই নিজেকে কোনোক্রমে গৌরমোহনের সমকক্ষ বলিয়া চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিত ইহা তাহাদের অসহ্য বোধ হইত। অন্য সকলে যেখানে ভক্তির সংকোচে গৌরমোহনের সহিত যথোচিত দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিত সেখানে বিনয় গায়ে পড়িয়া গোরার সঙ্গে এমন একটা মাখামাখি করিত যেন সে-আর সকলের সঙ্গে পৃথক এবং গোরার ঠিক সমশ্রেণীর লোক, গোরা তাহাকে স্নেহ করিত বলিয়াই তাহার এই অদ্ভুত স্পর্ধা সকলে সহ্য করিয়া যাইত– সেইপ্রকার অবাধ অহংকারেরই এইরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়া থাকে।

তাহারা কহিল–”আমার বিনয়বাবুর মতো বিদ্বান নই, আমাদের অত অত্যন্ত বেশি বুদ্ধিও নাই, কিন্তু বাপু, আমরা বরাবর যা-হয় একটা প্রিন্সিপ্‌ল্‌ ধরিয়া চলিয়াছি, আামাদের মনে এক মুখে আর নাই; আমাদের দ্বারা আজ একরকম কাল অন্যরকম অসম্ভব– ইহাতে আমাদিগকে মূর্খই বলো, নির্বোধই বলো, আর যাই বলো।’

গোরা এ-সব কথায় একটি কথাও যোগ করিল না, স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

বেলা হইয়া গেলে যখন একে একে সকলে চলিয়া গেল তখন গোরা দেখিল, বিনয় তাহার ঘরে প্রবেশ না করিয়া পাশের সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিয়া যাইতেছে গোরা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল; ডাকিল, “বিনয়!”

বিনয় সিঁড়ি হইতে নামিয়া গোরা ঘরের প্রবেশ করিতেই গোরা কহিল, “বিনয়, আমি কি না জেনে তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করেছি, তুমি আমাকে যেন ত্যাগ করেছ বলে মনে হচ্ছে।”

আজ গোরার সঙ্গে একটা ঝগড়া বাধিবে এ কথা বিনয় আগেভাগেই স্থির করিয়া মনটাকে কঠিন করিয়াই আসিয়াছিল। “এমন সময় বিনয় আসিয়া গোরার মুখ যখন বিমর্ষ দেখিল এবং তাহার কণ্ঠস্বরে একটা স্নেহের বেদনা যখন অনুভব করিল, তখন সে জোর করিয়া মনকে যে বাঁধিয়া আসিয়াছিল তাহা এক মুহূর্তেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া গেল।

সে বলিয়া উঠিল, “ভাই গোরা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে, অনেক জিনিস ত্যাগ করতে হয়, কিন্তু তাই বলে বন্ধুত্ব কেন ত্যাগ করব।”

গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “বিনয়, তুমি কি ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেছ?”

বিনয় কহিল, “না গোরা, করি নি, এবং করবও না। কিন্তু সেটার উপর আমি কোনো জোর দিতে চাই নে।”

গোরা কহিল, “তার মানে কী?”

বিনয় কহিল, “তার মানে এই যে, আমি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলুম কি না-নিলুম, সেই কথাটাকে অত্যন্ত তুমুল করে তোলবার মতো মনের ভাব আমার এখন আর নেই।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “পূর্বেই বা মনের ভাব কী রকম ছিল আর এখনই বা কী রকম হয়েছে জিজ্ঞাসা করি।”

গোরার কথার সুরে বিনয়ের মন আবার একবার যুদ্ধের জন্য কোমর বাঁধিতে বসিল। সে কহিল, “আগে যখন শুনতুম কেউ ব্রাহ্ম হতে যাচ্ছে মনের মধ্যে খুব একটা রাগ হত, সে যেন বিশেষরূপ শাস্তি পায় এই আমার ইচ্ছা হত। কিন্তু এখন আমার তা হয় না। আমার মনে হয় মতকে মত দিয়ে যুক্তিকে যুক্তি দিয়েই বাধা দেওয়া চলে, কিন্তু বুদ্ধির বিষয়কে ক্রোধ দিয়ে দণ্ড দেওয়া বর্বরতা।”

গোরা কহিল, “হিন্দু ব্রাহ্ম হচ্ছে দেখলে এখন আর রাগ হবে না, কিন্তু ব্রাহ্ম প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু হতে যাচ্ছে দেখলে রাগে তোমার অঙ্গ জ্বলতে থাকবে, পূর্বের সঙ্গে তোমার এই প্রভেদটা ঘটেছে।”

বিনয় কহিল, “এটা তুমি আমার উপর রাগ করে বলছ, বিচার করে বলছ না।”

গোরা কহিল, “আমি তোমার ‘পরে শ্রদ্ধা করেই বলছি, এইরকম হওয়াই উচিত ছিল– আমি হলেও এইরকম হত। বহুরূপী যেরকম রঙ বদলায় ধর্মমত গ্রহণ ও ত্যাগ যদি সেইরকম আমাদের চামড়ার উপরকার জিনিস হত তা হলে কোনো কথাই ছিল না, কিন্তু সেটা মর্মের জিনিস বলেই সেটাকে হালকা করতে পারি নি। যদি কোনোরকম বাধা না থাকে, যদি দণ্ডের মাশুল না দিতে হয়, তা হলে গুরুতর বিষয়ে একটা মত গ্রহণ বা পরিবর্তনের সময় মানুষ নিজের সমস্ত বুদ্ধিকে জাগাবে কেন? সত্যকে যথার্থ সত্য বলেই গ্রহণ করছি কি না মানুষকে তার পরীক্ষা দেওয়া চাই। দণ্ড স্বীকার করতেই হবে। মূল্যটা এড়িয়ে রত্নটুকু পাবে সত্যের কারবার এমন শৌখিন কারবার নয়।”

তর্কের মুখে আর কোনো বল্‌গা রহিল না। কথার উপরে কথা বাণের উপরে বাণের মতো আসিয়া পড়িয়া পরস্পর সংঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিতে লাগিল।

অবশেষে অনেকক্ষণ বাগ্‌যুদ্ধের পর বিনয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “গোরা, তোমার এবং আমার প্রকৃতির মধ্যে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। সেটা এতদিন কোনোমতে চাপা ছিল–যখনই মাথা তুলতে চেয়েছে আমিই তাকে নত করেছি, কেননা আমি জানতুন যেখানে তুমি কোনো পার্থক্য দেখ সেখানে তুমি সন্ধি করতে জান না, একেবারে তলোয়ার হাতে ছুটতে থাক। তাই তোমার বন্ধুত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি চিরদিনই নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে এসেছি। আজ বুঝতে পারছি এতে মঙ্গল হয় নি এবং মঙ্গল হতে পারে না।”

গোরা কহিল, “এখন তোমার অভিপ্রায় কী আমাকে খুলো বলো।”

বিনয় কহিল, “আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ বলে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ-বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হোক তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্রাণ থাক্‌ আর না-থাক্‌, এ আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারব না।”

গোরা কহিল, “মহাভারতের সেই ব্রাহ্মণশিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরোবে না কি?”

বিনয় কহিল, “আমার খড়কেতে বকাসুর মরবে কি না তা জানি নে, কিন্তু আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার অধিকার যে তার আছে এ কথা আমি কোনোমতেই মানব না–যখন সে চিবিয়ে খাচ্ছে তখনো না।”

গোরা কহিল, “এ-সমস্ত তুমি রূপক দিয়ে কথা বলছ, বোঝা কঠিন হয়ে উঠছে।”

বিনয় কহিল, “বোঝা তোমার পক্ষে কঠিন নয়, মানাই তোমার পক্ষে কঠিন। মানুষ যেখানে স্বভাবত স্বাধীন, ধর্মত স্বাধীন, আমাদের সমাজ সেখানে তার খাওয়া-শোওয়া-বসাকেও নিতান্ত অর্থহীন বন্ধনে বেঁধেছে এ কথা তুমি আমার চেয়ে কম জান তা নয় ; কিন্তু এই জবরদস্তিকে তুমি জবরদস্তির দ্বারাই মানতে চাও। আমি আজ বলছি, এখানে আমি কারো জোর মানব না। সমাজের দাবিকে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার করব যতক্ষণ সে আমার উচিত দাবিকে রক্ষা করবে। সে যদি আমাকে মানুষ বলে গণ্য না করে, আমাকে কলের পুতুল করে বানাতে চায়, আমিও তাকে ফুলচন্দন দিয়ে পূজা করব না–লোহার কল বলেই গণ্য করব।”

গোরা কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি ব্রাহ্ম হবে?”

বিনয় কহিল, “না।”

গোরা কহিল, “ললিতাকে তুমি বিয়ে করবে?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুবিবাহ?”

বিনয় কহিল, “হাঁ।”

গোরা। পরেশবাবু তাতে সম্মত আছেন?

বিনয়। এই তাঁর চিঠি।

গোরা পরেশের চিঠি দুইবার করিয়া পড়িল। তাহার শেষ অংশে ছিল–

“আমার ভালো মন্দ লাগার কোনো কথা তুলিব না, তোমাদের সুবিধা-অসুবিধার কোনো কথাও পাড়িতে চাই না। আমার মত-বিশ্বাস কী, আমার সমাজ কী, সে তোমরা জান, ললিতা ছেলেবেলা হইতে কী শিক্ষা পাইয়াছে এবং কী সংস্কারের মধ্যে মানুষ হইয়াছে তাও তোমাদের অবিদিত নাই। এ-সমস্তই জানিয়া শুনিয়া তোমাদের পথ তোমরা নির্বাচন করিয়া লইয়াছ। আমার আর কিছুই বলিবার নাই। মনে করিয়ো না, আমি কিছুই না ভাবিয়া অথবা ভাবিয়া না পাইয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছি। আমার যতদূর শক্তি আমি চিন্তা করিয়াছি। ইহা বুঝিয়াছি তোমাদের মিলনকে বাধা দিবার কোনো ধর্মসংগত কারণ নাই, কেননা, তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। এ স্থলে সমাজে যদি কোনো বাধা থাকে তবে তাহাকে স্বীকার করিতে তোমরা বাধ্য নও। আমার কেবল এইটুকুমাত্র বলিবার আছে, সমাজকে যদি তোমরা লঙ্ঘন করিতে চাও তবে সমাজের চেয়ে তোমাদিগকে বড়ো হইতে হইবে। তোমাদের প্রেম, তোমাদের সম্মিলিত জীবন, কেবল যেন প্রলয়শক্তির সূচনা না করে, তাহাতে সৃষ্টি ও স্থিতির তত্ত্ব থাকে যেন। কেবল এই একটা কাজের মধ্যে হঠাৎ একটা দুঃসাহসিকতা প্রকাশ করিলে চলিবে না, ইহার পরে তোমাদের জীবনের সমস্ত কাজকে বীরত্বের সূত্রে গাঁথিয়া তুলিতে হইবে–নহিলে তোমরা অত্যন্ত নামিয়া পড়িবে। কেননা, বাহির হইতে সমাজ তোমাদিগতে সর্বসাধারণের সমান ক্ষেত্রে আর বহন করিয়া রাখিবে না, তোমরা নিজের শক্তিতে এই সাধারণের চেয়ে বড়ো যদি না হও তবে সাধারণের চেয়ে তোমাদিগকে নামিয়া যাইতে হইবে। তোমাদের ভবিষ্যৎ শুভাশুভের জন্য আমার মনে যথেষ্ট আশঙ্কা রহিল। কিন্তু এই আশঙ্কার দ্বারা তোমাদিগতে বাধা দিবার কোনো অধিকার আমার নাই- কারণ, পৃথিবীতে যাহারা সাহস করিয়া নিজের জীবনের দ্বারা নব নব সমস্যার মীমাংসা করিতে প্রস্তুত হয় তাহারাই সমাজকে বড়ো করিয়া তুলে। যাহারা কেবলই বিধি মানিয়া চলে তাহারা সমাজকে বহন করে মাত্র, তাহাকে অগ্রসর করে না। অতএব আমার ভীরুতা আমার দুশ্চিন্তা লইয়া তোমাদের পথ আমি রোধ করিব না। তোমরা যাহা ভালো বুঝিয়াছ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাহা পালন করো, ঈশ্বর তোমাদের সহায় হউন। ঈশ্বর কোনো-এক অবস্থার মধ্যে তাঁহার সৃষ্টিকে শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখেন না, তাহাকে নব নব পরিণতির মধ্যে চির নবীন করিয়া জাগাইয়া তুলিতেছেন; তোমরা তাঁহার সেই উদ্‌বোধনের দূতরূপে নিজের জীবনকে মশালের মতো জ্বালাইয়া দুর্গম পথে অগ্রসর হইতে চলিয়াছ, যিনি বিশ্বের পথচালক তিনিই তোমাদিগকে পথ দেখান–আমার পথেই তোমাদিগকে চিরদিন চলিতে হইবে এমন অনুশাসন আমি প্রয়োগ করিতে পারিব না। তোমাদের বয়সে আমরাও একদিন ঘাট হইতে রশি খুলিয়া ঝড়ের মুখে নৌকা ভাসাইয়াছিলাম, কাহারো নিষেধ শুনি নাই। আজও তাহার জন্য অনুতাপ করি না। যদিই অনুতাপ করিবার কারণ ঘটিত তাহাতেই বা কী? মানুষ ভুল করিবে, ব্যর্থও হইবে, দুঃখও পাইবে, কিন্তু বসিয়া থাকিবে না; যাহা উচিত বলিয়া জানিবে তাহার জন্য আত্মসমর্পণ করিবে; এমনি করিয়াই পবিত্রসলিলা সংসারনদীর স্রোত চিরদিন প্রবহমান হইয়া বিশুদ্ধ থাকিবে। ইহাতে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য তীর ভাঙিয়া ক্ষতি করিতে পারে এই আশঙ্কা করিয়া চিরদিনের জন্য স্রোত বাঁধিয়া দিলে মারীকে আহ্বান করিয়া আনা হইবে–ইহা আমি নিশ্চয় জানি। অতএব, যে শক্তি তোমাদিগকে দুর্নিবার বেগে সুখ স্বচ্ছন্দতা ও সমাজবিধির বাহিরে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিয়াছেন তাঁহাকেই ভক্তির সহিত প্রণাম করিয়া তাঁহারই হস্তে তোমাদের দুইজনকে সমর্পণ করিলাম, তিনিই তোমাদের জীবনে সমস্ত নিন্দাগ্লানি ও আত্মীয়বিচ্ছেদকে সার্থক করিয়া তুলুন। তিনিই তোমাদিগকে দুর্গম পথে আহ্বান করিয়াছেন, তিনিই তোমাদিগকে গম্যস্থানে লইয়া যাইবেন।’

গোরা এই চিঠি পড়িয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলে পর বিনয় কহিল, “পরেশবাবু তার দিক যেমন সম্মতি দিয়েছেন, তেমনি তোমার দিক থেকেও গোরা তোমাকে সম্মতি দিতে হবে।”

গোরা কহিল, “পরেশবাবু সম্মতি দিতে পারেন, কেননা নদীর যে ধারা কূল ভাঙছে সেই ধারাই তাঁদের। আমি সম্মতি দিতে পারি নে, কেননা আমাদের ধারা কূলকে রক্ষা করে। আমাদের এই কূলে শতসহস্র বৎসরের অভ্রভেদী কীর্তি রয়েছে, আমরা কোনোমতেই বলতে পারব না এখানে প্রকৃতির নিয়মই কাজ করতে থাক্‌। আমাদের কূলকে আমরা পাথর দিয়েই বাঁধিয়ে রাখব, তাতে আমাদের নিন্দাই কর আর যাই কর। এ আমাদের পবিত্র প্রাচীন পুরী–এর উপরে বৎসরে বৎসরে নূতন মাটির পলি পড়বে আর চাষার দলে লাঙল নিয়ে এর জমি চষবে, এটা আমাদের অভিপ্রেত নয়, তাতে আমাদের যা লোকসান হয় হোক। এ আমাদের বাস করবার, এ চাষ করবার নয়। অতএব তোমাদের কৃষিবিভাগ থেকে আমাদের এই পাথরগুলোকে যখন কঠিন বলে নিন্দা কর তখন তাতে আমরা মর্মান্তিক লজ্জা বোধ করি নে।”

বিনয় কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি আমাদের এই বিবাহকে স্বীকার করবে না।”

গোরা কহিল, “নিশ্চয় করব না।”

বিনয় কহিল, “এবং–”

গোরা কহিল, “এবং তোমাদের ত্যাগ করব।”

বিনয় কহিল, “আমি যদি তোমার মুসলমান বন্ধু হতুম?”

গোরা কহিল, “তা হলে অন্য কথা হত। গাছের আপন ডাল ভেঙে প’ড়ে যদি পর হয়ে যায় তবে গাছ তাকে কোনোমতেই পূর্বের মতো আপন করে ফিরে নিতে পারে না, কিন্তু বাইরে থেকে যে লতা এগিয়ে আসে তাকে সে আশ্রয় দিতে পারে, এমন-কি, ঝড়ে ভেঙে পড়লে আবার তাকে তুলে নিতে কোনো বাধা থাকে না। আপন যখন পর হয় তখন তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া আন্য কোনো গতি নেই। সেইজন্যেই তো এত বিধিনিষেধ, এত প্রাণপণ টানাটানি।”

বিনয় কহিল, “সেইজন্যেই তো ত্যাগের কারণ অত হালকা এবং ত্যাগের বিধান অত সুলভ হওয়া উচিত ছিল না। হাত ভাঙলে আর জোড়া লাগে না বটে, সেইজন্যেই কথায় কথায় হাত ভাঙেও না। তার হাড় খুব মজবুত। যে সমাজে অতি সামান্য ঘা লাগলেই বিচ্ছেদ ঘটে এবং সে বিচ্ছেদ চিরবিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ায় সে সমাজে মানুষের পক্ষে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা–কাজকর্ম করার পক্ষে বাধা কত সে কথা কি চিন্তা করে দেখবে না?”

গোরা কহিল, “সে চিন্তার ভার আমার উপর নেই। সমাজ এমন সমগ্রভাবে এমন বড়োরকম করে চিন্তা করছে যে আমি টেরও পাচ্ছিনে সে ভাবছে। হাজার হাজার বৎসর ধরে সে ভেবেওছে এবং আপনাকে রক্ষাও করে এসেছে, এই আমার ভরসা। পৃথিবী সূর্যের চারি দিকে বেঁকে চলছে কি সোজা চলছে, ভুল করছে কি করছে না, সে যেমন আমি ভাবি নে এবং না ভেবে আজ পর্যন্ত আমি ঠকি নি–আমার সমাজ সম্বন্ধেও আমার সেই ভাব।”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “ভাই গোরা, ঠিক এই-সব কথা আমিও এতদিন এমনি করেই বলে এসেছি, আজ আবার আমাকেও সে কথা শুনতে হবে তা কে জানত! কথা বানিয়ে বলবার শাস্তি আজ আমাকে ভোগ করতে হবে সে আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তর্ক করে কোনো লাভ নেই। কেননা, একটা কথা আমি আজ খুব নিকটের থেকে দেখতে পেয়েছি, সেটি পূর্বে দেখি নি–আজ বুঝেছি মানুষের জীবনের গতি মহানদীর মতো, সে আপনার বেগে অভাবনীয় রূপে এমন নূতন নূতন দিকে পথ করে নয় যে দিকে পূর্বে তার স্রোত ছিল না। এই তার গতির বৈচিত্র৻–তার অভাবনীয় পরিণতিই বিধাতার অভিপ্রায়; সে কাটা খাল নয়, তাকে বাঁধা পথে রাখা চলবে না। নিজের মধ্যেই যখন এ কথাটা একেবারে প্রত্যক্ষ হয়েছে তখন কোনো সাজানো কথায় আর আমাকে কোনোদিন ভোলাতে পারবে না।”

গোরা কহিল, “পতঙ্গ যখন বহ্নির মুখে পড়তে চলে সেও তখন তোমার মতো ঠিক ঐরকম তর্কই করে, অতএব তোমাকে আমিও আজ বোঝাবার কোনো বৃথা চেষ্টা করব না।”

বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া কহিল, “সেই ভালো, তবে চললুম, একবার মার সঙ্গে দেখা করে আসি।”

বিনয় চলিয়া গেল, মহিম ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। পান চিবাইতে চিবাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুবিধা হল না বুঝি? হবেও না। কতদিন থেকে বলে আসছি, সাবধান হও, বিগড়াবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে–কথাটা কানেই আনলে না। সেই সময়ে জোর-জার করে কোনোমতে শশিমুখীর সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে কোনো কথাই থাকত না। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! বলি বা কাকে! নিজে যেটি বুঝবে না সে তো মাথা খুঁড়েও বুঝানো যাবে না। এখন বিনয়ের মতো ছেলে তোমার দল ভেঙে গেল এ কি কম আপসোসের কথা!”

গোরা কোনো উত্তর করিল না। মহিম কহিলেন, “তা হলে বিনয়কে ফেরাতে পারলে না? তা যাক, কিন্তু শশিমুখীর সঙ্গে ওর বিবাহের কথাটা নিয়ে কিছু বেশি গোলমাল হয়ে গেছে। এখন শশীর বিয়ে দিতে আর দেরি করলে চলবে না–জানোই তো আমাদের সমাজের গতিক, যদি একটা মানুষকে কায়দায় পেলে তবে তাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ে। তাই একটি পাত্র–না, তোমার ভয় নেই, তোমাকে ঘটকালি করতে হবে না; সে আমি নিজেই ঠিকঠাক করে নিয়েছি।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “পাত্রটি কে?”

মহিম কহিলেন, “তোমাদের অবিনাশ।”

গোরা কহিল, “সে রাজি হয়েছে?”

মহিম কহিলেন, “রাজি হবে না! এ কি তোমার বিনয় পেয়েছ? না, যাই বলো, দেখা গেল তোমার দলের মধ্যে ঐ অবিনাশ ছেলেটি তোমার ভক্ত বটে। তোমার পরিবারের সঙ্গে তার যোগ হবে এ কথা শুনে সে তো আহ্লাদে নেচে উঠল। বললে, এ আমার ভাগ্য, এ আমার গৌরব। টাকাকড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলুম, সে অমনি কানে হাত দিয়ে বললে, মাপ করবেন, ও-সব কথা আমাকে কিছুই বলবেন না। আমি বললুম, আচ্ছা, সে-সব কথা তোমার বাবার সঙ্গে হবে। তার বাপের কাছেও গিয়েছিলুম। ছেলের সঙ্গে বাপের অনেক তফাত দেখা গেল। টাকার কথায় বাপ মোটেই কানে হাত দিলে না, বরঞ্চ এমনি আরম্ভ করলে যে আমারই কানে হাত ওঠবার জো হল। ছেলেটিও দেখলুম এ-সকল বিষয়ে অত্যন্ত পিতৃভক্ত, একেবারে পিতা হি পরমং তপঃ–তাকে মধ্যস্থ রেখে কোনো ফল হবে না। এবারে কোম্পানির কাগজটা না ভাঙিয়ে কাজ সারা হল না। তা যাই হোক,তুমিও অবিনাশকে দুই-এক কথা বলে দিয়ো। তোমার মুখ থেকে উৎসাহ পেলে–”

গোরা কহিল, “টাকার অঙ্ক তাতে কিছু কমবে না।”

মহিম কহিলেন, “তা জানি, পিতৃভক্তিটা যখন কাজে লাগবার মতো হয় তখন সামলানো শক্ত।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল,”কথাটা পাকা হয়ে গেছে?”

মহিম কহিলেন, “হাঁ।”

গোরা। দিনক্ষণ একেবারে স্থির?

মহিম। স্থির বৈকি, মাঘের পূর্ণিমাতিথিতে। সে আর বেশি দেরি নেই। বাপ বলেছেন, হীরে-মানিকে কাজ নেই, কিন্তু খুব ভারী সোনার গয়না চাই। এখন কী করলে সোনার দর না বাড়িয়ে সোনার ভার বাড়াতে পারি স্যাক্‌রার সঙ্গে কিছু দিন তারই পরামর্শ করতে হবে।

গোরা কহিল, “কিন্তু এত বেশি তাড়াতাড়ি করবার কী দরকার আছে? অবিনাশ যে অল্পদিনের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজে ঢুকবে এমন আশঙ্কা নেই।”

মহিম কহিলেন, “তা নেই বটে, কিন্তু বাবার শরীর ইদানীং বড়ো খারাপ হয়ে উঠেছে সেটা তোমরা লক্ষ্য করে দেখছ না। ডাক্তারেরা যতই আপত্তি করছে ওঁর নিয়মের মাত্রা আরো ততই বাড়িয়ে তুলছেন। আজকাল যে সন্ন্যাসী ওঁর সঙ্গে জুটেছে সে ওঁকে তিন বেলা স্নান করায়, তার উপরে আবার এমনি হঠযোগ লাগিয়েছে যে চোখের তারা-ভুরু নিশ্বাসপ্রশ্বাস নাড়িটাড়ি সমস্ত একেবারে উলটোপালটা হবার জো হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে শশীর বিয়েটা হয়ে গেলেই সুবিধা হয়– ওঁর পেন্‌শনের জমা টাকাটা ওঙ্কারানন্দস্বামীর হাতে পড়বার পূর্বেই কাজটা সারতে পারলে আমাকে বেশি ভাবতে হয় না। বাবার কাছে কথাটা কাল পেড়েওছিলুম, দেখলুম বড়ো সহজ ব্যাপার নয়। ভেবেছি ঐ সন্ন্যাসী বেটাকে কিছুদিন খুব কষে গাঁজা খাইয়ে বশ করে নিয়ে, ওরই দ্বারা কাজ উদ্ধার করতে হবে। যারা গৃহস্থ, যাদের টাকার দরকার সব চেয়ে বেশি, বাবার টাকা তাদের ভোগে আসবে না এটা তুমি নিশ্চয় জেনো। আমার মুশকিল হয়েছে এই যে, অন্যের বাবা কষে টাকা তলব করে আর নিজের বাবা টাকা দেবার কথা শুনলেই প্রাণায়াম করতে বসে যায়। আমি এখন ঐ এগারো বছরের মেয়েটাকে গলায় বেঁধে কি জলে ডুব দিয়ে মরব?”

হরিমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী, কাল রাত্রে তুমি কিছু খেলে না কেন?”

সুচরিতা বিস্মিত হইয়া কহিল, ” কেন, খেয়েছি বৈকি।”

হরিমোহিনী তাহার ঢাকা খাবার দেখাইয়া কহিলেন, “কোথায় খেয়েছ? ঐ-যে পড়ে রয়েছে।”

তখন সুচরিতা বুঝিল, কাল খাবার কথা তাহার মনেই ছিল না।

হরিমোহিনী রুক্ষ স্বরে কহিলেন, “এ-সব তো ভালো কথা নয়। আমি তোমাদের পরেশবাবুকে যতদূর জানি, তিনি যে এতদূর সব বাড়াবাড়ি ভালোবাসেন তা তো আমার মনে হয় না–তাঁকে দেখলে মানুষের মন শান্ত হয়। তোমার আজকালকার ভাবগতিক তিনি যদি সব জানতে পারেন তা হলে কী বলবেন বলো দেখি।”

হরিমোহিনীর কথার লক্ষ্যটা কী তাহা সুচরিতার বুঝতে বাকি রহিল না। প্রথমটা মুহূর্তকালের জন্য তাহার মনের মধ্যে সংকোচ আসিয়াছিল। গোরার সহিত তাহার সম্বন্ধকে নিতান্ত সাধারণ স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধের সহিত সমান করিয়া এমনতরো একটা অপবাদের কটাক্ষ যে তাহাদের উপরে পড়িতে পারে এ কথা সে কখনো চিন্তাই করে নাই। সেইজন্য হরিমোহিনীর বক্রোক্তিতে সে কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। কিন্তু পরক্ষণেই হাতের কাজ ফেলিয়া সে খাড়া হইয়া বসিল এবং হরিমোহিনীর মুখের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিল।

গোরার কথা লইয়া সে মনের মধ্যে কাহারো কাছে কোনো লজ্জা রাখিবে না ইহা মুহূর্তের মধ্যে সে স্থির করিল, এবং কহিল, “মাসি, তুমি তো জান, কাল গৌরমোহনবাবু এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের বিষয়টি আমার মনকে খুব অধিকার করে বসেছিল, সেইজন্যে আমি খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। তুমি থাকলে কাল অনেক কথা শুনতে পেতে।

হরিমোহিনী যেমন কথা শুনিতে চান গোরার কথা ঠিক তেমনটি নহে। ভক্তির কথা শুনিতেই তাঁহার আকাঙক্ষা; গোরার মুখে ভক্তির কথা তেমন সরল ও সরস হইয়া বাজিয়া ওঠে না। গোরার সম্মুখে বরাবর যেন একজন প্রতিপক্ষ আছে; তাহার বিরুদ্ধে গোরা কেবলই লড়াই করিতেছে। যাহারা মানে না তাহাদিগকে সে মানাইতে চায়, কিন্তু যে মানে তাহাকে সে কী বলিবে। যাহা লইয়া গোরার উত্তেজনা হরিমোহিনী তাহাতে সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্রাহ্মসমাজের লোক যদি হিন্দুসমাজের সহিত না মিলিয়া নিজের মত লইয়া থাকে তাহাতে তাঁহার আন্তরিক ক্ষোভ কিছুই নাই, তাঁহার নিজের প্রিয়জনগুলির সহিত তাঁহার বিচ্ছেদের কোনো কারণ না ঘটিলেই তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন। এইজন্য গোরার সঙ্গে আলাপ করিয়া তাঁহার হৃদয় লেশমাত্র রস পায় নাই। ইহার পরে হরিমোহিনী যখনই অনুভব করিলেন গোরাই সুচরিতার মনকে অধিকার করিয়াছে তখনই গোরার কথাবার্তা তাঁহার কাছে আরো বেশি অরুচিকর ঠেকিতে লাগিল। সুচরিতা আর্থিক বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং মতে বিশ্বাসে আচরণে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এইজন্য সুচরিতাকে কোনো দিক দিয়া হরিমোহিনী সর্বতোভাবে আয়ত্ত করিতে পারেন নাই, অথচ সুচরিতাই শেষ বয়সে হরিমোহিনীর একটিমাত্র অবলম্বন এই কারণেই সুচরিতার প্রতি পরেশবাবুর ছাড়া আর কাহারো কোনোপ্রকার আধিকার হরিমোহিনীকে নিতান্ত বিক্ষুদ্ধ করিয়া তোলে। হরিমোহিনীর কেবলই মনে হইতে লাগিল গোরার আগাগোড়া সমস্তই কৃত্রিমতা, তাহার আসল মনের লক্ষ্য কোনোরকম ছলে সুচরিতার চিত্ত আকর্ষণ করা। এমন-কি, সুচরতার নিজের যে বিষয়সম্পত্তি আছে তাহার প্রতিও মুখ্যভাবে গোরার লুব্ধতা আছে বলিয়া হরিমোহিনী কল্পনা করিতে লাগিলেন। গোরাকেই হরিমোহিনী তাঁহার প্রধান শত্রু স্থির করিয়া তাহাকে বাধা দিবার জন্য মনে মনে কোমর বাঁধিয়া দাঁড়াইলেন।

সুচরিতার বাড়িতে আজ গোরার যাইবার কোনো কথা ছিল না, কোনো কারণও ছিল না। কিন্তু গোরার স্বভাবে দ্বিধা জিনিসটা অত্যন্ত কম। সে যখন কিছুতে প্রবৃত্ত হয় তখন সে সম্বন্ধে সে চিন্তাই করে না। একেবারে তীরের মতো সোজা চলিয়া যায়।

আজ প্রাতঃকালে সুচরিতার ঘরে গিয়া গোরা যখন উঠিল তখন হরিমোহিনী পূজায় প্রবৃত্ত ছিলেন। সুচরিতা তাহার বসিবার ঘরে টেবিলের উপরকার বই খাতা কাগজ প্রভৃতি পরিপাটি করিয়া গুছাইয়া রাখিতেছিল, এমন সময় সতীশ আসিয়া যখন খবর দিল গৌরবাবু আসিয়াছেন তখন সুচরিতা বিশেষ বিস্ময় অনুভব করিল না। সে যেন মনে করিয়াছিল, আজ গোরা আসিবে।

গোরা চৌকিতে বসিয়া কহিল, “শেষকালে বিনয় আমাদের ত্যাগ করলে?”

সুচরিতা কহিল, “কেন, ত্যাগ করবেন কেন, তিনি তো ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন নি।”

গোরা কহিল, “ব্রাহ্মসমাজে বেরিয়ে গেলে তিনি এর চেয়ে আমাদের বেশি কাছে থাকতেন। তিনি হিন্দুসমাজকে আঁকড়ে ধরে আছেন বলেই একে সব চেয়ে বেশি পীড়ন করছেন। এর চেয়ে আমাদের সমাজকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেই তিনি ভালো করতেন।”

সুচরিতা মনের মধ্যে একটা কঠিন বেদনা পাইয়া কহিল, “আপনি সমাজকে এমন অতিশয় একান্ত করে দেখেন কেন? সমাজের উপর আপনি যে এত বেশি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এ কি আপনার পক্ষে স্বাভাবিক? না, অনেকটা নিজের উপর জোর প্রয়োগ করেন?”

গোরা কহিল, “এখনকার অবস্থায় এই জোর প্রয়োগ করাটাই যে স্বাভাবিক। পায়ের নীচে যখন মাটি টলতে থাকে তখন প্রত্যেক পদেই পায়ের উপর বেশি করে জোর দিতে হয়। এখন যে চারি দিকেই বিরুদ্ধতা, সেইজন্য আমাদের বাক্যে এবং ব্যবহারে একটা বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায়। সেটা অস্বাভাবিক নয়।”

সুচরিতা কহিল, “চারি দিকে যে বিরুদ্ধতা দেখছেন সেটাকে আপনি আগাগোড়া অন্যায় এবং অনাবশ্যক কেন মনে করছেন? সমাজ যদি কালের গতিকে বাধা দেয় তা হলে সমাজকে যে আঘাত পেতেই হবে।”

গোরা কহিল, “কালের গতি হচ্ছে জলের ঢেউয়ের মতো, তাকে ডাঙাকে ভাঙতে থাকে, কিন্তু সেই ভাঙনকে স্বীকার করে নেইয়াই যে ডাঙার কর্তব্য আমি তা মনে করি নে। তুমি মনে কোরো না সমাজের ভালোমন্দ আমি কিছুই বিচার করি নে। সেরকম বিচার করা এতই সহজ যে, এখনকার কালের ষোলো বছরের বালকও বিচারক হয়ে উঠেছে। কিন্তু শক্ত হচ্ছে সমগ্র জিনিসকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে সমগ্র ভাবে দেখতে পাওয়া।”

সুচরিতা কহিল, “শ্রদ্ধার দ্বারা আমরা কি কেবল সত্যকেই পাই? তাতে করে মিথ্যাকেও তো আমরা অবিচারে গ্রহণ করি? আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি পৌত্তলিকতাকেও শ্রদ্ধা করতে পারি? আপনি কি এ-সমস্ত সত্য বলেই বিশ্বাস করেন?”

গোরা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আমি তোমাকে ঠিক সত্য কথাটা বলবার চেষ্টা করব। আমি গোড়াতেই এগুলিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছি। য়ুরোপীয় সংস্কারের সঙ্গে এদের বিরোধ আছে বলেই এবং এদের বিরুদ্ধে কতকগুলি অত্যন্ত সস্তা যুক্তি প্রয়োগ করা যায় বললেই আমি তাড়াতাড়ি এদের জবাব দিয়ে বসি নি। ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকারপূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপূজাতেই যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিণতি নেই, এ কথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের মতো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্যে, এমন-কি, বিজ্ঞানে ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোন কাজ নেই এ কথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষের সফল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তিপূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের কাছে অন্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণতর সত্য হয়ে ওঠে নি?”

সুচরিতা কহিল, “গ্রীসে রোমেও তো মূর্তিপূজা ছিল।”

গোরা কহিল, “সেখানকার মূর্তিতে মানুষের কল্পনা সৌন্দর্যবোধকে যতটা আশ্রয় করেছিল জ্ঞানভক্তিকে ততটা নয়। আমাদের দেশে কল্পনা জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে গভীররূপে জড়িত। আমাদের কৃষ্ণরাধাই বলো, হরপার্বতীই বলো, কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পূজার বিষয় নয়, তার মধ্যে মানুষের চিরন্তন তত্ত্বজ্ঞানের রূপ রয়েছে। সেইজন্যই রামপ্রসাদের, চৈতন্যদেবের ভক্তি এই-সমস্ত মূর্তিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তির এমন একান্ত প্রকাশ গ্রীস-রোমের ইতিহাসে কবে দেখা দিয়েছে?”

সুচরিতা কহিল,”কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও সমাজের কোনো পরিবর্তন আপনি একেবারে স্বীকার করতে চান না?”

গোরা কহিল, “কেন চাইব না? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে–ছেলেমানুষ ক্রমে বুড়োমানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর-বিড়াল হয় না। ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই , হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পণ্ড ও নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের শক্তি, দেশের ঐশ্বর্য, দেশের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে সেইটে আমি তোমাদের জানাবার জন্যই আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কথা বুঝতে পারছ?”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ, বুঝতে পারছি। কিন্তু এ-সব কথা আমি কখনো পূর্বে শুনি নি এবং ভাবি নি। নতুন জায়গায় গিয়ে পড়লে খুব স্পষ্ট জিনিসেরও পরিচয় হতে যেমন বিলম্ব ঘটে আমার তেমনি হচ্ছে। বোধ হয় আমি স্ত্রীলোক বলেই আমার উপলব্ধিতে জোর পৌঁচচ্ছে না।”

গোরা বলিয়া উঠিল, “কখনোই না। আমি তো অনেক পুরুষকে জানি, এই-সব আলাপ-আলোচনা আমি তাদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে করে আসছি, তারা নিঃসংশয়ে ঠিক করে বসে আছে তারা খুব বুঝেছে ; কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, তোমার মনের সামনে তুমি আজ যেটি দেখতে পাচ্ছ তারা একটি লোকও তার একটুও দেখে নি। তোমার মধ্যে সেই গভীর দৃষ্টিশক্তি আছে সে আমি তোমাকে দেখেই অনুভব করেছিলুম ; সেইজন্যেই আমি আমার এতকালের হৃদয়ের সমস্ত কথা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি, আমার সমস্ত জীবনকে তোমার সামনে মেলে দিয়েছি, কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করি নি।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি অমন করে যখন বলেন আমার মনের মধ্যে ভারি একটা ব্যাকুলতা বোধ হয়। আমার কাছ থেকে আপনি কী আশা করছেন, আমি তার কী দিতে পারি, আমাকে কী কাজ করতে হবে, আমার মধ্যে যে-একটা ভাবের আবেগ আসছে তার প্রকাশ যে কিরকম আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে। আমার কেবলই ভয় হতে থাকে আমার উপরে আপনি যে বিশ্বাস রেখেছেন সে পাছে সমস্তই ভুল বলে একদিন আপনার কাছে ধরা পড়ে।”

গোরা মেঘগম্ভীরকণ্ঠে কহিল, “সেখানে ভুল কোথাও নেই। তোমার ভিতরে যে কতবড়ো শক্তি আছে সে আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব। তুমি কিছুমাত্র উৎকণ্ঠা মনে রেখো না– তোমার যে যোগ্যতা সে প্রকাশ করে তোলবার ভার আমার উপরে রয়েছে, আমার উপরে তুমি নির্ভর করো।”

সুচরিতা কোনো কথা কহিল না, কিন্তু নির্ভর করিতে তাহার যে কিছুই বাকি নাই কথাটি নিঃশব্দে ব্যক্ত হইল। গোরাও চুপ করিয়া রহিল, ঘরে অনেকক্ষণ কোনো শব্দই রহিল না। বাহিরে গলিতে পুরানো-বাসন-ওয়ালা পিতলের পাত্রে ঝন্‌ ঝন্‌ শব্দ করিয়া দ্বারের সম্মুখ দিয়া হাঁকিতে হাঁকিতে চলিয়া গেল।

হরিমোহিনী তাঁহার পূজাহ্নিক শেষ করিয়া পাকশালায় যাইতেছিলেন। সুচরিতার নিঃশব্দ ঘরে যে কোনো লোক আছে তাহা তাঁহার মনেও হয় নাই; কিন্তু ঘরের দিকে হঠাৎ চাহিয়া হরিমোহিনী যখন দেখিলেন সুচরিতা ও গোরা চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতেছে, উভয়ে কোনোপ্রকার শিষ্টালাপমাত্রও করিতেছে না, তখন এক মুহূর্তে তাঁহার ক্রোধের শিখা ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত যেন বিদ্যুদ্‌বেগে জ্বলিয়া উঠিল। আত্মসংবরণ করিয়া তিনি দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, “রাধারানী!”

সুচরিতা উঠিয়া তাঁহার কাছে আসিলে তিনি মৃদুস্বরে কহিলেন, “আজ একাদশী, আমার শরীর ভালো নেই, যাও তুমি রান্নাঘরে গিয়ে উনানটা ধরাও গে–আমি ততক্ষণ গৌরবাবুর কাছে একটু বসি।”

সুচরিতা মাসির ভাব দেখিয়া উদ্‌বিগ্ন হইয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল। হরিমোহিনী ঘরে প্রবেশ করিতে গোরা তাঁহাকে প্রণাম করিল। তিনি কোনো কথা না কহিয়া চৌকিতে বসিলেন। কিছুক্ষণ ঠোঁট চাপিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “তুমি তো বাবা, ব্রাহ্ম নও?”

গোরা কহিল, “না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “আমাদের হিন্দুসমাজকে তুমি তো মান?”

গোরা কহিল, “মানি বৈকি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে তোমার এ কী রকম ব্যবহার?”

গোরা হরিমোহিনীর অভিযোগ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানীর বয়স হয়েছে, তোমরা তো ওর আত্মীয় নও–ওর সঙ্গে তোমাদের এত কী কথা! ও মেয়েমানুষ, ঘরের কাজকর্ম করবে, ওরই বা এ-সব কথায় থাকবার দরকার কী? ওতে যে ওর মন অন্য দিকে নিয়ে যায়। তুমি তো জ্ঞানী লোক, দেশসুদ্ধ সকলেই তোমার প্রশংসা করে, কিন্তু এ-সব আমাদের দেশে কবেই বা ছিল, আর কোন্‌ শাস্ত্রেই বা লেখে!”

গোরা হঠাৎ একটা মস্ত ধাক্কা পাইল। সুচরিতার সম্বন্ধে এমন কথা যে কোনো পক্ষ হইতে উঠিতে পারে তাহা সে চিন্তাও করে নাই। সে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “ইনি ব্রাহ্মসমাজে আছেন, বরাবর এঁকে এইরকম সকলের সঙ্গে মিশতে দেখেছি, সেইজন্যে আমার কিছু মনে হয় নি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা, ঐ নাহয় ব্রাহ্মসমাজে আছে, কিন্তু তুমি তো এ-সব কখনো ভালো বলো না। তোমার কথা শুনে আজকালকার কত লোকের চৈতন্য হচ্ছে,আর তোমার ব্যবহার এরকম হলে লোকে তোমাকে মানবে কেন? এই-যে কাল রাত্রি পর্যন্ত ওর সঙ্গে তুমি কথা কয়ে গেলে, তাতেও তোমার কথা শেষ হল না–আবার আজ সকালেই এসেছ! সকাল থেকে ও আজ না গেল ভাঁড়ারে, না গেল রান্নাঘরে, আজ একাদশীর দিনে আমাকে যে একটু সাহায্য করবে তাও ওর মনে হল না–এ ওর কী রকম শিক্ষা হচ্ছে! তোমাদের নিজের ঘরেও তো মেয়ে আছে, তাদের নিয়ে কি সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে তুমি এইরকম শিক্ষা দিচ্ছ–না, আর-কেউ দিলে তুমি ভালো বোধ কর?”

গোরার তরফে এ-সব কথার কোনো উত্তর ছিল না। সে কেবল কহিল, “ইনি এইরকম শিক্ষাতেই মানুষ হয়েছেন বলে আমি এঁর সম্বন্ধে কিছু বিবেচনা করি নি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “ও যে শিক্ষাই পেয়ে থাক্‌ যতদিন আমার কাছে আছে আর আমি বেঁচে আছি এ-সব চলবে না। ওকে আমি অনেকটা ফিরিয়ে এনেছি। ও যখন পরেশবাবুর বাড়িতে ছিল তখনই তো আমার সঙ্গে মিশে ও হিঁদু হয়ে গেছে রব উঠেছিল। তার পরে এ বাড়িতে এসে তোমাদের বিনয়ের সঙ্গে কী জানি কী সব কথাবার্তা হতে লাগল, আবার সব উলটে গেল। তিনি তো আজ ব্রাহ্মঘরে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। যাক্‌! অনেক কষ্টে বিনয়কে তো বিদায় করেছি। তার পরে হারানবাবু বলে একটি লোক আসত; সে এলেই আমি রাধারানীকে নিয়ে আমার উপরের ঘরে বসতুম, সে আর আমল পেল না। এমনি করে অনেক দুঃখে ওর আজকাল আবার যেন একটু মতি ফিরেছে বলে বোধ হচ্ছে। এ বাড়িতে এসে ও আবার সকলের ছোঁওয়া খেতে আরম্ভ করেছিল, কাল দেখলুম সেটা বন্ধ করেছে। কাল রান্নাঘর থেকে নিজের ভাত নিজেই নিয়ে গেল, বেহারাকে জল আনতে বারণ করে দিলে। এখন, বাপু, তোমার কাছে জোড়-হাতে আমার এই মিনতি, তোমরা ওকে আর মাটি কোরো না। সংসারে আমার যে-কেউ ছিল সব মরে ঝরে কেবল ঐ একটিতে এসে ঠেকেছে, ওরও ঠিক আপন বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। ওদের ঘরে আরো তো ঢের বড়ো বড়ো মেয়ে আছে–ঐ লাবণ্য আছে, লীলা আছে, তারাও বুদ্ধিমতী, পড়াশুনা করেছে; যদি তোমার কিছু বলবার থাকে ওদের কাছে গিয়ে বলো গে, কেউ তোমাকে মানা করবে না।”

গোরা একেবারে স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। হরিমোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, ” ভেবে দেখো, ওকে তো বিয়েথাওয়া করতে হবে, বয়স তো যথেষ্ট হয়েছে। তুমি কি বল ও চিরদিন এইরকম আইবুড়ো হয়েই থাকবে? গৃহধর্ম করাটা তো মেয়ে মানুষের দরকার।”

সাধারণভাবে এ সম্বন্ধে গোরার কোনো সংশয় ছিল না–তাহারও এই মত বটে। কিন্তু সুচরিতা সম্বন্ধে নিজের মতকে সে মনে মনেও কখনো প্রয়োগ করিয়া দেখে নাই। সুচরিতা গৃহিণী হইয়া কোনো-এক গৃহস্থ-ঘরের অন্তঃপুরে ঘরকন্নায় নিযুক্ত আছে এ কল্পনা তাহার মনেও ওঠে না। যেন সুচরিতা আজও যেমন আছে বরাবর ঠিক এমনিই থাকিবে।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার বোনঝির বিবাহের কথা কিছু ভেবেছেন নাকি?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “ভাবতে হয় বৈকি, আমি না হলে আর ভাববে কে?”

গোরা প্রশ্ন করিল, “হিন্দুসমাজে কি ওঁর বিবাহ হতে পারবে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে চেষ্টা তো করতে হবে। ও যদি আর গোল না করে,বেশ ঠিকমত চলে, তা হলে ওকে বেশ চালিয়ে দিতে পারব। সে আমি মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছি, এতদিন ওর যেরকম গতিক ছিল সাহস করে কিছু করে উঠতে পারি নি। এখন আবার দুদিন থেকে দেখছি ওর মনটা নরম হয়ে আসছে, তাই ভরসা হচ্ছে।”

গোরা ভাবিল, এ সম্বন্ধে আার বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই থাকিতে পারিল না; প্রশ্ন করিল, “পাত্র কি কাউকে মনে মনে ঠিক করেছেন?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তা করেছি। পাত্রটি বেশ ভালোই– কৈলাস, আমার ছোটো দেবর। কিছু্‌দিন হল তার বউটি মারা গেছে, মনের মতো বড়ো মেয়ে পায় নি বলেই এতদিন বসে আছে, নইলে সে ছেলে কি পড়তে পায়? রাধারানীর সঙ্গে ঠিক মানাবে।”

মনের মধ্যে গোরার যতই ছুঁচ ফুটিতে লাগিল ততই সে কৈলাসের সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিল।

হরিমোহিনীর দেবরদের মধ্যে কৈলাসই নিজের বিশেষ যত্নে কিছুদূর লেখাপড়া করিয়াছিল–কতদূর, তাহা হরিমোহিনী বলিতে পারেন না। পরিবারের মধ্যে তাহারই বিদ্বান্‌ বলিয়া খ্যাতি আছে। গ্রামের পোস্ট্‌-মাস্টারের বিরুদ্ধে সদরে দরখাস্ত করিবার সময় কৈলাসই এমন আশ্চর্য ইংরাজি ভাষায় সমস্তটা লিখিয়া দিয়াছিল যে, পোস্ট্‌-আপিসের কোন্‌-এক বড়োবাবু স্বয়ং আসিয়া তদন্ত করিয়া গিয়াছিলেন। ইহাতে গ্রামবাসী সকলেই কৈলাসের ক্ষমতায় বিস্ময় অনুভব করিয়াছে। এত শিক্ষা সত্ত্বেও আচারে ধর্মে কৈলাসের নিষ্টা কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই।

কৈলাসের ইতিবৃত্ত সমস্ত বলা হইলে গোরা উঠিয়া দাঁড়াইল, হরিমোহিনীকে প্রণাম করিল এবং কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

সিঁড়ি দিয়া গোরা যখন প্রাঙ্গণে নামিয়া আসিতেছে তখন প্রাঙ্গণের অপর প্রান্তে পাকশালায় সুচরিতা কর্মে ব্যাপৃত ছিল। গোরার পদশব্দ শুনিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। গোরা কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সুচরিতা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পুনরায় পাকশালার কাজে আসিয়া নিযুক্ত হইল।

গোরা গলির মোড়ের কাছে আসিতেই হারানবাবুর সঙ্গে তাহার দেখা হইল। হারানবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “আজ সকালেই যে!”

গোরা তাহার কোনো উত্তর করিল না। হারানবাবু পুনরায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওখানে গিয়েছিলেন বুঝি? সুচরিতা বাড়ি আছে তো?”

গোরা কহিল, “হাঁ।” বলিয়াই সে হন্‌ হন্‌ করিয়া চলিয়া গেল।

হারানবাবু একেবারেই সুচরিতার বাড়িতে ঢুকিয়া রান্নাঘরের মুক্তদ্বার দিয়া তাহাকে দেখিতে পাইলেন; সুচরিতার পালাইবার পথ ছিল না, মাসিও নিকটে ছিলেন না।

হারানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “গৌরমোহনবাবুর সঙ্গে এই মাত্র দেখা হল। তিনি এখানেই এতক্ষণ ছিলেন বুঝি?”

সুচরিতা তাহার কোনো জবাব না করিয়া হঠাৎ হাঁড়িকুঁড়ি লইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিল, যেন এখন তাহার নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই এরকম ভাবটা জানাইল। কিন্তু হারানবাবু তাহাতে নিরস্ত হইলেন না। তিনি ঘরের বাহিরে সেই প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিলেন। হরিমোহিনী সিঁড়ির কাছে আসিয়া দুই-তিন বার কাশিলেন, তাহাতেও কিছুমাত্র ফল হইল না। হরিমোহিনী হারানবাবুর সম্মুখেই আসিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন, একবার যদি তিনি হারানবাবুর সম্মুখে বাহির হন তবে এ বাড়িতে এই উদ্যমশীল যুবকের অদম্য উৎসাহ হইতে তিনি এবং সুচরিতা কোথাও আত্মরক্ষা করিতে পারিবেন না। এইজন্য হারানবাবুর ছায়া দেখিলেও তিনি এতটা পরিমাণে ঘোমটা টানিয়া দেন যে তাহা তাঁহার বধূবয়সেও তাঁহার পক্ষে অতিরিক্ত বলিয়া গণ্য হইতে পারিত।

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, তোমরা কোন্‌ দিকে চলেছে বলো দেখি। কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? বোধ হয় শুনেছ ললিতার সঙ্গে বিনয়বাবুর হিন্দুমতে বিয়ে হবে? তুমি জান এজন্যে কে দায়ী?”

সুচরিতার নিকট কোনো উত্তর না পাইয়া হারানবাবু স্বর নত করিয়া গম্ভীরভাবে কহিলেন, “দায়ী তুমি।”

হারানবাবু মনে করেছিলেন, এতবড়ো একটা সাংঘাতিক অভিযোগের আঘাত সুচরিতা সহ্য করিতে পারিবে না। কিন্তু সে বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করিতে লাগিল দেখিয়া তিনি স্বর আরো গম্ভীর করিয়া সুচরিতার প্রতি তাঁহার তর্জনী প্রসারিত ও কম্পিত করিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, আমি আবার বলছি, দায়ী তুমি। বুকের উপরে ডান হাত রেখে কি বলতে পার যে, এজন্যে ব্রাহ্মসমাজের কাছে তোমাকে অপরাধী হতে হবে না?”

সুচরিতা উনানের উপরে নীরবে তেলের কড়া চাপাইয়া দিল এবং তেল চড়্‌ বড়্‌ শব্দ করিতে লাগিল।

হারান বলিতে লাগিলেন, “তুমিই বিনয়বাবুকে এবং গৌরমোহনবাবুকে তোমাদের ঘরে এনেছ এবং তাদের এতদূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছ যে, আজ তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত মান্য বন্ধুদের চেয়ে এরা দুজনেই তোমাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ফল কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? আমি কি প্রথম থেকেই বার বার সাবধান করে দিই নি? আজ কী হল? আজ ললিতাকে কে নিবৃত্ত করবে? তুমি ভাবছ ললিতার উপর দিয়েই বিপদের অবসান হয়ে গেল। তা নয়। আমি আজ তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। এবার তোমার পালা। আাজ ললিতার দুর্ঘটনায় তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে অনুতাপ করছ, কিন্তু এমন দিন অনতিদূরে এসেছে যেদিন নিজের অধঃপতনে তুমি অনুতাপমাত্রও করবে না। কিন্তু, সুচরিতা, এখনো ফেরবার সময় আছে। একবার ভেবে দেখো, একদিন কতবড়ো মহৎ আশার মধ্যে আমরা দুজনে মিলেছিলুম–আমাদের সামনে জীবনের কর্তব্য কী উজ্জ্বল ছিল, ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ কী উদারভাবেই প্রসারিত হয়েছিল—আমাদের কত সংকল্প ছিল এবং কত পাথেয় আমরা প্রতিদিন সংগ্রহ করেছি! সে-সমস্তই কি নষ্ট হয়েছে মনে কর? কখনোই না। আমাদের সেই আশার ক্ষেত্র আজও তেমনি প্রস্তুত হয়ে আছে। একবার মুখ ফিরিয়ে কেবল চাও। একবার ফিরে এসো।”

তখন ফুটন্ত তেলের মধ্যে অনেকখানি শাক-তরকারি ছ্যাঁক্‌ ছ্যাঁক্‌ করিতেছিল এবং খোন্তা দিয়া সুচরিতা তাহাকে বিধিমতে নাড়া দিতেছিল; যখন হারানবাবু তাঁহার আহ্বানের ফল জানিবার জন্য চুপ করিলেন তখন সুচরিতা আগুনের উপর হইতে কড়া নীচে নামাইয়া মুখ ফিরাইল এবং দৃঢ়স্বরে কহিল, “আমি হিন্দু।”

হারানবাবু একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, “তুমি হিন্দু।”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ, আমি হিন্দু।”

বলিয়া কড়া আবার উনানে চড়াইয়া সবেগে খোন্তা-চালনায় প্রবৃত্ত হইল।

হারানবাবু ক্ষণকাল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া তীব্রস্বরে কহিলেন, “গৌরমোহনবাবু তাই বুঝি সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, তোমাকে দীক্ষা দিচ্ছিলেন?”

সুচরিতা মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, “হাঁ, আমি তাঁর কাছ থেকেই দীক্ষা নিয়েছি, তিনি আমার গুরু।”

হারানবাবু এক কালে নিজেকেই সুচরিতার গুরু বলিয়া জানিতেন। আজ যদি সুচরিতার কাছে তিনি শুনিতেন যে, সে গোরাকে ভালোবাসে তাহাতে তাঁহার তেমন কষ্ট হইত না, কিন্তু তাঁহার গুরুর অধিকার আজ গোরা কাড়িয়া লইয়াছে সুচরতার মুখে তাঁহাকে এ কথা শেলের মতো বাজিল।

তিনি কহিলেন, “তোমার গুরু যতবড়ো লোকই হোন-না কেন, তুমি কি মনে কর হিন্দুসমাজ তোমাকে গ্রহণ করবে?”

সুচরিতা কহিল, “সে কথা আমি বুঝি নে, আমি সমাজও জানি নে, আমি জানি আমি হিন্দু।”

হারানবাবু কহিলেন, “তুমি জান এতদিন তুমি অবিবাহিত রয়েছ কেবলমাত্র এতেই হিন্দুসমাজে তোমার জাত গিয়েছে?”

সুচরিতা কহিল, “সে কথা নিয়ে আপনি বৃথা চিন্তা করবেন না, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি আমি হিন্দু।”

হারানবাবু কহিলেন, “পরেশবাবুর কাছে যে ধর্মশিক্ষা পেয়েছিলে তাও তোমার নতুন গুরুর পায়ের তলায় বিসর্জন দিলে!”

সুচরিতা কহিল, “আমার ধর্ম আমার অন্তর্যামী জানেন, সে কথা নিয়ে আমি কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চাই নে। কিন্তু আপনি জানবেন আমি হিন্দু।”

হারানবাবু তখন নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি যতবড়ো হিন্দুই হও-না কেন–তাতে কোনো ফল পাবে না, এও আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি। তোমার গৌরমোহনবাবুকে বিনয়বাবু পাও নি। তুমি নিজেকে হিন্দু হিন্দু বলে গলা ফাটিয়ে ম’লেও গৌরবাবু যে তোমাকে গ্রহণ করবেন এমন আশাও কোরো না। শিষ্যকে নিয়ে গুরুগিরি করা সহজ কিন্তু তাই বলে তোমাকে ঘরে নিয়ে ঘরকন্না করবেন এ কথা স্বপ্নেও মন কোরো না।”

সুচরিতা রান্নাবান্না সমস্ত ভুলিয়া বিদ্যুদ্‌বেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “এ-সব আপনি কী বলছেন!”

হারানবাবু কহিলেন, “আমি বলছি, গৌরমোহনবাবু কোনোদিন তোমাকে বিবাহ করবেন না।”

সুচরিতা দুই চক্ষু দীপ্ত করিয়া কহিল, “বিবাহ? আমি কি আপনাকে বলি নি তিনি আমার গুরু?”

হারানবাবু কহিলেন, “তা তো বলেছ। কিন্তু যে কথাটা বল নি সেটাও তো আমরা বুঝতে পারি।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি যান এখান থেকে। আমাকে অপমান করবেন না। আমি আজ এই আপনাকে বলে রাখছি–আজ থেকে আপনার সামনে আমি আর বার হব না।’

হারানবাবু কহিলেন, “বার হবে কী করে বলো। এখন যে তুমি জেনেনা! হিন্দুরমণী! অসূর্যস্পশ্যরূপা! পরেশবাবুর পাপের ভরা এইবার পূর্ণ হল। এই বুড়োবয়সে তাঁর কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে থাকুন, আমরা বিদায় হলুম।”

সুচরিতা সশব্দে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করিয়া মেজের উপর বসিয়া পড়িল এবং মুখের মধ্যে আঁচলের কাপড় গুঁজিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের শব্দকে প্রাণপণে নিরুদ্ধ করিল। হারানবাবু মুখ কালি করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

হরিমোহিনী উভয়ের কথোপকথন সমস্ত শুনিয়াছিলেন। আজ তিনি সুচরিতার মুখে যাহা শুনিলেন তাহা তাঁহার আশার অতীত। তাঁহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল, তিনি কহিলেন, “হবে না? আমি যে একমনে আমার গোপীবল্লভের পূজা করিয়া আসিলাম সে কি সমস্তই বৃথা যাইবে!”

হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ তাঁহার পূজাগৃহে গিয়া মেজের উপরে সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া তাঁহার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং আজ হইতে ভোগ আরো বাড়াইয়া দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন। এতদিন তাঁহার পূজা শোকের সান্ত্বনারূপে শান্তভাবে ছিল, আজ তাহা স্বার্থের সাধন-রূপ ধরিতেই অত্যন্ত উগ্র উত্তপ্ত ক্ষুধাতুর হইয়া উঠিল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics