Abhra Malakar

Tragedy Inspirational Others

3  

Abhra Malakar

Tragedy Inspirational Others

এভাবেও ফিরে আসা যায়

এভাবেও ফিরে আসা যায়

7 mins
269



প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা গল্প থাকে। হতে পারে তা সাদামাটা, গতে বাঁধা একঘেয়ে, আটপৌরে , কিন্তু তাও সে তার বড় আপন। হয়ত কেউ সেই গল্পের খোঁজও রাখেনা, প্রয়োজন বোধ করেনা। তবে এর মধ্যেই কিছু মানুষের কাহিনী যেন উপন্যাসের মত, উথালপাথাল করা, নাটকীয়, হেরে যাওয়া, ঘুরে দাঁড়ানো..... ভীড়ের মাঝে নিতান্ত সাধারণ হয়েও তারাও এক অসাধারণত্বের দাবীদার!!

মজার ব্যাপার হল, এই নাটকের কুশীলব হয়েও কিন্তু সে নিজেই বোঝেনা, জানেনা এই গল্পের কথা। শুধু পথ চলতে চলতে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে যদি পিছন ঘুরে দেখে, তখন হয়ত সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ভেসে ওঠে ফেলে আসা ছবিগুলো.....হিসেবী মন বিচার করতে বসে - কোথায় ভুল হল, কেন অন্যরকম হল না ইত্যাদি।। 

কিন্তু আর ফিরে যাওয়া যায়না, শুধু সামনেই এগিয়ে চলতে হয়!!


যার জীবন চরম 'নাটকীয়তায়' মোড়া, সে ও কি সত্যিই চেয়েছিল সেই 'সংগ্রামী' জীবন, সে কি হাঁপিয়ে ওঠেনা এই লড়াই করতে করতে? সে কি পেতে চায়নি একটা নিশ্চিত, শান্তির জীবন?


আর পাঁচটা সমবয়সী ছেলে-মেয়ের মত কি হতে পারত না , মেঘ আর মুনের জীবনটা? কোন প্রয়োজন ছিল এত চড়াই-উৎরাইয়ের , এত টানাপোড়েনের, এত পতন-উত্থানের? 

ছিল হয়ত, যিনি 'রচয়িতা' এই গল্পের, তাঁর হয়ত সাধ হয়েছিল একটু 'অন্য' মোড়কে উপস্হাপনার!!


এক জনপ্রিয় টিভি শোয়ের অডিশনে প্রথম দেখার মাধ্যমে সম্পর্কের শুরু, তার পরপরই চাকরি পাওয়া এবং তাও মুম্বাইয়ের মত শহরের নামকরা আইটি কোম্পানিতে- মেঘ ত মুনকে ভীষণ 'পয়মন্ত' মনে করত।। আর মুনও ত এরকমই একজনকে চেয়েছিল, যে তার তপ্ত-শুষ্ক জীবনে নিয়ে আসবে বসন্তের বাতাস!! তাইতো করাল নেশার গ্রাসে ডুবে যেতে যেতেও মেঘ বারবার মুনের হাত ধরতে চেয়েছিল, উঠে দাঁড়াতে...মুন ও সব চক্ষুলজ্জা, সামাজিকতাকে অবজ্ঞা করে বারবার ছুটে গেছে নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে!!


তাহলে? কোথায় ভুল হয়ে গেল? কি দোষ ছিল তাদের? কেন তাদের জীবন একটা সরলরেখায় বইল না?

**************************************************************************************************************************************************************************************************

বোর্ডিং পাস কালেক্ট করে লাউঞ্জে এসে বসলো মেঘ।


মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে, একটা সিগারেট খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এতবড়ো এই হিথরো এয়ারপোর্টে একটা স্মোকিং জোন নেই!! দু'বার এদিক ওদিক ঘুরে এসে অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে বসে পড়লো।

এখনো যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে, গত দুঘন্টায় যেভাবে ঝড়ের বেগে সব ঘটে গেল!!

কাল রাতে ওয়াইনের নেশাটা একটু বেশিই হয়ে গেছিলো, তাই অত সকালে ফোনের আওয়াজ শুনতেই পায়নি প্রথমে। তিনবারের বার ঘুমচোখে যখন দেখে কৌস্তুভদার ফোন, একটু অবাকই হয়েছিলো। এত সকালে কৌস্তুভদা? ধরতে যেতেই কেটে গেলো, আর সঙ্গে সঙ্গেই মুনের নাম্বার ভেসে উঠলো।।

"বাবার ভীষণ শরীর খারাপ, তুমি যেভাবে হোক চলে এসো" - শুধু এইটুকুই মাথায় ঢুকেছে। ভাগ্যিস কৌস্তুভদা অনসাইট টীম, ট্রান্সপোর্ট ডেস্ককে ফোন করে সব ব্যবস্হা করে রেখছিলো, নাহলে হয় নাকি এত তাড়াতাড়ি সব......

আসলে ফেরার কথা আরো দু'দিন পর, শনিবার । একমাসের বিজনেস ভিসা, দশ বছরের কেরিয়ারে প্রথমবার বিদেশ সফর। আগের পাসপোর্টটা ত শুধু একটা আইডেনটিটি প্রুফ হয়েই থাকলো!! কোথায় ভেবেছিলো সব্বার জন্য কিছু না কিছু গিফ্ট কিনে নিয়ে যাবে.....তা না, ফিরতে হচ্ছে একদম খালি হাতে।

ভুল হল, সঙ্গী একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা!! পিসিকে একবার ফোন করেছিল, সেই একই কথা - "তুই চিন্তা করিস না, সাবধানে আয়। বাবা হসপিটালে ভর্তি আছে"।

হুঁ, আটকাবো বললেই কি যায় আটকানো, স্রোতের মত আছড়ে পড়ছে এক একটা ভাবনা!! মানুষের মন ত, সবার আগে খারাপটাই ভেবে নেয়....তবে কি? না না...সব ঠিক হয়ে যাবে।।

নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে দিতে উঠে দাঁড়ালো মেঘ, দুবাইগামী বিমানের বোর্ডিং এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে।।

**************************************************************************************************************************************************************************************************

কাকটা তারস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে টানা, দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চললো। ছোটপিসি এরমধ্যেই দুবার ডাক দিয়ে গেছে, 'যাচ্ছি' বলেও ঠায় বসে আছে - জানলায় থুতনি রেখে....


কি ভাবছে? নিজের অতীতের কথা, নাকি ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে? কেন তার সাথেই বারবার, কি এমন দাবী করেছিল সে, জীবনের কাছে? শুধুমাত্র একটু শান্তি, একটা নিরাপত্তা - এই ত? অথচ....


ছোটবেলায় ভারী স্নিগ্ধ, মায়ায় ভরা মুখখানি দেখে ঠাকুমা নাম রেখেছিল 'মুন'।।

কোন ছোট থেকে সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এসে পড়েছে কাঁধে - মাতাল বাপ, বৈষয়িক জ্ঞানহীন মা নিশ্চয়তা দিতে পারেনি মাথার ওপর ছাদ বা দুবেলা দুমুঠো ভাতের ও!! যে বয়সে মেয়েরা হেসে খেলে, প্রেম করে, সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছে, তাকে ছুটতে হয়েছে টিউশনি পড়াতে অথবা রেশনের লাইনে, একটা সখের জিনিস কিনতেও দশবার ভাবতে হয়েছে!!

তাই মেঘকে যেদিন প্রথম দেখে, কেন যেন মনে হয়েছিল ওর কাছেই মুক্তি, নিরাপত্তা, তাই নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।। আর মেঘও হাত ছাড়েনি, বরং পাগলামিটা ওরই বেশি ছিল। সারারাত ফোন, রাগ ভাঙ্গাতে অতদূর থেকে বারবার দৌড়ে আসা...তাইতো একটা সময়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েও মেঘের জেদের কাছে হার মানতে হল। আসলে নিজে ত 'ঘরপোড়া গরু', তাই নিজের এই ছন্নছাড়া জীবনের সাথে মেঘকে বাঁধতে চায়নি।।

ভুল কি ভেবেছিল সে? বিয়ের পাকা কথার দিন থেকে ননদ-নন্দাইয়ের ভোলবদল, সবার সামনে অশ্লীল ভাষায় অপমান, বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্হা নিয়ে ঠারেঠোরে খোঁটা...

অথচ ওদেরই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে বারবার ছুটে গেছে কোন দূর প্রদেশে, একা!! যে মেয়ে কোনদিন একা কলকাতায় যায়নি, তার পক্ষে একা মুম্বাইয়ের ট্রেনে উঠে পড়া কতটা কঠিন হতে পারে এরা বোঝেনা?

শুধু একজন, যিনি প্রথমদিন থেকে আদর-প্রশয় দিয়ে এসেছেন নিজের 'আত্মজা'র মত,

বিয়ের ছ'মাসের মধ্যেই সেই শ্বাশুড়িমাও চলে গেলেন , যে শ্বশুর বাবার আসন নিয়েছিলেন, তিনিও অন্যলোকের কথায় ভাবতে লাগলেন - 'বৌটা ভালো হল না'!! আর বয়স্ক মানুষটাকে দোষ দিয়েই বা কি হবে, পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ের তবু এখনোত একটা....।

তার জীবনে 'ভালো' কিছু সময়মত হোক না হোক, 'খারাপ'গুলো বোধহয় দলবেঁধে ওঁত পেতে থাকে।। জীবনখাতার প্রতি পাতায় শুধু 'বিয়োগ'....চাঁদের মত শুধু কলঙ্কই বয়ে চলতে হবে আজীবন।।


মেঘ কি করছে কে জানে, কদ্দূর পৌঁছলো? নিশ্চয়ই কিছুটা আন্দাজ করেছে, বারবার এককথা জিগ্যেস করছিলো, 'বাবা এখন কেমন আছে'? মুন-ই বা কি উত্তর দিতো,এতটা পথ আসবে ছেলেটা একা.....নাহহহ, আর চিন্তা করতে পারছেনা ।।একটু যদি ঘুমোতে পারত....

**************************************************************************************************************************************************************************************************


ঘরের দরজাটা খুলে দিল কেউ, কি দেখছে সে? কে .....কে শুয়ে আছে ঐ বরফের বিছানায়?

সেই দুর্দান্ত মানুষটা?

যাঁর হাত ধরে যুবভারতী-ইডেন-গড়ের মাঠে বইমেলা-ব্রিগেডে প্যারেড.... সব কিছুর প্রথমবার যাঁর হাত ধরে...যাঁর চোখে চিনতে শেখা লাল-হলুদ,মারাদোনা,কাস্তে-হাতুড়ি... সারাজীবন যাঁর ছায়ায় আশ্রয় খোঁজা.....

সেই মানুষটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে!! মেঘের পায়ের নীচে পৃথিবীটা দুলতে থাকে ...

বারবার করে বলত, 'যেদিন তোমার পাশে কেউ থাকবেনা, তোমার এই মেঘ থাকবে', আর আজ? মেঘ পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল আসে না একটুও!! পাশ থেকে কেউ বলে যাচ্ছে কিভাবে দু'দিন আগে ভোরবেলা হঠাৎ বুকে ব্যথা থেকে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেছে!! মেঘকে পুরোটা জানানো হয়নি....

...শেষের দিন সবাই ছিল, শুধু মেঘ? অনেক অনেক দূরে....

মেঘের পায়ের নিচে মাটিটা যেন সরে যায়...চোখের সামনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।।


এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল মুন, সবার আড়ালে।। দৌড়ে গিয়ে মেঘকে ধরে ফেলে।

**************************************************************************************************************************************************************************************************

দিন কেটে মাস যায়, মাস পেরিয়ে বছর ।

জীবন বয়ে চলেছে নিজের নিয়মে, কিন্তু কোথাও যেন কি একটা খামতি, কিছু একটা ফাঁক। রোজ সকালে উঠে মেঘ অফিসে বেরিয়ে যাওয়া অবধি মুন মুখ বুজে সব কাজ করে, কিন্তু তারপর এত বড় বাড়িটা তাকে যেন গিলতে আসে।। যতদিন যাচ্ছে তত যেন এই একাকীত্ব ঘিরে ধরছে তাকে। বেরিয়ে কোথাও যে যাবে সে উপায়ও নেই, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের বাঁকা কথা, চাহনি ....

বিয়ের পর একে-একে শ্বশুর-শাশুড়ি চলে গেল, অথচ 'নতুন' কেউ এলো না আজো এ সংসারে। এ সমাজে দায় ত সব মেয়েদের ই।


সিলিং ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুন। মেঘটাও আজকাল কেমন বদলে গেছে, প্রয়োজন ছাড়া দুটো কথাও বলে না।। কারণে অকারণে চিৎকার, ঝগড়া।

যার হাত ধরে এসংসারে আসা, তার মুখেও যদি শুনতে হয় 'বাঁজা' ...

ওড়নাটা সিলিং ফ্যানের দিকে ছুঁড়ে দেয়.....


**************************************************************************************************************************************************************************************************


কফির কাপটা নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় মেঘ। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আজকাল নিজেকেই যেন চিনতে পারে না। সবসময় যেন তিতিবিরক্ত, সামান্য ব্যাপারেই চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই আছে মুনের সাথে।

যে মেয়েটা তাকে ভালবেসে মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে চলেছে, বারবার ছুটে গেছে তাকে ঐ অন্ধকার থেকে তুলে আনতে, আজো যে মুন না থাকলে হয়ত আবার কোথায় তলিয়ে যেতো..…

কি অবলীলায় তাকে চরম আঘাত করে সে!! কি বিকৃত সুখ পায় সে এতে? এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেই নেই।

সেদিন বাবাকে ঐভাবে দেখার পর থেকেই সব কেমন ওলোটপালট হয়ে গেছে, আজ এক বছর পরও।। এখনো রোজ রাতে ঘুম ভেঙে যায়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয় ... কিন্তু পারে না!!

পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি সে?


নাহহহ, আজ আর কাজে মন বসবে না!! কৌস্তুভদাকে বলে বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে। আজ মুনের সাথে বসতে হবে, খোলাখুলি কথা বলতে হবে... কতদিন তারা বাইরে কোথাও বেড়ায়নি দুজনে হাত ধরে, রেস্টুরেন্টে বা পার্কে বসেনি পাশাপাশি... এভাবে চলতে থাকলে দুজনেই শেষ হয়ে যাবে।।

বাইকটা স্টার্ট করে বাড়ির দিকে....


ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা কেন? মুন কি কাছাকাছি কোথাও গেছে?

ঢুকে ডাইনিং টেবিলে ব্যাগটা রেখে মুনকে ফোন করতে যাবে, তখনই ...বেডরুমের দরজায় চোখ পড়ে.......


"মুউউউউউউউউউউউউউউনননননননন"


**************************************************************************************************************************************************************************************************


গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্ত হল না।।


মাঝখানে কেটে গেছে আরো চার-চারটে বছর। আবার সেই হিথরো এয়ারপোর্ট, লন্ডন।


ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম শেষ করে লাগেজ ক্যারিয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেঘ আর মুন। না, শুধু দুজন নয়, সঙ্গে তাদের ছোট্ট দুই 'রাজকন্যা'!!

হ্যাঁ, গত কয়েক বছরে মুনের কোল আলো করে এসেছে দুজন - 'দিয়া' আর 'হিয়া', মেঘের চোখের দুই মণি, মুনের প্রাণভোমরা!!



ভাগ্যিস সেদিন মেঘ ঠিক সময়ে পৌঁছতে পেরেছিলো....


যে হিথরো থেকে একদিন একরাশ উদ্বেগ নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল, এক অন্ধকার জগতে...আজ আবার সেখানেই নতুন জীবনের সূচনা করতে চলেছে মেঘ আর তার মুন।।

বাবার পিঠে চেপেছে দিয়া, মায়ের হাত ধরে হিয়া, ঐ তারা এগিয়ে যায় এক্সিট গেটের দিকে, আলোর দিকে....


মানুষের জীবনে আঁধার যেমন আসে, দেরিতে হলেও আঁধার কেটে ভোরও হয়। প্রকৃতির মত জীবনেরও এই নিয়ম।


হ্যাঁ, এভাবেই ফিরে আসা যায়।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy