Suman Jana

Classics Others

4  

Suman Jana

Classics Others

দূরে থেকেও বহু কাছে

দূরে থেকেও বহু কাছে

13 mins
397


'হ্যালো বন্ধুরা, কেমন আছো সবাই। আমি রিকি মিত্র,আর তোমরা দেখছো Ricky's Shorts. আমি আবারও তোমাদের সামনে চলে এসেছি এক নতুন অজানা, অচেনা, এবং রোমাঞ্চকর প্রেম কাহিনী নিয়ে। আমার আজ প্রায় দেড় বছরের youtube ক্যারিয়ারে আমি যতরকম প্রেম কাহিনী তোমাদের সামনে তুলে ধরেছি তার থেকে এটা কিন্তু কিছুটা আলাদা। শুনলে অনেকের মনে হতেই পারে বোধহয় আমি কোন সিনেমার গল্প বলছি,কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটা একটা সত্যিকারের কাহিনী।আমাদের কাহিনীর রাজকুমার হলো মিস্টার সিয়ান দাশগুপ্ত আর তার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারী হল নেহা গুহ। না,এখনই তোমাদের পুরোটা বলবো না। ভিডিওটা দেখলেই বুঝতে পারবে। নিচের ডেসক্রিপশন বক্সে থাকা ভিডিও লিংকটিতে ক্লিক করে এই রোমাঞ্চকর প্রেম কাহিনীর সাক্ষী হতে ভুলোনা কিন্তু! আর এই রকমই নানা গল্প শুনতে নিচে দেওয়া subscribe বাটনটি ক্লিক করে আমার চ্যানেলটিকে সাবস্ক্রাইব করে নাও।'

    ইউটিউব দেখতে দেখতে 'Ricky's Shorts' চ্যানেলটির এই ভিডিওটি দেখতে পেল রোহন। সবেমাত্র কলেজে উঠেছে সে।নিজের জীবনে রোমান্টিক গল্প খুব একটা না থাকলেও অন্যের প্রেম কাহিনী শুনতে তার বরাবরই ইন্টারেস্টের মাত্রা থাকে এভারেস্টের চূড়ায়। তাই শর্টস টা দেখে নিজেকে না সামলে রাখতে পেরে লিঙ্কটাতে ক্লিক করেই ফেলল। তবে রোমান্টিক কিংবা ভৌতিক গল্প হেডফোন ছাড়া ঠিক জমে না। তাই হেডফোনটা কানে দিয়েই সে গল্পটা চালু করল। সবেমাত্র ২৫ কি ৩০ সেকেন্ড হয়েছে, অমনি পাশের ঘর থেকে মা ডেকে বললেন-

'কিরে বাবু, খেতে আয়। রাত ১০টা বাজে যে!!'

তাই নেহাত মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ভিডিওটা বন্ধ করে খেতে যেতে হলো রোহনকে।


   রাত এখন ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট।অন্যদিন খেয়ে-দেয়ে উঠে বিছানায় শুতে আসতে একটু বেশি সময় লাগে রোহনের। কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা।তাড়া আছে যে! কোনোরকমে খেয়েদেয়েই চলে এসেছে সে।এসেই প্রথমে ব্লুটুথ হেডফোনটা ফোনের সাথে কানেক্ট করলো রোহন।ব্যাস এবার আর কোন বাধা নেই। কিন্তু কি হলো ইউটিউব খুলছে না কেন? ব্যাস রোহনের তো মাথা খারাপ। অবশেষে মেসেজ চেক করে সে বুঝতে পারলো যে আজকের মত তার ১.৫ GB নেট প্যাকটা শেষ। কিন্তু সে আজ ঠিক করেই নিয়েছিল যে ভিডিওটা দেখে তারপরে ঘুমাবে। তাই অবশেষে ৯৮ টাকা দিয়ে একটা ৭ GB এর টপ-আপ ইন্টারনেট প্যাক সে কিনলো। এবার আর কোন বাধা নেই।ভিডিওটা চালু করল সে।


    " And the best student of the year award goes to Sian Dasgupta. Let's have a great clap for him…এই নিয়ে টানা তিন বছর হলো।Best student award টার সঙ্গে যেন সিয়ানের কত জন্মের সম্পর্ক। দুজন দুজনকে কেউই যেন ছাড়তে চায় না।তবে হ্যাঁ এটা ঠিক সিয়ানের মতো ওরকম all-round ছেলে সত্যিই দুর্লভ। যেমন সে দক্ষ পড়াশোনায়,তেমনি তার কালচারাল গুণও,খেলাধুলাতেও আগ্রহ প্রচুর,আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া তো রয়েইছে। তাই গোটা কলেজে সিয়ান দাশগুপ্তকে চেনে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়াটা ভীষণই দুষ্কর। তবে হ্যাঁ ছেলেটা একটু লাজুক প্রকৃতির বটে।তাই তার boys গ্রুপে সিয়ান-ই হল একমাত্র সিঙ্গেল মানুষ। এই ব্যাপারে সিয়ান নিজেই বলেছে যে ওর সাথে প্রেম করতে হলে ওই মেয়েকেই প্রথম প্রপোজ করতে হবে। কারণ সিয়ানের আবার এইসব ব্যাপারে বলতে গেলে কেমন কেমন লাগে। তাই হয়তো আগে কাউকে ভালো লাগলেও বেচারা সাহস করে বলে উঠতে পারেনি।

         আজ কলেজে 'Freshers Day'। প্রথম বর্ষের সকল শিক্ষার্থীদের আজ বাংলা ভাষায় নবীন বরণ উৎসব। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে সিয়ান দাশগুপ্ত। ঘন্টাখানেক কলেজের পুরনো ছাত্র-ছাত্রীদের গানে নাচে আসর বেশ ভালই জমে উঠেছে।। এবার সিয়ান মঞ্চ থেকে বলে উঠলো…Guys, এখন আমাদের মাঝে ড্যান্সিং আর্ট তুলে ধরতে আসছে একজন fresher student.So let's have a big clap for none other than Neha Guha. চারিদিক থেকে হাততালির আওয়াজ উথলে পড়তে লাগলো। নেহা মঞ্চে উঠে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে নিজের নৃত্য পরিবেশন শুরু করল। এদিকে সিয়ান তখনও নেহাকে দেখেনি।অনুষ্ঠান নিয়ে তখন সে তার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল নৃত্যরত নেহার দিকে। Indian Classical এর সঙ্গে western dancing art এর মিশেলে কি সুন্দর এক নৃত্য পরিবেশন করছিল সে! আর এদিকে প্রথম দেখাতেই মিস্টার দাশগুপ্ত পুরোপুরি ক্লিন বোল্ট। ব্যাস চোখের আর পলক পড়লো না।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে শুধু একটা কথাই বলল…wow!

       সিয়ানের উপর থেকে নেহার মায়া সরলো হাততালির শব্দে। তার নাচ সমস্ত দর্শকদের একেবারে মুগ্ধ করে দিয়েছে। অনেকে তো আবার আবেগে দু'চারটে সিটিও দিল। সিয়ান-ও একটা মুচকি হেসে হাততালি দিল। নেহাও নমস্কার জানিয়ে নেমে গেল।

          

         সন্ধ্যায় সিয়ান আর তার বন্ধুরা আড্ডা দিতে বসলো। হঠাৎ সিয়ান বলে উঠলো…' আজকের অনুষ্ঠানের ছবি আর ভিডিওগুলো কে তুলেছিলি বল তো? পাশ থেকে অমিত বলে উঠলো 'কেন,আমিই তো তুললাম।'

-'ও.. তোর ক্যামেরাটা আমায় দিস তো।কয়েকটা ছবি নেবো।'

- 'ঠিক আছে,এই নে।'

ক্যামেরাটা নিয়ে সিয়ান পাল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। বন্ধুরা যখন খোঁজ মেজাজে গল্প করতে ব্যস্ত সে সময় সেয়ান চুপি চুপি নেহার নাচের ভিডিওটাও নিয়ে নিল। তারপর হঠাৎ এমন ভাবে ভান দেখালো যেন খুব ঘুম পেয়েছে। তাই সবাইকে গুড নাইট বলে সে নিজের রুমে চলে গেল। বন্ধুরা সবাই তো হতবাক। যে সিয়ান আড্ডার আসর থেকে উঠতে চাইতো না, সেই কিনা আজ এত তাড়াতাড়ি চলে গেল! তাও আবার আড্ডার আসর জমে উঠতে না উঠতেই!

       নেহার নাচের ভিডিওটা সাতবারের উপর দেখা হয়ে গেছে, তবুও যেন মন ভরে না সিয়ানের। যত দেখে ততই যেন বেশি করে তার ভিডিওটা দেখতে ইচ্ছা করে। অবশেষে ফোনের পাওয়ার অফ হয়ে যাওয়ার পরেই তার চোখে ঘুম এলো। রাত তখন একটা বেজে কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে।


         আজ কলেজের excursion day. গন্তব্য হল পাহাড়ে ঘেরা উটি। সিয়ানের কথাতেই এই বছরই প্রথম কলেজ ইউনিয়ন সমস্ত ক্লাসের একটা একসাথে ট্যুর প্রোগ্রাম করেছে। পাহাড় বরাবরই সিয়ানের প্রিয়, তার ওপর সে জানতে পেরেছে নেহারও পাহাড় বেশ ভালো লাগে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল সিমলা যাবে, কিন্তু নেহা,সিয়ান এবং আরো কয়েকজন আগে সিমলা গিয়েছিল বলে, শেষ পর্যন্ত উটি যাওয়াই স্থির হল। সিয়ান ট্যুর যাওয়ার আগে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিল। আসলে তো এমনিতে তো আর নেহার কাছ থেকে নাম্বার নিতে পারত না। তাই বেচারা এই পথই অবলম্বন করল। সাত দিনের ট্যুর। দেখতে দেখতে কখন যে কেটে গেল বোঝাই গেল না। কতবার নিজের মনের কথা বলতে চেয়েও সিয়ান বলে উঠতে পারেনি। কলেজেও অনেকবার সে চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলে উঠতে পারেনি। যাইহোক এই টুরের খাতিরে আপাতত নেহার নাম্বারটা সে জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছে। তা নিয়েই আপাতত সে দুধের কাজ ঘোলে মেটানোর মত নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

    দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে কলেজের শেষ দিনটা চলেই এলো। আজ বিদায়ের দিন। আজ সিয়ান ভেবে এসেছে সে আর কিছুতেই ভয় কিংবা লজ্জা পাবে না। নিজের মনের কথাটা আজ সে বলবেই।আজ নেহি তো কাভি নেহি। প্রথমে সিয়ান ভেবেছিল নেহা হয়তো আজ নৃত্য পরিবেশন করবে। কিন্তু তাকে সে কলেজে খুঁজেই পাচ্ছিল না। ভেবেছিল হয়তো ব্যাকস্টেজে আছে। কিন্তু হায়, এক্ষেত্রে 'সখী শ্যাম না এলো'এর পরিবর্তে,সখী রাধা না এলো…। হ্যাঁ আজ দুর্ভাগ্যবশত নেহা কলেজেই আসেনি। ওর কোন এক আত্মীয়ের নাকি আজ বিয়ে।তাই ও সেখানেই গেছে। অবশেষে মুখটা বাংলার পাঁচের মত করে বাড়ি ফিরে অরিজিৎ সিং এর sad song এর playlist টা চালিয়ে সে শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে সে ভাবছিল…দিনটা আজ কেমন হওয়ার কথা ছিল, আর কেমন হলো।


       মাঝে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। সিয়ান নেহাকে সামনাসামনি দেখে নি। তবে তাকে ভুলে উঠতেও পারেনি। কথায় আছে না.. প্রথম প্রেম কি অত সহজে ভোলা যায়! সিয়ান দাশগুপ্ত এখন দেশের অন্যতম বড় কোম্পানি SRN Industries এর মালিক। এছাড়াও নানা সামাজিক কাজকর্মের জন্য তার বাড়ি এবং অফিসে বহু মেমেন্টো সাজানো হয়ে আছে। Dashing look এর এই বিজনেসম্যান কে অনেকেই প্রপোজাল পাঠিয়েছিল। কিন্তু ওই যে…পহেলা পেয়ার..। তাই সবাই তার কাছে রিজেক্টেড। মাঝে অনেকবারই সে নেহাকে ফোন করেছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই ওপাশ থেকে বলে ওঠে…the number you have dialed is currently out of internet coverage,please try again later।তাই বলতেই হবে বেচারার ভাগ্য খারাপ। যখন ভয় ছিল তখনও বলতে পারেনি আর যখন সাহস হলো তখনও তার মনের কথা মনেই থেকে গেল।


      এক বৃষ্টি ভেজা দিনে জানালার পাশে চা খেতে খেতে সিয়ান ভাবছিল তার কলেজের দিনগুলির কথা, ভাবছিল তার সাফল্যের নানা কথা, আর ভাবছিল তার ব্যর্থতার কথা অর্থাৎ নেহাকে না বলতে পারার কথা।হঠাৎ পাশ থেকে তার ফোনটা বেজে উঠল।

-Hello

-হ্যালো স্যার আমি রাজ বলছি। প্যারিসে আমাদের কোম্পানির সাথে UR কোম্পানি একসাথে কাজ করতে রাজি হয়ে গেছে। শুধু আপনাকে একবার ফ্রান্সে এসে কয়েকটা মিটিং করতে হবে।

-ঠিক আছে তুমি ফ্লাইটের টিকিট আমাকে পাঠিয়ে দাও আর মিটিং সিডিউল তৈরি করে রেখো। আমি আসছি।

- ok sir.

সবেমাত্র হল সিয়ান প্যারিসের মাটিতে পা দিয়েছে। রাজ আগে থেকেই তাকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। গাড়িতে করে আধঘন্টা যাওয়ার পরেই তারা গিয়ে পৌঁছালো হোটেল রয়েল স্টার এর সামনে। রাজ সিয়ানকে রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিল এবং তার মিটিং সিডিউলটা বুঝিয়ে দিল। এরপর সে তার স্যারকে গুডবাই জানিয়ে চলে গেল।


আজ ২৯ তারিখ। অন্য অনেকের কাছে এই দিন টা আর পাঁচটা দিনের মতো হলেও সিয়ান এর কাছে নয়। কারণ আজকের দিনেই ওর আর নেহার প্রথম দেখা হয়েছিল। মনে মনে পুরনো স্মৃতিগুলোই সে গাড়িতে যেতে যেতে ভাবছিল। হঠাৎ রাজ বলে উঠলো…

-স্যার আমরা চলে এসেছি।

- ও, চলো তাহলে।

গাড়িটা ড্রাইভারকে পার্কিং করতে বলে তারা দুজন ভেতরে চলে গেল। মিটিং যে জায়গায় আয়োজন করা হয়েছিল সেখান থেকে আইফেল টাওয়ার সহ পুরো প্যারিস টা খুব ভালোভাবে দেখা যায়।

-চলুন স্যার। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

-হ্যাঁ চলো।

মিটিং হলে ঢুকে সবাই যখন সিয়ানকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত তখন সিয়ানের চোখ গিয়ে থমকে গেল একজনের মুখের উপর। হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ধরেছেন। ইনি হলেন সেই নেহা গুহ। সৌভাগ্যক্রমে আজ এত বছর পরও সিয়ান অবশেষে নেহার মুখোমুখি হতে পেরেছে। নেহা হলো UR company এর A.H.O। কোনক্রমে নিজের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সিয়ান তার মিটিং শেষ করল। মিটিং শেষ হওয়ার পর সে নেহাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলল।

      অফিসের ছাদ থেকে বাইরের দৃশ্যটা আরো সুন্দর লাগছিল। সিয়ান তখন ছাদে নেহার জন্য অপেক্ষা করছিল। মিনিট পাঁচেক পর সে এলো।

-Hi,Neha.কেমন আছো?

-হ্যাঁ ওই চলে যাচ্ছে আর কি। আজ কত বছর পর আবার দেখা হল তাই না! তাও আবার প্যারিসে।

-আচ্ছা পরের সপ্তাহে তুমি নাকি রাহুলের সঙ্গে বিয়ে করছো?

-তাই নাকি? আর রাহলই বা কে? বিয়ে তো দূরের কথা আমার কোন বয়ফ্রেন্ডও নেই।

(Mission Successful!! এটাই তো চাইছিল সিয়ান।তার মনের মধ্যে কেউ আছে নাকি, এটা জানার জন্যই এমন নাটক করলো।)

-বলছি যদি তোমার সময় থাকে তাহলে আমাকে শহরটা একটু ঘুরে দেখাবে?

-ঠিক আছে, আমার কোন অসুবিধা নেই।

ব্যাস,পরদিন থেকেই নেহা সিয়ানকে গাইড এর মত করে পুরো শহরটা ঘুরালো। সেই সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোকাল খাবারও তাকে খাওয়ালো। সবমিলিয়ে এই কটা দিন বেশ ভালই কাটলো। গল্পগুজব,মজা-ঠাট্টা করতে করতে তারা একে অপরের ভীষণ কাছে এসে গেল। অবশেষে এলো সেই দিন, দুজনে তখন দাঁড়িয়ে ভালোবাসার শহর প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের সামনে।

-নেহা,আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।অনেকদিন ধরেই বলবো বলবো করছি কিন্তু বলে উঠতে পারিনি।

-হ্যাঁ বলো।

-আমি বুঝতে পারছি না কেমন ভাবে শুরু করব, কিন্তু আজ না বললে হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। কলেজে তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা হচ্ছিল। এর আগে সত্যি কথা বলতে কোন মেয়ের দিকে মুখ তুলে তেমন ভাবে তাকাইনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। জীবনে অনেক সফলতা পাওয়া সত্ত্বেও কিছু যেন একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। কলেজে এটা বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু জানিনা কেন বলে উঠতে পারিনি। অনেকবার ফোনেও চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রত্যেকবারই তোমার ফোন নেটওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে দেখাচ্ছিলো। সত্যি কথা বলতে আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে হয়তো আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে তোমার সঙ্গে আমার এইভাবে এই প্যারিসে দেখা হবে। আমি জানিনা তুমি কাউকে পছন্দ করো কিনা। কিন্তু এই মিথ্যা ভরা জগতে আমি তোমাকে ঠিক কতটা সত্যিকারের ভালবাসি,তা আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। এখন পর্যন্ত এমন একটাও দিন যায়নি যেদিন আমি তোমার কথা ভাবিনি। নেহা,I am in love with you.Will you marry me?

কথাগুলো শুনে তৃষা লজ্জা ভরা একটা মিষ্টি হাসি দিল। এর উত্তর সে পরে জানাবে বলে চলে গেল।


তখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। একটা অজানা ফোন নম্বর থেকে সিয়ানের ফোনে ফোন এলো…

-হ্যালো

-হ্যাঁ হ্যালো, আমি নেহা।

-কিন্তু এই নাম্বার তো তোমার না।

-এটা আমারই নাম্বার। তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল তাই ফোন করলাম।

-হ্যাঁ বলো।

-কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তোমার নাম শুনছিলাম। দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল তোমায়। অনুষ্ঠানের দিন যেদিন তোমায় দেখি সেটা আমাদের দ্বিতীয় দিনের দেখা। এর আগেও আমাদের একবার দেখা হয়েছিল। মনে আছে, একটা মেয়েকে তুমি রনিদের দল থেকে বাঁচিয়ে ছিলে। সেটা আমিই ছিলাম। চোখে সানগ্লাস আর মুখে ওড়না ঢাকা দেওয়ায় তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি। সেদিন থেকেই আমার তোমাকে ভালো লাগে। তবে কোনদিন সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। আর ফোন নাম্বার? তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমার ফোনটা চুরি হয়ে যায়। চোরটা বোধহয় সিমটা খুলে ফেলে দিয়েছিল তাই ওরকম বলছিল। যাইহোক ভাগ্যক্রমে আবার আমরা দুজন একসাথে এখানে দেখা করতে পেরেছি। কোম্পানির সঙ্গে আমার আর এক মাসের কন্ট্রাক্ট বাকি আছে,তারপরেই ভাবছি দেশে ফিরে যাব।

-আমিও খুব বোকা। বন্ধুদের কাছ থেকে তোমার নাম্বারটা জোগাড় করার চেষ্টা করলেই ওরা করে দিতে পারতো। একদম মাথাতেই ছিল না। তবে আমার প্রশ্নের উত্তরটা…?

- je t' aime.

-এর মানে কি?

-গুগলে সার্চ করে দেখে নাও।বাই।

নেহা ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে সিয়ান গুগল ট্রান্সলেটারে ওই বাক্যটা লিখলো। এবং জানতে পারলো যে ওটা একটা ফরাসি বাক্য যার মানে হলো-I love you বা আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটা দেখার পর সিয়ান কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এরপর প্রথমে সে নেহার নাম্বারটা সেভ করল। তারপর তাকে ফোন করে আগামীকাল দেখা করতে বলল। নেহাও রাজি হয়ে গেল।

আজ প্রায় এক মাস হতে চলল। ফ্রান্স থেকে ফিরে আসার প্রথম কয়েকদিন নেহা সিয়ানকে ফোন করেছিল। তারপর হঠাৎ প্রায় দু সপ্তাহ কোন ফোন করেনি। সিয়ান ফ্রান্সের অফিসে ফোন করেও খোঁজখবর নিয়েছিল কিন্তু কোন সঠিক খবর জানতে পারেনি। এইসব নিয়ে যখন সিয়ান ভাবছিল তখন হঠাৎ এক সন্ধ্যায় একটা কল এলো..

-হ্যালো সিয়ান।

-হ্যালো, নেহা। তুমি হঠাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেছিলে। প্রায় দু সপ্তাহ তো কোন ফোনই করোনি। আমার তো চিন্তায় রাত্রে ঘুম আসতো না। এভাবে কেউ দুম করে উধাও হয়ে যায়!! ইন্ডিয়া কবে আসছ বলো?

-আমি যেতে পারব না। আর সেদিনের কথাগুলো তুমি সব ভুলে যাও। আমি তোমায় ভালোবাসি না।

-ভালোবাসি না মানে? তুমিই তো সেদিন বললে, আমি যেমন তোমাকে ভালবাসি তুমিও তেমন আমাকে ভালোবাসো।

-তাইতো বলছি সেদিনের কথা ভুলে যাও। তুমি নতুন করে পথ চলো।

-কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো বলো!

-আমি বলতে পারব না।কিন্তু তুমি আমাকে ভুলে যাও।

-হ্যালো…হ্যালো…নেহা!!

ফোনটা রেখে দিলো! আমাদের এতদিনের সব আবেগ, সবকিছু মিথ্যা! ঠিক আছে মিস গুহ, থাকো তুমি তোমার জীবন নিয়ে। আমিও আর তোমার কথা ভাববো না। হ্যাঁ, হয়তো খুব কষ্ট হবে কিন্তু তবুও নিজেকে মানিয়ে নেব। তোমার মত প্রতারক মেয়ে সত্যিই আমার সঙ্গে বেমানান।I hate you Neha…I hate you."


       এটা দেখার পর রোহন ভীষণ রেগে গেল। আর বলল-'এই মেয়েটা তো ভীষণ বেইমান। যদি ভালো না-ই বেসে থাকে, তাহলে এভাবে ছেলেটার আবেগ নিয়ে খেলার কি দরকার ছিল। আজকালকার মেয়েরা এভাবেই ছেলেদের ঠকায়। ঠিক যেমন হবে, শুভর গার্লফ্রেন্ড ওকে ঠকিয়েছিল। যাই হোক আর একটু বাকি আছে ভিডিওটা পুরোটা দেখেই নিই।'

এই বলে রোহন ভিডিওটা চালু করল…

"কিছুদিন পর হঠাৎ সিয়ানের ফোনে রাজের নম্বর থেকে একটা মেসেজ এলো তাতে লেখা…sorry sir. সেইসঙ্গে রাজ একটা চিঠির ছবিও পাঠালো, তাতে লেখা-

'প্রিয় সিয়ান,

                  আমি জানি তুমি আমার উপর হয়তো রাগ করে আছো। রাগ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কি করবো বলো। আমার অবস্থাটা এমনই। আমি জানিনা এই চিঠিটা যখন তুমি পাবে তখন আমি আদৌ এই জগতে থাকবো কিনা। ভেবেছিলাম তুমি আমায় ভুলে যাবে এবং নতুন করে জীবন শুরু করবে। কিন্তু তা তুমি করতে পারোনি। তাই ভাবলাম, আসল সত্যিটা তোমাকে জানানো দরকার। আসলে আমি যখন ভারতে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন হঠাৎই একদল দুষ্কৃতী আমার বাড়িতে আক্রমণ করে। তাদেরকে আমি যখন আটকাতে যাচ্ছিলাম তখন ওদের মধ্যে একজন একটা ভারি লোহার রড নিয়ে আমার মাথায় মারে। তারপর আর কিছু মনে ছিল না। উঠে দেখি আমি হসপিটালে আছি। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করায় আমার মাথার অনেকটা অংশ জুড়ে রক্ত জমাট বেঁধে তা নষ্ট হয়ে গেছে। আর মাত্র দুই থেকে এক সপ্তাহ আমি বাঁচবো। বিশ্বাস করো আমি মোটেও চাইনি, আমার মতো একজন মেয়েকে,যার আয়ু মাত্র কয়েক সপ্তাহ, তাকে তুমি বিয়ে করে নিজের সারাটা জীবন নষ্ট করো।তাই তোমাকে মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম।পারলে ক্ষমা করে দিও। বেশি কিছু লিখতে পারলাম না মাথায় ভীষণ ব্যাথা করছে। ভালো থেকো।ইতি তোমার নেহা।'

চিঠিটা পড়ার পর সিয়ান কিছু বলতে পারলো না। শুধু তার চোখ থেকে অঝোরে কান্না ঝরতে লাগলো। সবশেষে বললো আমি ওকে এতবড় ভুল বুঝলাম!

এরপর সিয়ান কাউকে বিয়ে করেনি।তার কাছে নেহা যেন দূরে থেকেও বহু কাছে…এটাই হয়তো ভালোবাসা, সত্যিকারের ভালোবাসা।"


ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর রোহন-ও ভীষণ কষ্ট পেল…আর বললো…

'সত্যিকারের ভালোবাসা কি এভাবেই অসম্পূর্ণ থেকে যায়..নাকি এভাবেই থেকে যায়.. দূরে থেকেও বহু কাছে।'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics