দুর্ধরা
দুর্ধরা
মগধের আকাশে আজ প্রভাত সূর্যের স্বর্ণ গৌরব কিন্তু তার মহাধিনায়কের হৃদয় তোলপাড় I সেখানে আজ জলদরাশির জমায়েত l তারা সবাই নির্ভার হবার আকুতি নিয়ে এসেছে I দাসীপুত্র একদিন রাজাধিরাজ হয়েছে আপন কর্মবলে, আজ তার কাঙাল হবার পালা l মুরা মায়ের কোল জুড়ে এসেছিলো যে, তার হাত ধরে ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে যুগান্তকারী অভ্যুত্থান I নন্দ বংশের অবসানে সিংহাসনে কায়েম হয়েছে মৌর্য বংশ Iনেতৃত্বে মুরাপুত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য I তারপরে সে এক রূপকথা ! প্রায় সমগ্র ভারতভূমি বিজিত হয়েছে তাঁর শাসন ছত্রের তলায় I ধন, যশ, নারী -বিধাতা পুরুষ দুহাতে উজাড় করে দিয়েছেন I কিন্তু তিনি তাঁর পাওনা বুঝেও নিয়েছেন কড়ায় গন্ডায় I রক্তের দামে, চোখের জলের দামে I দুর্ভিক্ষ আর খরার ছোবলে কতবার জর্জর হয়েছে রাষ্ট্র, হারিয়েছেন কত শত প্রাণাধিক প্রিয় প্রজাদের Iএক দুঃসহ বোঝা বুকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রতি নিয়ত - দুর্ধরা ! চোখের সামনে নীল হয়ে গেলো তার শরীর তবু কোনো বিকার নেই Iমৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মুহূর্তেও কি কোনো অভিযোগ ছিলোনা তার বিস্মিত চোখে? তার তো কোনো দোষ ছিলোনা! দোষ কি তাঁরও ছিল? চোখ বন্ধ করলেন চন্দ্রগুপ্ত I দুফোঁটা লবনবারি গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে I
- মহারাজের জয় হোক I
নিজেকে গুছিয়ে নিলেন রাজা Iতিনি মহাভারতেশ্বর I দুর্বলতা শোভা পায়না তাঁর Iঘুরে দাঁড়ালেন তিনি I গবাক্ষের ম্লান আলোয় ভালো বোঝা গেলোনা তাঁর মুখের প্রতিচ্ছবি I
- আসুন আচার্য !
- মহারাজ , দয়া করে পুনর্বিবেচনা করুন সল্লেখনার সিদ্ধান্ত I সমগ্র মগধ শোকে নিমজ্জিত I আপনি চলে গেলে ওদের কোনো অভিভাবক থাকবেনা I
- বিন্দুসার রইলো I ওরা অনাথ হবেনা I
একটু যেন থমকে গেলেন আচার্য চাণক্য I ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন - উনি এখনো অপরিণত I
তাকে শিখিয়ে দেবেন I আপনি তো রইলেন I
- আপনি মহারাজ সত্যি মন পরিবর্তন করবেননা ?
- না আচার্য ,ক্ষমা করবেন I
হয়তো আমার পাপের সাজাই পাচ্ছে আমার সন্তানতুল্য প্রজারা ! নইলে পরপর এতগুলো অনাবাদি বছর !
চাণক্যের মুখ যেন সঙ্কোচ আর বেদনায় কালো হয়ে গেলো I
- রাজন , সে তো আমার ভুল, আমার পাপ ! আমার শাস্তির বিধান দিন !
চন্দ্রগুপ্ত অবনত হয়ে চাণক্যের পাদস্পর্শ করলেন ;
-সবই নিয়তি I আচার্য ভদ্রবাহু বলেন যে এই জগতে সমস্ত ঐহিক পূর্বনির্ধারিত I আমরা পুতুল খেলার পুতুলমাত্র I আমি এসব থেকে মুক্তি চাই I অস্ত্র ত্যাগ করেছি, আর রাজধর্ম পালন করি কেমন করে? এওতো আপনার অজানা নয় আচার্য যে এই বংশেই আসবে সেই রাজার রাজা ! সে প্রেম দিয়ে জিতবে চরাচর I চিন্তা নেই আচাৰ্য, আমায় বিদায় দিন I
মন্থর পায়ে প্রস্থান করলেন চাণক্য Iচব্বিশ বছরের প্রজাকল্যাণমুখী রাজশাসনের উপান্তে ছেলে বিন্দুসারকে রাজ্যপাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চললেন শ্রবণবেলগোলার পথে, নিজের স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অভীপ্সায়। নিতান্ত নিরাড়ম্বরে, আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে I লোক, লস্কর, সৈন্যসামন্ত কাউকেই নিলেননা শেষ পথের যাত্রায় I শুধু একটাই খেদ রয়ে গেলো I বিন্দুসার শেষ দেখা করতে এলোনা I বড় অভিমানী ছেলেI মুখে কোনোদিনই কিছু বলেনি I কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন সবই I মা দুর্ধরার মৃত্যুর জন্য মনে মনে তাঁকেই দোষী ঠাউরায় ছেলে I তাই বোধ হয় তাঁদের সম্পর্কটাও কোনোদিন স্বাভাবিক হয়নি I শেষবেলায় একবার মন ভরে চেয়ে দেখলেন রাজপ্রাসাদ I কত উত্থান পতনের সাক্ষী I উঠে বসলেন হাতির পিঠে Iমাহুত রওনা হলো শ্রবণবেলগোলার অভিমুখে Iচাণক্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন Iবিন্দুসার আয়োজন করেছেন বিচারসভার Iকুশলাকে ডেকে পাঠিয়েছেন মহারাজ বিন্দুসার Iকুশলার কোলে পিঠেই মানুষ তিনি I অন্তঃপুরের দাসী হলেও বিন্দুসার মা বলতে তাঁকেই বোঝে Iমাতৃহারা সন্তানের যন্ত্রণার কথা তাঁর মতো কেউ আর বোঝেনা Iবিন্দুসারের প্রতি স্নেহে যাতে কম না হয় সেই জন্য তিনি বিবাহ করেননি , গর্ভে সন্তান ধারণও করেননি Iআজ তিনি প্রধান সাক্ষ্য I আজ বিচারের দিন Iঅযাচিত দুর্ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে মা দুর্ধরার জীবন Iএই অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী মহামতি চাণক্য Iরাজপ্রহরী বন্দি করে সভায় এনেছে আচার্য চাণক্যকে রাজার অনুমতিক্রমে কুশলা বলতে শুরু করলেন - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপদেষ্টা চাণক্য Iশত্রু দ্বারা বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টার বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিষেধক তৈরী করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে তাঁর অজান্তে অল্প মাত্রায় বিষ পান করাতেন শত্রুর সম্ভাব্য বিষের আক্রমণ থেকে তাঁকে বাঁচাতে। চন্দ্রগুপ্তের শরীর এক সময় যে কোনও বিষের দংশন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পাবে - সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু অভ্যাস ভেঙে নিজের খাবার যেদিন চন্দ্রগুপ্ত ভাগ করে খেতে গেলেন স্ত্রীর সঙ্গে, সেদিন সেই সামান্য বিষই কেড়ে নিল গরলে অনভ্যস্ত তাঁর অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীর জীবন।আর সাতদিন পরই সন্তান প্রসবের কথা ছিলো। বিষক্রিয়ার খবর পেয়ে ছুটে এলেন চাণক্য। বিষের তেজে এলিয়ে পড়েছেন দুর্ধরা Iখাবারের থালা হাতে পাশে চন্দ্রগুপ্তকে দেখে চমকে উঠলেন চাণক্য। চাইলেন একটা ছুরি। দুর্ধরার গর্ভ থেকে তারপর তুলে আনলেন এক শিশুপুত্রকে। চন্দ্রগুপ্তের কোল আলো করে এলেন বিন্দুসার আর মন কালো করে চলে গেলেন দুর্ধরা।বৃদ্ধা বললেন - মহারাজ, বিষের আক্রমণ থেকে বিদগ্ধ ক্ষিপ্রতায় আপনাকে বাঁচিয়ে সেদিন পৃথিবীর মুখ দেখান আচার্যই। তবু একবিন্দু বিষ মাতৃগর্ভে ছুঁয়ে ফেলে আপনার কপাল। তাই মহারাজের কপালে আজও একটি নীল টিকা, তাই মহারাজের নাম বিন্দুসার। আচার্য নীরবে শুনলেন সমস্ত কথা Iক্রোধ নয়,অনুশোচনা নয়, এক অদ্ভুত শূন্যতা তাঁর দুই চোখে Iসমস্ত পাটলিপুত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বিচারের রায় শোনার অপেক্ষায় Iআচার্যকে বিশ্বাসঘাতক ভাবার জন্য বিন্দুসার ক্ষমা চাইলেন, সসম্মানে মুক্তি দিলেন তাঁকেI স্মিত হেসে আচার্য আশীর্বাদ করলেন বিন্দুসারকে Iসভাশেষে ফিরে এলেন নিজের মহলে Iকুরূপ হওয়ার জন্য একদিন অপমানিত হয়েছিলেন নন্দ রাজসভায়, তারপর প্রতিশোধস্পৃহায় রাজা তৈরির খেলায় মেতে উঠেছিলেন Iএকসময় রাজনীতি হয়ে উঠলো তাঁর নেশা Iরাজনীতির সেই কুটিল মারপ্যাঁচে বলি হয় দুর্ধরা Iআজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান সব I বিষে জর্জর মরণাপন্ন মা আর তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে সদ্য জঠর মুক্ত নবজাতক Iসেই অবোধকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মায়ের থেকে Iরাজপ্রাসাদের অলিন্দে আজও যেন প্রতিধ্বনিত হয় শিশুর নিষ্ফল আর্তি Iবুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে চাণক্যের Iসত্যিতো! কী দোষ ছিল ওই শিশু আর তার মা বাবার ? অনুচরদের স্বেচ্ছামৃত্যুর চিতা সাজানোর নির্দেশ দেন চাণক্য Iসমস্ত সম্পদ বিলিয়ে দেন খরা কবলিত দেশবাসীর মধ্যে Iস্বয়ং বিন্দুসারও টলাতে পারেনি তাঁর সিদ্ধান্ত Iচিতা প্রস্তুত ,ধ্যান মঞ্চে নিবিষ্ট আচার্য চাণক্য Iআত্মগ্লানিতে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে বিন্দুসার Iদাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন Iলেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেললো Iকয়েক মুহূর্ত পরে মৌর্য সাম্রাজ্য হারালো পৃথিবীর অন্যতম সেরা রাজনীতিবিদ তথা অর্থনীতিবিদকেI
তপ্ত লাভা বেরিয়ে এলো হতভাগ্য বিন্দুসারের চোখ বেয়েI মাতৃহারা পিতৃহারা সে আগেই ছিল, আর আজ হারালো সাম্রাজ্যের প্রকৃত অভিভাবককে Iএবার তার একার লড়াই Iআজ আবার মগধের আকাশ সোনায় সেজেছে Iইতিহাসের অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণ Iঅখণ্ড ভারতের যে সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হচ্ছে, তার মহীরুহ পরিণতি অনেকটাই নির্ভর করছে বিন্দুসারের দক্ষতার ওপর Iদাক্ষিণাত্য বাগে আনা যায়নি, তার ওপর গ্রীক হানা হলো বলে Iচোয়াল শক্ত করে সে তাকিয়ে রইলো দিগন্তলীন সীমানার দিকেI মহাকাল কোন পথে চালিত করবেন মৌর্য সাম্রাজ্যের নিয়তি?