Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

1.7  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

দ্বিতীয় পিতা

দ্বিতীয় পিতা

4 mins
651


সেই কোন ছোট্টবেলায়, বোধহয় ক্লাস এইটে কি নাইনে সবে পড়ে তখন, বিয়ে হয়ে গেলো অমিতার। একবার মায়াপুরে বাপেরবাড়ি থেকে কৃষ্ণনগরে শ্বশুরবাড়ি যেতে গিয়ে, ওরা বেজায় ঝড়বৃষ্টিতে পড়েছিলো। অমিতারা সেই বৃষ্টি মাথায় করেই নদী পেরিয়েছিলো, চূর্ণীনদী। ছইঢাকা নৌকায়।


পৌঁছতেই হবে সেদিন শ্বশুরবাড়িতে, ভাদ্রের সংক্রান্তি সেদিন, নিজের বাড়িতেই রাত কাটানো নিয়ম বাড়ির ছেলে বৌয়ের। অগত্যা, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করেই নৌকাযাত্রা।


মাথার উপর শেষ ভাদ্রের স্লেটরঙা আকাশে যেন ঝুলে রয়েছে থোকা থোকা ভারী মেঘের দল। এতো নীচে নেমে এসেছে মেঘেরা, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। আকাশ আর মেঘের ছায়ায় চূর্ণীর সবজেটে জল তখন কালচে। সেই কালো ঢেউয়ের তালে দোলে নাচছে যেন সেই ঘনশ্যাম মেঘের ছবি। শুরু হয়েছিলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর শনশনানি হাওয়া আগেই। এবার বৃষ্টিফোঁটাদের মাপ বড়ো হয়েছে। দুরুদুরু বুকে অমিতা আর তার বর সুরেশ, সঙ্গে আরো ক'জন যাত্রী নৌকায় চেপে বসলো, ওপারে যাবে বলে। বুড়ো মাঝি আকাশে চেয়ে গলায় জোর এনে অমিতার ভীরু মুখ দেখে বলেছিলো, "বোসো গো মা জননী, ভয় পেয়ো নি, ঠিক পৌঁছে দেবো।" আর ছোকরা স্যাঙাত মাঝিটি তার গামছাটা মাথায় ফেট্টি করে বেঁধে, ততক্ষণে নোঙর নিয়েছে তুলে।



নৌকা যখন মাঝনদীতে, হাওয়ার টানে নৌকাটা যেন এক মোচার খোলের মতো, এই উল্টে পড়ে তো, সেই উল্টে পড়ে। হঠাৎ চূর্ণীর ঘূর্ণিপাকে পড়ে নৌকার নিশানা গেলো ঘুরে। দু'পাক ঘুরে নৌকার দিশা গেলো বেঁকে। দু'জন মাঝি পাগলের মতো দাঁড় টেনে নৌকার মুখ ফেরাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই নৌকার মুখ আর ফেরে না। উদ্দাম ঝোড়ো হাওয়ায়, খোলা আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা বুক চিরে বিজলি হেনে যায়। কী কর্কশ সেই আওয়াজ, যেন কানের পর্দা ফেটে ফর্দাফাঁই হবে।




বুড়ো মাঝির মুখে তখন ভয়ের চিহ্ন, বৃষ্টিরেখা ভেদ করে তার পাথরকোঁদা কালো পিঠে স্পষ্ট ঘামের রেখা। ছোকরা স্যাঙাত মাঝির কপালের দু'পাশের রগ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অসহায় পরিশ্রমসাধ্য ঘাম।অমিতার দু'চোখ বিস্ফারিত, সুরেশ তিনমাসের পুরনো বৌয়ের হাত নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে দেখছে বৃষ্টিধারায় অস্পষ্ট দূরের পাড়ের দিকে।একটা বৃদ্ধ মানুষ, আর এতোগুলো কচিকাঁচা যাত্রীর দল, বড়ো তাড়া ছিলো যে তাদের নদী পারানির। এতোগুলো যাত্রীর ভাগ্য ঐ বৃদ্ধের হাতের বৈঠায়। একসময় শেষ হোলো ঝড়বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর সাথে দুই মাঝির হাতের টানা দাঁড়-বৈঠার লড়াই। কে ঈশ্বর, আজ অমিতা-সুরেশ আর বাকী ছানাপোনা সমেত যাত্রীদের কাছে? কিভাবে প্রকৃতির রোষকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আর এক অসম লড়াইয়ে জিতে রক্ষা করেছে নিজের দেওয়া কথার মানকে, আর অভিজ্ঞতায় নিজেকে!



আজন্মকাল ধরে এমনি করেই কিছু কিছু মানুষ, সর্বক্ষণ নিজেরাই নিজেদের অতিক্রম করে চলে। চেষ্টা করে চলে জেতার, কখনো জেতে, তবে কখনো বোকার মতো হেরেও তো যেতে পারে! কিন্তু ভাবে না তারা সে কথা, ঈশ্বরের সাথে লড়াইয়ে নামে কখনো, নিয়তিকে হারিয়ে দেয় কখনো, আবার কখনো নিজেই হেরোভূত হয়ে যায়।


বালিকা বধূ অমিতা নৌকা থেকে নেমে বর সুরেশের হাত ছেড়ে, পাঁকে কাদায় হাঁচোড়পাঁচোড় করে ছুটে গিয়ে বৃদ্ধ মাঝির পা জড়িয়ে ধরেছিলো, কাঁদতে কাঁদতে। বুড়ো মাঝি রহিম মিঞা একহাত জিভ বার করে বলেছিলো, "আরে বেটি, ছাড়! যেটুক তোদের দয়ায় পুণ্যি জমা করলাম, তার সবটুকুকে পাপের ঘরে পাঠিয়ে দিলি রে মা?" অমিতার সেসব কথায় কান নেই। সে নিজের বড়ো ব্যাগটা খুলে তখন শ্বশুরবাড়ির জন্য পাঠানো মিষ্টির হাঁড়িতে হাত ডুবিয়ে তুলে এনেছে একমুঠো মিষ্টি, তারপর বৃদ্ধ মাঝির হাতে দিয়েছে মিষ্টি। বৃদ্ধের দু'চোখ থেকে বাঁধভাঙা জল। কাঁধের ভিজে গামছা দিয়ে চোখ মুছে ছোকরা মাঝিকে দিয়ে মিষ্টি নিজেও মুখে দিলো।



সুরেশ বাদলঘেরা ভাদ্রবেলায় নতুন বৌ অমিতার মুখে অকালে দীপাবলি দেখলো। জন্ম হোলো এক নতুন সম্পর্কের। মেয়ে জামাইয়ের পারানির পয়সা আর কিছুতেই নিলো না বৃদ্ধ মাঝি। আর তার পর থেকে প্রতি ভাইফোঁটায় ছোকরা মাঝি ঠিক এসে দিদির বাড়িতে নিজের জালে ধরা মাছ, কখনো ইলিশ, কখনো আড় বা রিঠে মাছ নিয়ে এসেছে। অমিতাদিদির কাছে ফোঁটা নিয়ে গেছে।



প্রথম প্রথম সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু সুরেশ বুঝতো, জানতো অমিতার সেই সেদিনের পারানির কথা। অমিতা সুরেশ এখন পাকা সংসারী কর্তা-গিন্নি, তবু কালেভদ্রে মায়াপুরে বাপেরবাড়িতে গেলে ঠিক তার প্রাণদায়ী মাঝিবাবার সাথে দেখা করে দু'টো মিষ্টি খাইয়ে যায়, কি শীতে একখানা তূষের চাদর দিয়ে যায়। সুরেশই নিজে সঙ্গে করে অমিতাকে নিয়ে যায়, কারণ সুরেশও বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে ঐ বৃদ্ধ মাঝিই তাদের দ্বিতীয় পিতা, নব জন্মদাতা।

অমিতার সেই ছেলেবেলার পারানির বৃদ্ধ মাঝিকে অমিতা ভালোবেসেছিলো জাতপাত ধর্ম অধর্মের ঊর্দ্ধে উঠে। সেই ভালোবাসা অকৃত্রিম। এখন অমিতা নিজেই বৃদ্ধা, সুরেশ চোখ বুজেছে চির নিদ্রায়। অমিতার অন্তরের মাঝে গুঞ্জরিত হয় শুধু একটিই শব্দ.... ভালবাসা। যা পেরেছে, যেটুকু পেরেছে, ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি সবাইকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। অমিতার হিসেবে বাকী এখনো অনেক। যা পারে নি, লজ্জা পায় নি তার জন্য। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে নি অমিতার।


তবে অমিতা বোঝে সেও আরেক রকম মস্ত এক ফাঁকি। তবে অমিতা বিশ্বাস করে, "সব ফাঁকি ভরাট হয় ভালবাসায়, সব ক্ষতও একসময় শুকিয়ে যায় স্নেহের পরশে। অমিতার আটাত্তর বছরের শরীরটা তো তাই আজো ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ায়। দু'হাতে সাধ্যমতো বিলিয়ে যায় অকৃপণ ভালোবাসা। মানুষ ভগবানের পুজোয় লাগে অকুন্ঠ সদিচ্ছা। ফুল চন্দন আর মন্ত্রোচ্চারণের ঈশ্বরপ্রাপ্তিতে অমিতার বিশ্বাস নেই।




আর আজ তাই অমিতা যাচ্ছে নয়াদিল্লি..... ভারত সরকারের আমন্ত্রণে, কী একটা পুরস্কার নিতে! ও হ্যাঁ, সেবামূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য "পদ্মশ্রী" পুরস্কার নিতে। আজ আর অমিতার আফশোষ নেই স্কুলের পড়া অসময়ে শেষ হয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ার জন্য। আজ এই পুরস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাই দু'জন মানুষের অভাব খুব অনুভব করছে অমিতা, স্বামী সুরেশ আর তাদের দ্বিতীয় পিতা সেই পারানির বৃদ্ধ মাঝি রহিম মিঞাকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational