ABHISEK DUTTA

Tragedy Others

3  

ABHISEK DUTTA

Tragedy Others

দায়ভাগ

দায়ভাগ

6 mins
372



স্কুল থেকে ফিরেই লেখাটা নিয়ে বসে পড়েছিল তপতী। আগামী মাসের পনেরো তারিখ স্কুল প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী বর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার বছরে পাড়ার কয়েকজন মিলে স্থাপন করেছিল এই গার্লস স্কুলটি - যাতে পৰ মেয়েদেরকে আর দূরে পড়তে যেতে না হয়। সেটাই কোনোক্রমে টিমটিম করতে করতে শতাব্দীর সিকিভাগ পূর্ণ করতে চলেছে। সেই উপলক্ষ্যেই একটা ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তপতী যেহেতু ইংরাজীর শিক্ষিকা তাই প্রধানশিক্ষিকা তার ওপরেই ভার দিয়েছেন একটা একাঙ্ক ইংরাজী নাটককে ছাত্রীদের উপযোগী করে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য। হয়তো বা পরিচালনাটাও তাকেই করতে হবে। সেজন্যই একটা ইংরাজী ছোট হাসির গল্পের নাট্যরূপ দেবার চেষ্টা করছিলো তপতী ।


তপতীর বাবার ছিল দোকান। কিন্তু ভদ্রলোক কোনো ভাবেই ব্যবসায়ী প্রকৃতির ছিলেন না। একটার পর একটা ব্যবসা পাল্টেছেন, আর বাড়িয়েছেন লোকসানের বহর । অবশেষে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে অকালেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন তিনি - পিছনে রেখে গেছেন বিবাহযোগ্যা বড়ো মেয়ে, দুটি নাবালক পুত্র আর বিধবা স্ত্রীকে । শুধুমাত্র ছোট মেয়ে রঞ্জনারই বিবাহ দিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি। আর সেটাও নিতান্ত দৈবচক্রেই। এক আত্মীয়ের বিয়েতে রঞ্জনাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেছিলো ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের। তপতীই বাবাকে জোর করে রঞ্জনার বিয়ের ব্যবস্থা করিয়েছিলো। আজও তপতীর মনে পড়ে রঞ্জনার বিয়ের পাকাকথা মেটার দিন রাত্রিবেলা বাবা ওর মুখের দিকে কিরকম একটা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন । কিন্তু বিয়ের পরেই পতিব্রতা কন্যাটি বাপেরবাড়ীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ঘুচিয়েছিলো। কুলোকে অবশ্য বলে জামাইবাবাজী সাতঘাটের জল খাওয়া এক ঘোড়েল – শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা সুবিধের নয় বুঝেই নিরাপদ দূরত্ব অবম্বন করেছিল। ওস্তাদ গায়কের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছিল তার সহধর্মিনীটিও। বাবার মৃত্যুর পরেই অবশ্য মেয়ে জামাইয়ের পায়ের ধুলো পড়েছিল ওদের বাড়ীতে। আর সেই দূর্দিনেই তপতী বুঝে গেছিলো ভাত দিতে না পারুক, কিল মারার নাহোক ক্ষমতা আছে গোঁসাই বাবাজীবনের। একে সংসারের গুরু দায়িত্ব অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এই দুইয়ের চাপে দিশেহারা হয়ে একদিন আর থাকতে পারলো না তপতী। কঠিন গলায় কথামালার সেই বালকটির কথা বলেছিলো ভগ্নীপতিকে - জলে ডুবে যাবার সময় পাড় থেকে যাকে উপদেশ দিছিলো এক ব্যক্তি। ফলশ্রুতি হাতে হাতে। ভগ্নীপতিটি শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে, না না সম্পূর্ণ সম্পর্ক ত্যাগ করেনি, স্ত্রী, পুত্রকন্যার নলচের আড়াল দিয়ে সেটা বজায় রেখেছিলে । তবে আত্মীয় মহলে তপতীর যে চরিত্র চিত্রণ করেছিল, তার সঙ্গে কুখ্যাত একনায়কদের বেজায় মিল।


তপতীর অবশ্য তখন সে সব দিকে মাথা ঘামানোর সময় ছিলোনা। ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ এই প্রবাদবাক্যটার মর্ম সে তখন ভালোভাবেই হৃদয়ঙ্গম করেছে। প্রায় দৈবানুগ্রহের মতোই সেই সময় এসেছিলো একশো তিরিশ টাকা মাসমাইনের স্কুল চাকরিটা। সেই একশো তিরিশটাকা আর তপতীদের মামারবাড়ীর মাসোহারা কুড়ি টাকা - এই দেড়শো টাকা সম্বল করেই তপতীদের সংসার সমুদ্রে তরী ভাসানো - অভাবের ঢেউয়ে টলমল করাই যার রোজনামচা। তবে এই অভাবের সংসারের নিত্য যন্ত্রণাও তপতীর প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে পারেনি। বাবার এক বন্ধু আর তার স্ত্রী সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন তপতীকে। তবে সে ভদ্রলোকেরও অদ্যভক্ষ ধনুর্গুন অবস্থা। তবে অর্থ সাহায্য করতে না পারলেও, সাহস দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে আর সময়োপযোগী সৎ পরামর্শ দিয়ে তপতীর গতিপথকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেননি। বোধহয় এই নবীনা কর্ণাধারটির মধ্যে নিজের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন বিলিতি চকোলেট কোম্পানির কর্মচারীটি। আর দিয়েছিলেন বিপুল আত্মবিশ্বাস - হাস্যমুখে অদৃষ্টকে পরিহাস করার সাহস। তার জোরেই তপতী এগিয়ে চলছিলো সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে - ভগ্নীপতির তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর টিটকিরিকে অগ্রাহ্য করে। এই যন্ত্রণার মরূভূমিতে একমাত্র মরূদ্যান তার সামান্য এই লেখালিখির অভ্যাসটুকুই। সাহিত্যজগতের সেই ছোট্ট জানলাটাই তপতীর কাছে ধূলায় ধূলায় মুক্তির স্বাদ এনে দিতো।


লেখাটা প্রায় শেষ করে এনে ফেলেছে, এমন সময় সদরদরজার কড়াটা বেশ জোরে বেজে উঠলো। দরজা খুলেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে তপতী দেখলো রঞ্জনা আর তার দুই আল্হাদি ছেলে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বত্রিশপাটি দাঁত বের করে রঞ্জনা বললো, তোমার ভগ্নীপতি ব্যবসার কাজে দুদিনের জন্য বাইরে গেলো - আর ওরাও আবদার ধরলো মামারবাড়ী যাবো, তাই নিয়ে এলাম।


সহজ সুরে তপতী বললো বেশ করেছিস, ভেতরে যায়। তারপর সদরদরজাটা বন্ধ করতে করতে মনে মনে ভাবতে বসলো মাসের শেষ হতে কত বাকি আর হাতেই বা কত টাকা আছে !


রাত্রিবেলা আলালের ঘরের দুলাল দুটোর কথা শুনে পিত্তি চটে গেলো তপতীর। আদরের সাতপর্দা তুলে দিদিমার হাত থেকে গুড়ের কৌটোটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে খোক্কসদুটো - গুড় ঢেলে দুধটাকে পুরো লাল করতে হবে দিদিমাকে। তপতীর মা বিপন্ন গলায় বলে চলেছে, দুধ যথেষ্ট মিষ্টি হয়েছেরে বাবা। মনে মনে বোধ হয় ভাবছে বাকি মাসের গুড়টুকু কি ভাবে বাঁচাবে ওই খোক্কসদুটোর হাত থেকে। কঠিন গলায় তপতী বলে ওঠে , গুড়টুকু দিয়ে দাও মা। তারপর বেরিয়ে আসে বাইরে - মনটা তেতো হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে খোক্কসদুটোর হাসির আওয়াজ।


পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই তপতী শুনতে পেলো, রঞ্জনা আদুরী গলায় বড়ভাই দেবুকে বাজার থেকে কি কি আন্তে হবে তার ফিরিস্তি দিচ্ছে। একটা ছোটোখাটো ভোজের আয়োজন করতে হবে শুধুমাত্র তার আর তার ছেলেমেয়েদের জন্য। বিশেষতঃ তাদের বিনে পয়সার রাঁধুনি দিদিমা আর মামারবাড়ীর উনুন যখন আছে। তবে ভোজটা শুধুমাত্র সে আর তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এই যা। দেবুকে দেওয়া ফিরিস্তিগুলো শুনতে পায় তপতী। পাকা রুইমাছ, মহার্ঘ্য সবজি, ভালো সর্ষের তেল - ওকে জাগতে দেখে বোধহয় আরও শুনিয়ে বলে রঞ্জনা। তপতী ভাবতে থাকে দেবু এতো সব বাজার এনে কখন যাবে টাইপের স্কুলে আর কখনই বা বড়োবাজারে - বাবার দোকানের কিছু টাকা আটকে আছে ওখানকার এক ব্যবসায়ীর কাছে। সেখানেই নিয়মিত তাগাদায় পাঠায় দেবুকে। মরুকগে, যাক আজকের দিনটাতো শুধু সন্ধ্যাবেলাতেই আপদ বিদায় হবে। হাতমুখ ধুয়ে চায়ের কাপটা নিয়েই লেখার টেবিলে বসে পড়ে তপতী। লেখাটা শেষ করার জন্যই স্কুলের বড়দি আজ ওকে এই ছুটিটা দিয়েছেন। তাই আজকেই এটাকে ফাইনাল করে ফেলবে সে। বেশ তরতর করে লেখাটা এগিয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা বেশ খুশিয়াল হয়ে ওঠে।

দুপুরবেলা ওর মা এসে দাঁড়ায় টেবিলের সামনে। মৃদুস্বরে বলে, অনেক বেলা হয়ে গেলো তপু, এবার স্নান করে খেয়ে নে।

- হ্যাঁ চলো, ছোটু ফিরেছে?

- না, ফিরবে আর কিছুক্ষনের মধ্যে। আজ ওদের হাফছুটি।

একেবারে ছোট ভাইটিকে নিয়ে তপতীর গর্বের শেষ নেই। প্রচন্ড মেধাবী, স্কুলের শিক্ষকরাও ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । অভাবের সংসারে ওরাইতো তপতীর একমাত্র ভরসা।


স্নান সেরে আসতেই ওর মা ভাত বেড়ে দেয় - তারপর মৃদস্বরে বলে ওঠে, একটু মাছের তরকারি দিই তপু।

তপতী হেসে বলে, গলা দিয়ে নামবে না মা। তার চেয়ে আলুভাতে আর ডাল দিয়ে দাও, খাওয়া শেষ করি।

তপতীর খাওয়া শেষ হতেই ছোটু স্কুল থেকে ফেরে। মা তাড়াতাড়ি ওর খাবার বেড়ে দেয়। রঞ্জনা ওর ছেলেমেয়েদুটোকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই সুযোগেই ছোটুকে খাইয়ে দিতে চায় ওর মা। খোক্কসদুটো জেগে উঠলেই ছোটমামার ওপর এমন উৎপাত শুরু করবে যে বেচারার আর খাওয়া হবেনা। পায়ে পায়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসে তপতী। লেখাটাকে ঘষামাজা করতে থাকে। বেশ ভালোই লাগে, তৃপ্তির একটা ভাব ফুটে ওঠে মনের মধ্যে।

হঠাৎ রান্নাঘর রঞ্জনার তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ ভেসে আসতেই সচকিত হয়ে ওঠে তপতী। কি ঝামেলা বাধ্য আবার! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে একদিকে ওর মা চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ভাতমাখা অবস্থায় বসে আছে ছোটু, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সবার দিকে - আর রঞ্জনা তীব্র আনুনাসিক সুরে ধমকে চলছে মাকে। ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগে তপতীর - তারপর বুঝতে পারে। রঞ্জনার আনা মাছটার মুড়ো আর ল্যাজাটুকু রেখে দিয়েছিলো মা –সেদুটো দিয়ে ছোটুকে ভাত বেড়ে দেবার সময়ে অকুস্থলে রঞ্জনার আবির্ভাব। আর তারপরেই তার স্বামীর পয়সায় কেনা মাছ কেন অন্যকে দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে মায়ের কৈফিয়ত তলব।

বড়োমেয়েকে দেখে বোধহয় একটু ভরসা পায় মা - নীচুস্বরে বলে, মুড়ো আর ল্যাজায় কোনো মাছ ছিল নারে রঞ্জু ...

-থাকে মা, তোমাকে আর বোঝাতে হবে না। আমার ছেলে মাছের মুড়ো খেতে কত ভালোবাসে তা তুমি জানোনা! কি আক্কেলে তুমি ও দুটো আলাদা করে রেখেছো....

ইতিমধ্যে রঙ্গমঞ্চে খোক্কসদুটোর আবির্ভাব হয়েছে ।

- সবকিছু টিফিনক্যারিয়ারে গুছিয়ে দাও, আমরা বেরোবো - এই বলে দুপদুপ করে পা ফেলে চলে যায় রঞ্জনা।

মাতৃঅনুগামী হয় খোক্কসদুটো। 

অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে মা। কিন্তু ততক্ষনে অপমানে তপতীর মুখ কালো হয়ে গেছে। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ও দুটো কেন রাখতে গেছিলে মা। অন্যদিন তো মাছ না হলেও আমাদের চলে যায়। মেয়ের এঁটোকাঁটা তোমার ছেলেকে না দিলেই চলছিলো না।

ছোটুকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িতে থাকে তপতীর মা। চোখ দিয়ে জাল গড়িয়ে পড়ে! বিকেলবেলায় রঞ্জনারা বিদায় হয়েছে। যতক্ষণ ছিল ততক্ষন বাপেরবাড়ীর লোকজন কত খারাপ বলে গেছে ইনিয়ে বিনিয়ে। বাড়ি থেকে চলে যেতে বাড়িটা যেন শান্ত হল।

রাত্রিবেলা সারা বাড়ী নিস্তব্ধ।দুপুরের ঘটনার পর থেকেই তপতীর মা জানলার ধরে চুপ করে বসে ছিল। ছোটু ঘুমিয়ে পড়েছে। দেবুর আসার সময় হল। ছাদে একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়েছে তপতী। তাকিয়ে আছে ঝকঝকে আকাশের দিকে। তারার মেলা বসেছে সেখানে। তপতীর মনে পড়ে ছোটবেলায় এরকমভাবেই ছাদে বাবার পশে শুয়ে থাকতো, আর বাবা চিনিয়ে দিতো তারাগুলো - সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ আরো কত কি! ধ্রুবতারার দিকের তাকিয়ে বাবা মেয়ে গেয়ে উঠতো, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা । সেসব কথা ভেবে মনে মনে হাসে তপতী। কতদিন হয়ে গেলো, সবকিছু কেমন যেন পাল্টে গেছে! ধ্রুবতারা আজ একজায়গাতেই আছে, কিন্তু আজ আর তপতীর গলা দিয়ে ওই গান বেরোয় না। তার বদলে সে গুনগুন করে ওঠে, আমাকে যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি !


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy