Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Fantasy Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Fantasy Others

চুল নিয়ে চুলোচুলি

চুল নিয়ে চুলোচুলি

6 mins
171


'ও মাগো '- 

যেন হাই ভোল্টেজ কারেন্টের শক খেলাম একটা । গভীর ঘুম থেকে একেবারে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায় । ঘরের বাতানুকূল যন্ত্রটি বাইশে চলছে তবু গলা-কপাল ঘামে জবজব করছে । তাকিয়ে দেখি ঘড়িতে পাঁচটা ,তার মানে প্রায় ভোর হয়েছে । ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! আচ্ছা,এমন দুঃস্বপ্ন হলেও কী সত্যি হয়! ইতিপূর্বে ভুরিভুরি দুঃস্বপ্ন দেখেছি । বলতে গেলে দুঃস্বপ্নের ভাঁড়ার আমার পরিপূর্ণ - শুধু কামিজ পরে সালোয়ার না পরে বিয়েবাড়ি চলে যাওয়া , ভূগোল পরীক্ষার দিন রুটিন ভুলে জীবন বিজ্ঞান পড়ে গিয়ে খাতায় ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকা, সর্বসমক্ষে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়া ইত্যাদি ভ্যারাইটিস দুঃস্বপ্ন আমার দেখা আছে । কিন্তু 'আজি এ প্রভাতে ' এ কেমন দুঃস্বপ্ন দেখলাম! অবশ্যি এর পিছনে একটা গূঢ় কারণ আছে । কোনো অবচেতনের চিন্তাভাবনা নয়, চেতনস্তরেই এর কারণ ঘোরাফেরা করছে । 

কোনোকালে আমি যে কাজ করি না, কাল সে কাজ করেছি । রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঘন্টাখানেক ধরে ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে, ইনিয়ে-বেনীয়ে, ফুল-মালা জড়িয়ে একলক্ষ রকমের চুলবাঁধা দেখেছি । যে মানুষটির আজীবন একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করা ছাড়া ভাগ্যে আর কিচ্ছু জুটল না তার কী অতোরকম হেয়ার স্টাইল পেটে সয়, থুড়ি মনে সয়! সইলো না । হেয়ার স্টাইল, হেয়ার-ফল হয়ে দুঃস্বপ্নে হানা দিল । যত চুল আঁচড়াই, ততো ওঠে, উঠতে উঠতে শেষে মাথা ফাঁকা আর স্বপ্নের ইতি ।


এবার তড়িঘড়ি খাট থেকে নেমে বড় আলোটা জ্বালিয়ে মাথাটা ভালো করে আয়নায় দেখলাম । নাঃ, যে কুড়ি-পঁচিশটা নিজেদের মধ্যে দুগজ দূরত্ব মেনটেন করে বসে ছিল, তেমনই বসে আছে । একেবারে সমূলে বিনাশ হয় নি । দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, একসময় কী চুল ছিল আমার ! ফিমাসে বাবা কানু নাপিতের সেলুনে চুল কাটাতো । বয়স্ক কানু জেঠু বাটিছাঁট দিতে দিতেই হাঁপিয়ে যেত । ক্লাস এইটে উঠে দেখলাম বন্ধুদের চুল কোমর ছুঁইছুঁই । অতএব শখ হল, আমিও চুল রাখবো । বাটিছাঁট ছেড়ে দোকান থেকে ফিতে কিনে আনলাম । কাকিমা অ্যায়সা টাইট করে চুল বেঁধে দিতে লাগলো যে মাথাময় আঁটফোঁড়া বেরিয়ে গেল । তাও সহ্য করলাম । বৃহত্তর সুখের জন্য ক্ষুদ্র কষ্ট মেনে নিলাম । ফনফন করে চুল বাড়লো, মাধ্যাকর্ষণের টান অগ্রাহ্য করে সোজা আকাশের দিকে উঠে পড়লো । অন্যদের যেখানে বেনী খুললে চুল ঝমর করে পিঠে পড়ে, আমার সেখানে উর্দ্ধমুখী । ছোট্ট বৃত্তাকার মুখের উপরিভাগে রাশি রাশি তারকা রাক্ষসীর মতো চুল । অচিরেই নাম জুটল- কাঠির মাথায় আলুর দম । পুজোপার্বনেও শ্যাম্পু করে বেরোতে পারি না । আয়নায় মুখ দেখলেই মনে হয় যেন মা চামুন্ডা । কোনোরকমে রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলের পুঁটুলি বেঁধে মা দুর্গার সামনে গিয়ে জোড়হস্তে প্রার্থনা করি-

"মা চুলের ভার কমিয়ে গায়ে একটু মাংস লাগিয়ে দাও !"

পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-কুটুম সবাই বলে- 

"যা খায় , পুষ্টি সব চুলেই টেনে নেয়, শরীরে কিছু লাগে না ।"

প্রত্যেক প্রার্থনার তাই কমন টপিক-

"চুল একটু কমিয়ে চেহারাটা একটু শুধরে দাও মা "


প্রার্থনা মঞ্জুর হল কিন্তু যখন হওয়ার তখন না হয়ে একযুগ পরে হলো । এত্ত সিরিয়াসলি মা অবশেষে আমার প্রার্থনা শুনলেন যে কহতব্য নয় । চেহারা বাড়তে লাগলো যে রেটে, হু হু করে চুলও উঠতে লাগলো সেই রেটে । তখনও ব্যালেন্স ছিল না, এখনও ব্যালেন্স রইলো না । এখন কোমরে পেটে কেজি কেজি মেদ, মাথায় দু-চারটে চুল । সামনের পুজোয় বোধকরি ও কটাও থাকবে না । টাক মাথায় প্রার্থনাহীন ঠাকুর প্রণাম করতে যাবো । যা স্বপ্ন দেখলাম তাতে তো আশঙ্কায় সিলমোহর পড়ে গেল ।


 ঐ যে কথায় বলে না- morning shows the day, morning -এর স্বপ্নও তেমনি সারাদিনটাকে তেতো করে দিয়েছে । অফিসে গিয়ে তোম্বামুখে ফাইলের পাতাগুলো নাড়াচাড়া করা দেখে পাশের টেবিলের শ্রাবনীদি জিজ্ঞেস করলেন-

"কী হয়েছে রে সোমা ? মুড অফ,"

ভীষণ চোখ ভদ্রমহিলার । কী আর বলবো!-

"নাঃ, তেমন কিছু না । ঐ একটা বাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ ।"

"বাজে স্বপ্ন? খুব খারাপ কিছু? ভোরবেলা দেখেছিস নাকি?"

অগত্যা বলতেই হয় । গড়গড়িয়ে বলে আমারও মনটা একটু হাল্কা হয় ।ভেবেছিলাম উনি হাসবেন কিন্তু দেখি কিনা উনি ওঁনার ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা কার্ড বের করে দিলেন-

"নে, অনেক তো বিউটি পার্লার ঘুরলি, এবার ডাক্তার দেখা ।"

"ডাক্তার !" চশমাটা চোখে আর একটু এঁটে কার্ডটা দেখি---

       Dr. Aloka Roy

      MBBS, MD(Dermat)

     Dermatologist, Cosmetologist

     For appointment contact- 98xxx xxxxx

"ফোন করবো?"

"হ্যাঁ, কর ।"

" আজই?"

" হ্যাঁ, মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা । আজ বুধবার । দেরি কীসের?"

"নেবো অ্যাপয়েন্টমেন্ট?"

'অবশ্যই, যদি না স্বপ্নটা সত্যি করতে চাস ।"

শ্রাবনীদির কথায় বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে আমার । তাড়াতাড়ি ফোন লাগাই । পনেরোশো টাকা গুগল পে করে এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করি । আগামী রবিবার, বেলা সাড়ে দশটায় । বলেই দিল- টাইম নিয়ে যেতে ।

"রবিবার শ্রাবনীদি ।"

"বেশ । খুব নাম শুনি । দেখ তোর উপকারই হবে ।"


প্রকৃতির নিয়মে বুধবার থেকে রবিবার ঠিকই এসে যায় । কলার কাঁদির মতো চুল টিকটিকির লেজের মতো হয়ে যায়, এক্স এস সাইজ ডাবল এক্স এল হয়ে যায় আর বুধবার থেকে রবিবারের দূরত্ব আর কতটুকু । ঠিক সাড়ে দশটায় ক্লিনিকে হাজির হই । কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি । চারখানা এসির হাওয়ায় ভিতরটা যাকে বলে- 'চিল্ড'। আলো পিছলে যাওয়া ঝকঝকে টাইলসের মেঝের উপর সারি সারি স্টিলের চেয়ারে অপেক্ষমান বেশ কয়েকজন । আমি সোজা রিসেপশনের সামনে যাই, নাম বলি । হাস্যমুখী রিসেসশনিস্ট বাকির পাঁচশো টাকা নিয়ে বলেন-

"বসুন "

"সাড়ে দশটায় টাইম ছিল।"

"হ্যাঁ, ম্যাডাম এখনও আসেননি । আপনি দশ নম্বরে আছেন ।"


ও বাবা ! তারমানে এখন দীর্ঘ অপেক্ষা । চেয়ারে গিয়ে বসি । আশেপাশে চকচকে স্কিন, ঝকঝকে একঢাল চুলের মহিলাদের অপেক্ষারত দেখে মনে ভরসা পাই যে বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এসেছি । পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণে বেশ কিছুটা সময় কাটার পর ভিতরে আসার কাঁচের দরজাটি খুলে একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী ঢোকেন । বয়স আন্দাজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে । রিসেসশনিস্টের তৎপরতা দেখে বুঝি ইনিই ডাক্তার । পায়ে কালো হাইহিল জুতো, নীল জিন্স, সাদা শার্ট, চোখে চৌকোনা কালো ফ্রেমের চশমা কিন্তু এ কী! ভুল দেখছি নাকি! মাথায় তো উইগ মানে পরচুলা । রঙবাহারি কিন্তু পরচুলা । আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয় । দুনিয়াসুদ্ধ লোকের চুল দেখে বেড়াই আমি । এ পরচুলা না হয়ে যায় না । 

এ কী ডাক্তার দেখাতে এলাম আমি! চুল ওঠার চিকিৎসা করাতে এলাম যার নিজেরই মাথায় পরচুলা তার কাছে!


পৃথিবীটা দুলে ওঠে আমার । চেয়ারে বসে বসেই মনে হয় এবার পড়ে যাবো । চোখদুটো ঝাপসা ঝাপসা লাগে । একটা মাত্র খড়কুটো পেয়েছিলাম তাও ভেসে গেল । শ্রাবনীদি তো জানে না হেন জিনিস নেই, অথচ এটা জানতো না! ধুর ছাই কী হবে আর ডাক্তার দেখিয়ে! চলে যাবো? টাকা তো আর ফেরত দেবে না । দু হাজার টাকা! থাক, টাকা দিয়েছি যখন দেখিয়েই যাই । দেখি ডাক্তার কী বলে!

গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে থেকে অবশেষে ডাক আসে । লাল আঁচিলের সমস্যা নিয়ে ঢোকা একজন ধবধবে ফর্সা মারোয়াড়ি ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসবার পর আমি চেম্বারে ঢুকি । সুসজ্জিত একটা ছোট্ট ঘর । ঘরের উজ্জ্বল আলো ছাপিয়ে ডাক্তারের হাসিমুখ আমাকে অভ্যর্থনা জানায়-

"বসুন । কী সমস্যা?"

আবার হতাশা ফিরে আসে আমার মনে । বলে আর কী হবে? তবু বলি-

"চুল উঠছে খুব ।"

"ওঃ" - বলে সোজা আমার দিকে উঠে আসেন । মাথাটা ধরে নেড়েচেড়ে, চুলের গোড়ায় গোড়ায় আঙুল চালিয়ে দেখে নিজের সিটে গিয়ে বসেন ।


" হ্যাঁ । বেশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে মাঝখানটা । আমি ওষুধ আর একটা শ্যাম্পু দিচ্ছি । কাজ না হলে অন্য থেরাপি স্টার্ট করবো ।"

"আদৌ কিছু হবে?"

"মানে?"

"মানে আদৌ কী কিছু হবে? হলে কী আর আপনি পরচুলা পরতেন ।"

"ওঃ, এই ব্যাপার, বুঝে ফেলেছেন "- বলে হাসতে হাসতে উনি পরচুলাটা খুলে ফেলেন । কী সুন্দর করে কাটা মাথাভর্তি ছোট্ট ছোট্ট চুল ওঁনার । হাঁ হয়ে যাই আমি-

"পরচুলা পরেছেন কেন?"

"স্টাইল করে পরেছি । অনেক বড়ো চুল ছিল যখন পরতে পারতাম না । এখন চুলটা কাটার পর একটু ট্রাই করেছি ।"

"চুলটা কাটলেন কেন?"

"আসলে আমার এক বন্ধুর একটা এন জি ও আছে । ওরা ক্যান্সার পেশেন্টদের জন্য উইগ বানায় আসল চুল দিয়ে । সেগুলো দেখে আপনিও বুঝতে পারবেন না ।"

ওঁনাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠি-" আমিও কী চুল দিতে পারি? এ তো মহান কাজ।"

"আপনি? হ্যাঁ, তা পারেন বৈকি । "

"তাহলে ঠিকানাটা একটু লিখে দিন ।"

"আচ্ছা , বেশ ।"

" চুল ছোট করে কাটলে তো চুল ওঠাও কমে, তাই না "

চোখের এককোনায় হাসির ঝলক খেলে যায় ওঁনার-

"হ্যাঁ তা কমে, অবশ্যই কমে ।"

তড়বড় করে আমি বলে উঠি-

"আর উইগটা কোথা থেকে কিনেছেন তাও লিখে দেবেন ।"

"কেন?"

"বলা তো যায় না, যদি দরকার পড়ে।"

"না, না, আমি থাকতে দরকার পড়বে না ।"- বলে প্রাণখুলে হাসতে থাকেন ডক্টর অলকা ।

লোকে বলে- কেশই নাকি বেশ, কেশেই যাবতীয় সৌন্দর্য । ভুল, একদম ভুল । আসল সৌন্দর্য নিহিত থাকে হাসিতে, প্রাণখোলা হাসিতে ।।


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy