বন্ধু চল
বন্ধু চল
খেলা শেষের বাঁশি বাজতে আর বোধহয় তখন মিনিট খানেক মাত্র বাকি। ফলাফল তখনো গোলশূন্য চলছে। জয়ী দল পাবে কালীকিঙ্কর মেমোরিয়াল ট্রফি।
প্রায় নিজের পেনাল্টি বক্সের কাছে বলটা পায়ে পেলো সাত্যকি। লেফট হাফে খেলে সে। বলটা পায়ে নিয়ে মসৃনভাবে উপরে উঠতে থাকলো লেফট উইং ধরে। একটা আউটসাইড ডজে ছিটকে গেলো একজন। এবারে দু'দিক দিয়ে দু'জন তেড়ে আসছে। বাঁদিকে একটা ফেইন্ট করেই ইন্সাইড কাট করে সোজা পেনাল্টি বক্সের বাঁদিকের কোণের কাছে পৌঁছে গেলো। দর্শকদের তীব্র কোলাহল তখন আর তার কানের মধ্যে পৌঁছাচ্ছেনা। জলে ডুব দিকে যেমন একটা গুমগুম আওয়াজ পাওয়া যায়, সেরকম আওয়াজ শুধু আসছে। সম্পূর্ণ ফোকাসড সে। কিন্তু কী করবে এখন সে? এখান থেকেই শট করবে নাকি? ওদের দুটো ব্যাক আর গোলকিপার এমন লাইন করে দাঁড়িয়ে, গোলের অ্যাঙ্গলটা ছোট করে দিয়েছে যে, গোল হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু গোলটা করতে পারলেই নগদ পাঁচহাজার টাকা পুরস্কার আছে। বাবার চাকরিটা গেছে, ইস্কুলের খরচ আর টানতে পারছেনা বাবা ও বুঝতেই পারে। শটটা নেবে? যদি গোল না হয়? পা পিছনে করে কিক মারবার জন্য প্রস্তুত হয় সতু। কিন্তু ওই মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যেই গুমগুম শব্দটা ভেদ করে গেমস টিচার শঙ্করবাবুর কথা ভেসে আসে ওর কানে। স্যার প্র্যাকটিসের সময় বলতেন, "খেলার সময় সেল্ফলেস হতে হবে তোকে। নিজের কথা ভাববিনা। মনে রাখবি, তুই হাফে খেলিস, তুই হলি আসলি গেমমেকার। তোকে স্বার্থহীন হতে হবে। গেমমেকাররা গোল করায়, নিজের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় দলকে।" ডান পাটা পিছন থেকে এগিয়ে এসে বল স্পর্শ করে।
আউটস্টেপের আলতো টোকায় বলটা সে ভাসিয়ে দেয় বক্সের উল্টোদিকে, যেখানে সবার অলক্ষ্যে তখন পজিশন নিয়ে নিয়েছে কাঞ্চন, তাদের স্কুলের সেরা স্ট্রাইকার।
বক্সের ডানদিকে বুক দিয়ে বলটা রিসিভ করে পায়ে নামিয়ে অরক্ষিত গোলের দিকে শটটা নিয়ে যাবে কাঞ্চন, চোখ পড়ে সতু'র দিকে। প্লেটে করে রসগোল্লা দেবার মতো গোলটা সাজিয়ে দিয়েছে সে তাকে। ব্যাকদুটো আর গোলকি তখন সবেমাত্র মুখ ফিরিয়েছে তার দিকে, গোল ফাঁকা। শঙ্করস্যারের গলা ভেসে আসছে তার মনে, "তুই স্ট্রাইকার, তুই স্বার্থপর , তুই খালি তেকাঠিটা চিনবি, আর কিছু না। হ্যাংলা বিড়ালের মতো ছোঁকছোঁক করবি সবসময় পেনাল্টি বক্সের সামনে।"
ডানপায়ে বলটা পড়ার পরে একবার নাচিয়ে ভলিটা নিল কাঞ্চন।
সাত্যকি দাঁড়িয়ে ছিলো পেনাল্টি বক্সের বাঁদিকে গোলপোস্টের থেকে হ্যান্ডশেক করা দূরত্বে। অবাক হয়ে সে দেখলো, দ্বিতীয় পোস্টের থেকে একটু আগে একটা ক্রস করেছে কাঞ্চন, নিজে গোলে শট না করে। সে পায়ে বল নিয়ে যে একবার নাচিয়েছিলো,চতখনই দুই ব্যাক আর গোলকিপারকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলো। এদের তিনজনেরই মোমেন্টাম তখন কাঞ্চনের দিকে। বাঁ পায়ে চলতি বলেই টোকা মেরে বলটা ফাঁকা গোলে ঠেলে দিতে কোনই অসুবিধে হলোনা তার এবার।
"গোওওওল" গর্জনটা আছড়ে পড়ার আগেই রেফারির বাঁশি বাজলো। এক গোলে ট্রফি জিতে নিলো কালীকিঙ্কর মেমোরিয়াল বিদ্যালয়।
বিজয়ী গোলদাতার পাঁচহাজার টাকার চেক নেবার সময় চোখ চিকচিক করে উঠলো সাত্যকির। টাকাটা যে তার কতটা দরকার ছিলো, তা জানতো কাঞ্চনকিঙ্কর বসু, কালীকিঙ্করের নাতি। একসাথেই ছোট থেকে ফুটবল খেলে বড় হয়েছে তো দু'জন।