বিপ্লব
বিপ্লব


তখন ঠিক রাত আটটা বেজেছে। আজ সাধারণ নির্বাচনের দিন ছিলো। একটু আগেই ভোট শেষ হয়েছে। ইতস্তত পাড়ার দাদাভাইরা নিজের নিজের পার্টি অফিসের সামনে সবুজ বা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছে। এদিক ওদিকে দু'একজন পুলিশ কনস্টেবল লাঠি হাতে বিরসবদনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকাই ওদের কাজ, আর কোন গন্ডগোল বাঁধলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে বিশাল গাম্ভীর্য নিয়ে অবলোকন করা। অবিশ্যি কখনো সখনো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে, দু'একটা খুন জখম হবার পরে থানায় ফোন করে ফোর্স নিয়ে আসার কাজটা তারা করে থাকেন ঠিকই।
এমতাবস্থায়, চারিদিকে একটা চাপা উত্তেজনা। দুই পার্টিই তল ঠুকছে বসে বসে। সামান্য একটু ফুলকি পেলেই লেগে যাবে দাবানল। এর মধ্যেই রামগড় মোড়ের বাসস্ট্যান্ডের ঠিক বাঁ পাশে চায়ের দোকানটার সামনে হঠাৎ আমার দেখা হয়ে গেল আসল শ্রী শ্রী ১০৮ ভৃগুর সাথে। দিব্যি একটা প্লাস্টিকের কাগজ পেতে তার উপরে কিছু পাঞ্জাছাপ চটি বই, কিছু লাল নীল পাথর, আর তামা, দস্তা, সীসার আংটি তুলোর বিছানায় রেখে বসে রয়েছে। কয়েকটা ঘোড়ার নালও দেখতে পেলাম। পিছনে একটা ব্যানার ঝুলছে, তাতে লেখা, কামাখ্যার আসল বাকসিদ্ধ তান্ত্রিক, হস্তরেখাবিদ ও জ্যোতিষী, আসল শ্রীশ্রী ১০৮ ভৃগু।এই আসল শ্রী শ্রী ১০৮ ভৃগু কথাটা আবার বেশ বড় হরফে টকটকে লাল রঙে লেখা। উপর থেকে একটা সরু ইলেক্ট্রিক তারের আগায় ঝুলছে একটা প্যাঁচানো সি এফ এল ল্যাম্প, যত না আলো ছড়াচ্ছে, তার থেকে বেশি পোকা টানছে। পোকাগুলো বালবের চারধারে গুণগুণ করছে, দু'একটা ছিটকে গিয়ে শ্রী শ্রী ১০৮ ভৃগুর মুখের পাশে ঘুরঘুর করছে। আর শ্রী ভৃগু বিরক্ত হাত তুলে তাদের তাড়াচ্ছে।
এর ফাঁকেই আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল শ্রীভৃগুর। আমি ওকে দেখে অবাক নিশ্চয়ই হয়েছি, যদিও সেটা প্রকাশ করিনি। শ্রীভৃগুও দেখলাম, আমার দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে। তারপরে হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকলো।
আমি শ্রীভৃগুর সামনে বসে জিজ্ঞেস করলাম, "তারপরে, ভার্গবচন্দ্র, এককালের আগুনখেকো বিপ্লবী, এখন হাত দেখছেন?"
"ধুস, তুই শালা তো একদম পাতি বুর্জোয়া হয়ে গেছিস দেখছি। স্যুট বুট পরে এখন কোথা থেকে ফিরছিস রে? অফিস থেকে নাকি? নাঃ, আজ তো ভোটের দিন, অফিস তো থাকার কথা নয় আজ। দেখি দেখি, ভোট দিয়েছিস নাকি তুই?" ভার্গব আমার বাঁ হাতের তর্জনীটা টেনে নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে আমার আস্থার জাজ্বল্যমান চিহ্ন দেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো, "বিপ্লব তো তোরও করার কথা ছিলো। আগুন নিয়ে কি তুই কম খেলেছিস? আর আজ, পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়ার স্লোগান দেওয়া ছেলে সুশীল নাগরিকের মতো ভোট দিয়ে ফিরছে!"
বিপ্লব! চারিদিকে আলো ঝলমল দোকান মল ভর্তি এই অচেনা কলকাতা শহরের ব্যাস্ত রাস্তার পাশে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের কথা কিরকম অলীক মনে হয় আমার। সি এমের সেই গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো নীতি, পাতি বুর্জোয়াদের চিহ্নিতকরণ আর খতম অভিযান, আরো কত কি! আমরা ক'জন কলেজ ছেড়ে চলে গেছিলাম গ্রামে। সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে তো বিপ্লবের জন্য। চোখের মণির মতো করে রেখেছিলো ওরা আমাদের। অকর্ষিত জমিতে বিপ্লবের বীজ ছড়িয়ে দু'চারদিন সারজল দিতেই হু হু করে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো বিপ্লবের আগুন। সেই আগুনে সব আগাছা পুড়ে খাক হয়ে গিয়ে পড়ে থাকার কথা শুধু মহীরুহদের। তারপরে কি যে ভুল হলো কে জানে! বেনো জলের মতো ব্যাড এলিমেন্ট ঢুকে পড়লো আন্দোলনে। আগুন নিভতে শুরু করলো। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম আমরা। নেতৃত্ব একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলো। চীনের জমি আর বাংলার মাটি যে এক নয়, তা বুঝতে ভুল করলো। মাকু আর কংগ্রেসি গুন্ডারা আমাদের মারতে শুরু করলো। আমাদের মধ্যেও বিভিন্ন সংশয় দেখা দিলো। কেউ কেউ কংশাল হয়ে গেলো। আমাদের মতো কয়েকজন, যাদের উচ্চ মহলে যোগাযোগ ছিলো, তারা চলে গেলাম পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গেলো। বাকিরা কেউ জেলে গেলো, কেউ এনকাউন্টারে খতম হলো। দু'চারজন তাদের আদর্শ নিয়ে চলে গেল অন্ধ্র বিহার ওড়িষায়।
ভার্গব জেলে গেছিলো। পুলিশের মার খেয়ে কোমর ভেঙ্গে গেছিলো শুনেছিলাম। আমি খবর রাখিনি, উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে বসেছিলাম দিল্লীতে জামাইবাবুর কাছে। সব থিতিয়ে যাবার পরে ফিরে এসে মুচলেকা দিয়ে কলেজে ফের ভর্তিও হয়েছি। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি।
ভার্গব মুচলেকা দেয়নি। ওর বিশ্বাসের জোর আমার থেকে বেশি ছিলো বোধ হয়। পরে বন্দিমুক্তির সময় যারা বেঁচে ছিলো, সবাই ছাড়া পেলো।
আমি খবর রাখিনি। তখন আমি চাকরির সোপান বেয়ে উপরে উঠতে ব্যস্ত ছিলাম। চারিদিকে তাকানোর সময় কোথায়? বৌ বাচ্চা নিয়ে ল্যাজেগোবরে অবস্থা।
"কি, ভাবছিস ভুল করেছিস? ভাবিস না। আমরা সবাই ঠিক, আবার সবাই ভুল।" ভার্গব বললো।
"বিয়ে করেছিস?" আর কোন প্রশ্ন এলো না আমার মাথায়।
"না। এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে আছি। বিপ্লবীদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে নেই জানিস না?" ভার্গবের চোখ জ্বলে ওঠে।
"বিপ্লব?", আমি বিষণ্ণ হাসি। "আজ তো ফুল খেলবার দিন রে। বিপ্লব শেষ।"
"না, বিপ্লব হবে, হবেই।" ভার্গব স্থির অকম্প গলায় বলে ওঠে।
ওর শিরা ওঠা হাত আর কন্ঠার হাড় দেখা যাওয়া গলা দেখে আমার মুখে আর কথা ফোটে না। ওর হাতের ওপর হাত একবার রেখে আমি এগিয়ে যাই আমার বাড়ির দিকে। নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার আমার।
ভার্গব একা বসে থাকে তার ভবিষ্যৎ দেখার সরঞ্জাম নিয়ে বিপ্লবের অপেক্ষায়।