বিকল্প ভালোবাসা
বিকল্প ভালোবাসা
অমিয়দার বাড়ি যেতে যেতে সুদীপ ভাবছিল, গত ১টা বছর কিভাবে কাটছে সকলের। সেই যেদিন থেকে কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়েছে সেদিন থেকে জীবনটা দমবন্ধ করা নরক হয়ে উঠেছে। একই আবাসনে সকলে মিলে যেভাবে হৈ হৈ করে আনন্দে বাঁচতো, সেটা যেন আজকে স্বপ্ন বলে মনে হত। ইদানিং সংক্রমণের হার নীচের দিকে যাওয়াতে সরকার নিয়ম কানুনের কিছু ছাড় দিয়েছেন. তারপর ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে আবাসনে টিকাকরনের ক্যাম্প হয়ে গেলো। এসবের ফলে ভয়টা কিছুটা কম অনুভব হচ্ছে। তাই অনেক দিনের থেমে থাকা জীবনকে সচল করতে একটা পিকনিকের আয়োজন করেছে - জায়গাটা মন্দারমণিতে। সবাই মোটামুটি অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। একমাত্র অমিয়দাই যাবার ব্যাপারে রাজি নন - অথচ সব মহলে ওনার জনপ্রিয়তা প্রচন্ড। তাই সবার অনুরোধে সুদীপ অমিয়দার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।
একটু যেন ফাঁকা লাগে সুদীপের । আনন্দের একটা দিনে সবটুকু আনন্দ যেন বুঝি আর পাওয়া হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন যাবে না অমিয়দা? খটকা লাগে তার। কিছু একটা রহস্য আছে। আর সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে অমিয় নিজেই দরজা খুলে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সুদীপ । তাকে দেখে একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানাল অমিয় । বলল, আরে এসো, এসো....
সুদীপ ভিতরে এল। আর তখনই ওর চোখ পড়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবতী। বাদামি গায়ের রং। কিন্তু রীতিমতো সুন্দরী। চেহারায় তীব্র আকর্ষণ।
এই মেয়েটিকে আগেও কয়েকবার দেখেছে সুদীপ । মেয়েটি সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া বলেই তার যেন বেশি করে কৌতূহল হল।
সুদীপ বলল, অমিয়দা, পরশু আমরা সবাই মিলে মন্দারমনি পিকনিকে যাচ্ছি। তুমিও নিশ্চয়ই যাবে....
অমিয় যেন শিউরে উঠল। বলল— না, না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কেন, অদ্বয়দা? ফ্ল্যাটের সবাই যাচ্ছে।
অদ্বয় কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল— আমার বাবা অসুস্থ। যে কোনো সময় দাদার ফোন আসতে পারে। এই অবস্থায় আমি কোথায় যাবো?
সুদীপ জানে, এই কথাটা অমিয়দা বলেই থাকে। অমিয়দার বাবার অনেক বয়স হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে একদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে পারবে না। ওই ফোন কালেভদ্রে আসে। অমিয়দা এখন ফ্ল্যাট থেকে প্রায় বেরই হয় না। তাহলে না যাওয়ার কারণ কী?
সুবীর সামান্য জোর দিয়ে বলল— অমিয়দা, সবাই চাইছে তোমাকে। তুমি না গেলে সবাই মিস করবে তোমাকে। সেই তো ঘরেই বসে থাকবে....
অমিয়কে সবাই পছন্দ করে। তার ব্যবহার খুব আন্তরিক। তার সঙ্গে মিশলে, কথা বললে একটা অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। অমিয় একদম ভেতর থেকে মেশে। হৃদয় দিয়ে মেশে। সে কোথাও গেলে সেখানকার পরিবেশই পাল্টে যায়।
একটু যেন ফাঁকা লাগে সুদীপের । আনন্দের একটা দিনে সবটুকু আনন্দ যেন বুঝি আর পাওয়া হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন যাবে না অমিয়দা? খটকা লাগে তার। কিছু একটা রহস্য আছে। আর সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না।
অমিয়ের গলাটা এবার একটু গম্ভীর শোনায়। সে বলে, সুদীপ , তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো যে, কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী....
আর কিছু বলতে পারে না সে। সুদীপও বুঝতে পারে, এরপর আর কোনো কথা চলে না। অমিয়দার স্ত্রী অপর্ণা বৌদি কয়েক মাস আগেই মারা গেছে। হঠাৎ করেই ক্যানসার ধরা পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি অমিয়দা। এখনও হয়তো সেই শোক বহন করে বেরাচ্ছে অমিয়দা....
অমিয় আবার বলে— আমাদের নিঃসন্তান জীবন খুব সুখের ছিল। আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসতাম সুদীপ ....
সুদীপ চুপ করে থাকে। অমিয়ের শোক এবার যেন সত্যিই ওকে স্পর্শ করে যায়। সে মৃদুস্বরে বলে, বুঝতে পেরেছি। আমি আর জোর করব না....
সে উঠতে যায়। অমিয় বলে ওঠে, আরে, একটু চা খেয়ে যাও....
সুদীপ এমনিতে লাজুক প্রকৃতির। অন্য সময় হলে হয়তো বলত— না, না, পরে কখনও এসে খেয়ে যাবো....
কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে সে বসে পড়ল। কী কারণ এর? আর তখনই সামান্য লজ্জায় ওর ফর্সা মুখ যেন লাল হয়ে উঠল। ওই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তার কথা সে ভুলতে পারেনি। কথা বলছিল অদ্বয়দার সঙ্গে। কিন্তু মনে মনে মেয়েটার কথাই ভাবছিল। অমিয়দার প্রস্তাবে তাই সে রাজি না হয়ে পারেনি। মেয়েটাকে আর একবার, সামনা সামনি, দেখতেই হবে। তীব্র লোভ হচ্ছে তার।
অদ্বয় সামান্য গলা তুলে ডাকল, কেয়া....
রান্নাঘর থেকেই মেয়েটি বলল, বলুন....
আমাদের একটু চা দেবে?
দিচ্ছি।
সুদীপ কৌতূহলী হলে তাকিয়ে আছে দেখে অমিয় গলা নামিয়ে বলল, আমার কাছেই থাকে। কী করব বলো! তোমার বৌদি মারা যাওয়ার পর রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরাতাম। রোজ ঠিকমতো খাওয়া–দাওয়াও জুটত না....
সুদীপ বলল— হ্যাঁ, সে তো জানি....
কিছুদিন পর কেয়ার সন্ধান পাই। আমার
বাবাদের পাড়ায় থাকে। আমার এক দাদাই ওকে নিয়ে আসে....
যাক, খুব ভালো হয়েছে।
হ্যাঁ, ও রোজ এসে রান্না করে দিয়ে যেত। কিন্তু তারপরই এল কোভিড....
সুবীর তাকিয়ে রইল। একটু একটু করে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে সে....
অমিয় বলে চলে, কেয়াকে আমার কাছেই রেখে দিলাম। ও রাজি হয়ে গেল। বাইরে থেকে ওইভাবে আসা–যাওয়া তো এখন আর অ্যালাউ করা যায় না, কী বলো?
হ্যাঁ, খুবই রিস্কের ব্যাপার। সুদীপ বলল। আমাদের ফ্ল্যাটেই তো বাইরে থেকে যেসব কাজের লোক আসত, তাদের সবাইকেই নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে....
সেটাই স্বাভাবিক, অমিয় বলল— কিন্তু আমার তো চলবে না। আমাকে তো খেতে হবে। আমি রান্না জানি না। আর না খেয়েও তো চলবে না। তাই না? তারপর এখন বয়স হয়েছে। রোগ–ব্যাধি আছে। নিয়ম করে, নির্দিষ্ট সময়ে খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে....
সুদীপ জানতে চায়, কত নেয়?
দশ হাজার।
সে তো অনেকটাই। তুমি রিটায়ার করেছ....
হ্যাঁ। খরচটা একটু বেশিই করতে হচ্ছে। কিন্তু ওই যে বললাম....
সুদীপ বলল, সে তো ঠিকই। তারপর এ পাড়ায় যা শুরু হল! কোভিড আক্রান্ত পরপর চারজন.... বিশেষ করে অশোকের ব্যাপারটা তো মানাই যায় না। একদম সুস্থ একটা ছেলে, দুদিনের মধ্যে ওইভাবে....
অমিয় বলল, আমার বয়স এখন তেষট্টি। বুঝতেই পারছ, রিস্ক কতটা। আমি নিজেও এখন ফ্ল্যাট থেকে বেরোই না। কেয়াকেও বেরোতে দিই না। বাইরে মেলামেশা একদম বন্ধ....
সুদীপ মনে মনে হিসাব করে। অমিয়দা এখন তেষট্টি। কেয়া? বড়োজোর পঁচিশ–ছাব্বিশ। দু’জনে দিনের পর দিন একসঙ্গে, একই ফ্ল্যাটে আছে। বাইরে বেরোয় না। কারো সঙ্গে মেশে না।
হঠাৎ সে বলে, তোমাকে দেখলে কিন্তু তেষট্টি বলে মনেই হয় না....
অমিয় হাসে। জানতে চায়, কী মনে হয়?
তেত্রিশ— সুবীর বলে।
যাঃ। হেসে উড়িয়ে দেয় অমিয়। এ পাড়ায় সবার কাছেই সে অমিয়দা। কেউ তাকে কাকু বা জেঠু বলে না। এখনও তার ছিপছিপে শরীর। শরীরে এতটুকু মেদ নেই। বয়স সত্যিই বোঝা যায় না।
ঠিক এই সময় কেয়া আসে। একটা ট্রে সামনে রাখে। তাতে রাখা ফুল আঁকা চায়ের কাপ আর এক বাটি চাউমিন।
প্রথমেই চায়ের কাপে চুমুক দেয় সুদীপ ; আর বলে ওঠে— বাঃ! তারপর চাউমিন খেতে গিয়েই বুঝতে পারে, ওর রীতিমতো খিদে পেয়েছে। গোগ্রাসে সবটুকু চাউমিন খেয়ে নেয় সে।
কিন্তু আর বসে থাকা যায় না। সুদীপ উঠে দাঁড়ায়। এদিক–ওদিক তাকায়। কোথায় গেল কেয়া? মেয়েটি সুন্দরী তো বটেই! তাছাড়া সেই সৌন্দর্যের মধ্যে কেমন যেন একটা বন্যতা রয়েছে। আর একবার দেখতে পেলে হতো!
কিন্তু কেয়া অন্য কোনও ঘরে আছে। সুদীপকে নিরাশ হতে হয়। অমিয়ও উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সারা মুখে হাসি। বলে— নাঃ, তোমাকে আর আটকাবো না....
সুদীপ বেরিয়ে যায়। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। অপর্ণা বৌদি মারা যাওয়ার পর কী অবস্থা হয়েছিল এই ফ্ল্যাটের। এখন আবার সব পরিপাটি করে গোছানো। ঘরগুলো আগের মতোই ছিমছাম, সাফসুতরো, বিছানার চাদরটা একদম টানটান। এত সৎ মানুষ অমিয়দা। কিন্তু নিজের কাছেই যেন কিছু একটা লুকোচ্ছে।
একটু পরেই ভেতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কেয়া। একটার পর একটা পোশাক ছাড়তে থাকে। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। অমিয় তখন পিছন ফিরে একটা বই খুঁজে চলেছে।
আর ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে ওঠে। আর একটু পরেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে অমিয়....
ওদিক থেকে কেউ বলে, দশ হাজার? অত টাকা দিয়ে মেয়েটাকে তুমি রেখেছো?
না রেখে উপায় কী? খাবো কী? বয়স হয়েছে, রোগ–ব্যাধি আছে....
তা একদিন না হয় মেয়েটা একাই থাকবে। তুমি পার্টিতে চলে এসো....
অসম্ভব। যে কোনও সময় বাবার ওখান থেকে ফোন আসতে পারে...
এলেই-বা? তুমি তো এমন কিছু দূরে আসছ না....
আমার পক্ষে এখন আনন্দ–ফুর্তি করা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী....
হ্যাঁ, ওদিকের গলা এবার নিস্তেজ শোনায়....
তুমি তো জানো, আমার স্ত্রীকে আমি কত ভালোবাসতাম....
কে না জানে সে-কথা? ওদিকের কণ্ঠ বলে। গোটা দুনিয়া জানে....
একটু পরে অমিয় ফোনটা রেখে দেয়। আর হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সামনের ফটোর দিকে। তার স্ত্রী’র ফটো। সেদিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকে, তোমাকে আমি ভালোবাসতাম। এখনও বাসি। বিশ্বাস করো আমাকে....
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমিয়। অন্য কেউ বিশ্বাস করুক বা না-করুক, সে নিজে যেখানে এখনও বিশ্বাস করে....
কিন্তু তবুও, পিকনিক বা পার্টিতে তার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়। অসম্ভব। কেয়াকে ছেড়ে গেলে যে-কোনও জায়গাই তার কাছে নরক হয়ে উঠবে।
কেয়াকেই-বা সে অস্বীকার করে কী করে?
এটাই হয়ত জীবন, কথিত আছে প্রকৃতি শূন্যস্থান রাখে না - তাই হয়ত ভালোবাসার শূন্যতা পূর্ণ হয়ে যায় বিকল্প ভালোবাসা দিয়ে।