Sheli Bhattacherjee

Drama

0.2  

Sheli Bhattacherjee

Drama

ভাঙা-গড়ার খেলা

ভাঙা-গড়ার খেলা

5 mins
1.9K


'প্রথম যেদিন বুঝেছিলাম, 'আমার সংসার' কথাটা শুধু কথার কথাই। নিছক একটা বাক্যগঠন ছাড়া কিছুই নয়। আসলে খুব কম মেয়েরই বিয়ের পর নিজের সংসার হয়, বা সে সংসারে তার নিজের মতামত গ্রহণের স্বাচ্ছ্যন্দতা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার উপর চাপানো হয় অন্যের ভালো লাগা না লাগার নিয়মাবলী, আর সেগুলোকে মেনে চলার অঘোষিত রক্তচক্ষু নির্দেশ। বিশ্বাস কর, তাই করছিলামও আমি। কিন্তু তারপরেও ওরা খুশি হয় নি। আর আমিও নিজের মতের বিরুদ্ধে যেতে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। দিন কে দিন যেন পরের সাথের লড়াইটা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছিল ... লড়াইটা আসলে কার সাথে, পরের সাথে না নিজের সাথে নিজের? পরকে খুশি রাখা, কাছের মানুষকে না হারানো, নিজেকে সম্পর্কের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা ... ঠিক কোন মনস্তাত্ত্বিক ধারণাকে আমি এতোগুলো বছর ধরে জোর দিয়ে স্থাপন করতে পেরেছি? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই পাচ্ছিলাম না। উপরন্তু মনে হচ্ছিল, নিজের সন্তানের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছি। ও ভাবছিল মায়ের মেরুদণ্ড ভঙ্গুর। সে শর্ত মেনে নেয়, তর্কে দুকথা শোনে চুপ করে ... হয়তো সেই দোষী। না, আর পারিনি তাই। দেরিতে হলেও বুঝেছি, বিচ্ছেদের চরম ব্যাথাটা একবার আমায় পিষে দিয়ে গেলেও, বারবার একই হারানোর আতঙ্কে তিলেতিলে শেষ হতে হবে না আমায়। বুঝেছি, জোর করে আর যাইহোক, সম্পর্কের দখলদারি করা যায় না। এ সম্পদ যার জীবনে থাকে, সে ধনী। আর যার কাছে থাকে না, তাকে বাকি পার্থিব বস্তুর তুচ্ছ মালিকানার স্বাদ নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তাই বিচ্ছেদের পর আট বছরের বাচ্চা মেয়েটার দায়িত্বের সাথে কিছু ভরণপোষণের মালিকানা পেলাম ওই 'নিজের সংসার' নামক শব্দদুটো থেকে উচ্ছিষ্টের মতো। তারপরের দেড় বছরে আমার জীবনে কি কি শুধরালো সে হিসেব ভুলেও করিনা আজ। এটুকু জানি নিজের সাথে নিজের লড়াইটা এখন দাঁড়িয়ে আছে কর্তব্যের প্রান্তরে। মেয়েটার বিষন্ন মুখটা দেখলে বুকটা হু হু করে ওঠে। ও যেদিন আদালত চত্বরে নিজের এতোদিনের চারপাশের লোকগুলোকে ওর দিকে একবারের জন্যও ছুটে আসতে দেখে নি, সেদিন থেকেই কেমন যেন আৎকে গেছে। আমিও সে দৃশ্যে শেষবারের জন্য আমার সংসার প্রাপ্তির রূপ দেখে অবাক হয়েছিলাম। মানুষ যে কত নিষ্ঠুর ... কত নির্দয় হতে পারে, বুঝেছিলাম সেদিন। মনে হচ্ছিল এ যেন আমার তাস নির্মিত পুতুলের ঘর ছিল। ভালো না লাগলেই সেখান থেকে একটা পুতুলকে অনায়াসে সরিয়ে দেওয়া যায়। আর এই ভাঙা-গড়ার খেলায় আমরা নিছক নিমিত্ত মাত্র।'


'ম্যাডাম, ম্যাডাম ... এই লোকেশনই তো?' ওলা ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরল পর্ণার। দেখল বাড়ির গলির সামনে এসে গেছে। ক্যাবের ভাড়াটা দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো পর্ণা। একনাগাড়ে এতোক্ষণ ধরে তার মাথায় ঘুরছিল বাল্যকালের স্কুল বন্ধু অদৃজার কথাগুলো। কিছুক্ষণ আগেই পর্ণা যখন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ক্যাব বুক করছিল, তখন অনেক বছর পর দেখা হয়েছিল ওর সাথে ওর পুরানো বন্ধুর। প্রথম এক নজরে দেখে তো পর্ণা থমকে গিয়েছিল সংশয়ে। এই কি সেই দুই বিনুনি করা ছটফটে সুন্দরী অদৃজা? এতো বুড়িয়ে গেছে মাত্র ৩৩ এই? তারপর অদৃজাই এগিয়ে এসে পর্ণার সংশয়গুলো ভেঙে ওর মনের কোণের অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে গিয়েছিল মাত্র কয়েকটা মিনিটের কথায়। হয়তো বাল্যবন্ধুকে পেয়ে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাগুলোকে উগড়ে দিয়ে কিছুটা শান্ত হয়েছিল মেয়েটা। 


ওর সব কথার মধ্যে পর্ণার মনে দাগ কেটেছিল অদৃজার বলা শেষ কথাগুলো। 'সন্তানের বিষন্ন মুখ'... এ যে চরম যন্ত্রণার। একজন মায়ের কাছে তার নিজ সন্তানের এমন কষ্ট সহন করার চেয়ে বড় আর কি কষ্টই বা হতে পারে? মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া এসবের ভারসাম্য রক্ষা করাটা সত্যি খুব দুষ্কর। কিন্তু বড়দের এই কঠিন জটের মধ্যে পড়ে নিষ্পাপ শিশুটা কেন পিষ্ট হবে? কেন শিশুটিকে তার জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত একচ্ছত্র স্নেহের ছাদের ভাঙনহেতু যেকোনো একজনের স্নেহচ্ছায়ায় গুটিসুটি মেরে আশ্রয় নিতে হবে? কেনইবা মা বাবা থেকে শুরু করে পরিবারের বাকিরা শিশুটির মানস জগতের প্রতি যত্নশীল না হয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকেন্দ্রিক চাওয়া-পাওয়ার প্রাধান্যকেই কেবল আস্ফালিত করবে? বড়রাই যদি ঘরের চাবি নিয়ে, অধিকার নিয়ে, মোড়ল হওয়ার লোভ নিয়ে টানাটানি করে কূপমন্ডুকতার পরিচয় দেয় ... তবে সে ঘরের শিশু কিকরে নিজের মন মানসিকতাকে বটবৃক্ষ করে গড়ে তুলবে? সেওতো একদিন একা একা তালগাছের মতো উঁচু হওয়ার স্পর্ধা দেখাবে, তারপর কাউকে ছায়া না দিয়ে সেও একদিন কারো স্বার্থের সাথে সংঘাতের ঝড়ে ভেঙে পড়বে। সে দায় তখন বর্তাবে কার উপর? শিশুটির নাকি তার শিশুকালের পারিপার্শ্বিকতার উপর?


প্রশ্নগুলো যেন এক এক করে চাবুক মারছিল পর্ণার বিবেকের পৃষ্ঠদেশে। নিছক নিউক্লিয়ার পরিবারে বসবাসকারী ওর আর মৃন্ময়ের ইগোর লড়াইটাকে বড্ড ঠুনকো মনে হচ্ছিল তখন ওর কাছে। ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, মৃন্ময় ডাক্তার। দুজনের কেরিয়ার, সেলারি, প্রতিষ্ঠা এসবের মিলনে তো চার বছর আগে ওদের কোলে ছোট্ট তিন্নি আসেনি? এসেছিল তো নিখাঁদ ভালোবাসার বীজ হয়ে। আর আজ যখন সেই বীজ হতে একটা দুটো করে সবুজ পাতা ছড়াচ্ছে, তখন তাকে স্নেহের আলো ... ভালোবাসার উত্তাপ ... আগলে রাখা বারিধারা না দিয়ে তারা কিনা বিচ্ছেদের কথা ভাবছে! এসব ভেবে অজান্তে পর্ণার নিজের প্রতিই নিজের ধিক্কার আসে। সে বদ্ধপরিকর হয়, মৃন্ময়ের সাথে আবার ঠান্ডা মাথায় বসে আলোচনা করার জন্য।


ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দরজায় পৌঁছালো পর্ণা। তারপর ডোরবেল বাজাতে মিনতি মাসি দরজা খুলে দিতেই পর্ণা দেখল মৃন্ময় ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে। অবাক বিষ্ময়ে তখন পর্ণার প্রশ্ন 'তুমি? এতো তাড়াতাড়ি? চেম্বারে যাও নি?'

মৃন্ময় চাপা কণ্ঠে উত্তর দিল 'এদিকে এসো।'

'তিন্নি ঠিক আছে তো?' মৃন্ময়কে অসময়ে ঘরে দেখে, পর্ণার পরবর্তী উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।

কিছু না বলে মৃন্ময় একটা আঁকার খাতা তুলে দিল পর্ণার সামনে। পর্ণা দেখল তিন্নির খাতায় অপটু হাতে আঁকা আছে একটা মধ্যিখানে চিরে যাওয়া ছোট্ট বাড়ি, তার একদিকে একটা বাচ্চা এক মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে আর বাড়িটার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ। যার চোখে চশমা আঁটা। কতকটা মৃন্ময়ের মতোই। পর্ণার বুঝতে অসুবিধা হল না, তিন্নি কি কষ্টের মধ্য দিয়ে এই ছবি এঁকেছে। গতকাল রাতে তিন্নি মা বাবার মধ্যের অশান্তি, রাগের মাথায় বিয়ের আংটিগুলো খুলে দেওয়া, আলাদা আলাদা থাকার প্রস্তাব রাখা ... সব শুনেছিল। আর তার ফলেই এই আঁকা .... ভাবতেই পর্ণা ওর সাইড ব্যাগটা সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক ছুটে গেল তিন্নির ঘরে। সেখানে বিছানায় কোলবালিশের বেড়ির মাঝে ঘুমিয়ে আছে ও শান্ত হয়ে। ওর দিকে চেয়ে পর্ণার এক মুহূর্তে মনে হল, ওর ছোট্ট অপরিণত মনের ভেতরে বোধ হয় জমাট বেঁধেছে অনেক ব্যাথা। ভেবেই ওর সারা গায়ে মাতৃত্বের চুম্বনে ভরিয়ে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল পর্ণা। অত:পর মৃন্ময় পর্ণার কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ধরা গলায় বলল তখন 'আমাদের এবার শপথ নিতে হবে তিন্নির জন্য। ওর মনে ব্যথার ছাপ ফেলতে পারে, এমন কোনো কাজ আমরা আর করব না।'

মৃন্ময়ের কথা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল পর্ণা। যেন অনেক দিনের পুঞ্জীভূত অভিমানের মেঘ হঠাৎ স্নেহের শীতল স্পর্শে বারিধারা হয়ে নেমে এলো। ছোট্ট তিন্নি ঘুম থেকে জেগে গেল মায়ের অশ্রুধারার ছোঁয়ায়। সে একসাথে অসময়ে মা বাবাকে পেয়ে অকস্মাৎ থমকে গেল। তখন পর্ণা আর মৃন্ময় দুজনে মিলে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল 'চল, বেরিয়ে আসি। কোথায় যাবি বল?'

ছোট্ট তিন্নি হঠাৎই প্রাপ্ত অচিন্তনীয় এই শীতল ভালোবাসার ছোঁয়ায় মনের গুমট কাটিয়ে বলে উঠলো 'সমুদ্দুর দেখতে যাব।'


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama