ভালোবাসা
ভালোবাসা
ভা
" দেখো তো শাড়িটা কেমন ? সাত হাজার টাকা দাম, কাল শুভনীল ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে গিফট দিলো",
হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠায় সেমন্তী । "জানিস তো এবার না পুজোর পর আমরা ভাইজাগ যাচ্ছি ,অনেকদিন ধরে সমুদ্র দেখার ইচ্ছে,তাই আরকি! সৈকতটা এত অসভ্য! আমাকে কিচ্ছু জানায়নি, হঠাৎ করেই ! তুই আমার প্রিয় বন্ধু, তোকে কিছু না বললে আমার পেট ফুলে যায়! " সোমা খুশিতে ডগোমগো, ফোনের ওপাড় থেকে খুশি এসে ধাক্কা মারে এ পাড়েও।
"দেখো এটা", "ভালো ,নতুন বানালি ?","নাগো !কাল ও দিল ধনতেরাস উপলক্ষে! আমি কত বারণ করলাম কিছুতেই শুনলো না",স্বামী গরবে গরবিনীরা সব নিজের নিজের স্বামীর উপহার দেখায়, ভালোবাসার গল্প বলে, কত আদর সোহাগ এর গল্প! জানো, "রিনা দি ,কি বলবো !চান করে বেরিয়েছি আর ওমনি শুরু,যত বলি মেয়ে দেখবে, ছাড়ো !ছাড়ো! কিছুতেই শুনল না! আবার চান করতে হলো !আমাকে নাকি স্নান করে বাথরুম থেকে বের হলে ,দারুন দেখতে লাগে ,তাই ও সেদিন সামলাতে পারেনি ,অসভ্য! ", এই কথার পেছনের চাপা আনন্দ ঠিকরে বেরোয় চোখ মুখ থেকে।
বিয়ের আঠারো বছর পর, আজ পর্যন্ত একটা সুতির শাড়িও কোনদিন হাতে করে আনেনি বিনয় ,নিজের রোজগারে। ওর বিড়ি খরচটা পর্যন্ত আমাকে দিতে হয়! বিয়ের পর এত বছরে সমুদ্র ,পাহাড় তো দুরের ব্যাপার নিদেন গড়ের মাঠেও যাওয়া হয়নি, না একটা সিনেমা!ও সব বিয়ের আগেই চুকেবুকে গেছে!সোনাদানা যা বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে পরতাম, তাই আছে কারণ পালিয়ে বিয়ে। বাবা-মা পরে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি নিইনি আর বৌদিও বলেছিল, "গয়না নিতে হলে তো ভাই তোমাকে অনুষ্ঠান করে বিয়েটা করতে হয়! ", হেসেছিল তারপর ,যেন ঠাট্টা !কিন্তু কথাটা ঠাস করে পড়েছিল আমার গালে । আমার বেড়ানো মানে বাপের বাড়ি ,শাড়ি বলতে তিনশো থেকে পাঁচশো, খুব বেশি দামের একটাই শাড়ি কিনেছি বিয়ের পর, আটশো টাকা দিয়ে । আসলে শাশুড়ি ,ছেলেমেয়ে, বিনয়, মোট পাঁচ জনের সংসারের একমাত্র রোজগেরে আমি। তাও আবার রোজগারের বহু টাকা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসার জন্য দিয়েছি ,দুবার দোকানও করে দিয়েছি, বলাবাহুল্য সেই গুলো সবই লস্। শেষে বললাম, "ক্ষ্যামা দাও !আর তোমার কিছু করার দরকার নেই বাবা ,তুমি খাও-দাও ঘুড়ে বেড়াও ,তবু বাড়তি খরচ তো হবে না। না হলে হাজারো ঝক্কি !
ছেলে মেয়ে দুটোর ইস্কুল, ছেলেটার ইলেভেন,মেয়েটা নাইন। প্রাইভেট মাস্টার ছজন,তা,ও সবগুলোর জন্য দিতে পারিনি !বিনয় তো নিয়ে বসতে পারে অনায়াসে কিন্তু টিভি দেখেই ওর হয় না ,আর দুহাজার আটশো এগারো রকম রোগের উৎস হচ্ছেন শাশুড়ি, তার চিকিৎসা আছে । প্রতি মুহূর্তে পস্তাই, কথা শোনাই ,"কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম !তোমায় বিয়ে করাই ভুল! তখন মিষ্টি কথায় ফাঁসিয়ে এখন রোজগারের মেশিন বানিয়ে ফেলেছ!" আমাদের মধ্যে আগুন জ্বলে না আর, সোহাগ সোহাগ প্রাগৈতিহাসিক শব্দ। যখন বলি, " গুষ্টি শুদ্ধ আমার ঘাড়ে ,লজ্জা ঘেন্না কিচ্ছু নেই!",বিনয় মাথা নিচু করে শোনে! আগে ঝগড়া করত, এখন তাও করে না !কেন যে ওর এতো স্থবিরতা কি জানি? "কাজ না করে ,বসে খেয়ে খেয়ে ,অভ্যাস হয়ে গেছে !ভালোবাসে না ছাই ! বসে বসে খাবে বলে আমার চাকরি দেখে প্রেমের জালে আমায় ফাঁসিয়েছে! " হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে টের পেলাম গায়ে হাতে প্রচন্ড ব্যথা, গলাতেও,গায়ে জ্বর, একটা ঘোরের মতো। আমার উঠতে দেরি দেখে বিনয় বিছানার পাশে এসে আমার কপালে হাত দিলো। বিছানাতো অনেক আগেই আলাদা। তবুও কপাল গরম দেখে শাসনের সুরে বলল, "চুপ করে শুয়ে থাকো, একদম উঠবে না", আমি শুয়ে রইলাম ,উঠবার ক্ষমতা ও ছিল না।একটু পরে ব্রাশ, গামলা, জল এনে দিল ,"এখানে ব্রাশ করো, আমি চা দিচ্ছি ",ছেলে মেয়েকে ডেকে বলল, "মাকে বিরক্ত করবি না, মায়ের ঘরে যাবি না"! ভয় পেয়ে গেলাম ,"করোণা নয়তো!", "হোক না, তুমি রোজ রোজ অফিসে বের হও,হতেই পারে !",সান্তনা দেয় বিনয়। "তুমি এখানে এসো না ",বিনয়কে ঘরে আসতে বারণ করে দিলাম। রিপোর্টটা আসার সাথে সাথে যখন দেখা গেল যে ,যা ভয় করেছিলাম তাই হয়েছে, আমাকে পর পর গত পনেরো দিন নিয়ম করে যাকে আক্ষরিক অর্থে সেবা বলে, তাই করে গেছে বিনয়। ওষুধ,পথ্য একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনে, যতটা সম্ভব সতর্কতা বজায় রেখে। ছেলেমেয়েদের দেখেছে, শাশুড়িকেও, রেঁধে খাইয়েছে। এখন বেশ ভালো ,গত কদিন তো ভালোভাবে ভাবতেই পারিনি,মাথার মধ্যে কেমন যেন ঘোর কাজ করেছে। আজ সকাল থেকে ভাবতে পারছি । দরকার নেই বাবা শাড়ি ,গয়না ,পুরি ,দিঘা, আমার এই ভাল !অনেকদিন বাদে তা প্রায় সতেরো বছর পর আদরের সুরে ডাকলাম, "বিনু,বিনু...",ও দৌড়ে এল, "এই নাও চা, আজ একটু দেরি হয়ে গেল", বুঝলাম ভালোবাসা মানে শুধু শাড়ি, গয়না, আদর নয় ,ভালোবাসা এর চেয়ে অনেক অনেক বড়।

