ভালবাসার হার
ভালবাসার হার
সবে বেলা দশটা বাজে,সায়নীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে এরই মধ্যে তিনটি সিগারেট শেষ করে ফেলেছে সুমন। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। তাই খালি পেটে এতোগুলো সিগারেট খাওয়ার জন্যে তাঁর গা গুলিয়ে উঠছে । গাছপালা ঘেরা এই পার্কের মধ্যেও সূর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে। ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপটে গেছে শার্টটা। চার নাম্বার সিগারেটটা জ্বালাতেই সায়নীকে দেখতে পেল সে। সায়নীও তাকে দেখতে পেয়েছে। রিকশা করে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আজ সায়নী নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে।তার অবাধ্য খোলা চুল বার বার বাতাসের ঝাপটায় চোখের উপর এসে পড়ছে। বেশ সুন্দর লাগছে। তবে প্রতিদিনের মতো মিষ্টি হাসিটা আজ নেই। মুখটা থমথমে। কারনটা জানে সুমন। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে সায়নীর। কিন্তু সে বিয়েটা করতে চায় না। সায়নী নিশ্চয় তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলবে আজ। হাসলো সুমন। মেয়েটা এতো সরল। সাদা কালো পৃথিবীতে রঙীন ভালবাসার যে ঠাঁই নেই , এই সাধারন কথাটা বোঝে না।
রিকশাটা সুমনের কাছে আসতেই নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো সায়নী। চুপচাপ দুজন হেঁটে পার্কের একটা বেঞ্চে বসলো। সুমনের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো, স্যরি, আজ তোমাকে অনেকখন অপেক্ষা করতে হলো।
- আরে ধুর! অপেক্ষা করতে আমার খারাপ লাগে না। আর তোমার জন্যে তো অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি।
অন্য দিনের মত আজ হাসলো না সায়নী। থমথমে মুখে বললো, আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে।
-ছেলে কি করে?
- USA - এতে থাকে।
- বাহ বেশ ভাল।
- এর মানে কি?
- জানিনা।
- জানো না মানে! তোমার কি কিছুই বলার নেই?
-আছে।
-কি?
- বিয়েটা করে ফেলো।
- আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। তুমি একটা ব্যবস্থা করো। আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো।
- আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না সায়নী।
-সুমন তুমি কি মানুষ?
মনে মনে হাসলো সুজন। মেয়েটা বোকা হলেও মাঝে মাঝে সত্যি কথা বলে ফেলে। এই যেমন সুমন মানুষ কি না? তার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের দুঃখের সাথে নিত্য বসবাস। প্রতিদিন দুঃখ নিংড়ে সুখ খুজে বের করার যে অমানুষিক চেষ্টা করতে হয় তাতে তার নিজেকেই মাঝে মাঝে মানুষ মনে হয় না। সায়নীর দিকে তাকালো সে। কাঁদছে সায়নী। তার ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু যেন খচ খচ করে বিধছে সুমনের বুকে। কি বা করতে পারে সে নিজের প্রেমের জন্যে? সায়নীর জন্যে? না, এই যুদ্ধের চিন্তা থাক! বাস্তবতার নির্মম ঝড়ে প্রেম যে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় সে অভিজ্ঞতা নাই বা হলো মেয়েটার।তাছাড়া এত দিন যারা মেয়েকে ভালোবাসা দিয়ে এত বড় করল,তাঁদের কাছ থেকে মেয়েকে সারা জীবনের জন্য পর করা মানসিকভাবে সুমনের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব চিন্তার মাঝ থেকে আবার বাস্তবে ফিরে এল সায়নীর কথায়।
‘আমি চললাম’, উঠে দাড়ালো সায়নী। ‘আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না।’ এ কথা বলে সুমনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
হঠাত্ করেই বুকটা খালি খালি লাগছে আর ভীষণ কান্না পাচ্ছে সুমনের। সে নিজেও হয়তো সায়নীর মতো বোকা। না হলে কি বোকার মতো কান্না আসে? সায়নীর যাত্রা পথের দিকে তাকালো সে। তার মাথাটা যেন দুলছে। দুলছে সায়নীর যাত্রা পথ। দুলছে শহর। এমনকি পুরো পৃথিবী। চোখের কোনে জমে থাকা জলটা মুছে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাড়ালো সুমন। প্রচন্ড এক অসহায় ভাব বোধ হচ্ছে - বিনাদোষে আজ ভাগ্যের কাছে তাকে হার মানতে হল । রাষ্ট্রের অসম ধন বন্টন ব্যবস্হা - বৃত্তির অভাব, তার স্বপ্নকে কেড়ে নিল আজ। একটু বসে একটা সিগারেট ধরাল আর চেষ্টা করতে লাগল বাস্তবের জমিতে ফেরার। সুমনের সমস্যা অনেক - বাবার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এদিকে ছোট বোনের স্কুলের বেতনটা দেওয়ার আজকেই লাস্ট ডেট। কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কতো কাজ পড়ে আছে তার! পার্ক থেকে বেরোতে বেরোতে সুমনের মনে হল, হয়ত কখনও অলস অবসরে মনে পড়বে ওর এই হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার সুন্দর কিছু সময় - যা সুমনকে লড়াই করে বাঁচার অক্সিজেন যোগাবে।

