Jubak Anarjo

Tragedy

4  

Jubak Anarjo

Tragedy

বাক্

বাক্

6 mins
276


জরিকে নির্বাচন করা হলো কমিটির সভাপতি। এটা সে মেনে নিতে পারছে না।অন্যদের পড়াশোনা-জানাশোনা তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়।তার লেখা অবশ্য মন্দ নয়- এ কথা সে কিছুটা বিশ্বাস করে বটে।তবে এ বিশ্বাস আসতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন।দীর্ঘদিন ধরেই তো ওরা বলে আসছে- তোর লেখা সত্যিই ভালো ,মিথ্যে পামটাম নয়। তুই হলি আমাদের তুই। তোর সঙ্গে নিশ্চয়ই পাম্পিং রিলেশন নয়?


আসলে ওদের কথাতে খুব একটা নয় যতোটা হয়েছে তার 'নুলিয়াডাঙার ক্ষত' প্রকাশের পর।সাধারণত যা হয়- অনলাইন প্রযুক্তির সহায়তা অন্যদের মতো কবি-লেখকরাও নিচ্ছেন।নেয়াটাই স্বাভাবিক যৌক্তিক এবং হয়তো জরুরিও বটে।প্রিন্ট মিডিয়া অনলাইন সংস্করণ ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে ওয়েবজিন ইত্যাদি মাধ্যমে লেখা প্রকাশ করা, বই বেরুবার আগেই পান্ডুলিপির নাম প্রচ্ছদ পোস্ট করা।প্রকাশ পেলে গুণীজন বিশিষ্টজনদের খুঁজেটুজে বা দেখা হলেই দু'চারটা সেল্ফি মেরে নিজের পাবলিকেশন প্রমোট করা- এসব হচ্ছে।কিন্তু তার নিজের বেলায় চিত্রটা ছিলো আলাদা।ফেসবুকে সে সময় দেয় খুব কম,তার চেয়ে বরং জরি বই পড়তেই বেশি পছন্দ করে।১৫/২০ টা কবিতা লিখলে ফেবু'তে ১ টি পোস্ট করে।প্রোফাইল পিকচারে তার ছবিটা তার চেয়ে সুন্দর- কীভাবে যেনো ছবিটা বেশ ভালোই ক্লিক হয়ে গিয়েছিলো।ক্লিকারের ভূমিকা নিয়েছিলো টোটন।অই একই ছবি, আর বদলানো হয় নি।কবিতা ভালো না হলে সুন্দর ছবি দিয়ে কি কবি হওয়া যায়!কবিতা পোস্ট করার পর লাইক আর গৎবাঁধা - দারুণ আপু, অসাধারণ,অনবদ্য, নিপুণ বুনন, মুগ্ধতা ইত্যাদি কমেন্টগুলির দিকে সে সন্দেহের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নিয়ে তাকায়।হো হো করে হাসে।অইসব অসংখ্য ইমুজি আর কমেন্টগুলি যদি রিয়েল হয়ে থাকে তাহলে তো সে রাহমান ভাইয়ের চেয়েও বড়ো কবি! সে খুব বুঝতে পারে শুধু মহিলা আইডি বলেই অতোশত ফ্যালাসির ঢল।ঠিক তখন দারুণ আহত হয় সে।হচ্ছে কী এসব- শিল্পের নামে!


এই সময়ের প্রধান ও প্রসিদ্ধ কবি যারা তাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন ষাটের দশকের।সত্তরের রুদ্র, আবিদ বেঁচে নেই।ষাটের দশকের জীবিত কিংবদন্তি কবিদের আইডিতে ভালো একটি কবিতায়ও হয়তো ২০০'র বেশি লাইক চোখে পড়ে না।অথচ কী অদ্ভুত একটি মহিলা আউডিতে কবিতার নামে যা খুশি তাই লিখলেও ৪৫০ লাইক ৩০০ কমেন্টস। জরি লক্ষ্য করেছে- দুই এক দশক আগের এমন কবিও আছেন যিনি কবিতা যেমনই লিখুন না কেনো শুধু পেশাগত ও অর্থনৈতিক জীবনে ভালো অবস্থানের কারণে লাইক পাচ্ছেন 1k plus।ভাবা যায়! একবার শক্তিদা(কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) বলেছিলেন- " এতো কবি কেনো!" শক্তিদা যদি এই সময়ে বেঁচে থাকতেন, ফেবু' র এসব আদিখ্যেতা দেখে রাগে অভিমানে হয়তো লেখাই ছেড়ে দিতেন।


জরির বিশ্বাস হয়,কিছুটা, যে, তার লেখা মন্দ নয় যখন ঘটনাটি ঘটে গেলো 'নুলিয়াডাঙার ক্ষত' নিয়ে।চার ফর্মার বই। ৬৪ পৃষ্টায় ৫৬ কবিতা।এই ৫৬ টির মধ্যে মাত্র ১৪/১৫ টি কবিত প্রকাশিত।বই বের হবার আগে ও পরে এমনকি আজ অব্দি

বই নিয়ে ফেবু'তে সে কোনো পোস্ট দেয় নি।কবি হিসেবে সে খুব একটা পরিচিতও নয়,তবু,কেন যেনো,এক মেলাতে তার বই বিক্রি হয়েছে ২২২ কপি।একে ব্যাখ্যা করার উপায় কি? নারী আইডি? নারী আইডি মানে তো কবিতা ভালো না হলেও ৪৫০ লাইক ৩০০ কমেন্টস, কিন্তু যারা "wow apu", " so cute" বলে ফেবু'তে ফেনা তুলে ফেলে,কিনবে ৪৫০ কপি বই?


তবে জরি জানে - দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সকলে তার বিপরীত মত-ই পোষণ ক'রে বলবে- রবি ঠাকুর নিজেও প্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন,স্বয়ং জীবন বাবুও রবীন্দ্রনাথকে কবিতা পাঠিয়েছিলেন।'ফিনেগান্স ওয়েক' বের হবার পর জয়েস জানতে চেয়েছিলেন- কতো কপি বিক্রয় হলো তার বই।

না,এসব ঐতিহাসিক সত্যকে নিশ্চয়ই অস্বীকার করবার উপায় নেই।কিন্তু এর ব্যতিক্রমও যে আছে তা অধিকাংশজনই এড়িয়ে যাবেন।যেমন এড়িয়ে যাবেন- সতীনাথ ভাদুড়ী'র 'জাগরী'র আকাদেমি পুরস্কার পাবার ইতিহাস; চেপে যাবেন সাবদার সিদ্দিকী'র প্রচারবিমুখ ইতিহাস। হালের উজ্জ্বল উদাহরণ - শোয়েব শাদাব দীর্ঘ বছর মানসিক ভাবে অসুস্থ,সেই আশির দশকের কবি।কোথায় তার ফেবু আইডি কোথায় প্রচার প্রসার কোথায় লবিং দলবাজি খেলা কিন্তু তাঁকে তো সম্প্রতি সম্মাননা সংবর্ধনা ইত্যাদি দেয়া হলো।কবি অনিকেত শামীম প্রকাশ করলেন 'লোক' এর শোয়েব শাদাব সংখ্যা। এসব কি শাদাব ভাইয়ের কাব্যশক্তির পরিচায়ক নয়? রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আর আবুল হাসানের কবিতা এই মুহুর্তে বাংলাদেশের অনলাইনে সবচে বেশি কোটেড হচ্ছে।কেনো?কাব্যক্ষমতার কারণেই কি নয়?


-'কি রে টুনি এখানে আছিস তো!' বলে নীলু জরির চোখের সামনে দুই হাত দিয়ে বাতাসের মতো করছিলো।নীলু'র কথায় জরির ভাবনার ঘোর কেটে গেলো।জরি সত্যিই যেনো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো।


: সরি।আমি আসলে একটু এবসেন্ট হয়ে গেছিলাম।তবে যাই বলিস অবলা রমণী পেয়ে আমাকে জোর করে চাপিয়ে দিলি।


-তো কি হয়েছে, সুন্দরী!


: সমস্যা তো ওখানেই।আমি চাই নি নিজেকে প্রদর্শিত দেখতে।


-তওবা তওবা, আমাদের এতো খারাপ ভাবছিস!ছি ছি ছি, তোকে এভাবে মানায় না।"এক্কেবারে মানাইসে না রে..."


: না মানালে মানাতে গেলি কেনো!


কেউ আর যেনো কিছু খুঁজে পেলো না।আজকের মতো সভা শেষ হলো।


জরির দায়িত্বটা সবচে ঝুঁকিপূর্ণ ও সংবেদনশীল। তাকেই দিতে হবে চূড়ান্ত রায়। না,এটা ওরা মোটেই ঠিক করে নি।যুক্তি হিসেবে ওরা বলেছে- সব মিলিয়ে জরির একটা ফেস ভ্যালু আছে,তার গ্রহণযোগ্যতাই সবচে বেশি।ইচ্ছে না হলেও পিছলে পড়ার উপায় নেই আর।যা হবার হয়েই গেছে।


লিটলম্যাগ প্রকাশের বিষয়টা চূড়ান্ত হলো।নাম - 'শব্দত্রাস'।প্রকাশক অরুণ, সম্পাদক নিঝুম, সম্পাদনা সহযোগী নীলু।সভাপতি জরি।


জরি, খুব বেশি না,তবে কালেভদ্রে হলেও কতিপয় লিটলম্যাগে কবিতা পাঠিয়েছে।রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক লেখা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে তার অধিকাংশ লেখাই সতর্ক সম্পাদক সাহেবের নিকট থেকে গেছে অমনোনীত।অথচ রাজনীতি ও ধর্ম বাদ দিয়ে ভাবা যায় না মানব সভ্যতা, ভাবা সম্ভব নয় সাহিত্য।তবে এটা অবশ্য সম্পাদকদের দোষ নয়।রাজনীতি নিয়ে লিখলে গ্রেফতার করবে প্রশাসন আর ধর্ম নিয়ে লিখলে কুপিয়ে মেরে ফেলবে প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রদায়।জরি,ভাবছে- 'শব্দত্রাস'-এ-ও স্বাভাবিক যে লেখকগণ রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক লেখা পাঠাবেন। সেসব লেখা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কি জরিরা তাদের ম্যাগে ছাপাবে? বড়ো মুশকিলে পড়া গেলো গো!বড্ড স্ববিরোধীতা! আত্মপ্রবঞ্চনা!


তবে কি ম্যাগ বাদ? ম্যাগে এ যাবত যা হয়ে আসছে - দলবাজি তেলবাজি গোষ্ঠীবাজি সম্প্রতি এসব ইত্যাদি বাজিটাজি মহামারী আকার ধারণ করেছে।ঘোড়াড্ডিম কাকের ডিম লেখা হাইলাইট করা হচ্ছে।যার কাছে যত তেল পাওয়া যাবে সে তত বড় কবি সে তত বেশি হাইলাইটেড।যেমন "তৈলচরিত"- এর কথাই ধরা যাক।সম্পাদক একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতা দেখেন।অই পাতা ভাঙিয়ে বেশ করে খাচ্ছেন।"তৈলচরিত" শতভাগ গোষ্ঠীবাজি করে এপার বাংলা ওপার বাংলা উভয় বাংলা থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে পুরস্কার।আজকাল সম্পাদক ভদ্রলোকটির চামচার অভাব নেই।চামচাগুলি যথাযোগ্য অকবির দল।


 "দাদনপ্রণালী" ম্যাগে নিয়মিত তেলের যোগান দিচ্ছেন জনৈক আলু- পটল বিক্রেতা।না আছে লেখাপড়া, না লিখতে জানে কবিতা।সে-ই কিনা অই পত্রিকার শ্রেষ্ঠ ও সফল কবি!


না,জরি আর ভাবতে পারছে না।রাত নেমে এলো।ঘুম আসছে না।হয়তো আসবে না ২ হাজার বছর ধরেও। 


৫০ টি নাম তালিকাভুক্ত করে লেখা চাওয়া হলো।সাকুল্যে ১৫ জনের লেখা পাওয়া গেলো।জরিদের নিজস্ব লেখক ৬ জন।মোট ২১ জনের লেখা নিয়ে প্রকাশ পেলো 'শব্দত্রাস'।কোনো লেখককেই অনুরোধ করে বলা হয় নি- আপনি আমাদের ম্যাগের প্রচ্ছদ আপ্লোড করে আপনার আইডিতে কাইন্ডলি একটি

পোস্ট দেগে দিন।তবু ৫/৭ জন লেখক নিজে থেকেই পোস্ট করলেন 'শব্দত্রাস' প্রকাশের সংবাদ।


জরিদের কমিটির লোকজন পোস্ট করলো 'শব্দত্রাস'র প্রকাশনা সংবাদ।

সাদামাটাভাবে শুধু লেখা হলো - " প্রকাশ পেয়েছে 'শব্দত্রাস' লিটলম্যাগ প্রথম সংখ্যা"।সঙ্গে লেখকদের নামের তালিকা।


অই একটি সংখ্যাই প্রকাশ পেয়েছিলো।তারপর টাকার যোগান নেই বলে মাত্র একটি সংখ্যাতেই ঘটেছিলো 'শব্দত্রাস'র মৃত্যু।মানুষের দ্বারেদ্বারে গিয়ে ভিখিরির মতো বিজ্ঞাপন চাওয়া ওদের ধাতে নেই।যায় না ব্যক্তিত্বের সঙ্গে- জরিদের।


দলের প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে লেখা ছেড়ে দিলো।অরুণ আর চাষী পারি জমালো বিদেশ বিভুঁই।অন্যরা গ্রাজুয়েশন করে চাকুরিতে ঢুকে গেলো।এখন শুধু লিখছে জরি আর পরাণ।


একদিন পরাণ বলল- চল না আবার শুরু করি।


জরি সঙ্গে সঙ্গেই 'না' করে দিলো।পরাণ সম্ভবত প্রত্যাখ্যাত হবে ধরেই নিয়েছিলো।তাই বিচলিত হবারও কারণ রইলো না।পরাণ ভালো করেই জানে নগ্ন-নোংরা আত্মপ্রচারে জরি বিশ্বাসী নয়।কেবল একটি ভালো লেখাই প্রকৃত লেখকের ধ্যান -জ্ঞান।কবিতা 'পণ্য' নয়।যদিও কতিপয় জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যকে 'পণ্য' করেছেন, করছেন এবং করতে থাকবেন।পাশাপাশি থাকবেন বিনয় মজুমদার, ফাল্গুনী রায়দের মতন কবিতার শহিদ।


জরি জানে সে এমন কিছু লিখেনি যা সাহিত্যে ইতিহাসে হয়ে বেঁচে রবে।তাহলে কেনো লেখালিখি!যা টিকবে না চিরায়ত নয় তা লিখে কি হবে-এ প্রশ্নের উত্তর জরি আজও খুঁজে চলেছে।সে না হতে পারবে মানিক, না হতে পারবে জনপ্রিয় হুমায়ুন আহমেদ কিংবা একজন ছোটখাটো সাদাত হোসাইন।তাহলে কেনো শুধু মিছে সময়ের অপচয়!এর চেয়ে পেঁয়াজ নিয়ে কাওরান বাজারে বসে থাকা অধিক ফলপ্রসূ নয়? 


তবু,জরি লেখা থামিয়ে দিতে পারছে না।লিখে চলেছে।চলছে পঠনপাঠন।একদিন পরাণ একটি গদ্য চাইলো।বিষয়- "বাক্ স্বাধীনতা"।লেখার মধ্যে দেখাতে হবে বাক্ স্বাধীনতা মরে গেছে।


লেখাটি পরাণ কোথায় ছাপাবে জরিকে বলেনি।লেখাটা হয়তো সত্যিই কেউ ছাপাবেন সাহস বা দুঃসাহস নিয়ে।প্রশাসন গ্রেফতার করবে জরি পরাণ আর সেই দুঃসাহসী সম্পাদককেও।হয়তো বা হয়ে যেতে পারে গুম জরি পরাণ আর সাহসী সম্পাদক।


কী হবে দেখবার জন্য অপেক্ষা করে আছে নুলিয়াডাঙা গ্রামের সেই লাল ঝুটি মোরগ যে সাত সকালে প্রচন্ড চিৎকারে ভেঙে দিতে চায় মানুষের ঘুম।ঘুম ভাঙবে কবে - সেই অপেক্ষায় ধারালো ছুরির মতো কলম চালিয়া যায় 'নুলিয়াডাঙার ক্ষত'- এর স্রষ্টা জরিনা চৌধুরী।


Rate this content
Log in

More bengali story from Jubak Anarjo

Similar bengali story from Tragedy