বাবা
বাবা
লেখিকার নামঃ ইসরাত জাহান মারিয়া।
শিহ্মাপ্রতিষ্ঠানঃচট্টগ্রাম বন্দর কতৃপহ্ম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
এই ছেমরি সর এখান থেকে।মোটা গঠন এর মানুষ টা আমাকে ফেলেই দিল। হাতের কনুই টা আচড় এ হালকা কেটে গেছে।ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বের হতে লাগলো। কিন্তু আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দিলাম না।হাত দিয়ে হালকা করে রক্ত টা মুছে নিলাম।আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো এত স্বাভাবিক থাকতো না।কিন্তু আমার এতে অস্বাভাবিক কিছু ই মনে হলো না। আসলে নিত্য দিন এর ব্যাপার তো তাই স্বাভাবিক ই মনে হলো। তারপর আমি ফুটপাত এ বসে পড়লাম।
পরনে ময়লা কাপড়, গায়ের রং চাপা, মুখে ময়লা,এলোমেলো চুল।দেখতে হয়তো আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে।কিন্তু তাতে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই।আমি হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে বসে রইলাম।খুব খিদে পেয়েছে।সকাল থেকে কিছু খাইনি।কিন্তু আজকে ভিহ্মে করে তেমন একটা টাকা পাইনি। তাছাড়া এত রাতে সব দোকান বন্ধ।একটা দোকান খোলা ছিল, সেখানের দোকানদার ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দোকান বন্ধ করে দিল। খিদার জ্বালায় কাঁদতে মন চাইছে।কিন্তু আমি কান্না করলাম না।কোনো মত গুটি শুটি মেরে ফুটপাত এ শুয়ে পরলাম। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও পরছিল।হালকা ভিজে গেলাম।মধ্য রাত এ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ কাঁপতে লাগলাম।মাথা টা কেমন যেন ভারি হয়ে গেল।মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। মাথা ও ঘুরাচ্ছে অনেক। কপাল এ হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম জ্বর এসেছে।তারপর আর কিছু মনে নেই। সকাল বেলা আমার ঘুম ভেঙে গেল এক মহিলার ডাকে।
—এই মেয়ে সর ঝাড়ু দিবো।
আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম।তারপর কোনো মতো উঠে দাড়ালাম। এখন ও খানিকটা মাথা ঘুরাচ্ছে। খিদে পেয়েছে প্রচুর।নিজেকে দুর্বল মনে হচ্ছে। হাঁটার শক্তি পেলাম না আমি। যে টাকা টুকু ছিল তাও বৃষ্টি তে ভিজে ছিড়ে গিয়েছে। একটা দোকান এ গিয়ে কিছু খেতে দিতে বললাম। কিন্ত দোকানদার ফ্রি তে দিতে রাজি না।তারপর অনেক কান্না কাটি করার পর ছোট একটা বিস্কুট এর প্যাকেট দিলো।সেটা আমি এক মিনিট এ শেষ করে ফেললাম। খিদা মিটেনি কিন্তু আগের থেকে হালকা ভালো লাগছে। তারপর আমি ফুটপাত এ বসলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার থেকে কিছুটা দূরে একটা লোক বসে বসে কান্না করতেসে।আমি এর আগে পুরুষ মানুষ কে কান্না করতে দেখিনি। লোকটাকে দেখে আমার ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে গেলো।আমি গিয়ে তার চোখ মুছে দিলাম।লোকটা হালকা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
—আপনি কেন কাঁদছেন? কি হয়সে আপনার?আমি প্রস্ন করলাম।
—জানিস তোর মত আমার ও একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু একবছর আগে আমার কলিজা টা কে আমি হারিয়ে ফেলেছি। তখন থেকে খুজতেসি পাচ্ছি না।জানিনা সে কেমন আছে।কোথায় আছে। তুই এখানে কি করছিস? যা বাসায় যা তোর মা বাবা চিন্তা করবে। লোকটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
—আমার তো মা বাবা নেই। মুচকি হাসি দিয়ে বললাম।
—নেই মানে? কোথায় তারা?
—জানিনা, আমি এখানেই থাকি।দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বললাম।
—মানে?ফুটপাত এ থাকিস?
—হুম।
—কখন থেকে থাকতেসস?
—যখন থেকে বুঝতে শিখেছি। এই তো ধরেন পাঁচ বছর।
—খাওয়া দাওয়া?
—ভিহ্মা করে টাকা পেলে খায়, নাহলে খায় না।মুচকি হেসে বললাম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম লোকটার চোখে পানি টল টল করছে।তিনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
—তুই আমার সাথে যাবি?
—কই যাবো?
—আমার বাসায়। তুই যেটা চাস সেটাই দিবো।
—খেতে দিবে তো?
—যত খুশি খেতে পারবি।
—আচ্ছা। এক মুহূর্ত ও না ভেবে বললাম।
লোকটা চোখের পানি মুছে আমার হাত ধরে হাটা শুরু করলো। আমার হাত টা এত শক্ত করে ধরেছে যেন একটু ছাড়া পেলেই আমি হারিয়ে যাবো।
বাসায় পোছে আমি পুরা ঘর খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলাম। এর আগে কখনো বাসায় থাকি নি তাই জানি না কেমন হয় বাসা।হাটতে হাটতে হঠাৎ আয়না সামনে পরলো।আমি নিজেকে দেখে অনেক অবাক হলাম। অনেক দিন পর আয়নায় নিজেকে দেখেছি।আমাকে দেখতে যে এত জঘন্য লাগছে সেটা আমি ভাবতেই পারিনি।
—মা এই নে তোর জামা গোসল টা সেরে আয়।এসে নাস্তা খেয়ে নে।
আমি জামা নিয়ে গোসল করতে গেলাম। তারপর নাস্তা করলাম।
—মা শুন আমি অফিস এ যাচ্ছি। তোর সাথে এই খালাটা থাকবে। আমি দুপুর এ চলে আসবো। তোর যদি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে ওনাকে বলিস ওনি কল দিবে।
— ঠিক আছে আঙ্কেল।
আমার কথা শুনে আন্কেল কেমন যেন হতাশার চোখে আমার দিকে তাকালেন।।তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
আমি ঘরে হাটাহাটি করতে লাগলাম।ঘরের বাইরে ই বিশাল একটা গার্ডেন।সেখানে একটা দোলনা ও আছে। আমি গিয়ে সেখানে বসলাম।এর আগে কখনো এগুলো দেখিনি তাই কেমন যেন লাগছিলো।
দুপুর এ আঙ্কেল এলেন। এসেই আমাকে খুজতে লাগলেন।
— ভাত খেয়েছিস?
—নাহ। আস্তে করে বললাম আমি।
— চল একসাথে খাই।
—ঠিক আছে।
আমরা খেতে বসলাম।টেবিল এ এত এত খাবার সাজানো দেখে আমি অবাক হলাম। এর আগে কখনো দেখিনি তো।
—এত গুলো খাবার? আমি প্রস্ন করলাম।
—হুম সব তোর জন্য। নে শুরু কর।
আমি খাওয়া শুরু করলাম।কিছু সময় পর ওনি আমায় প্রস্ন করলেন।
—আচ্ছা তোর নাম কি মা?
—জানিনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললাম।
—জানিস না? আচ্ছা আমি তোর নাম রাখি?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
তিনি কি যেন ভাবতে লাগলেন।তারপর হঠাৎ হেসে বললেন
—অরুশা।নাম টা পছন্দ হয়েছে?
—হুম।মুচকি হেসে বললাম।
—ঠিক আছে আজকে থেকে তোর নাম অরুশা। জানিস এই নাম টা আমার মেয়ে কে দিয়েছিলাম।কিন্তু সে তো নেই। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বললেন তিনি। মুখ টা কেমন যেন বিশর্ন হয়ে গেলো ওনার।তারপর হঠাৎ হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন আজকে থেকে তুই আমার মেয়ে।
উওর এ আমি হাসলাম।
রাতে খেয়ে দেয়ে আমাকে বিছানায় শুয়েদিয়ে আঙ্কেল চলে গেলেন। আগে কখনো বিছানায় ঘুমায়নি তাই ঘুম আসছে না।আমি এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। তারপর সকাল এ ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলাম আমার পাশেই বসে বসে ঘুমাচ্ছেন আঙ্কেল। আমার মাথায় জল পট্টি। তারমানে রাতে আমার জ্বর এসেছিলো। আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম তখনই আঙ্কেল উঠে গেলেন।
—অরুশা তুই উঠে গেছিস?এখন কেমন লাগছে?
—ভালো লাগছে আঙ্কেল।
—তুই মুখ হাত ধুয়ে নে আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
একটু পর আঙ্কেল এসে নিজ হাতে আমাকে সু্্যাপ খাইয়ে দিলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে দিয়ে জলপট্টি করতে লাগলেন।একটু পর পর থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপতে লাগলেন। দুপুর এ নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিলেন। জ্বর পরে যাওয়ার পর ভিজা কাপড় দিয়ে মুখ হাত মুছে দিলেন। পুরাদিন আমার সেবায় লেগে গেলেন। আমি তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার চোখের কোনা ভিজে গেছে।সেকি!! আমি কাঁদছি!! এই প্রথম আমি কান্না করলাম। আসলে বাবার আদর কি সেটা এই লোকটা না থাকলে বুঝতে পারতাম না। একটা ফুটপাতের মেয়ে কে যে কেউ এত আদর করতে পারে কখনো ভাবিনি।আমি ভাবতাম পৃথিবীর সবলোক নিষ্ঠুর হয়। কিন্তু না সেটা এই লোকটা ভুল প্রমান করলেন।
কয়েক মাস পর আমি অনেক টা বদলে গেলাম।আমি আর ঐ ফুটপাতের মেয়ে নেই। এখন আমি স্কুল এ পড়ি। পড়তে জানি,লিখতে জানি।স্কেচ ও করতে জানি। স্কেচ এর জন্য পুরস্কার ও পেয়েছি।
—বাবা, বাবা কোথায় তুমি? আমি স্কুল থেকে এসে বাবা কে খুজতে লাগলাম।
—আসছি, আসছি অস্থির হচ্ছিস কেন? কি হয়সে বল।
—তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে চোখ বন্ধ করো।
—সারপ্রাইজ!! কোই দেখি তো।
—আগে চোখ অফ করো।
—নে করসি।
আমি বাবার সামনে একটা কাগজ তুলে ধরলাম। বাবা চোখ খুলেই অবাক দৃষ্টিতে কাগজ টার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাগজ টা তে আমার আর বাবার ছবি স্কেচ করা। আমরা হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
—এ,এটা তুই একেছিস!!! কাঁপা গলায় বললেন বাবা।
—হুম, কেমন হয়েছে?
—এই ছবি টা তো সেদিনের যেদিন তোকে আমি প্রথম দেখেছিলাম।
বাবার চোখে পানি টল টল করতে লাগলো।বাবা নির্বাক দৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—বাবা কাঁদছো কেন? উপহার পছন্দ হয়নি?
—এটা আমার জীবন এ পাওয়া সেরা উপহার। এই দিনটা আমার জীবন এ সব সময় স্বরণীয় হয়ে থাকবে। বাবা আমায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললেন।
—আমার জীবন এ ও।মুচকি হেসে বললাম আমি।
ছবিটা বাবা বাঁধাই করে দেওয়াল এ টাঙিয়ে দিলেন।তারপর আমি আর বাবা দু'জন দুজনার হাত শক্ত করে ধরে নির্বাক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
