Sanghamitra Roychowdhury

Drama

3.1  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama

অর্ধাঙ্গিনী

অর্ধাঙ্গিনী

5 mins
2.0K


তারপর তোমার কী হল জানি না, আমি যখন সেই রাতে সব ছেড়ে ...সব পিছুটান কাটিয়ে চলেই যেতে যখন পেরেছিলাম ক্ষত বিক্ষত শরীর আর মন নিয়ে, তখন আমার আর একবারও পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় নি। খুব কষ্ট হয়েছিলো, মনটা দুমড়ে মুচড়ে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো নিঃশব্দ ক্ষরণে। তাও আমি পিছন ফিরি নি, আমার আত্মমর্যাদাবোধ আর শিক্ষার ঋজুতা আমাকে পিছন ফিরতে দেয় নি। আর আমাকে আমার অবশিষ্ট অহং ভিক্ষুণী বেশে দেখতে চায় নি। তোমার কী হল তা জানতেও ইচ্ছে হয় নি আমার, প্রবৃত্তিই হয় নি। তোমায় বুক ভরে ঘৃণা করেছিলাম শুধু সেদিন।


তুমি তো কথা রাখো নি, তেইশটা বছর কাটলো কেউ তো তোমরা কথা রাখো নি, সামান্য কোনো দায়ও অনুভব করো নি। তোমার সংসারে, তোমাদের সংসারে তো চিরকাল বহিরাগত হয়েই থেকেছিলাম। জানো, ছেলেবেলায় এক বোষ্টম আর বোষ্টুমী আসতো আমার বাপের বাড়ীতে। তারা একবার আগমনী গান শোনাতে এসে আকাশে ঘন কালো অসময়ের বাদল দেখে হঠাৎ গান থামিয়ে বলেছিলো যে ঠিক দু'দিন বাদে এসে বাকী গানটুকু শুনিয়ে যাবে। তারপর দু'দিন ছেড়ে কতগুলো দিন পার হয়ে গেলো, বছর ঘুরে আরেক শরৎ চলে এলো, একসময় চলেও গেলো, তারপর আরও একটা শরৎ এলো গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টম বোষ্টুমী আর এলো না। পঁচিশ বছর পার করে আজও অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছি ।

বাপেরবাড়ি থেকে তোমার বাড়ী এলাম, বিয়ে হয়ে, ঘর করতে। কত কথা দিয়েছিলে নতুন বৌকে আদর করে তার শরীরের খালে-বিলে ডুবতে ডুবতে। কখনো বা মাঝি হয়ে নৌকা ভাসিয়ে আমাকেও সওয়ারি করেছো। কথা দিয়েছিলে, আমার নিজের ঘরের সংসারের দায়িত্ব তুমিই নেবে। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসবো। বললে সেবার, পরের মাসে বদলী হয়ে এসেই আমাকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতবে। সেই পরের মাসটা আর এলো না।

ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলো সেদিন আমার দৃষ্টি, বৃষ্টিরা সব আমার ঘরেই এলো। আমি একলা ঘরে একাকী তোমার অপেক্ষায়। তারপর তুমি এলে, কিন্তু তোমার সঙ্গে এলো আরেকজন, তোমার নতুন বৌ, আমার সতীন। আমায় তবে তুমি আর কি করে ঘর দেবে, সংসার দেবে, রাশিয়ান ব্যালে দেখাবে, সাগরের ঢেউ দেখাবে ?

একটাও দামী শাড়ী গয়না কিনতে পারিনি কখনো জানো? শুধু তোমার চাপ পড়বে বলে। তবে তুমি কথা দিয়েছিলে, নীল মসলিন জামদানি কিনে দেবে, কামরাঙা হার আর রতনচূড় গড়িয়ে দেবে। আমি তো সেসব কখনো চাই নি, ভুলেও, ঘূর্ণাক্ষরেও। আমি ঘর সংসার, কেবল নিজের ঘর সংসার চেয়েছিলাম, আর তুমিও কথা দিয়েছিলে। কথা দিয়েছিলে আমার সব চাহিদা তুমি পূরণ করবে। আমি স্ত্রী তোমার, তোমার অর্ধাঙ্গিনী।


তবে আর ইচ্ছে হয় নি জানো, তোমার নতুন বৌয়ের সামনে ভিখারীর মতোন দাঁড়িয়ে নিজের অপমান আর তোমার নতুন বৌয়ের বৌভাতের উৎসব দেখতে। অবিরল রঙ্গ তামাশার মধ্যে সোনার গয়নায় ঝমঝম আওয়াজ তুলে সুন্দরী ফর্সা এয়োস্ত্রী রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে, আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি। তোমার নতুন বৌয়ের আগমনে স্ত্রী আচার চলছে।

বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলো, দেখিস, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা আমার আত্মাভিমানটা বোঝে নি। মা তো আমার কোন ছোট্টবেলায় ভাইকে নিয়ে ফিরে আসবে কথা দিয়ে হাসপাতালে গেলো, আর ফিরে এলো না। তারপর থেকে বাবাই আমার সব, লেখাপড়া শেখালো, ভালো সরকারি চাকুরে ছেলে দেখে বিয়ে দিলো। বাবা কথা দিয়েছিলো, বাবা থাকতে আমার কোনো কষ্ট হতে দেবে না। কথা তো শেষ পর্যন্ত বাবাও রাখতে পারলো না।

বাবা এখন অন্ধ, ভাগ্যিস অন্ধ! তাই তো আমার এই শুকনো মুখ, হতশ্রী চেহারা, কোটরাগত চোখের কোণে সর্বক্ষণ টলমল করতে থাকা দু'ফোঁটা জল দেখতে পায় না।

বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে তুমি যখন আমার সুগন্ধি সাবানের গন্ধ পান করতে, তখন কথা দিয়েছিলে আমার জন্য একটা সুন্দর স্নানঘর করে দেবে, মার্বেল বিছিয়ে, শুধু আমার আর আমার সুগন্ধি সাবানের জন্য। রাখতে পারো নি নিজের দেওয়া একটা কথাও। এলোমেলো করেছো শুধু আমার জীবন। আমি বলেছিলাম, যেদিন আমায় তুমি সত্যিকারের ভালবাসবে সেদিন আমার সব চাওয়া পাওয়ায় পূরণ হবে। ভালবাসার জন্য আমি কাঙাল থেকে আরো কাঙাল হয়েছি শুধু।

আচ্ছা আমার অপরাধটা কি ছিলো? বিয়ের পরে তিনটে রাসের মেলা পার হয়েছিলো। আমি মা হতে পারি নি। তোমাদের বংশরক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না, তা তো একটা গুরুতর অপরাধ বটে। তোমারও যে অসম্মতি ছিলো না আবার বিয়েতে তা তোমার কাজেই বুঝেছিলাম আমি। আমার পিছনে কাপুরুষের মতো তুমি তোমার মায়ের কথায় বংশরক্ষা করার অজুহাতে আমাকে কী সাংঘাতিক উপেক্ষাটাই না করলে। তাই তোমার কথা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির ঝুড়ির ভার থেকে তোমাকে মুক্তি দিয়েছিলাম। গরীব, ভাঙাচোরা বাবার ভাঙাচোরা বাড়ীতে ফিরে আসতে আমার কোনো দ্বিধা হয় নি।


তারপর নয়নয় করে তেইশটা বছর পেরিয়েছে। তেইশ বছরে কত ঘন্টা, কত মিনিট, কত সেকেন্ড হয় তার হিসেব কখনো করে দেখেছো? নিষ্ফলা আমি, আমার ঠকাতে কীই বা যায় আসে? তাই বলে তুমি? এমন হদ্দ ঠকান ঠকলে? একেবারে নির্ধন, চূড়ান্ত গরীব হয়ে গেলে? এতো সেই কাকের বাসায় কোকিলছানার গল্প! জানতে না চাইলেও কানে ঠিক এসেছিলো, বিয়ের পাঁচ মাস পার না হতেই তুমি বাবা হলে, তোমার নতুন বৌয়ের গর্ভজাত পুত্রসন্তান। আবার অশান্তি, তোমার ছেলের মুখের ছাঁচখানা তোমার বা তোমার নতুন বৌয়ের মতো হোলো না। সে ছেলের মুখখানা তোমার এক লতায় পাতায় তুতো শ্যালকের মুখের সাথে বেমালুম মিলে গেলো। পাড়াজোড়া ঢি ঢি। মুখ লুকোতে তুমি আবার কোন দূর দেশে বদলী নিয়ে একা একা চলে গেলে। আর তোমার নতুন বৌ ছেলে কোলে করে বাপের বাড়ী ফিরে গেলো।

অনেক কানাকানি হয়েছিলো, ধর্মে না কি সয় নি, এক বৌকে বিনা দোষে ঠকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করাতে। তবে তুমি আর কারুর সাথেই না কি যোগাযোগ রাখো নি, কোনো এক বন্ধু মারফত আমায় খবর পাঠিয়েছিলে, নিজের ঠিকানা দিয়ে। সেও হোলো প্রায় বছর আঠেরো আগের কথা। আমি সেদিন তোমার ডাকে আর সাড়া দিতে পারি নি। কারণ আমি তোমার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিজেকে কিছুতেই অতটা সস্তা খেলার পুতুল ভাবতে পারি নি। উল্টে বেশ আত্মপ্রসাদ পেয়েছিলাম। তুমি কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার শাস্তি পেয়েছো ভেবে আত্মতৃপ্তি হয়েছিলো খুব।


তারপর আরো একটা একটা করে বছর গড়িয়েছে আর আমি আমার নিজের চারপাশের আবরণটা আরও দুর্ভেদ্য করে তুলেছি। কোনো অবস্থায়ই আমি দুর্বলতা বা পিছুটান অনুভব করি নি। বাবা চলে গেছে তাও অনেক বছর। এতবড়ো বাড়িটা আগলে আমি একাই থাকি। আমি কোনো অন্যায় করি নি আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করি নি।

এমনকি সেই রাতে তোমার বাড়ী ছেড়ে চলে আসার সময় আমি গঙ্গার ঘাটে এসে সিঁথি কপাল ধুয়ে ফেলেছিলাম, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম মাঝগঙ্গায় শাঁখা পলা আর লোহার আয়োস্তি। আমার চোখ দিয়ে তখন জল নয় আগুনের গরম হলকা বেরোচ্ছিলো। আসলে বিয়ের মন্ত্র, অগ্নিকুণ্ড, গাঁটছড়া, সিঁদুর দান, রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক... এই সবই একটা অন্তঃসারশূন্য ভুয়ো ব্যবস্থা মনে হয়েছিলো। আর তার সাথে সর্বাঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলেছিলো অপমানের আগুন।

তবে আজ কেন আবার আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম।


আসলে তোমায় আমি বড্ড ভালোবাসতাম গো। এই তেইশ বছর ধরে ঘৃণা করতে করতেও ভালোবেসে গেছি, নিজের মতো করে। আজ তুমি মৃত্যুশয্যায় একাকী পড়ে পড়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছো জানার পরে জানো, আমি আর নিজেকে গন্ডীতে বেঁধে রেখে শাসন করতে পারলাম না। চললাম হয়তো তোমার সাথে শেষ দেখা করতে। তাই বলে, তুমি কিন্তু ভেবো না তোমার কথা খেলাপি হওয়ার অপরাধ আমি ক্ষমা করতে পেরেছি। আমি পারি নি ক্ষমার মহত্ত্ব দেখাতে। আমি পরাজয় স্বীকার করি নি ভাগ্যের লিখন বলেও। আমি তোমার পুনরাহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছি লহমায়। তবে যাচ্ছি কেন জানো তোমার অন্তিম সময়ে? আমি যাচ্ছি আমার অর্ধাঙ্গকে চির বিদায় জানাতে। আর কখনো হয়তো সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা নেই যেই অর্ধাঙ্গের সাথে, সেই অর্ধাঙ্গের বিদায় কালে অর্ধাঙ্গিনী উপস্থিত থাকবে না, তা কি হয়?

---------------------------------------



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama