অণুগল্প
অণুগল্প
পার্ক- বেঞ্চ
আচ্ছা বলুন তো বন্ধু হতে গেলে কি বয়সের খুব দরকার ? পরিতোষ আর প্রাণতোষ দুই বন্ধু মানে ' হরিহর আত্মা ' ।এই বন্ধুত্বর শুরুটা ঘটেছিল এক অভিনব ঘটনার মাধ্যমে।প্রাণতোষ ওপার বাঙলার , আর পরিতোষ এইপাড় বাংলার।তবুও দুই জনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে যে এটা অনেকের চক্ষুশূল।
সেই ইন্টার ভিউয়ের সকাল টা মাঝে মাঝেই মনে পরে প্রাণতষেরর।পাঁচ ছয় জন বসে আছে একটা হল ঘরের মধ্যে । সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে পিয়ন এসে যখন বলল--তোষ বাবু কে আছেন ? তখন পরিতোষ আর প্রাণতোষ। দুজনেই বলে ওঠে আমি !! পিয়ন একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলে: ' আপ লোগো কো আন্দার বুলা রাহা হ্যায় '!
সেই থেকেই বন্ধুত্ব দুজনের ।এতোটাই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যে,দুজনে পাশাপাশি জমি কিনে বাড়ি করেন ।বাড়ির ডিজাইন দুজনের এক।বিবাহ ও করেন একই বছরে , এমন কি ছেলে পুলেও হয় ঐ আগু পিছু কয়েক মাস এদিক ওদিকে ।দুজনে ঘুরতে যেতেন এক সঙ্গে দল বেঁধে বা দুইজনে একা একা নিরুদ্দেশে হারিয়ে যেতে কেউ করিনি মানা তাদের এই ভঙ্গিতে৷
এমন কতো জায়গায় ঘুরেছেন তারা।দার্জিলিং টু হরিহর পাড়া।কিন্তু বছর বারো হল ঐ পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে সকাল-বিকাল বসে থাকেন। এমনই একদিন পরিতোষ বাবুর বড় ছেলে বদলি হয়ে যায় সুরাটে আর তারা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যায় একমাস।সেই থেকেই প্রাণতোষ বাবু বড় একা।একদিন ভোরে বেরিয়ে ঐ পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছেন আর মনে হল যেন পরিতোষ বলছেন,'চলে এসো বন্ধু, আর যে একা থাকা যাচ্ছে না। সকাল ৯:০০ বেজে গেছে অথচ প্রাণতোষ বাড়ি ফিরছেন না দেখে স্ত্রী সুধীরা বললেন নাতিকে ''দেখে আয় তো দাদাই কোথায় ? নাতি দেখতে গেলে সেই পার্কের বেঞ্চিতে৷
ভ্যালেন্টাইন্স ডে
হাতের কাছেই মোবাইলটা বেজে চলেছে ।এই নিয়ে দুইবার হল।অনেক কষ্টে জানালার ধারে আসা গেছে ।এরসব ক্রেডিট কিন্তু মুনের।মুন না থাকলে কি যে হত ! সারাদিনে পরপর তিনবার ফোনে না পেলেই ও চলে আসে।এ সবটাই জানা আছে। আজ জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুইটি কোকিল।সমান তালে কুহু কুহু করে ডেকে যাচ্ছে ঐ ,ঐযে
আম গাছের ডালে।আম গাছটায় এবার মুকুল এসেছে কম।তবে কিশলয়ের দল প্রচুর ।তখন থেকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মেহুল।এই ঘরটা আজ তার কাছে একমাত্র আশ্রয়।
হ্যাঁ ,তারপর যা বলছিলাম;পরপর তিন বার ফোনে না পেলে মুন চলে আসে মেহুলের কাছে।মেহুলের মতন অনাথ ছেলের আর কি চাই ?মুন সাধারণ ঘরের মেয়ে ,তাই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় ওকে মেহুলকে কাছে পাবার জন্য ,একটু ভাল রাখার জন্য ।মেহুল ও সেটা খুবই ভালভাবে জানে।মেহুল জানে গতকালই মুন যাবে নাচের শো করতে শান্তিনিকেতন আর বিষ্ণুপুরে।এই সময়টাই তো মুনের যত কাজ হয়।তাই গতপরশু এসে বলেছিল,'ফোন করলে ফোনটা তুলো লক্ষ্মীটি।আমার অনেক অনেক কাজ এই দুই দিনে সারতে হবে।' সবটা শুনে মেহুল বলেছিল,'' ফোন করার দরকার কি?বেশ তো আছি দেখতেই তো পাচ্ছ ।ভালই থাকব, তোমার অত চিন্তা করতে হবে না।'' তাতে মুন কোন কথা বলেনি শুধু চুপ করে উঠে পড়ে বলেছিল, 'আজ মুডটা তোমার ঠিক নেই আমি চলি;যা বললাম মনে রেখো।'
ইচ্ছা করেই, নাকি আলসেমিতে, নাকি অভিমানে আজ মেহুল কিছুতেই ফোনটা ধরছে না।এতদিন ধরে মানে এই দুই বছর ধরে এই ঘর বা পাশের ঘরটা ছিল একা মেহুলের।আজ দিন দশেক হল এক সঙ্গী জুটেছে মেহুলের ।তাই মুনের আসাটাও কম হয়ে গেছে আগের থেকে।বোধহয় লজ্জা পায়।দুপুরে আবারও ফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গীটি একটু করুণার চোখে তাকাল মেহুলের দিকে,তবুও মেহুল ফোনটা ধরল না।
বিকালের ঠিক আগে ,হন্তদন্ত হয়ে মুন এল মেহুলের কাছে। এসেই মেহুলের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কিছু সময়।মেহুলের চোখ দিয়ে তখন শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে ।আর মুন তার হাত দুটি দিয়ে মেহুলের শুয়ে থাকা মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে নিল, আর অনেক অনেক আদর করল যা মেহুলের কোমরের ক্যান্সারের জন্য কেমোর বিকল্প বা তারচেয়ে ও বেশি কার্যকরী ওষুধ ।
মেহুল শুধু বলল,'' আজ যে 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে' মনে ছিল না।'' সামনের বেডে সাবিনা যখন উঠে বসতেও পারে না আর কথাও বলতে পারে না অথচ, তার স্বামী ওকে দেখেই সকালে আদর করতে লাগল তখন মনে পড়ল ,আমার পোঁচিটাও কি আমায় আজ আদর করবে না?