অনন্তর (পর্ব ৫)
অনন্তর (পর্ব ৫)
-
"আমি কোনোদিনও তোকে ছেড়ে হারিয়ে যাব না রে, ছুটকি। যদি কোনোদিন হারিয়েও যাই, তোর মনের বারান্দাতে জোনাকি হয়ে ফিরে আসবো।"
দাদাভাই তো পালককে কথা দিয়েছিলো, তাহলে কেন যে ওকে ভালোবাসার জন্য সবাইকে এতবড় শাস্তি দিলো !! ওকে ভালোবাসার মতন অপরাধ করে বসে আছে পালকের বৌদিমনি, তাকে একেবারে নির্বাক, নিস্পন্দ করে দিয়ে গেছে দাদাভাই। বড় দাদাভাইকে ভালোবাসার শাস্তিস্বরূপ তার স্নেহের সহোদরাকে করে দিয়ে গেছে একা এবং নিঃসঙ্গ। এরপর সে আর কখনোই আর কাউকে ভালোবাসবার মতন এত বড় স্পর্ধা দেখাতে পারে নি। এমনকি যে তাকে সবটুকু উজার করে ভালোবাসতে চেয়েছিল, তাকে প্রতিদানে দিয়েছে দুঃখ, গভীর যাতনা, অবহেলা, অপ্রেম, অমনোযোগ, সহস্র বছরের জমানো অনিদ্রার রাত।
একটা সময় যার কথা ভেবে ভেবে হতো বুক ভার, একটা দিন যার ফোন না এলে ভেতরের ছোট্ট মেয়েটা অভিমানে ঠোঁট ফোলাতো; একটা সময় পর তাকেও আর মনে পড়তো না ঠিক করে। মনের সব অনুভূতি, স্বপ্ন, ইচ্ছেদের তালা চাবি বন্ধ করে ডুবে গিয়েছিল সংসারে। ভালোবাসা, স্বপ্ন দেখা, ইচ্ছেপূরণ তখন যে ছিল একান্তই বিলাসিতা মাত্র। তাই 'জীবন'-কে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর পেয়েছিলো,
"বেঁচে থাকার জন্য ভুলে যাওয়াটাও দরকার। মানুষ নতুনত্ব খোঁজে, পুরাতনকে ভুলতে তবু কি পারে !! পুরাতনকে কি মেলাতে পারে নতুনের সাথে !! পুরাতন সে তো থাকে অন্তরের গহীন কোনে। ঠিক তেমনই নয় থাকুক তোমার ভালোবাসা। সে তো তোমাকে চোখে দেখে নি কখনো, তেমন কোনো সম্পর্কও তৈরী হয় নি। কতদিন আর মনে রাখবে !! হয়তো নতুন কারোর মধ্যে নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে পাবে। তুমি থেকে যাবে তার জীবনে ক্ষণিক মোহ রূপে। কিন্তু তুমি তাকে তোমার মনে সযত্নে রেখো।"
পালক এই দীর্ঘ সময়টা এইভাবেই অবিরত এক অদ্ভুত অপরাধবোধে ক্ষতবিক্ষত হতে থেকেছে। সেই গ্লানি থেকেই ও ফোন হাতে নিয়েও আর কথা বলে উঠতে পারে নি আজ অব্দি, এক মূহুর্তের জন্যও নিজের ক্লান্তিটুকুও ভাগ করে নিতে পারে নি। আর তাই বোধহয় এত দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি এসে অবরোধ করেছে ওর দৃষ্টিপথ, কম্পিত চোখের পাতাদুটো খুলে তাকাতেও পারছে না আজ। আবেগে গলা কাঁপছে আগন্তুকের, চোখ দুটোও ছল ছল করে উঠেছে হঠাৎ হঠাৎই। তবুও সে আরোও একবার কোমল, নরম স্বরে ডাকে পালককে কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ কড়া সুরটা যেন থেকেই যায়,
"Palak, do you listen to me !!! শুনতে পাচ্ছো আমাকে !! পালক !!! আমি মেঘোত্তম... তোমার মেঘ..."
'তোমার মেঘ', আগন্তুক কথাটা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই একবার সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠলো পালক। নিজের অজান্তেই মূহুর্তে একটা হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো আগন্তুকের হাতের পাঞ্জাবী, যার মন জুড়ে তখন এলোপাথাড়ি দাপাদাপি করছে একরাশ পুরোনো স্মৃতি। মাত্র একুশ বছরের পালক আচমকা ছেয়ে গেছে তার সমস্ত স্মৃতিপট জুড়ে। আজ যে পালকের অবুঝ ইচ্ছেরা কিছুতেই হার মানতে চাইছে না, বুকের মধ্যে ভালোলাগার বৃষ্টি হয়ে ঝমঝম করে ভিজিয়ে দিচ্ছে পালকের রিক্ত হৃদয়টা। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
"যে তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসে, সে তোমার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাকাও পালক, চোখ মেলে তাকাও..."
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় পালক। তার আবছায়া দৃষ্টিপথ জুড়ে তখন এক সুকান্তি দেহপট। ঠিক যেন বরফে ঢাকা তুষার রাত আর এক অপার্থিব আলোয় ভেসে যাচ্ছে পালকের অবলোকনায়ন। পালক চোখ মেলে তাকাতেই সেই আগন্তুকের শিরায়, শিরায় ছড়িয়ে পড়লো একটা উষ্ণতা, ঠিক যেন তার সামনে মানস সরোবরের বুকে পূর্ণিমা চাঁদের প্রতিবিম্ব। এক অদ্ভূত প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে পালকের দিকে, যেন পালকের চোখে চোখ রেখে সে হারিয়ে যেতে চাইছে এক ভিন্ন সংক্রমণের চাহিদায়। দু'চোখ মুহূর্তে লজ্জায় ঢেকে ফেললো পালক। পালকের ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে, তবুও একটু হাসার চেষ্টা করলো পালক। কিন্তু ঠোঁটে হাসির আভা ছড়িয়ে পড়ার আগেই চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা মুক্তদানা, যেন সেই হাসির মধ্যেও কত কষ্ট, কত বেদনা লুকিয়ে ছিল মিষ্টি মেয়েটা ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"কেন এলে তুমি, মেঘ ??"
প্রত্যেক শব্দের শেষে মেঘোত্তমের কানে ভেসে এলো অন্য প্রান্তের ঘনঘন কাশির শব্দ। বিচলিত হয়ে মেঘোত্তম জানতে চাইলো,
"তোমার এমন খবর পেয়েও আসতাম না, বলছো ?? আমাদের প্রত্যেকের একটা গল্প থাকে, পালক। অতীত ঘাটলে অশ্রু ভেজা রাত ছাড়াও দিনের আলোটুকু তুমি খুঁজে পাবে। বোকা বোকা ভুল থেকে একটা সুন্দর বন্ধু পাবে। সেই বন্ধু যে জানতো তোমার অতীত, জানতো তোমার না বলা শক্ত চোখের ভাষা। সেই বন্ধু যার কাছে অশান্ত মন ব্যাকুল হয়ে খোঁজে কোমলতা, যার উষ্ণ স্পর্শে থাকে দীর্ঘ স্থিরতা, যার কথার মায়ায় ডুবে যায় ভাবের বিভোরতা, সকল কর্মব্যস্ততা ফেলে ছুটে আসা যায় যার এক চিলতে হাসির টানে।"
পালক নিরুত্তর, শক্ত হয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। শুধু মেঝেতে নিবদ্ধ চোখ উপচিয়ে অভিমানের ধারা গড়িয়ে পড়ে। 'অভিমান' শব্দটা কতো ছোট অথচ এই অভিমানের ভার সইতে সইতে বুকের ভেতর কী ভয়ানক দমবন্ধ একটা অনুভূতি রোজ পুষে যেতে হয়।
"আচ্ছা, এই অভিমান নামক বেহায়া, অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতিটুকুর জীবনে থাকার কী এমন দরকারই বা ছিলো ??"
এক অজেয় ঋজু স্বরে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ পালকের কানে আসতেই পালক চমকে উঠে মেঘোত্তমের দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই কোনো অচেনা অপরিচিত মানুষ কি করে মনের এত কাছে হয়ে যায় যে সে অব্যক্ত অনুভূতি মূহুর্তে পড়ে ফেলতে পারে, ঠিক যেমন পাহাড়ের কোলে কোলে মেঘের রাজ্যে ভেসে আসা কিছু প্রেমের কবিতা হঠাৎই হয়ে ওঠে মিষ্টি মধুর প্রেমের আলাপন !! মেঘ যেন ওর কতোদিনের পরিচিত !! অথচ মাঝের বিগত পাঁচটা বছর ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমনকি, তার আগেও ওরা দু'জন দু'জনকে কখনো চোখের দেখাটুকুও দেখে নি। আসলে কিছু মানুষ হয় পাহাড়ের মতো। ধূসর, রুক্ষ্ম, ঋজু, বলিষ্ঠ, অনমনীয়। তাদের দূর থেকেই ভালোবাসতে হয়, সম্মান করতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়। কারণ তাদের ছোঁয়া যায় না, কিন্তু তাদের অকলুষিত মনোরাজ্যে যে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে খুব। ইচ্ছে করে, সেই পাহাড়কে ভালোবেসে আজীবন তার কাছে থেকে যেতে। ধূর, ভালোবাসতে কি এতো কারন লাগে না কি !! ভালোবাসা তো এমনিতেই হয়ে যায়। ঠিক যেমন হয়েছিলো ওদের দু'জনের মনের আতুর ঘরে। কেউ কাউকে না দেখেই সেই মন কেমন করা অব্যক্ত প্রেমের আলাপন, ঠিক যেমন পাহাড়ের কোলে কোলে মেঘেদের ভাসতে দেখে মনে হয় তারা একে অপরের সাথে প্রেমের আলাপন চলছে।
পালক এতোক্ষণে খেয়াল করে, মেঘোত্তমের চোখের মণি নীল। সমুদ্রের গভীর নীল জলের মতোই স্বচ্ছ অথচ যার তল পাওয়া যায় না, খোলা নীল আকাশের মতোই স্বাধীন ছিল ওর ভালোবাসা, ওর বন্ধুত্ব। মেঘোত্তম বলেছিলো, ওর দেশ পাহাড়। ও ওর ভালোবাসাকে, বন্ধুত্বকে কখনো জোর করে আটকে রাখবে না, পাখির মতো মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেবে ডানা মেলে ওড়ার জন্য। আচ্ছা, সেই আকাশটা কি ওর এই স্বচ্ছ নীল চোখ !! যে এক বুক ভরসাস্থল, ওর চোখ দুটোর মতোই অতল, অসীম।
হৃদয়ের এতো ভাবনার ভার আর বইতে পারলো না পালকের দুর্বল হৃদয়। আবারও চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বরে পালক জিজ্ঞেস করলো,
"আচ্ছা মেঘ, ভালোবাসা কি বন্ধন না কি স্বাধীনতা !! ভালোবাসা কি শুধুই দায়িত্ব না কি অনুভূতি !! ব-বলো না.. ব-ব..."
মেঘের কোলে মাথা রেখে আবার ঘুমপরীদের ছোঁয়ানো যাদুকাঠির স্পর্শ পায় পালকের কাজল কালো গভীর দুটো চোখ। মেঘোত্তম কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে পালক এবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর যে জ্ঞান ফিরেছে, এটাই মেঘোত্তমের কাছে অনেক। দূরে কারোর দ্রুত পায়ের শব্দ পায় মেঘোত্তম। পালককে পরম যত্নে বিছানায় শুইয়ে নিজের সবটুকু অনুভূতি উজার করে ওর অধর ছোঁয়ায় পালকের কপালে, ঘুমের মধ্যেই আবারও কেঁপে ওঠে পালক। মেঘ ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যায় কিছু শব্দবন্ধ,
"To some other, it may be confusing... But to us… there’s always that part of you and me, in our own little world... No definite name… Yet, the feeling has always been the Same."

