STORYMIRROR

অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Romance Action Thriller

3  

অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Romance Action Thriller

অনন্তর (পর্ব ২)

অনন্তর (পর্ব ২)

7 mins
202


"বাঁধনখোলা মেঘেদের আজ,

ঝোড়ো হাওয়ায় বিরহ মন...

অনুরাগ মেটাতে তাই শরৎ-এ এলো শ্রাবণ..."

                                                       (সংগৃহীত)

কথাগুলো অস্ফুটে উচ্চারণ করার পরেই 'নক্ষত্র'-র মূল ফটকে উঁকি দিলো একজন সাদা আর দুধ আলতা রঙের Handloom শাড়ি পরিহিতা। দুধ আলতা রঙের ব্লাউজ যেন গায়ের দুধ আলতা রঙের সাথে আলাদা করা যাচ্ছে না। কোমর ছাপানো মাথার এক ঢাল কোঁকড়ানো কালো চুল আলগোছে খোঁপা করা। গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঈষৎ ভেজা ঠোঁট, টানা টানা এক জোড়া চোখ যেন তার যোগিনীসম রূপের ডালিকে সযত্নে আগলে রেখেছে। কাঁধের ব্যাগটাকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছে সে। আগাগোড়া পুরো ঘটনাই যে সাদা চিকনের পাঞ্জাবী পরা একজন নিজের দু'চোখের Scanner-এ Scan করে চলেছে, তা ওই যোগিনী জানতেও পারলো না... আকাশে মেঘ ডাকছিল, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। ছাতাতে মুখ ঢেকে রাখার কারনে তার মুখটাও দেখতে পেলো না যোগিনী। জানতেও পারলো না, তার এই নীরব দর্শনও নীরবে এক বিধ্বংসী ঝড় হয়ে আছড়ে পড়লো একজনের হৃদপিন্ডে... তবে সে সাদা চিকনের পাঞ্জাবী পরিহিতের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে বুঝিয়ে দিল, যোগিনী কারোর কাছ থেকে বাঁচতে চাইছে... সচেতন হয়ে উঠলো সে, নিমেষে শরীরের সব পেশি জেগে উঠলো তার... সে যোগিনীর পিছু নিতেই যাবে, এমনসময় পেছন থেকে ভেসে আসা এক কমনীয় পুরুষ কন্ঠ ওকে থামিয়ে দিল...

" পালক... পালক... দাঁড়া বলছি... খুব খারাপ হবে কিন্তু তা না হলে !!! "

যোগিনী বাধ্য হয় তার পা দুটোকে বেড়ি পরাতে... সাদা চিকনের পাঞ্জাবী পরা মানুষটার ঠোঁটেও অঙ্কিত হয় এক চিলতে হাসি। আসলে যে আসছে, সে অন্তরে নারীসত্ত্বা নিয়ে পালকের পুরুষ বন্ধু। আমাদের সমাজ বরাবরই অচলাতনে বিশ্বাসী, ভিন্নতা গ্রহণে নিরন্তর এক তীব্র অনীহা। তাই পালকের এই বন্ধুটির পালক ভিন্ন আর কোনো বন্ধু নেই। ইনি হচ্ছেন মেঘান্ত, পালকের একমাত্র বন্ধু। গোটা পৃথিবী একদিকে থাকলেও, এরা কখনো পরস্পরের হাত ছাড়ে না। ঝগড়াঝাটি, খুনসুটি, মান, অভিমান, সবকিছুর পর্ব পার করেও এরা একে অপরের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কিন্তু আজ পালক নিতান্তই বিরক্তি সহকারে বলে,

" কি হচ্ছে কি মেঘ !! আজ কতো দেরী হয়ে গেলো দেখছিস না !!! তাহলে আবার কেন পথ আটকাচ্ছিস আমার !!! "

" চুপ কর। একদম চুপ করে থাকবি, বলে দিচ্ছি। এখন মাত্র আটটা বাজে। আর তুই অন্যান্য দিন রাত দশটাতেও এখান থেকে বেরোস। আজ 2nd জানুয়ারি। সবার এখনও উৎসবের আমেজ কাটে নি। তুই আমাকে টেনে কাজে নিয়ে এলি। এখন আমি তোর সাথে কথা বলতে চাইছি, তুই পালাচ্ছিস। "

কঠিন হল পালকের স্বর, যদিও কথাগুলো বলার আগে ও নিজের বিবেককে উপড়ে ফেলেছে...

"কারন, আমি এই Topic-টা নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। প্রেম, ভালোবাসা... This is not my Cup of Tea, Megh। আমার জীবনে কোনোদিনও কোনো রঙ আসবে না, মেঘ। আমার জীবনের একটাই রঙ, আমার ভাইঝি 'চিরাগ'। আমার একমাত্র বন্ধু। আর আমার ভালোবাসা বলতে আমার পরিবার। আমার বিধবা মা, আমার বিধবা বৌদিভাই। মেঘ, দাদাভাই-এর শরীরে না আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ছ ছ'টা গুলি লেগেছিলো। দাদাভাই বৌদিভাইকে শেষ কথা বলেছিলো, 'I Love You'... পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেছে মেঘ, বৌদিভাই দাদাভাই-এর সাথেই নিথর হয়ে গেছে... পার্থক্য শুধু একটা, দাদাভাই আর কোনোদিনও আমাদের মধ্যে ফিরবে না আর বৌদিভাই আমাদের মধ্যে থেকেও নেই। তুই তো সব জানিস, মেঘ... এইসব কথা আগে বলি নি তোকে !!! দাদাভাই চলে যাবার পর অনেক কষ্টে নরম মাটি থেকে শক্ত পাথর হয়েছি মেঘ, আবার আমাকে মাটি হতে বলিস না। "

সবার অলক্ষ্যেই প্রতিবারের মতোই গিলে ফেললো নিজের গহীন আক্ষেপটা। পালকও একটা সময় স্বপ্ন দেখতো একটু অন্যরকম হবার, স্বপ্ন দেখতো ভিড়ের মাঝেও সবার থেকে একটু আলাদা হয়ে বাঁচার। কিন্তু পালকের মতো অভাগা মেয়েদের স্বপ্ন যেমন দু চোখের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে। শুধু বুক ঠেলে বেরিয়ে এসেছিলো একটা দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাস কিন্তু একজনের দৃষ্টি এড়ালো না।

"এক জীবনে আমি এত বেশি চলে যাওয়া দেখেছি যে এখন আর কারো চলে যাওয়াই কোনো ভাবান্তর করে না। বরং হঠাৎ হঠাৎ কেউ থেকে গেলে অবাক লাগে। কারো কারো না যাওয়াটাই ভাবিয়ে তোলে। আর আমার জীবনের সাথে অন্যদের জীবন মিলিয়ে দিস না, Please..."

ধীরস্থির মেঘান্ত কিছুক্ষণ থেমে হঠাৎই নিজের স্বভাববিরুদ্ধ উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে,

" তার মানে ওই একটা ঘটনাতেই তোর সারাটা জীবন আটকে থাকবে, তাই তো পালক !!! তুই বল, তোর উদ্দালক বসুর প্রতি কোনো অনুভূতি নেই !!! হ্যাঁ আমি জানি, উদ্দালক আর পাঁচটা ছেলের মতো Presentable ছিল না। ঢিলেঢালা পাঞ্জাবী, মোটা ফ্রেমের চশমা, উসখুসকো চুল, ছাপোসা চেহারার অগোছালো একটা ছেলে। কিন্তু পালক, এই মানুষটাও যে তুই। যার সবথেকে প্রিয় মানুষগুলোই যে চিরাচরিত ধ্যানধারণা থেকে একদম আলাদা। তুই অনেকটা কিরকম জানিস !!!

         "কোনো এক রূপকথার জগতে,

      তুমি তো এসেছো আমারই হতে !!"

হঠাৎ কাঁধের কাছে আলতা স্পর্শে চমকে পেছনে তাকাতেই দেখে পালক তাকিয়ে আছে মেঘান্তর দিকে। ওর দুচোখ ভর্তি আশা। দুঃসময়কে পেরিয়ে যাবার হাতছানি ওর চোখের তারায়। চোরের মত সবার কাছ থেকে নিজের সত্ত্বাকে চেপে রাখতে গিয়ে মেঘান্তকে গুমরে গুমরে মরতে হয়েছে একা একা। সবটুকু যন্ত্রণা, সবটুকু কষ্ট একা বহন করতে হয়েছে সেই কোন ছোট্ট বয়স থেকে। এত বড় অন্যায়ের যে বিচার পাওয়া ওর অধিকার ছিল, ওর মুখ বন্ধ রাখতে গিয়ে সেই অধিকারই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তীব্র ঘৃণায় পালকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাগুলোর দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে মেঘান্ত...

" চুপ করতো তুই, মেঘ !!! সমাজ !!! কোন সমাজের কথা বলছিস তুই, মেঘ !! রাধার হৃদয় আর কৃষ্ণের শরীর নিয়ে জন্মানো মহাপ্রভুকে তারা 'প্রেমের ঠাকুর' বলে পূজো করবে। আর তোদের মতো মানুষদের অচ্ছুত করে রাখবে !!! সেই সমাজ !!! আমি মানি না এই সমাজ। জীবনটা কোনো রূপকথা নয় রে, মেঘ। "

বাইরের আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে। ভেতরের ক্যাম্পাসেও আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও পালকের চেহারায় লেগে থাকা দৃঢ়তা, চোখের সঙ্কল্প পরিষ্কার পড়ে নিতে পারলো সেই ছাতায় নিজেকে অবগুণ্ঠিত রাখা ব্যক্তিটি। আসন্ন সর্বনাশের ইঙ্গিত কাঁপন ধরাল তাঁর বুকে। মেঘান্ত স্থির চোখে তাকিয়ে আছে পালকের দিকে। মেঘান্তর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, গলার কাছটায় কেমন এক কষ্টে ব্যথা করছিল।

কথাটা বলেই পালকের চোখের কোণটা ভিজে উঠলো যেন। কোন চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল মানুষ যখন কোনো আঘাতে হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যায়, তখন বুঝে নিতে হয় আঘাতটা বেশ তীব্র ছিল। সব কথা মুখ ফুটে বলার দরকার পড়ে না, কিছু ক্ষেত্রে চোখের চাহনিও অনেক কিছু বলে যায়। ছাতার আড়ালে নিজেকে অবগুন্ঠিত রাখা ব্যক্তিটির নিস্তরঙ্গ জীবনে যে পালক একরাশ তাজা হাওয়া। সবার অলক্ষ্যে আজ ওরা দু'জন চলে যাবার আগে অবগুণ্ঠিত ব্যক্তিটি নিঃশব্দ পদচারণায় এসে পালকের পেছনে দাঁড়ালো... তারপর আস্তে আস্তে সবার অলক্ষ্যে পালকের কানে কানে বলল,

     " তোমার রঙে রাঙাবে কি আমায় !! "

বলেই তেমনি নিঃশব্দে চলে গেল। কথাটা শুনে পালক যতক্ষণে তার দিকে তাকালো ততক্ষণে সেই ব্যক্তি দূরে চলে গেছে... তবে ও স্পষ্ট পালকের চোখের জল দেখতে পাচ্ছে। তার মানে পালক এখনও সবকিছু ভুলে যায় নি... ও তো পালককে এই বন্দি জীবন থেকে মুক্ত দিতে চায়। ও তো পালকের ওই রঙবিহীন চোখের জলেও নিজেকে রাঙাতে চায়। পালকের নীরব, অবুঝ অভিমানে নিজেকে রাঙাতে চায়। পালকের হারিয়ে যাওয়া মুক্তোর মতো হাসিতে নিজেকে রাঙাতে চায়।

এদিকে পালকের কানে একটাই কথা বাজছে, "তোমার রঙে রাঙাবে কি আমায় !!" কথাটা শুনে পালক অবাক হয়ে গেল। পাঁচ বছর আগেও তাকে একজন ঠিক এই কথাটাই ফোনে বলেছিলো... আসলে সেই রাতে ঘটে যাওয়া সেই অবিশ্বাস্য অথচ একটা জঘন্য বাস্তব ঘটনা ও এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু তার কয়েক মূহুর্ত আগেই সেদিনের ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা এই একই জলদগম্ভীর স্বর আর এই একই শব্দগুচ্ছ কোথাও পালকের অবচেতন হৃদয়ে ছাপ ফেলে গিয়েছিলো। তাই আজও ওই স্বর আর শব্দগুচ্ছ ওর পিছু ছাড়ে নি। ভুলে যেতে পালক চায় না, এমনটা নয়। চেষ্টাও করেছে কোটি কোটি বার। আসলে কিছুক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া মানে ভুলে গেছে তা নয়, ভুলে যাওয়া মানে তীব্রভাবে মনে রাখা। তবে কিছু স্মৃতি আর কিছু ক্ষত কখনো ঢাকা যায় না। তাই আজ কাল আর সে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে না। পালক দেখে সেই ব্যক্তি তার দৃষ্টিপট থেকে বহুদূরে সরে যাচ্ছে, ঠিক পাঁচ বছর আগে যেমন পালক সরে এসেছিল... তাহলে কি সে পালককে খুঁজে বের করলো !!! কিন্তু কেন !!! কি সম্পর্ক ছিল তাদের দু'জনের মধ্যে !!! আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল কি !!! না কি কিছু সম্পর্কের কোনো নাম দেওয়া যায় না !! পালকের এই মূহুর্তে ঠিক মনে পড়লো না, কিন্তু সমরেশ মজুমদার কোথাও লিখেছিলেন,

একজন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে আর একজন নিজস্ব আনন্দের সন্ধানে জীবন খুঁড়ে যাচ্ছেন অবিরত। এই খোঁড়া সব সময় সুখের হয় না, যন্ত্রনা চলে আসে ভেতর বাইরে...” (হিমশীতল)

আসলে প্রথম চাক্ষুস দর্শনেই পালকের ওই শান্ত, সৌম্য, যোগিনীসুলভ স্নিগ্ধতা ছাতার আড়ালে অবগুণ্ঠিত ব্যক্তিটির মনে দাগ কেটে ফেলেছে। সুদীর্ঘ ত্রিশ বছরের জীবনে বহু নারীর সংস্পর্শে এলেও এমন পবিত্র সৌন্দর্য সে কোনোদিনও কারোর মধ্যেই দেখে নি। পালকের এই সীমাহীন রূপের বৈরাগ্য, কোমল হাসি, চারিত্রিক দৃঢ়তা তার হৃদসাগরের স্থির জলতলে এক অদৃশ্য তরঙ্গ তৈরি করে দিয়েছে। তার হৃদয়ের মন্ত্রমুগ্ধতার মাঝেও তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি অঙ্কিত হয়ে রইলো। না, সেই হাসিতে কোনো কামুকতা ছিল না। ছিল এক রাশ মুগ্ধতা আর কিছু উত্তরসন্ধানী প্রশ্ন। মনে মনে সে যোগিনীকে বলে,

"পাগলি রে, আর কেমন করে বোঝাই তোমাকে যে তুমি আমার কি !!! তোমাকে দিতে না পারা সময়ের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাকে তিল তিল করে জ্বালায়। আমিও চাই তোমার হাত ধরতে। তোমার সাথে দুষ্টু, মিষ্টি গল্প হয়ে জড়িয়ে থাকতে। প্রতিটা খুশির দিন দুজনের পাঁচমিশেলি আলাপের রামধনু দিয়ে সাজাতে। হয়তো অনেক অপেক্ষা করেছিলে সেদিন। আর একটু করো। আমি ফেরার আগে চলে যেও না। মুখ ফুটে বলা হয় নি কখনো, 'ভালোবাসি'... অথচ দুজন কাঙ্ক্ষিত থেকেছি একে অপরকে দেখার জন্য, ঠিক জল চাওয়া চাতকের মতো... আমাদের সম্পর্কে ছিল শুধুই অপেক্ষা... তুমি হয়তো একটা দেশলাই কাঠি জ্বালানোর অপেক্ষায় ছিলে। আমি দাবানল নিয়ে ফিরবো। তুমি একটা তারা চেয়েছিলে আমার কাছে। আমি এক আকাশ ভর্তি খুশির রাত নিয়ে ফিরবো। আমি ফিরবোই। অপেক্ষা করো। Please..."



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance