STORYMIRROR

অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Romance Action Thriller

3  

অনিশ্রীর ঝুড়োগল্প

Romance Action Thriller

অনন্তর (পর্ব ৫)

অনন্তর (পর্ব ৫)

7 mins
172


পালকের কেবিনের জানলাতে এসে দাঁড়ায় সেই সাদা পাঞ্জাবী পরা আগন্তুক। নার্সিংহোমের বেডে পালককে ওইভাবে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চোখের পলক ফেলা তো দূর, যেন নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে সে। পালককে দেখলে এখন কে বলবে, এত যন্ত্রণার মধ্যেও ও একজন Self Made Woman। তাই হয়তো বড্ড একগুঁয়ে আর সামান্য রাগী। তাই বোধহয় এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এত সফল হয়েছে জীবনে। কিন্তু পালককে নিয়ে সবচেয়ে সমস্যার যেটা, সেটা হলো পালক নিজেকেই নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ওর জীবনে ওর নিজেরই কোনো গুরুত্ব নেই। তাই তো, এখন পালকের এক হাতে IV Channel করা, পালক ওষুধের প্রভাবে চোখ বন্ধ করে অচেতন হয়ে ঘুমাচ্ছে। পালকের যোগিনীসমা রূপের ডালি দেখে মনের শত দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কার মধ্যেও আগন্তুকের হৃদয়ের গোপন অলিন্দে অদ্ভূত এক আদিম অনাবিল অনুভূতি ফিরে আসে। আগন্তুক অস্ফুটে মনে মনে মন্ত্র জপ করার মতো উচ্চারণ করতে থাকে,

"তোর কাছেতে লুকিয়ে আসা,

আলো আঁধারি, ধুলো ধোঁয়াশা,

ছোট্ট কোণায় ভালোবাসা।

তোর সাথে প্রেম অবাধ্যতায়,

জড়িয়ে থাকা আলস্যতায়,

রোজ জাগা রাত গল্পকথায়।

তোর কাছে মন যত্নে রাখা,

শত অজুহাত একটু দেখা,

স্পর্শকাতর একটু একা, গন্ধটা তোর শরীরে মাখা।

তোর সাথে রাগ, ঝগড়া, আড়ি,

ঘন্টাখানেক ছাড়াছাড়ি,

একলা হলেই বুঝতে পারি,

তুই ছাড়া সব বেরঙ ভারী।"      (সংগৃহীত)


এই মিশ্র অনুভূতির মাঝে হঠাৎই যেন খেয়াল করে সেই মায়াবিনীর পদ্ম পাতার মতো ঠোঁট দুটো যেন নড়ছে, যেন কিছু বলতে চাইছে কাউকে। কিন্তু মাঝে শব্দরোধক কাঁচের অভেদ্য দেওয়াল থাকায় সে শুনতে বা বুঝতে পারছে না পালক ঠিক কি বলতে চাইছে। আগন্তুক ব্যস্ত চোখে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে আশেপাশে কোনো ডক্টরের দেখা পাওয়া যায় কিনা !! বিছানার চাদরটা দুই হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে পালক। মূহুর্তে যেন এক তীব্র ব্যাথায় পালকের শরীরের প্রতিটা শিরা, উপশিরা জেগে উঠছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না আগন্তুক। মনের কষ্ট পাঁজরে চেপে পরম উদ্যমে ইতস্ততঃভাবে ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলো আগন্তুক। মনিটরের বিপ বিপ শব্দের মাঝেই পালকের পরিচর্চা করতে করতে সামনে দাঁড়ানো আগন্তককে নার্স ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

"আপনি কি পরিবারের কেউ ??"

উত্তরে 'না'-সূচক মাথা নাড়লো আগন্তুক। মনের মতো উত্তর না পেয়ে নার্স আবার জিজ্ঞেস করলেন,

"তাহলে কে ?? বন্ধু ??"

এবারও সেই একই ইঙ্গিত ফিরে পেলো নার্স।

"তাহলে এমনি ??"

এবার উত্তর এলো সম্মতিসূচক। যে সমস্ত মানুষ 'বিকল্প' শব্দটাকে নিজেদের জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলেছি, কিংবা যে সমস্ত মানুষ ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেতেই অভ্যস্ত, কিংবা ভালোবাসায় চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে ব্যস্ত, কিংবা সাফল্যের সিঁড়ি হিসেবে নিজের কাছের ভালোবাসার মানুষকে শুধু 'পাশার গুটি' হিসেবে ব্যবহার করে; তারা বুঝতে পারবে না এই পালক আর আগন্তুকের সম্পর্ককে। পালক শুধুমাত্র নিজের জীবনের প্রতিকুলতার ঘুর্ণাবর্ত থেকে এই মানুষটাকে দূরে রাখতে ওর নিজের জীবন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে এই বিশাল জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলো। আর এই মানুষটা পালকের উপর নিজের এক আকাশ অভিমান নিয়েও কখনো পালকের জায়গায় অন্য কারোর কথা ভাবতেও পারে নি। সবসময় এটাই ভেবেছে যদি তারা এক নাও হতে পারে, তাও তাদের ওই সময়গুলো তো মিথ্যে হতে পারে না কখনো। এই রাতজাগা গল্পগুলো। দু'জনের ঝলমলে আকাশে একই চাঁদের জ্যোৎস্নার বৃষ্টি আর কয়েকটা তারার সামিয়ানা। সেই রাতগুলোর, সেই জোৎস্নার বৃষ্টি আর তারার সামিয়ানার অর্থ কেবল তারাই জানে, শুধুমাত্র তারা দু'জন জানে। ওদের সম্পর্কের শুরুটা ছিলো বেশ, কেউ কাউকে চোখে না দেখলেও ওদের সেই অনাম্নী সম্পর্কে বিশ্বাস ছিল, সততা ছিল, ভরসা ছিল। মাঝপথে কখন যে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠলো, ওরা দু'জনেই একটুও টের পায় নি। বড্ড হোঁচট খেয়েছিলো আগন্তুক পালকের ওইভাবে আকস্মিক অন্তর্ধানে।

"অভিমানের জল ভরা ও আঁখি,

কোথায় বলো এত অভিমান রাখি !!"

                                              (সূর্যআরণ্যক)

অভিমানে মনকে বুঝিয়েছিলো, পৃথিবীতে অনেক ধরনের আনন্দ আছে। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার আনন্দ সর্বোপরি। আর চাইলেই তো জীবন নিজের ইচ্ছেমতো কাটানো যাবে। তাই জীবন এতোটাও কঠিন নয় যে তাকে মানিয়ে চলা যাবে না। জীবন জীবনের মতো। জীবনকে জীবনের মতো মেনে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর। জীবন সত্যিই সুন্দর। তবে পালককে খুঁজে পাওয়ার আশা ছাড়ে নি কখনো। পরে পালককে সত্যি করে চেনার পর, জানার পর উপলব্ধি করেছে যে জীবনে হোঁচট খেয়েছিলো বলেই জেনেছে এবং বুঝেছে, এই ছোট্ট জীবনে শক্ত করে পালকের হাত ধরে রাখার মতো আর কেউ নেই। যদিও পালক আজোও জানে না, পালকের জন্য এই আগন্তুকের কত কত বিনিদ্র রাত কেটেছে, সকলের অজান্তেই পুড়ে গেছে কত রঙীন-বেরঙীন স্বপ্ন, হারিয়ে ফেলেছে কত মিষ্টি মধুর হাসি। তবুও সে নিজের ভালোবাসায় থেকেছে অবিচল, যদিও পৃথিবীর আর কেউই আর নির্লিপ্ত অবয়ব দেখে এইসবের কিছুই উপলব্ধি করতে পারে নি। এমন কি পালকও আজ অব্দি জানতেও পারে নি যে তাকে নীরবে নিভৃতে কেউ এত গভীরভাবে ভালোবেসে গেছে।

হঠাৎই নার্সিংহোমের বেডে ছটফট করতে শুরু করে পালক, যেন অপরিসীম যন্ত্রণা সর্বাঙ্গে। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা নয়। পালকের হঠাৎই এই শারীরিক অবনতির কারণ নার্সও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার হাত থেকে ব্যাপারটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে। অন্তর্নিহিত মানসিক সংক্রমণটা ধরা পড়তে অনেকটা বিলম্ব হয়ে গিয়েছে যে। দু'হাতে চাদর আঁকড়ে ধরে তীব্র বেগে দু'দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে পালক ঘোরের মধ্যেই বলতে শুরু করে,

"দ্দা... দা-আ-আ... দাদা... ভা-আ-আ... ই-ই-ই...

Don't Shoot... Don't Shoot Please... আমাদের... ছেড়ে দিয়ে... যাস না... দ্দা... দাদাভাই... চোখ খোল... Please... কথা বল না, Please... এক... একবার পালক বলে ডাক... না... নাআআআআ.... ও... ও ঘুমিয়ে আছে... ওকে নিয়ে যেও না তোমরা... নিয়ে যেও না...."

উদ্বেগে আর দুশ্চিন্তায় যেন ফেটে যাচ্ছিলো আগন্তুকের মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা। তার চোখে অথৈ জলের বন্যা দেখে হতবাক হয়ে নার্স বলে উঠলো,

"কি নির্মম যন্ত্রনা, তাই না !! ডক্টর উপমন্যু রায়কে ডাকতে হবে, মনে হচ্ছে। আপনি একটু ধরবেন ওকে।"

আগন্তুক দ্রুত পায়ে এগিয়ে নিজের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে পালককে, নয়তো স্যালাইনের সূচ বেয়ে রক্তপাত অনিবার্য ছিল। সে স্বপ্নেও ভাবেনি এতদিনের চেপে রাখা মনের গোপন অনুভূতিটা সে এভাবে প্রকাশ করতে পারবে সকলের সামনে। যত্ন করে পালকের Channel করা শায়িত, কম্পমান, রুগ্ন, শীর্ণকায় হাতে নিজের বলিষ্ঠ, লোমশ হাত রাখলো আগন্তুক। আবেগী হয়ে নার্সের চোখের কোণেও যেন চিকচিক করে উঠলো Saline Water। নিজেকে সংযত করতে সে একনিমেষে হন্তদন্ত হয়ে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। পালক তখন নিজের ঠোঁট দুটো ক্রমাগত নাড়িয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে করতে নির্বিচারে নিজের হাত, পা ছুঁড়ছে। মাঝে মাঝে বিছানা ছেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য কিছু একটা আটকানোর চেষ্টা করছে, পর মূহুর্তেই ওর দুর্বল শরীরটা নিজেরই ভার বহন করতে না পেরে আবার ধপ করে বেডে লুটিয়ে পড়ছে। পালকের ওই পালকের মতো নরম, তুলতুলে শরীরটাতে তখন যেন অকস্মাৎ আসুরিক শক্তি ভর করেছে, আগন্তুককে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে পালককে আগলে রাখতে গিয়ে। চোখের জল ধরে রেখে আগন্তুক আধো গলায় পালককে বলে,

"শান্ত হও, পালক। শান্ত হও। এমন করতে নেই।"

কিন্তু সময় বড়ো বিচিত্র। সময়ের সাথে সাথে উত্তেজনাও আস্তে আস্তে প্রশমিত হতে থাকে। স্নায়ুগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। দেহতন্ত্রীতে রক্তপ্রবাহ ধীরগতি হয়। অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতি পড়ে গিয়ে মানুষ সঠিক চিন্তাধারায় ফিরে আসে।

কে ডাকলো পালককে !!! এতদিন পর পালকের মনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আভাস কে পেলো !! এতদিন পর কানে এসে ক্ষীণভাবে ধাক্কা মারলো সেই পরিচিত কন্ঠস্বর !!! একটা মানুষ যে ছিলো পালকের। তাহলে কি সে এত তীব্র অবহেলা, অনাদর পেয়েও এখনও পালকের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে !! কে ওকে এমনতর শক্ত বাঁধনে আগলে ধরে বসে আছে, যেন পালকের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিরা, উপশিরাতে তরঙ্গায়িত করতে চাইছে এক অনুচ্চারিত অনুভূতি,

"তোমার জন্য আমার চিন্তা কমে না। আচ্ছা, আমার জন্য তোমার মন কেমন কেমন করে না ?"

আঙুলটা একটু নড়ে উঠলো পালকের, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো আলিঙ্গনবদ্ধ মানুষটাকে। আনন্দে চোখ চিকচিক করে উঠলো আগন্তুকের। কিন্তু মুহূর্তের মাঝেই যেন নিভে গেলো। বুকের মধ্যে কি এক অব্যক্ত কষ্ট চিনচিন করছে। পালক যে ওর ভালোবাসা। তাকে ওমন বিধ্বস্ত, কষ্টে মলিন দেখে কি সহ্য করতে পারে কোন প্রকৃত প্রেমিক? নাহহ... সে সহ্য করতে পারছে না পালকের কষ্ট। এই মেয়েটাকে যে বড্ড ভালোবাসে ও। কি দোষ করেছে এই নিষ্পাপ মেয়েটা ?? যে পরিবারকে ভালোবেসে একেবারে ভেঙেচুরে গেছে। এতটাই সে ভঙ্গুর আজ যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, সে আজ ভুলে গেছে পথ। হারিয়ে ফেলেছে গন্তব্য। অতীত আজ তার চোখে এনে দিয়েছে আর্তনাদ আর অঝোর জল।

ওদিকে, ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেলার চেষ্টা করতে থাকে পালক। কিন্তু ক্লান্তিতে চোখের পাতার ভারী পর্দাটা যে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারছে না। কিন্তু পালককে যে জানতেই হবে, সত্যিই কি 'সে'-ই এসেছে !! আজ যে তারা দু'জন দুই প্রান্তের মানুষ, তাদের মাঝে হাজার বছরের দূরত্ব। মাঝে মাঝে মনে হয়, শতাব্দী আগে তাদের ভালোবাসা বন্ধুত্বের গন্ডী পেরোনোর আগেই হারিয়ে গিয়েছিলো। সূর্যের উপর তীব্র অভিমান থেকে ভোর হবার আগেই রাতের অন্ধকারে যেমন স্বর্গের পারিজাত যেমন শরতের শিউলি ফুল হয়ে ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনই তাদের ভালোবাসাও বাস্তবতার অভিঘাতে ঝরে পড়ে গেছে। আচ্ছা, কিছু স্বপ্ন আজীবন যেমন অপূর্ণ রয়ে যায়, কিন্তু তবুও অপূর্ণতাতেও সে তো রয়ে যায়। ঠিক তেমনই এক আকাশ অভিমান নিয়েও কি তাদের ভালোবাসা 'রয়ে গেছে'। কোথাও না কোথাও। মনের কোনো এক চোরা পথে। সেই পথ ধরেই কি সে আজ ফিরে এলো !! সেটাই বা পালক বুঝবে কি করে !!! পালক তো কেবল তার কন্ঠস্বর শুনেছে, তাকে তো চোখে দেখে নি কখনো !!! তাহলে !!! মনের গোপনে সযত্নে লুকিয়ে রাখা কেবলমাত্র ওই কন্ঠস্বর দিয়ে কি কাউকে চেনা যায় !!! না কি ভালোবাসার যে নিজস্ব ভাষা আছে, যে ভাষায় একজন বাকশক্তিহীন মানুষও নিজের প্রকাশের অসাধ্য অনুভূতিও প্রস্ফুটিত করতে পারে; সেই ভাষাই আজ সাঁকো হয়ে দুলবে দু'জনের মাঝে !!! নীরবে দু'জনের হৃদয়ে গুঞ্জরিত হয়ে বলবে,

    "আমি যতবার হারিয়ে যেতে চাই,

   মায়ার বাঁধনে আবার বেঁধে যাই... !!"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance