অনাবিল
অনাবিল


তিতিরের ক্লাসেই পড়ে অনাবিল। সামনের দাঁত দুটোতে পোকা ধরা। হাসলে দু'গালে টোল পড়ে আর চোখ দুটো বুজে যায়। ভারী মিষ্টি বাচ্চা! ওর হাসিখুশি মুখ আর সরল সাদাসিধে হাবভাবের জন্য মিসেরা ওকে খুব আদর করে,নাক নেড়ে দিয়ে,গাল টিপে।
মিসের মতো করে অন্য বাচ্চারাও সুর করে করে বলে, "মাছভরা খালবিল, মাছরাঙা অনাবিল"।
ক্লাস ওয়ানে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে ওদের ক্লাসের সবাই নামীদামী স্কুলে চান্স পেয়ে ভর্তি হোলো। অনাবিলের নাম কোনো লিস্টেই নেই। কেউ জানতেই পারে নি অনাবিল কোন স্কুলে ভর্তি হোলো। তিতিরের মায়ের সাথে দোকানে একদিন অনাবিলের মায়ের দেখা। স্টেশনের ওপারের কৌলীন্যহীন স্কুলটাতেই এখন অনাবিল পড়ছে।
এরপর দীর্ঘকাল পার। তিতির আর ওর সব বন্ধুরাই দারুণ দারুণ সব কেরিয়ার গড়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে।সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে একে অপরের সব খবর সবার নখদর্পণে।তিতির এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ওর জন্মদিনে পুজো দেবার জন্য মিষ্টি কিনতে গিয়ে তিতিরের মা অনাবিলের মা মুখোমুখি,আবার সেই মিষ্টির দোকানেই।
দু-এক কথার পর অবধারিত ভাবেই উঠে এলো, "অনাবিল এখন কি করছে?"
"অনাবিল স্টেশনের পাশের চায়ের যে ছোট্ট স্টলটা, ওটাই চালায়। এইটের গন্ডীটাই তো পেরোতে পারে নি।"
এটুকু বলেই সংকুচিত অনাবিলের মা একরকম তিতিরের মা'কে এড়িয়েই চলে গেল। তিতিরের মায়ের মনে ঠিক কী অনুভূতি হোলো সেটা ওঁর নিজের কাছেই স্পষ্ট পরিষ্কার নয়। অনাবিলে মায়ের প্রতি অনুকম্পা নাকি অবজ্ঞা?
তিতির ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে রোজই রাতের দিকে ফোন করে। আজও তিতির ফোন করেছে, কিন্তু গলাটা যেন কেমন শোনালো!বাবা-মার জিজ্ঞাসার উত্তরে ভেঙে কিছু বললো না। শুধু সংক্ষেপে জানালো দেশে ফিরছে আর দু'দিন পরেই। যথাসময়ে বাবা-মায়ের সব উদ্বেগের অবসান করে তিতির দেশে ফিরলো, ঠিক দু'দিনের মাথায়।
এরপর তিতিরকে নিয়ে ওর বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা সহস্রগুণ। কোলকাতা শহরের সব খ্যাতনামা ডাক্তারের চেম্বারে ছুটোছুটি। একমত সব ডাক্তার... তিতিরের একটা কিডনি রিপ্লেস করতেই হবে খুব তাড়াতাড়ি। তিতির নামী হাসপাতালের কেবিনে লড়ছে, কিডনি ফেইলিওর নিয়ে। ছোট্ট থেকে শুধু লেখাপড়া আর কেরিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে ভেতরে ভেতরে এত বড়ো অসুখটা ঘাপটি মেরে বাসা বেঁধেছে, তা তিতির বা তিতিরের বাবা-মা কেউ বুঝেই উঠতে পারে নি। তিতিরের খুব রেয়ার গ্রুপ, এখনো পর্যন্ত একটি কিডনিও ম্যাচ করে নি। হন্যে হয়ে খোঁজ চলছে, অন্ততঃ একটি কিডনির, কিম্বা একজন ডোনারের, তিতিরের ব্লাড গ্রুপ টিস্যু সব ঠিকঠাক ম্যাচ করে।
তিতিরের বাবা-মা ভেঙে পড়েছে একেবারে। প্রথম প্রথম বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন দু-চারজন ওদের সঙ্গে সাথে থাকছিলো। যতদিন যেতে লাগলো সহমর্মীদের সংখ্যাটা কমতে কমতে এসে শূন্যয় ঠেকলো, কারণ সবারই তো নিজস্ব কাজকর্ম আছে। তিতিরের বাবা-মা দুশ্চিন্তায় অর্ধমৃত প্রায়। মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়েছে। তিতির ওদের একমাত্র সন্তান।
মেয়ের ঐ তিলতিল যন্ত্রণাময় রোগভোগের সময় যখন তিতিরের বাবা-মা দিশাহারা, ঠিক তখনই হঠাৎ করেই হসপিটাল থেকে এক ডোনারের খোঁজ এলো। অপারেশনের দিন..... ডোনারের মুখটা কী তিতিরের মায়ের কাছে একটু চেনা মনে হোলো?সাকসেসফুল রিপ্লেসমেন্ট, কোনো সমস্যা হয় নি।
ক'দিন পরেই ডোনারের ছুটি হোলো। তিতিরও ভালোর দিকেই, তবে আরও বেশ কিছুদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে। পরপর খালি বন্ধুদের মেসেজ ঢুকছে। তিতির বেডে আধশোয়া হয়ে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বন্ধুদের মেসেজ চেক করছে, তারপর রিপ্লাই করছে।
এমনসময় অন ডিউটি নার্স এসে তিতিরের হাতে একটা মুখবন্ধ লম্বা সাদাখাম দিলো। খামের ওপরে কোনো নাম ঠিকানা কিচ্ছু লেখা নেই। নার্সের হাত থেকে খামটা নিয়ে তিতির উল্টে পাল্টে নেড়েচেড়ে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
"কে দিয়েছে?"
নার্স বললো, "রিসেপশনে এসে তিতিরের কোনো বন্ধু দিয়ে গেছে।"
তিতির থৈ খুঁজে পেলো না, কে বন্ধু হতে পারে?
নার্সটি জানালো, "ভিজিটিং আওয়ার্স নয় বলে হয়তো দেখা করতে পারে নি, তাই রিসেপশনে পেশেন্টের নাম আর কেবিন নাম্বার বলে দিয়ে রেখে গেছে। অন্যদিন হয়তো আসতে পারবে না।"
বেশ সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে দিয়ে নার্সটি নিজের কাজে চলে গেলো। খানিকক্ষণ দোনোমোনো করে তিতির খামটা খুলেই ফেললো। তিতির হাঁ.....মুখবন্ধ খামটা খুলে ভেতরটা দেখে। এত সেই চেকটা বোধহয়, তিতিরের বাবার সই করা চার লাখ টাকার চেকটা, একজন মহিলার নামে। তিতিরের অবাক হওয়ার আরও বাকী ছিলো। এটা কি চেকের সাথে? একটা চিরকুট! চিরকুটে গোটা গোটা অক্ষরে লেখার রয়েছে...."মাছভরা খালবিল, মাছরাঙা অনাবিল"!
তিতিরের দু'চোখে অকাল শ্রাবণধারা। তার মানে অনাবিল? আবার অনাবিল? নার্সারী ক্লাসে রোজ তিতিরের পাশে বসতো, আর তিতিরের পেন্সিল শার্প করে দিতো, জলের বোতল খুলে দিতো, টিফিন বক্স খুলে দিতো, রেনকোটের বোতাম লাগিয়ে দিতো। আর তিতিরও আগলে রাখতো অনাবিলকে। পরীক্ষার সময় সব বলে দিতো। মাঝে কতগুলো বছর, ভুলেই তো গিয়েছিলো ও বন্ধুকে।
অপরিশোধযোগ্য ঋণ..... বন্ধুত্বের ঋণ। তিতির চোখ বুজে মনে মনে বললো, "সত্যিকারের বন্ধু! সার্থকনামা বন্ধু!"