অলস শামুক ও নিরলস গোলাপগাছ
অলস শামুক ও নিরলস গোলাপগাছ
বিশাল এক বাগান। খুবই সুন্দর ও মনোরম। পুরো বাগানজুড়ে ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। রজনীগন্ধার দল, চন্দ্রমল্লিকার ঝোঁপ, হাসনাহেনার ঝাড়—কী নেই সেখানে? সবই আছে। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে গোলাপগাছটি। তার শরীরে ফুটে আছে রক্তের মতো টকটকে অসংখ্য লাল গোলাপ।
গোলাপগাছটির নিচে একটি গর্ত আছে। সেখানে বাস করে থলথলে শরীরের এক শামুক। গায়ে শুকনো ও শক্ত খোল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাইরে বেরিয়ে এলো সে। হাই তুলতে তুলতে গোলাপগাছকে বলল, ‘কী গোলাপ, করছোটা কী? কাজকর্ম কিছু নেই নাকি? একনাগাড়ে করে ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছো? ভালো কাজ করতে চাইলে আমার মতো আস্তে-ধীরে করতে শেখো।’
গোলাপগাছ শামুকের কথা শুনে নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। কিছু বলল না। শামুক আবারও বলল, ‘আমি পৃথিবীতে যত বড় কাজ করে যাবো, তত বড় কাজ কি তুমি করতে পারবে কখনও?’ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল গাছটি। বলল, তা পারবো না। আপনি কত বয়োজ্যেষ্ঠ। জানেন বেশি, বুঝেন বেশি। আপনার কাছথেকে আমরা এমন কিছুই আশা করি। তা সেই বড় কাজটি কবে করবেন, জানতে পারি?’ ‘কখন, কবে—সেটি জেনে তোমার লাভ কী?সময় হলেই করবো।
তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তাড়াহুড়ো করো বলেই বড় কিছু করতে পারো না।’ বলতে বলতে শামুক তার খোলসের ভেতর ঢুকে পড়ল। দিন যায়। মাস যায়। বছর আসে। শামুক কোনও কাজই করল না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটাল। নতুন বছর এলো।
এক সকালে সে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হলো। হাই তুলতে তুলতে গোলাপগাছকে ডেকে বলল, ‘কী গোলাপ, আর কত?সারা বছর ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে নিজেকে বুড়ি বানিয়ে ফেললে। শক্তি যেটুক ছিল সেটুকও নষ্ট করলে। লাভ কী হলো তাতে? আমাকে দেখো, বছরজুড়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিজের কত উন্নতি করলাম। তোমার মতো শক্তি অপচয় করে নিজের যোগ্যতা শেষ করিনি।
একটু দম নিয়ে শামুক আবারও বলল, ‘এত যে ফুল ফোটাচ্ছো; কখনও কী ভেবেছো, কেন ফোটাচ্ছো? ফুটিয়ে লাভটা কী? না ফোটালে শামুকের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল গোলাপগাছটি। বলল, ‘না তো। কখনও তা ভেবে দেখিনি। ফুল ফোটাতে ভালো লাগে আমার। না ফুটিয়ে থাকতে পারি না। তাই ফোটাই। সূর্য তার নরম আলোয় আমার শিরাগুলো গরম করে দেয়। দখিনা বাতাস আমার পাতায় শীতের পরশ মেখে দেয়। ভোরের শিশির মুখ ধুইয়ে দেয়।
গা ধুইয়ে দেয় বর্ষার কোমল জল। আনন্দে পাপড়িগুলো কাঁপতে থাকে। আমি কিছুতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।’ ‘বাহ্, খুবই মজার জীবন কাটাচ্ছো দেখছি!’ শামুক মুখ বাঁকিয়ে বলল। গোলাপগাছ ঠোঁটে হাসি মেখে সাড়া দিলো, তা ঠিক। খুব সুন্দরভাবেই কাটছে। তবে আপনার জীবনও তো কম সুন্দর নয়। পৃথিবীতে অনেক বড় কাজ করবেন আপনি, দশের উপকার করবেন; তা তো আমি করতে পারবো না কখনও।’
শামুক মুচকি হেসে বলল, “দশের উপকার করবো! বোকা নাকি? শোনো, নিজের উপকার করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। তোমার মতো ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে শুকনো কাঠি হয়ে মরার কী কোনও দাম আছে?’ এই বলে শামুক গর্তে ঢুকে পড়ল। শক্ত খোলসে নিজেকে লুকিয়ে আবারও ঘুমোতে লাগল।
গোলাপগাছ মনে মনে ভাবল- কিছুই বুঝতে পারি না ওর কথা। সারা দিন কেমন গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকে। এটি কোনও জীবন হলো? আমি বাপু এমন হতে পারবো না। ফুল ফুটিয়ে হয়ত রোগা হয়ে যাই। কিন্তু কেউ যখন আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়, ফুলের সুবাস নেয় তখন আমার কী যে ভালো লাগে।