অকাল মৃত্যু। …
অকাল মৃত্যু। …
আমাদের বন্ধুদের একটা অদ্ভুৎ দল আছে। অদ্ভুত এই জন্যে যে আজকালকার দিনে এইরকম কোন ক্লাব বা দল শুধু গল্পের বইয়ের পাওয়া যায়। আজকাল বন্ধুদের মধ্যে নির্ভেজাল গল্প খুব কম হয়। সবাই নিজের “লাইফ” নিয়ে ব্যাস্ত। লাইফ আর ওয়ার্ক , কিসের এতো ওয়ার্ক এত কিসের এতো লাইফ নিয়ে চিন্তা তারাই জানে। মন খুলে গল্প করা যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আমরা তাই সমাজ বিরোধী। আমরা , মানে আমি আর আমার কিছু বন্ধুরা প্রত্যেক শনিবার আমার বাড়িতে একজোট হই। আমি ঝাড়া হাত পা , মানে অক্রিতদার। শিক্ষকতা করি , স্বাধীন জীবন যাপন করি। আমার চারজন বন্ধু, অনিমেষ, দেবজিৎ , বিভাস আর সৌম্য , আমাদের একটা ক্লাব আছে। একটা পত্রিকা বার করি, আর এটা খুব সহজেই বোধ গম্য হওয়া উচিত যে সেই পত্রিকা লসেই চলে। কারণ আজকালকার উন্নত সাহিত্যের বাজারে , আমাদের পত্রিকা যাতে না আছে যৌনতা , না আছে দুর্বোধ্য কবিতা না আছে প্রেম আলোড়ন, এক কোণে পড়ে থাকে।
আমাদের পত্রিকার বিষয় হলো প্যারানরমাল বা অলৌকিক ঘটনা এবং তার যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা। কিছুদিন হলো আমাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে “অকাল মৃত্যু”. এই অকাল মৃত্যুর সঠীক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।
সাধারণত আমরা মনে করি যে যখন অসময়ে মৃত্যু হহয় যখন তাকে অকাল মৃত্য বলা হয়। কিন্তু অকাল বলে কোন নিচু সৃষ্টিতে ঘটনা। পদার্থ বিদ্যার কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা যদি বলি তাহলে , ঘটনা আগে থেকেই সাজানো থাকে। আমাদের মাধ্যমে সেই ঘটনা প্রকাশ পায়ে। সৃষ্টির চালনা হয় খুব সূক্ষ্ম গাণিতিক অংকের মাধ্যমে। বা এই রকম ও বলা যায় আমাদের আলসে পাশে বা আমাদের নিজেদের সাথে যাই ঘটছে সেটা কিছু সূক্ষ্ম অনেক বা সমীকরণ মেনে ঘটছে। আমরা সেই সমীকরণ জানিনা। সব ঘটনা নিজের নির্দিষ্ট স সময় ঘটে। সেই জন্যে অকাল বলে কিছু হয় না।
আমার গবেষণা বা সময় নষ্টের বিষয় হলো যারা রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা যায় তারা কি কি আসন্ন মৃত্যুর কোন আভা সই পায়না ? আমরা জানি , স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মানুষ কিছু আভাস পায়ে যে তার দিন শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু যারা খুন হয়ে যায় , দুর্ঘটনাউয়ে মারা যায় তারা কি কোন সংকেত পায়ে ?
এই নিয়ে আমার গভীর গবেষণা চলছিল। স্বাভাবিক ভাবেও আমি হয়ে উঠেছিলাম হাসির পাত্র। কেউ বলে মাথার চিকিৎসা করাও কেউ বা বলে বিয়ে থা করে সংসার করো। অনেকে কিছুদিন বউরে ঘিরে আসার উপদেশ দেয়া। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা। আমাদের চার্ বন্ধুর মধ্যে অনির্বান , আমাদের থেকে আলাদা। সে একটি বহুজাতীয় কোম্পনিতে কাজ করে, তার সামনে মাসে বিয়ে। আমাদের সভায় সে আর আসেনা। তার মোতে আমাদের মতন অপদার্থ আর অকর্মণ্য দেড় সভায় আসা যার পক্ষে সম্ভব নয় । অনির্বাণ যাবে শুধু নিজের কাজ , যে কোন উপায়ে উন্নতি , টাকা আর নিজের ভালোবাসার সাথে সিখে ঘর করা। আর আমাদের কেউ নুরভহেজেল আর নিস্তেজ ক্লাবে নষ্ট করার মতন সময় তার নেই। এক কোথায় অনির্বাণ আজকালকার দিনের আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর যুবক। আমরাও তাকে কিবহু বলিনা সবাই কি আর আমাদের মতন হয় ? আমার গবেষণা চলতে থাকে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুলিশে কর্মরত। তাকে আমার গবেষণার কথা বলতে সে বললো , “তোকে এক রাত্তির মর্গে রেখে এসব স্বকার সাথে ইন্টারভিউ সেরে তোর ওই ছয়ি বইয়ে ছেপে দিস। তোর মতন আতাকেলানে অনেক পাঠক পড়বে।” কি রকম লাগে সব শুনলে ? আমি ও তাকে আচ্ছা করে শুনিয়ে এলাম , যে পুলিশে যারা চাকরি করে তাদের কোন বোধ বুদ্ধি থাকেনা।
কিন্তু অনেক পড়াশুনা আর অনেক চেষ্টার পরেও আমার গবেষণার ফলাফল খুব ভালো নয়। আমার ও মনে হতে লাগলো যে সত্যি আমি পাগল, আমি সময় নষ্ট করছি। কিন্তু পনেরো দিন পরে যা আমার সাথে ঘটলো , সেটা বাস্তব না অবাস্তব সে বিচার আপনাদের।
ডিসেম্বর মাসের এক সন্ধ্যে। সকাল থেকেই আকাশের মুখে বিষণ্ণতা। শীতকাতুরে বাঙালি একটু রোদ্দুরের আশায় বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু রোদ্দুরের দেখা মিললো না। সন্ধ্যা নামতেও শুরু হলো বৃষ্টি। আজকে আমাদের ক্লাবের আড্ডার আদর্শ দিন। কিন্তু এই বৃষ্টি মাথায় করে কেউ এলো না। অগত্যা আমি কুচু বই পরে আর একটি টিভি দেখে সময় কাটাচ্ছিলাম। হটাৎ কলিং বেল বাজলো। নিশ্চয়ই দেবজিৎ , ও কাছেও থাকে। দরজা খুলে একটু স্তম্ভিত আর একটু বিরক্ত হলাম। সামনে অনির্বান দাঁড়িয়ে। অনির্বাণের মুখে সেই একটু ব্যাঙ্গের হাসি।
“আরে অনির্বাণ আজকে এতদিন পর এই অপদার্থের বাড়ির দরজায়? ব্যাপার কি ?” আমি ও ব্যঙ্গ করতে ছাড়লাম না।
“কি যে বলো ? অপদার্থ হতে যাবে কেন ? আমার সাথে তোমাদের চিন্তা ধারা মেলে না এই যা”? অনির্বাণ বলে।
অনির্বাণের গলার স্বর কেমন যেন ভাঙা ভাঙা।
“বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লাগালে নাকি গলার এমনি কেন ?” আমি বললাম।
এস একটু গরম কুফি খাও বৃশক্তি থামলে বেরিয়ে। আমি বললাম।
অনির্বান সামনে সোফায়ে বসলো।
“ না এখন আর কফির দরকার নেই. বরং একটু গল্প করি।
তোমার সেও প্রিয় সামথিং অলৌকিক”. অনির্বান বললো। তার কথার কাঁটা গায়ে মাখলে চলবে না। আমি ও হারবোনা। মনে মনে ভাবলাম।
“তা আজ হটাৎ এই সব আজগুবি ব্যাপারে তোমার গল্প করতে ইচ্ছে করছে কেন ?” আমি বললাম।
অনির্বানের কক্ষের দৃষ্টি কেমন যেন ফাঁকা। আমার মন কু ডাকলো। নিশ্চই চাকরি নিয়ে সমস্যা , নয়তো তানিয়ার সাথে ঝামেলা। অনির্বাণ যা স্বার্থপর। এখন মনে পড়েছে বন্ধুদের কথা।
অনেক সময় এই আজগুবি ব্যাপার গুলো খুব শান্তি দেয় , আর অনেক দিন মদের সাথে দেখা হয়নি , তোমাদের অনেক সমালোচনাও করেছি , কিন্তু তোমার বন্ধু সুলভ আচরণ করেছো তাই। ..”
অনির্বানের কথা শেষ হলো না। আমি বললাম যায় ভাবলে একটু ঔষধ লাগিয়ে যাই” আমি বললাম।
“অনির্বাণ কোন উত্তর দিলো না একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকলো , যার মুখে একটা ক্লান্ত হাসি।
“বুঝি আমার ওপর তোমার রাগ আছে. তাহলে শোনো তোমার ওই অকাল মৃত্যুর গবেষণায় কিছু সাহায্য করি.” অনির্বান বললো
আমার মাথা তা ঝিঁ ঝিঁ করছিলো রাগে। কিন্তু এতদিন পর এসেছে , তাও বোধ হয় মন ভালো নেই আমি কিছু বললাম না।
অনির্বাণ বলতে শুরু করলো।
“মানুষের জীবনে এক সেকেন্ড পর কি হবে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু খুব সূক্ষ্ম একটা আভাস প্রকৃতি দেয় যা মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। কুন্তু তোমার এই কথা তা একদম ঠিক যে যখন যে ঘটনা ঘটবার কথা সেটা ঘটবেই তাকে কেউ ঠেকাতে এটাতে পারবে না.” অনির্বাণ বলল। আমি স্তম্ভিত হয় শুনছিলাম। এর আগে অনির্বানের মুখে এই ধরণের কথা শুনেছি বলে তো মনে পড়েনা।
“চলো তোমাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই।
ধরো একজন ব্যক্তির আজ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়া নিশ্চিত। সকাল থেকেই তার মন খুব চঞ্চল নয় ও খুব অস্থির নয় তো খুব খারাপ থাকছে। কিন্তু মানুষ মনে করে সংসার ভালোবাসা আর কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে এই রকম লাগছে। এই মনের অবস্থাটা বলে বোঝানো বা শব্দে বোঝানো সম্ভব নয়। এখন কেউ মোর যাওয়ার পর যাকে ইন্টারভিউ করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
অনির্বাণ থামলো এবং আমার দিকে তাকিয়ে একটা কুটিল হাসি হাসলো। আমি কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। তাই আর খোঁচা গায়ে মাখলাম না। ঘরে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ অনুভব করলাম। একটানা বৃষ্টির জন্যে নিশ্চই পাশের নর্দমায় জল ভরেছে।
তারপর ?
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম।
“হ্যাঁ। যা বলছিলাম সেই মানুষটার মনে হয় চারদিকে যেন সব ফাঁকা।মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা দৃশ্য। শূন্যতা আর ব্যাথা। কিন্তু মানুষ এগুলো কে পাত্তা দেয় না। সে কাজে যায় প্রেম করে.”
এবার আসি ক্লাইম্যাক্স এ” অনির্বান আবার সেই কুটিল হাসি হাসে। আমু জানি ওর ফাজলামির ধরণ। কিন্তু কেন জানি না ওর কথা গিলো আমাকে আকর্ষণ করছিলো।
যা বলার ছোট করে বলে ফেলো”. আমি বললাম
এদিকে আঁশটে গন্ধ টা যেন আরো তীব্র হয়েছে। কিন্তু সেটা পরে দেখা যাবে আগে শুনি কি বলছে অনির্বাণ।
“হ্যাঁ যা বলার এবারে বলে ফেলি সময় কম। এবার আমাদের সাবজেক্ট সেই লোকটি গাড়ি চালিয়ে নিজের প্রেয়সীর কাছে যাচ্ছে। প্রেমের তারনাউয়ে গাড়ির স্পীড বেশ আর ফোন ও আছেই। হটাৎ। …” অনির্বাণ কাপ করে গেলো।
কি হটাৎ আমি বললাম।
হওয়ায় যার সামনে বিকেলের বৃষ্টি ভেজা আকাশের রং হয়ে গেলো গাঢ় লাল। তার মধ্যে কালো ও আছে অদ্ভুত একটা রং। তার চারপাশের গাড়ি মানিষ সব অদৃশ্য। তার সামনে ভেসে উঠছে তার সারা জীবন। ঠিক সেই সময় শুনতে পাচ্ছে “ওরে বাপ্ আমু তোর ঠাকুমা।, কেন বাপ্ এমন করে গাড়ি চালাচ্ছিস?” তার সাথে ভেসে আসছে ভয়াবহ আরো শব্দ যা সে বিঝতে পারছে না। হটাৎ তার সামনে তীব্র আলোর ঝলকানি। আবছা একটা লরি। ব্যাস।..” অনির্বান থামলো।
বল তার পর। . আমি অধৈর্য হয়ে বললাম।
সি সব কিছু হয়ে গেলো মাত্র ফ্রাকশন অফ সেকেন্ড এ। তার পর সব হালকা। কি সুন্দর গন্ধ। সেই মানুষ যেন পাখি। এই হালকা যে উড়ে বেড়াতে পারে।নিজের দলকোচা মারা রক্তে ভাষা শরীর তা অবশ্য দেখতে খুব বাজে লাগে।
অনির্বাণ চুপ করে গেলো। আমার ও মুখে কথা ফুটছে না।
আজ আসি। অনির্বাণ নিস্তব্ধতা ভাঙলো। আমি দেখলাম অনির্বাণের কক্ষ রক্তাভ লাল। তার সাথে কক্ষের কোন অশ্রুবিন্দু।
আমি কিছু বলার আগেই অনির্বান চলে গেলি। আমি পাথরের মূর্তির মতন চেয়ারে বসে রয়ে গেলাম।
সেই আঁশটে গন্ধটা এখনো ঘরে রয়েছে। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিলো।
নাহ , ইটা অনির্বাণের একটা বাজে রসিকতা। আমাকে অপমান করা আর কিচ্ছু নয়। এই বলে নিজেকে বোঝাচ্ছি আমার মোবাইল বাজলো।
স্ক্রিন এ ফুটে উঠলো দেবজিতের নাম।
“হ্যালো “ আমি বললাম।
“কি রে এতক্ষন ফোন বাজছে কোথায় ছিলি ?” দেবজিৎের গলায় উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা অনুভব করলাম।
“না মানে ওই অনির্বাণের সাথে কথা…” আমার কথা শেষ হলো না। .
“কি বাজে বকছিস সত্যই তোর মাথা গেছে। এদিকে সাংঘাতিক ব্যাপার , অনির্বাণের মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে আস্তে পারলে চলে আয়ে. দেবজিৎ ফোন কেটে দিলো।
আমার ঘোর কাটেনি। কি হচ্ছে এই সব। আমার সত্যই কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো এতক্ষন কথা বললাম আর তার নাকি এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। আমার ফোন সব সময় আমার কাছে ছিল , কিন্তু শুনতে পেলাম না ?”
এই সব উত্তর খোঁজার সময় ছিল না। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছালাম। না হাসপাতাল নয় , মর্গে।
অনির্বাণের থেঁতলানো শরীর পরে রয়েছে আর চার্ দিকে সেই আঁশটে গন্ধ ম ম করছে। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় একটা লরির সাথে ধাক্কা লাগে। অনির্বাণ প্রায় একশোর স্পিড এ ছিল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু।
