আগামীর ইতিহাস
আগামীর ইতিহাস
"খুঁজে পেয়েছ, সুপর্ণা?"
"কি বলো তো? কিছু খুঁজে পাওয়ার কথা ছিল?"
"নাহ্, কথা তেমন কিছু ছিল না, তাও..."
"তাও... কি নিখিল?"
"সময়, খুঁজে পেয়েছ সময়?"
"হাঃ হাঃ হাঃ! বেশ বললে তো! তুমি এখনও একইরকম আছ।"
"বদলে যাওয়ার কথা ছিল নাকি?"
"ধুত, কথাটথা আবার কিছু থাকে নাকি? আর সময় খোঁজা, সে আবার কেমন? সময় খুঁজতে হয় নাকি? সে তো আপনি এসে ধরা দেয়।"
"উঁহু, সময় মোটেই ধরা দেয় না সুপর্ণা ম্যাডাম, বরং সে সুযোগ পেলেই ফসকে পালায়। 'সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়', ছোটবেলায় পড়োনি?"
"আমি লিটারেচারে বরাবরই উইক, মনে নেই তোমার?"
"সে আর মনে থাকবে না? আমার অত সাধ করে লেখা চিঠি,কবিতাগুলোর যা দশা করতে!দেখে মনে খিস্তি, চোখে জল আসতো৷ নয়া প্রেমে ইমেজ ভালো রাখতে সব একঢোঁকে গিলে ফেলে ছেঁড়া কবিতার লাইনগুলো মনে রাখার চেষ্টা করতাম।"
"চোখে জল? দেখিনি তো কখনও!"
"কি করে দেখবে? তাকিয়েছ কখনও মাটির দিকে? ইয়ে, মানে আমার দিকে?"
"এটা ঠিকই বলেছ নিখিল। সেসময় অদ্ভুত একটা অহঙ্কার ছিল আমার। তোমরা সবাই সে অহঙ্কারের গোড়ায় আরও খানিক হাওয়া দিতে, সবাই এমন করতে যেন সুপর্ণা রায়চৌধুরীর মধ্যে কোনও দোষত্রুটি থাকতেই পারে না!"
"ওহ্, এখন আমাদের সবার দোষ হলো! নিজে ঠিক কেমন ছিলে মনে করে দেখো তো! কেউ তোমার ভুল ধরিয়ে দিতে চাইলে তাকে আর নিজের আশেপাশে ঘেঁষতে দিতে? ঘেঁষতে দিয়েছিলে?"
"হ্যাঁ, ওটা একটা বড় মিসটেক্ হয়েছিল আমার, মানছি। আসলে তখন ইগনোর করা একটা স্বভাব হয়ে যাচ্ছিল, বিশেষত যারা আমার তালে তাল না দিতো, তাদের মাটিতে মিশিয়ে ভারি তৃপ্তি পেতাম, জানো?"
"জানি। স্বভাবটা তোমার বরাবরই ছিল, তখন আল্পসের হাতছানি পেয়ে আরও বেড়ে গিয়েছিল, এই যা। তবে সে হাতছানিতে সাড়া দিতে অমন একটা পাপ তুমি করেছ, এটা মানতে পারিনি কিছুতেই। মাধুরীর মতো ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে যেটা করেছিলে, ছিঃ!"
"তাছাড়া আমার কাছে আর কি রাস্তা ছিল বলো? আমার বরাবরের স্বপ্ন ইউরোপে হায়ার স্টাডিজের, স্কলারশিপের অতগুলো টাকা আমায় টপকে ওই ঝিয়ের মেয়ে মাধুরী পেয়ে যাবে, এটা আমি কি করে মেনে নিতাম?"
"তা বলে এমন একটা মিথ্যে? পরীক্ষার রুটিনটাই পুরো এলোমেলো করে একটা ভুল রুটিন তুলে দিলে মাধুরীর হাতে? আর ও-ও এমন গাধা সেটা আর ভেরিফাই করলো না কারও কাছে? এত বিশ্বাস করতো তোমায়!"
"অন্য কোনও উপায় কি ছিল ওর? আর কেউ মিশতো ওই ছোটলোকের মেয়ের সঙ্গে? নেহাৎ আমাদের বাড়িতে ওর মা অনেকদিন ধরে কাজ করতো, তাই আমায় মেশার ভান করতেই হতো।"
"আর সেই ভানকেই বন্ধুত্ব বলে চেটেপুটে খেতে চেয়েছিল মেয়েটা। তুমিও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলে, বলো?"
"এভাবে বোলো না। ইট ওয়জ জাস্ট আ পার্ট অফ দ্য কম্পিটিশন। আই হ্যাড টু ফলো সাম ট্রিকস্ টু উইন, সিম্পল!"
"ওহ্, তাই? তাহলে পরে যখন ওর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলেছিলাম, তখন ক্ষেপে গিয়েছিলে কেন? কেন মাধুরীর সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে দুজনকেই অপমান করে চলে গিয়েছিলে?"
"আসলে একদম সময় ছিল না, জানো? পাসপোর্ট, ভিসা, বাড়ির লোকের ইমোশন সামলানো, ওসব ক্ষমা-টমা চাওয়ার নাটক করার সময় কোথায় তখন?"
"জানি ম্যাডাম, এটাই ছিল তোমার শেষ কথা। বলেছিলে, সব কাজ সেরে সময় পেলে ক্ষমা চাওয়া, ফিরে আসা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে। তাই তো, এত বছর পর, যখন রেকর্ডবুকে শ্রেয়সের ডকুমেন্টসে ছবি দেখে জানতে পারলাম তুমিই ওর মা, লোভ সামলাতে পারলাম না, ডেকেই ফেললাম, প্রশ্নটা করেই ফেললাম, পেয়েছ সময়?"
"তুমি, বুবানের..."
"ক্লাস টিচার। শ্রেয়স বোধহয় ক্যাবেই আসে, তাই না? তাই আমাদের আবার দেখা হতে বছরখানেক লেগে গেল!"
"বুবানের গার্জেন কল হয়েছে কেন? কি করেছে ও?"
"আহা, টেনশন নিও না। এমন কিছু বড়সড় অন্যায় করেনি। তমোজিৎকে চেনো? তোমাদের কমপ্লেক্সেই থাকে বোধহয়?"
"হ্যাঁ, চিনি। একসঙ্গে ক্যাবে যায় তো, কেন?"
"সে মনে হয় দুদিন স্কুলে আসেনি, তার মা বিকেলে শ্রেয়সের কাছে ইউনিট টেস্টের রুটিন চেয়েছিলেন। তুমি বাড়িতে থাকলে তোমার কাছেই চাইতো হয়তো, এনিওয়ে, শ্রেয়স তাকে এলোমেলো একখানা রুটিন ধরিয়ে দিয়েছে, আর সে বেচারা কাল ম্যাথ টেস্টের দিন ইংলিশ পড়ে এসে কোশ্চেন পেপার দেখে হাউহাউ করে কেঁদেছে।"
"সো, হোয়ট ডু ইউ ওয়ণ্ট টু প্রুভ? হি ইজ জাস্ট এইট নাও, একটা আট বছরের বাচ্চা প্ল্যান করে বন্ধুকে ভুল রুটিন দেবে, এটা হতে পারে নিখিল?"
"কি হতে পারে, কি পারে না আমি জানি না ম্যাডাম, সব দেখেশুনে তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছিল, তাই শ্রেয়সের মাকে ডাকলাম। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ, জানো তো সুপর্ণা?"
--সমাপ্ত--