কর্কটক্রান্তি
কর্কটক্রান্তি
তিনদিন ধরে অবিশ্রান্তভাবে ধারাবর্ষণ হয়েই চলেছে। কখনো মুষলধারে, কখনো বা টিপটিপ করে। আকাশের মুখ ভার, চোখে জল। কবে হাসি ফুটবে, কে জানে! বঙ্গোপসাগরে নাকি ডিপ্রেশন হয়েছে।
ডিপ্রেশন! কি সমাপতন। এত দুঃখেও হাসে রাই।শ্রীজাতর একটা কবিতা আছে না? ডিপ্রেশনের বাংলাটা কি? নিম্নচাপ, না মনখারাপ?
জানালা খুলে বাইরে তাকায় রাই। বৃষ্টির ছাঁটে চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে, তা একটু ভিজুক। রাস্তার ওপারে রায়বাড়িতে আজ খুব ধূমধাম। সানাই বাজছে। একমাত্র পুত্র সন্দীপের বিয়ে আজ। না, ভাববে না রাই, সন্দীপের কথা ভাববে না একদম। কি লাভ ভেবে? ও মন, তুই অন্য কথা ভাব। তোর কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়া মৃত্যুদূতের কথা ভাব বরং।
ডক্টর আঙ্কল বলেছিলেন,
"ফাইট, ফাইটটাই আসল, বুঝলি রাই। আর মনের জোর। মনের জোরের কাছে ক্যানসার কিছুই না। লড়াই করতে হবে, মেন্টালি স্ট্রং হতে হবে। সবসময় ভাবতে হবে, আমি পারবো, আমি বাঁচবো।"
বোকা রাই! ভেবেছিলি এই লড়াইয়ে সাথে পাবি সন্দীপকে? বেচারা সন্দীপ, ব্লাড ক্যানসারের নাম শুনেই যে গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিলো? কেমোথেরাপির পরে প্রবল জ্বালা তখন রাইয়ের শরীরে। কি ভীষণভাবেই না ও চেয়েছিলো, সন্দীপ ওর গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিক। চুল পড়ে গিয়ে রাইয়ের মাথা তখন প্রায় ন্যাড়া। অনেকবার খবর দেবার পরে সন্দীপ একবার এসেছিলো। পাঁচ মিনিটও বসেনি। ওর চোখে স্পষ্টতই বিকর্ষণ দেখেছিলো রাই। আর কোনদিনও নিজেকে ছোট করেনি সে। ভালোবাসা যদি চামড়া আর মাংসের স্তর ভেদ করে গভীরে না যেতে পারে, তো সে ভালোবাসাকে সহস্র ধিক্কার! বরং, ওর সন্দীপের উপর করুণা হয়েছিলো। রাই তো ওকে ভালোবেসেছিলো, ও বুঝতেই পারলোনা, হেলায় কদমফুল পায়ে দলে চলে গেল।
কিন্তু মনের উপর তো আর জোর চলে না। কারণে অকারণে সন্দীপের কথা মনে এসেই যায়। বিভিন্ন অনুষঙ্গে। যেমন, এই অঝোর বৃষ্টিতে ওদের প্রথমবার প্রেম করতে ভিক্টোরিয়ায় যাবার কথা মনে পড়ছে, সেদিনও ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিলো। ফেরার সময় ওদের এক হাঁটু জল ভেঙ্গে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো। সন্দীপ সযত্নে ওকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিলো, আর ওর স্পর্শে শিহরিত হচ্ছিলো রাই। তারপরে কারণে বা সম্পূর্ণ অকারণে ওদের দেখা হতে লাগলো। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় একে অপরের বাড়ি যাতায়াতে বিধিনিষেধ ছিলো না কিছুই। মানসিক দূরত্ব তো রাইয়ের তরফ থেকে ছিলোই না, ফলে আধুনিক সমাজের নিয়ম মেনে শারীরিক দূরত্বও ক্রমহ্রাসমান হতে হতে একসময় বিন্দুতে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু সে অন্য কোন সময়, অন্য কোন জীবনে ছিলো, রাই জানে।
জানালার বাইরে একটা কদম ফুল আর একটা কলকে ফুলের গাছ। এই তিনদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে কলকে ফুলের গাছটা পড়ে গেছে আজ সকালে। হয়তো শিকড় আলগা ছিলো। গভীরে ঢুকতে পারেনি মাটিতে। গাছটা অদ্ভুত ভাবে বেঁকে পড়েছে কদমগাছের উপর। কলকে গাছটা কালকেই বৃষ্টি একটু ধরলে কাটিয়ে দিতে হবে সুদাম মালীকে দিয়ে, না হলে, ওটা কদমগাছটাকেও উলটে ফেলবে। এত সুন্দর গাছটা! গাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। একটা হালকা মিষ্টি গন্ধে সুরভিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।
জানালা বন্ধ করে দিয়ে পড়ার টেবিলে এসে বসে রাই। করেসপন্ডেন্সে একটা সাইকোলজি কাউন্সেলিং এর কোর্স শুরু করেছে সে, প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার দিন এসে গেছে। ঠিক সময়ে জমা দিতেই হবে।
ক্যানসার আসলে ওর বন্ধু। ওকে লোক চিনতে শিখিয়েছে। আর শিখিয়েছে, অঙ্গে পচন ধরলে, সে যতই প্রয়োজনীয় অঙ্গ হোক না কেন, তা তৎক্ষণাৎ কেটে ফেলতে হয়, না হলে, পচন ছড়িয়ে পড়ে, মরণ আসে অনিবার্য ভাবে!
বৃষ্টির শব্দটা একটু ধরে আসায়, জানালার ফাঁক দিয়ে সানাইয়ের আওয়াজটা আবার ভেসে আসে।
ওদের ভালো হোক। ভালো থাক ওরা। কিন্তু, আমিও ভালো থাকবো, থাকবোই। অনেক কিছু করার আছে এখনো। জীবনটা শেষ হয়ে যায়নি, সবে শুরু হয়েছে। পড়ায় মন বসাতে বসাতে ভাবে রাই।