চাং লি
চাং লি
বিগত ১০ বছরে সারা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে ও বাড়ছে। চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এখন আর এলিট পর্যায়ের নেই, বরং একটা সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। যোগ্যতা থাকলে সমাজের যে-কোনো শ্রেণির শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা নিতে পারে।
ছিংহুয়া চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরএকজন প্রথিতযশা শিক্ষকের নাম চাং লি। তিনি ১৯২৫ সালে চীনের থিয়ানচিন মহানগরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে বিজ্ঞান একাডেমির প্রথম সারির ছাত্র হিসেবে ফুরেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ ছেড়ে দিয়ে চীনে ফিরে আসেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বয়স্ক শিক্ষক। ২৪ বছর বয়স থেকে তিনি শিক্ষকতা করছেন। শুরুর দিকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ছিল প্রায় তার সমবয়সী। বর্তমানে তাঁর বয়স প্রায় ৯৬ বছর। এখনও তিনি শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন।
১৯৫৭ সালে ছিংহুয়াতে যোগ দেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ক্লাস নিতে শুরু করেন। শিক্ষকের অভাবের কারণে তাকে এটা করতে হতো। কোনো কোনো বিষয় পড়ানোর আগে তাকে নিজে পড়াশুনা করতে হতো। এতে তার লাভই হয়েছে। তিনি অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পদার্থবিদদের ভুমিকা ও অবদানের ব্যাপক প্রশংসা করেন।
ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তাঁর আবেগ প্রসঙ্গে শিক্ষক চাং বলেন, ‘পদার্থবিদ্যার প্রতি আমার ভালোবাসা ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করছি। এখানকার ছাত্রছাত্রীরাও সেরা ও মেধাবী। আমার মূল কাজ তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া, তাদের উন্নতিতে অবদান রাখা।”
নিজের ছাত্রছাত্রীদের ওপর তিনি খুবই সন্তুষ্ট। তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী দেশের বিভিন্ন খাতের সেরা ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটা চাংয়ের জন্য বড় পাওয়া। ‘এটাই আমার জীবনের সাফল্য; আমি এ কাজের জন্য বেঁচে থাকি’, তিনি বললেন।
বর্তমানেও, ৯৬ বছর বয়সে, শিক্ষক চাং লি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি শুধু মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিদ্যার ক্লাস নিচ্ছেন। তবে, অনেক স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীও তার ক্লাসে উপস্থিত হয় জ্ঞানলাভের আশায়। প্রতিবার ক্লাস নেওয়ার আগে তিনি নতুন করে প্রস্তুতি নেন।
২০২০ সালের বসন্তকালে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন শিক্ষক চাং। অনলাইনে ক্লাস নেওয়া মানে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যেটি তার জন্য ছিল একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। উইচ্যাট গ্রুপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নে উত্তর দিতে শুরু করেন তিনি এবং যে বিষয় তারা বুঝতে পারে না, সে বিষয় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। যদিও ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন তিনি, কিন্তু প্রতিবছর তিনি শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, বিজ্ঞানের জগতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। শিক্ষক হিসেবে তাকে এসব পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হয় ও শিক্ষার্থীদের জানাতে হয়। এ সম্পর্কে তাঁর সহকারী শিক্ষক হু চিয়া চুং বলেন, পড়ানোর কাজে শিক্ষক চাংয়ের আশেপাশে কেউ নেই। তিনি বয়স্ক হলেও, এখনও অনেক পরিশ্রম করেন।
শুধু ক্লাসরুমে পড়ানোর কাজে তিনি ভালো, তা নয়; তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের গবেষণায়ও নানাভাবে জড়িত। দীর্ঘকাল ধরে পদার্থবিদ্যার গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত আছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরও তিনি গবেষণা চালিয়েছেন, গবেষণা জার্নালে থিসিস প্রকাশ করেছেন। ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টামসহ বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। ২০০৯ সালে ৮৪ বছর বয়সে তিনি ‘পদার্থবিদ্যার এক্সপ্রেস পত্রিকা’য় নতুন একটি থিসিস প্রকাশ করেন এবং ‘ছিংহুয়া পদার্থবিদ্যা গ্রন্থ’ রচনা করেন।
গত ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের শিক্ষকতার জীবনে তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়াতে চেষ্টা করে এসেছেন। একসময় তিনি খেয়াল করেন যে, ক্লাসরুমে পড়ানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা। পদার্থবিদ্যায় সৃজনশীল গবেষকরা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন। তাই তিনি শিক্ষার্থীদেরকে সৃজনশীল গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের কাজ নিয়েও গবেষণা করেছেন। তাঁরা কিভাবে কাজ করেন, কেন তাদেরকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছে নোবেল কমিটি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
১৯৮৬ সালে বিশ্ব বিখ্যাত চীনা পদার্থবিজ্ঞানী জনাব ইয়াং চেন নিং বেইজিংয়ে নবম বারের মতো সেমিনার আয়োজন করেন। তিনি সে-সেমিনারে আধুনিক পদার্থবিদ্যার অনেক তাত্ত্বিক ধারণার সৃষ্টি ও উন্নয়নসম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরেন। শিক্ষক চাং জনাব ইয়াংয়ের সব সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান বিষয়ক বই রচনা করেন। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বই রচনার জন্য ৫/৬ বছর সময় লেগেছে তার। অনেক পরিশ্রমের পর এ কাজ সম্পন্ন করেন তিনি।
১৯৯৭ সালে শিক্ষক চাংয়ের রচনা ‘আধুনিক পদার্থবিদ্যার উন্নয়ন’ নামের বই প্রকাশিত হয়, যা চীনের শ্রেষ্ঠ পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিষয়ের ছাত্র ছেং ফেং শিক্ষক চাংয়ের ক্লাস করেছেন। চাংয়ের ক্লাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গত সেমিস্টারে আমি বিজ্ঞান-গবেষণার কাজে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। শিক্ষক চাংয়ের ক্লাসে আমি সেসব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছি। তাঁর ক্লাস থেকে আমি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। আমি তাঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।’
শিক্ষক চাং তাঁর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, তা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়া আমাকে সেরা শিক্ষক বানাবে না; নিজের শিক্ষার্থীদেরকে ভালোবাসতে হবে, অজানাকে জানার ও অনুসন্ধানের প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। এটাই যোগ্য শিক্ষকের কাজ।”
তথ্য : আন্তর্জাল, বিভিন্ন পত্রিকা।
