STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational Others

যুদ্ধজয়

যুদ্ধজয়

4 mins
190

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে - এইসব দিন গুলো খুব মন খারাপ করে, এক আশ্চর্য ধরনের একটা অলসতা ও বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে।


“আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে

জানিনে, জানিনে,

কিছুতে কেন যে মন লাগে না…”


পছন্দের একটা বই নিয়ে এফ.এম শুনছি,বাজছে চিরচেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত।সকাল থেকেই অবিরাম বর্ষণ। রিমিঝিমি এই বর্ষাকালের টুপটাপ বর্ষণের সাথেই আমার জীবনের চুপচাপ সুখ দুঃখের বর্ষণের সূচনা।


ওহ, আপনাদের আমার পরিচয় দেওয়া হয় নি - আমি রাশা,একজন উচ্চ শিক্ষার জন্য এডমিশন পরীক্ষার্থী । স্বপ্ন আমার আকাশ ছোঁয়ার ,বিদেশী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়াই আমার একমাত্র লক্ষ্য।বাবা একটি বেসরকারী ব্যাংকে উচ্চপদে চাকুরী করেন।আমি আর আমার ছোট ভাই আর মা,বাবা।এই হলো আমাদের ছোট্ট সুখের পরিবার।

যাই হোক, যে কারণে এতো কথার চর্চা সেই গল্পের শুরুটা ঠিক এখান থেকেই, ঝড়ঝড় বাদলের এক সন্ধ্যা!


"সেই বিশেষ দিনটি ছিল ১৭ ই আষাড়। সন্ধ্যার দিকে পুরো এলাকা লোডশেডিং, মা একটি শেজবাতি রেখে গেলেন আমার ঘরে ।আমি মোমবাতির আলোয় পড়ছিলাম।হঠাৎ কে যেন কলিংবেল বাজালো!! আমি একটি মোমবাতি নিয়ে দরজার দিকে এগুচ্ছিলাম। "কে?” বলে বেশ কয়েকবার ডাকলাম ও। কিন্তু কেউ সারা দিল না।আমি ভাবলাম হয়ত বাবা আর প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে হয়ত শুনতে পায় নি। দরজা খুললাম ওমনি দমকা বাতাসে আলো নিভে গেল।তারপরে?

তারপরে কি হলো আর মনে নেই।ঠিক কত ঘন্টা পরে জানি না, তবে যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা ছোট্ট স্টোর রুমে।আমার হাত পা বাঁধা।চিৎকার করছিলাম,ডাক দিচ্ছিলাম কিন্তু কেউ আসল না।

অনেক্ষণ পরে দরজা খুলে একটা ছেলে আসল।আরে ওকে তো আমি চিনি!এ তো আমার এলাকার মাতব্বরের বখাটে ছেলে! যার প্রেমের প্রস্তাব না করে দিয়েছিলাম।শুরুতে ভদ্র আচরণ করলেও শেষে যখন দেখল আমি রাজি হচ্ছি না তখন কুরুচিকর, অশ্লীল কথা বলত,বাজে ইঙ্গিত দিত।তবে কি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করাতেই আজ এই পরিস্থিতিতে দাড়িয়েছি? ভয় হতে শুরু করল।ওকে দেখে আমি চমকে উঠি, আমার গা শিহরিত হতে থাকে অজানা বিপদের ভয়ে।আমার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো তারপর বলল,”তোর রুপের এত গৌরব!এত অহংকার তোর।আজ আমি সব শেষ করে দিব।”

আমি বারবার বললাম আমাকে যেন ছেড়ে দেয় কিন্তু সে তা মানল না।

ওরা এক এক করে ৪ জন মিলে আমাকে ধর্ষন করল।

দীর্ঘ ৩ দিন ওরা আমার উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালালো।তারপর ৪ দিনের দিন বিকেলে আমার বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।


আমার অবস্থা সিরিয়াস ছিল।শহরের সবচেয়ে ভালো মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে ভর্তি করানো হল।এতটাই খারাপ অবস্থা নরপিশাচরা করেছিল যে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম,মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষত,ঘা,রক্ত বের হচ্ছিল প্রচুর।এদিকে থানায় জিডি করানো হলো।পুলিশ ওদের ধরে ও ফেলল।প্রভাবশালী সেই মাতব্বর আমার বাবা - মাকে অনেক হুমকি ধমকি দিল যেন পুলিশ কেস প্রত্যাহার করা হয় কিন্তু মা বাবা সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন ,শাস্তি পেতেই হবে।খুব শীঘ্রই কেস কোর্টে উঠবে।।তারপরে দীর্ঘদিন পরে বাড়ি আসলাম।খবর তো আর চাপা থাকে না। চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল।

আশে পাশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিল।পাড়া প্রতিবেশিরা কানাঘুষা শুরু করল।সবাই আমাকেই দোষারোপ করতে লাগল।যেন ভুলটা আমি ই করেছি।বাবা বাজারে যেতে পারত না,ভাই খেলতে গেলে সে এক ধর্ষিতার ভাই বলে অনেকেই কথা শোনাতো,হাসাহাসি করতো।পাশের বাসার আন্টিরা মাকে টিটকারী দিয়ে কথা শোনাত ।আমরা একঘরে হয়ে গেলাম।অবস্থা এমন যে সব দোষ আমার। কারণ আমি একজন ধর্ষিতা!কোর্টের লম্বা শুনানি,হয়রানি।কবে বিচার পাব? প্রশ্ন বারবারই বিঁধে যায়।

অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছে ছিল যে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আমি ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত, হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে মরা ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছিলাম না। একদিন রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম সুইসাইড করব।

রাত ১.১০ বাজে,বারবার সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এক সময় লাল ওড়নাটা বেঁধে দিলাম।খাটের মাঝখানে যেই চেয়ারটা টেনে আনব তখনই চোখে পড়ল আমার পড়ার টেবিলে এইচ এস সির বই! সাথে সাথে মাটিতে ঠাস করে বসে পড়লাম।আমার চোখের সামনে এক এক করে ভাসতে লাগল আমার পিছনের দিনগুলো,আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন,আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়! ক্যাম্পাস,বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর,আমার মা বাবা ছোট ভাইয়ের হাসি মাখা মুখ।কি করে তাদের ছেড়ে আমি চলে যাই না ফেরার দেশে?কি করে?

মনের মাঝেই দমকা হওয়ার মতো চন্ঞ্চল এক আশা জাগ্রত হলো।আমি তো কোনো দোষ করি নি তাহলে আমি, আমার পরিবার কেন সে কষ্টের বোঝা বহন করবে ?

এই প্রথম মনে হলো এ হতে পারে না।নতুন করে,নতুন উদ্যমে আবার শুরু করব।অপরাধীদের শাস্তি দিয়েই ছাড়ব।ঈশ্বরের নামে শপথ নিলাম।বই খুলে পড়া শুরু করলাম ঠিক আগের মতো।আমার পরিবর্তন দেখে বাবা মা ও আশার আলো দেখতে পেলেন।আমি ক্যারাটে শিখলাম। তারপরে সেল্ফ ডিফেন্সের একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুললাম বাড়িতেই।যাতে মেয়েরা প্রতিরোধ করতে পারে নিজেকে নরপিশাচের হাত থেকে।রাত দিন এক করে পড়তে লাগলাম।বেশ কয়েকদিন পরপর কোর্টে হাজিরা দিতে হতো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে লাগলাম। ”আত্মহত্যাকে না বলুন” # ট্যাগ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে গনসচেতনতা শুরু করলাম। অনলাইনে একটা প্লাটফর্ম শুরু করলাম যেখানে বিভিন্ন আত্মহত্যা করতে চাওয়া মানুষকে বোঝানো হতো এবং এসব থেকে দূরে রাখা হতো।আমার বিভিন্ন বন্ধু বান্ধব আমাকে শুরু থেকেই সাহায্য করল।

আমরা আমাদের এই কাজে বেশ সারা পেলাম,ধীরে ধীরে সফলতা পেতে লাগলাম।

  দেখতে দেখতে এডমিশন পরীক্ষা চলে এল।আমি পরীক্ষা দিলাম।শত কষ্টের পর বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ছোঁয়া পেলাম।আমার চান্স হয়ে গেল দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে।এখন যত পাড়া প্রতিবেশীরা আমাদের একঘরে করেছিল তারাই প্রেরণা,উৎসাহ দিতে শুরু করল।সাহায্যও করল।

দীর্ঘ দুই বছর ছয় মাস পরে কোর্ট তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিল।অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হলো।আমি জয়ী হলাম”।


২০২০ সাল,জয় বাংলা ইয়ুথ লিডারশীপে রাশাও পুরষ্কার পেল এবং নিজের ভেঙ্গে পড়ার কাহিনী থেকে নতুন করে বাঁচতে শেখার ঘটনা এভাবেই সে তুলে ধরলো।এটাই এক ধর্ষিতা নারীর আত্মহত্যা না করার গল্প।

২০২১ সাল,আজ রাশা তরুণ-তরুণীর এক আশার নাম।তার সেল্ফ ডিফেন্স ইনস্টিটিউট আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইনস্টিটিউট। অনলাইনে “আত্মহত্যাকে না বলুন” পেজটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং বহু তরুণ তরুণীর জীবন বাঁচিয়েছে।

আসুন রাশার মতো আমরা ও হতাশাকে ছাপিয়ে আত্মহত্যা মূলক জঘন্য কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখি এবং অন্যকে বাঁচাই।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational