Siddhartha Singha

Classics

3  

Siddhartha Singha

Classics

যত্তসব

যত্তসব

16 mins
1.3K


গোটা বস্তি জুড়ে হইচই। এ ওকে বলছে, সে তাকে। আর শোনামাত্র সবাই দলে দলে গিয়ে ভিড় করছে কার্তিকের ঘরের সামনে। ঘর বলতে আট বাই আটের একটা ছোট্ট খুপরি। কোনও জানালা নেই। এ পাশে ঘর ও পাশে ঘর। পিছনেও পর পর ঘর। কোনও ক্যালেন্ডার ঝোলানোর জন্য দেওয়ালে পেরেক ঠুকতে গেলে আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, ভিতরটা কত ফাঁপা। তাই পাশের ঘরের লোক চিৎকার করে হাঁক পাড়ে— আরে, আস্তে আস্তে। দেওয়াল পড়ে যাবে যে… দিনের বেলাতেও লাইট জ্বালাতে হয় বলে বস্তির আরও অনেকের মতো ও-ও ঘরের একটা টালি সরিয়ে তার বদলে ওই মাপেরই একটা কাচ বসিয়ে দিয়েছে। শুধু আলো নয়, সূর্য উঠলে প্রায় তিনটে-সাড়ে তিনটে অবধি ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণ পর্যন্ত গুটিগুটি পায়ে হামাগুড়ি দেয় রোদ।

দরজার দিকের ছাউনিটা প্রায় দেওয়াল অবধি। টায়ে টায়ে। মাপলে হয়তো দেখা যাবে এক বেঘতেরও কম। ফলে বৃষ্টি এলে সেই ছাউনির নীচে কেউ তো দাঁড়াতেই পারে না। উল্টে দেওয়ালটাই ভিজে একসা হয়। দীর্ঘদিন ধরে ভিজে ভিজে চুন-সুরকির চলটা উঠে উঠে দেওয়ালটা খাবলা খাবলা হয়ে গেছে। যেন দাঁত-নখ বের করে হাসছে। কাঠের দরজাটার অবস্থাও তাই। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে কোথা থেকে এক টুকরো পুরনো টিন এনে দরজার উপরে লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই টিনেও এখন জং ধরেছে।

পাশের ঘরের যে কাগজকুড়ুনি লোকটা ভোর থাকতে উঠে কাগজ কুড়োতে বেরোয়, তার আসল নামটা যে কী, কারও আর মনে নেই। ওখানকার আরও অনেকে তার মতো কাগজ কুড়োতে বেরোলেও, সবাই একমাত্র তাকেই ‘কাগজকুড়োনি’ বলে ডাকে। ওটাই এখন তার নাম হয়ে গেছে। সে প্রত্যেক দিন বেরোবার সময় কার্তিককে ডেকে দিয়ে যায়। আজ সে ডাকতে এসে দেখে, যাকে একবার ডাকলেই দরজা খুলতে একটু দেরি হয় বলে, ভিতর থেকেই বলে ওঠে, ‘উঠছি রে… উঠছি… দাঁড়া দাঁড়া…’ তার পর দরজা খুলে বেরিয়ে কোনও দিন বলে, ‘যাচ্ছিস? আয় তা হলে। দুগ্গা দুগ্গা।’ আবার কোনও দিন বলে, ‘ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি, কাগজ কুড়োতে কুড়োতে আজ যেন কাগজে মোড়া এমন একটা ঢাউস প্যাকেট পাস, যার মধ্যে প্রচুর টাকা আছে। প্রচুর প্রচুর প্রচুর…’ 

তাকে আজ একবার নয়, দু’বারও নয়, বারবার ডাকার পরেও সে যখন দরজা খোলা তো দূরের কথা, সামান্য ‘হ্যাঁ’, ‘না’-ও বলল না, তখন সে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। সেই শব্দ শুনে এ পাশ ও পাশের ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এল লোকজন।

তাদের অনেকেরই মনে হল, এখানকার কাউকেই তো এমনিতে কেউ ধার দেবে না, নিশ্চয়ই কাবুলিওয়ালা বা ওই রকম কারও কাছ থেকে কেউ সুদে টাকা নিয়েছিল। আর যারা সুদে টাকা খাটায়, তাদের যে কত ক্ষমতা, এখানে যারা থাকে এবং সুদে টাকা নেয়, তারা জানে। আসল তো নয়ই, হয়তো সুদও ঠিক মতো দিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল, সুদ যা দিয়েছি, দিয়েছি। আর দেব না। এ বার এক থোকে আসলটা মিটিয়ে দেব।

অথচ আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করে করে রোজই ঘোরাচ্ছিল। অবশেষে কাল রাতের মধ্যে হয়তো টাকা শোধ করবে বলেছিল। কিন্তু করেনি। তাই সক্কালবেলায় লোকজন নিয়ে সেই লোকটা এসে হাজির হয়েছে তার ঘরের সামনে।

কিন্তু বেরিয়ে এসে যখন দেখল, না বাইরের কেউ নয়। কার্তিকের ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে তাদেরই মহল্লার কাগজকুড়োনি, তখন তারা জিজ্ঞেস করল, কী গো, কী হল? এই সক্কালবেলায় কী শুরু করেছ?

কাগজকুড়ুনি বলল, ওকে এত বার ধরে ডাকছি, উঠছে না।

—উঠছে না দেখে হল্লা বাধাতে হবে? ঘুমোচ্ছে হয়তো।

—না গো। আমার মনে হচ্ছে এটা এমনি ঘুম নয়। কিছু একটা হয়েছে!

—কী হয়েছে?

—কাগজকুড়ুনি বলল, ব্যাপারটা আমার ঠিক ভাল ঠেকছে না।

—মানে?

—ওর কিছু হয়ে যায়নি তো?

—এ কী বলছ গো… সরো সরো সরো, দেখি তো… 

মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল খবর। সবাই এসে জড়ো হল ওর দরজার সামনে। ছুটে এল ক্লাবের ছেলেরাও। তারাই দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখে কাগজকুড়োনি যা ভেবেছিল, সেটাই সত্যি। মেঝেয় পাতা হতদরিদ্র মাদুরের উপরে ছেঁড়া গেঞ্জি আর ময়লা তেলচিটে লুঙ্গি পরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কার্তিক। পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে মুখ খোলা একটা বোতল। তাতে খানিকটা জল। বাকিটা যে পড়ে গিয়েছিল, শুকিয়ে গেলেও হালকা ধুলোর মধ্যে জলের রেখা দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

একজন বলল, মনে হয় শুয়ে শুয়ে জল খেতে গিয়েছিল, সেই জল শ্বাসনালিতে আটকেই…

অন্য জন বলল, রাতেই হয়েছে মনে হচ্ছে…

আর এক জন ওকে ছুঁয়ে বলল, গা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। মুখে এ কথা বললেও কার্তিকের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখল, শ্বাস পড়ছে কি না…

ভিড়ের মধ্যে ছিলেন বস্তিরই একজন দাদাগোছের হোমড়াচোমড়া মানুষ— দশরথবাবু। তিনি কার্তিকের কোমরে লুঙ্গির গোঁজে কী একটা মোড়া দেখে বললেন, আরে, এত লোক এখানে কেন? যা সব এখান থেকে, যা তো। কাজ করতে দে।

তাঁর কথা শুনে দু’-চার জন যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে, যেহেতু প্রচলিত আছে, ম়ৃতদেহকে ছুঁয়ে থাকতে হয়, না হলে অন্য কোনও অপ-আত্মা সেই শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। তাই সেই মৃতদেহ ছুঁয়ে থাকার ভান করে উনি কার্তিকের কোমরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মরার সময়ও ও যখন এটা কোমরে গুঁজে রেখেছিল, তখন এটা নিশ্চয়ই দামি কিছু হবে! উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে খৈনির ডিবে জাতীয় কিছু একটা। কিন্তু যত দূর শুনলাম, ও নাকি পান, বিড়ি, সিগারেট, খৈনি কিছুই খেত না। তার মানে খৈনির ডিবে হলেও নিশ্চয়ই তার মধ্যে তেমন মূল্যবান কিছু আছে। কিন্তু কী! তখনই তিনি ঠিক করলেন, যা-ই থাক না কেন, পরে দেখা যাবে। আগে তো এটা সরিয়ে নিই।

তখনও ঘরের মধ্যে বেশ কয়েক জন লোক। তার মধ্যেই চোখের পলকে উনি সেটা চট করে বের করে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন। ফোন করলেন কাউন্সিলরকে। কাউন্সিলরই এক ডাক্তারকে বলে ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দিলেন। সঙ্গে বিনে পয়সার শববাহী গাড়িও।

যখন মৃতদেহ নিয়ে বেরোচ্ছে সঙ্গে তখন মাত্র জনাকতক লোক। বাকিরা তক্কে তক্কে আছে। ঘুরঘুর করছে। সবার মনেই এক প্রশ্ন, ও তো বিয়ে-থা করেনি। ওর কোনও নিকটআত্মীয় আছে কি না, তাও কেউ জানে না। ফলে এ ঘরটার কী হবে! যে-লোকটা কাগজ কুড়োতে যাওয়ার সময় প্রতিদিন ভোররাত্রে ওকে ডেকে দিয়ে যেত, সেই কাগজকুড়ুনি বলল, ও আমাকে বলে গেছে, আমি মারা গেলে এ ঘরটায় তুই থাকিস।

সে কথা শুনে জটলার মধ্যে থেকেই একটা বউ বলে উঠল, এ কী বলছ গো জামাই? সবাই জানে, আমার ছোট নাতনিটাকে ও কত ভালবাসত। ফেরার সময় প্রত্যেক দিন তার জন্য লজেন্স নিয়ে আসত। পুজোর সময় তো জামাও কিনে দিয়েছিল। নিজের নাতনির মতো ভালবাসত ওকে। আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক ছিল না ঠিকই, কিন্তু ও ছিল আমাদের একেবারে আত্মীয়ের মতো। সেই হিসেবে কার্তিকের ঘরটা তো আমার নাতনিরই পাওয়ার কথা, তাই না?

ঠিক তখনই ও দিককার একটা লোক হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, ও রকম একটা মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি এ ভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমি ভাবতেই পারিনি। না হলে তো ওকে দিয়ে লিখিয়ে রাখতাম। এই তো সে দিন, আমার ছেলে ঘরের জন্য বিয়ে করতে পারছে না শুনে বলেছিল, আমি আর ক’দ্দিন! আমার তো আর কেউ নেই। আমার কিছু হয়ে গেলে তুই এই ঘরটা তোর ছেলেকে দিয়ে বলিস, আমি তার জন্য এটা দিয়ে গেছি।

তখন ক্লাবেরই একটা ছেলে তাদের ধমকে উঠে বলল, তোমরা কী পেয়েছ বলো তো? লোকটার এখনও সৎকার হয়নি, আর তোমরা ওর ঘর নিয়ে পড়েছ? কেউ পাবে না এ ঘর। এ ঘর ক্লাবের।


শববাহী গাড়ির চালকের পাশের সিটে বসেছেন দশরথবাবু। বসার কথা নয়, তবু চালকের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে গাড়ির পিছনে মৃতদেহ ঢাকা কাচের কফিনের এ পাশে ও পাশের রডে গুঁতোগুঁতি করে বসেছে বস্তিরই আট-দশ জন ছেলে। গাড়ি যাচ্ছে। রব উঠছে, ‘হরি বোল বলো হরি… হরি বোল বলো হরি… হরি বোল বলো হরি…’ আর গাড়ি যত শ্মশানের দিকে এগোচ্ছে, দশরথবাবুর উসখুস যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই পাঞ্জাবির পকেটের ভিতরে হাত গলিয়ে দেখে নিচ্ছেন ওটা আছে তো! কখনও সখনও নেড়েচেড়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, কার্তিকের কোমরের লুঙ্গির গোঁজ থেকে কায়দা করে যেটা বের করে নিয়েছেন, সেটা আসলে কী! গোলগাল! মসৃণ! ঠান্ডা ঠান্ডা! আচ্ছা, এটার কথা কেউ জানে না তো! 

শ্মশানে পৌঁছে সবাই যখন ধরাধরি করে গাড়ি থেকে মৃতদেহ নামাতে ব্যস্ত, তখন ‘এই, তোরা বডিটা ভিতরে নিয়ে গিয়ে লাইনে রাখ, আমি বাথরুম থেকে আসছি’ বলেই, উনি পে অ্যান্ড ইয়ুজের দিকে হাঁটা দিলেন। এবং ঢুকেই, এ দিক ও দিক ভাল করে দেখে নিয়ে ঝপ করে পকেট থেকে ওটা বের করেই উনি অবাক হয়ে গেলেন, এটা তো একটা পাথর! তার পরেই তাঁর মনে হল, এটা খালি চোখে পাথর মনে হতে পারে ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয়, এটা কোনও দুর্মূল্য ছাপোষা পাথর নয়। এমনি সাধারণ পাথর হলে এত যত্ন করে কেউ এ ভাবে আগলে রাখে না! এটা নিশ্চয়ই কোনও রত্নপাথর! এ রকম গোল গোল, মসৃণ, তেলতেলে সবুজ রঙের পাথর কিছুতেই রাস্তার নুড়ি পাথর হতে পারে না! কিন্তু কী পাথর এটা! না। পোখরাজ নয়। মুক্তো নয়। নীলাও নয়। এমনকী গোমেদও নয়। এগুলো উনি চেনেন। তা হলে এটা কোন পাথর! উনি না চিনলেও কোনও রত্ন ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। না। এক্ষুনি হবে না। তা হলে জানাজানি হয়ে যেতে পারে! ক’দিন যাক, তার পর নাহয় বড় কোনও সোনার দোকানে যাওয়া যাবেখ’ন… না, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সবুরে মেওয়া ফলে। তা ছাড়া কেউ তো আর তাঁর কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে না! তবে?


না। একজনকে নয়। ও নাকি নানা সময়ে নানান লোককে ওর জীবনের নানা কথা বলত। ও মারা যাওয়ার পরে কে ওর কত কাছের, তা প্রমাণ করার জন্য সবাই যেন উঠেপড়ে লাগল। সেগুলো বলতে শুরু করল। আর সেগুলো ঝাড়াইবাছাই করে যা দাঁড়াল, তা হল— কার্তিকদের নাকি বাড়ি ছিল নদিয়ায়। খুব ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে একবার কলকাতায় বেড়াতে এসেছিল। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা দেখে ওরা যখন কালীঘাট মন্দিরে যাওয়ার জন্য রাস্তায় যে দু’-একজনকে দেখতে পাচ্ছে, তাকেই জিজ্ঞেস করে করে শটকার্ট রাস্তা ধরে এগোচ্ছে, বাবা-মা এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। পিছনে ও একা। তখন হঠাৎ সামনের বড় বাড়িটা থেকে বেশ বড় থলের মতো দেখতে ভেলভেট কাপড়ের সুদৃশ্য একটা ঢাউস ব্যাগ এসে পড়ল ওর সামনে। ও যদি আরও দু’-তিন পা এগিয়ে যেত, তা হলে হয়তো ওর মাথাতেই পড়ত। না। আশপাশে তখন কেউ ছিল না। বড়লোকদের এলাকা। বাড়ি নয়, সবারই প্রায় বাংলো। যারা ওখানে থাকে তারা বাড়ির ভিতর থেকেই গাড়ি করে বেরোয়। আর গাড়ি করেই ঢোকে। যেটুকু হাঁটে, সেটা শখে। তাও এ রাস্তায় নয়। হয় হর্টিকালচারে। নয়তো গড়ের মাঠে। মানে ফাঁকা জায়গায়। এবং সেটা সকালে। ফলে এই পড়ন্ত বিকেলে পুরো রাস্তাটাই একদম সুনসান। সেই মুহূর্তে আশপাশে কেউই ছিল না। তাই এত সুন্দর একটা ব্যাগ দেখে ও আর লোভ সামলাতে পারেনি। টুক করে তুলে নিয়েছিল।

কিছুটা গিয়ে ছেলের জন্য দাঁড়িয়ে পড়তেই ও তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়েছিল বাবা-মায়ের কাছে। ছেলের হাতে ও রকম একটা ব্যাগ দেখে তারা জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কোথায় পেলি?

যেখানে পেয়েছিল, ও আঙুল তুলে পিছনের সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। বাবা-মা বলেছিল, দেখি দেখি, কী আছে, দেখি… ওর হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ওরা খুলে দেখেছিল, তার মধ্যে হিরে-জহরত-মণি-মাণিক্যখচিত দামি দামি সব সোনার অলঙ্কার।

না। আগে থেকে ঠিক করা থাকলেও ওরা সে দিন আর কালীঘাটের মন্দিরে যায়নি। স্বয়ং মা-ই যখন ওদের ওপরে এমনিতেই প্রসন্ন হয়ে গয়নাগাঁটি ভরা একটা গোটা ব্যাগই তুলে দিয়েছে, তখন তাদের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাবার কথা বলার জন্য কেন ওরা কালীঘাটে যাবে!

তখনই ওরা বাড়ি ফিরে এসেছিল। দরজা আটকে স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সব ক’টা গয়না ভাল করে দেখেছিল। ঠিক করেছিল, এর মধ্য থেকে কয়েকটা বেচে দেবে। সেই টাকায় বাড়িওয়ালাকে রাজি করিয়ে বাইরের দিকের ভাঙাচোরা ঘরটা সারিয়ে নিয়ে একটা মুদিখানার দোকান দেবে। সেই মতো পরদিন সকাল-সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল… কিন্তু না। সে আর বাড়ি ফেরেনি। ফিরেছিল তার গলার নলি কাটা নিথর দেহ। সঙ্গে না ছিল কোনও গয়নাগাঁটি। না কোনও টাকাপয়সা।

ওর মা বলেছিল, তোর বাবা যে-দোকানে গয়না বিক্রি করতে গিয়েছিল, সেই দোকানের মালিকই হয়তো লোক লাগিয়ে তোর বাবাকে খুন করিয়েছে। কিংবা গয়না বিক্রি করে সোনার দোকান থেকে বেরোনোর সময় বাইরে যারা তক্কে তক্কে থাকে, তারা হয়তো চেহারা দেখে বুঝেছিল, এ গয়না কেনার লোক নয়। নিশ্চয়ই বিক্রি করতে এসেছে। সঙ্গে টাকা আছে। আর টাকা যদি নাও থাকে, এমনি এমনি তো কেউ আর সোনার দোকানে ঢোকে না। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু কিনেছে। কারও মুখেভাতে দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা আংটি হলেও কিনেছে। আর কিছু না থাক সেটা তো পাব। আর ভাগ্য যদি ভাল থাকে তার চেয়ে বেশিও পেতে পারি। এটা ভেবে তারা হয়তো তোর বাবার কাছে যা ছিল, সেগুলো কেড়ে নিয়েছিল। সেই সময় তোর বাবা নিশ্চয়ই বাধা দিয়ে গিয়েছিল, আর বাধা পেয়েই ওরা এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, নিজেদের পথ পরিষ্কার করার জন্য তোর বাবার গলার নলিটাই কেটে দিয়েছিল।

না। ওই ঘটনার পর তিন মাসও হয়নি। একদিন সকালে উঠে দেখে ওর মা ঘরে নেই। নেই তো নেই-ই। সে দিন না। তার পরদিন না। তার পরদিনও না। ওর মা আর ফিরল না। লোকমুখে জানতে পারল, যে লোকটার সঙ্গে ওর মা লুকিয়ে লুকিয়ে মেলামেশা করত, মধ্যরাতে তার সঙ্গে নাকি চুপিচুপি পালিয়ে গেছে। ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে বুঝতে পারল, যাওয়ার সময় নিয়ে গেছে বাকি গয়নাগুলোও।

না। ঘরে একটাও টাকা ছিল না। বাড়িওয়ালার বউ দিনকতক খাওয়াদাওয়া দিয়েছিলেন ওকে। তার পর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওর মাথার উপর থেকে শুধু হাত নয়, ছাউনিটাও সরিয়ে নিয়েছিলেন উনি। ও চলে এসেছিল কলকাতায়। 

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখে একদল লোক হইহই করে একটা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। মুখে ‘হরি বোল বলো হরি’ বলছে আর খই ছিটোচ্ছে। খইয়ের সঙ্গে ওগুলো কী! দেখে চার আনা, আট আনা, এক টাকার কয়েন। ও কুড়োতে শুরু করেছিল। কার মুখে যেন ও শুনেছিল, কলকাতায় টাকা ওড়ে। কিন্তু এই প্রথম ও নিজের চোখে দেখল, শুধু ওড়ে না, লোকেরা টাকা ছুড়েও ফেলে।

কুড়িয়ে কুড়িয়ে প্রচুর পয়সা পেয়েছিল ও। গুনে দেখে অনেকগুলো টাকা। সেই টাকা দিয়ে ঘুঘনি-পাঁউরুটি খেয়েছিল। এবং খেতে খেতে ওর মনে হয়েছিল, এই কলকাতার রাস্তাঘাটে যা পড়ে থাকে, লোকে যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে, চোখ-কান খোলা রেখে চললে তার মধ্যে থেকে যদি সামান্যও কুড়িয়ে নেওয়া যায়, তা হলে তাতেই যে-কোনও লোকেরই একটা গোটা জীবন অনায়াসে চলে যেতে পারে। তা হলে তার জীবনটা চলবে না কেন!

তার পর থেকেই ও রাস্তা দিয়ে হাঁটত। এ রাস্তা ও রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে হাঁটত। বড় বড় বাড়ি দেখলে তার গা ঘেষে হাঁটত। এবং যখনই হাঁটত, মাথা একেবারে নিচু করে হাঁটত। আর মনে মনে ভাবত, এই বুঝি এটা পেলাম! এই বুঝি ওটা পেলাম! 

নীচে তাকিয়ে হাঁটত বলে কোনও দিন কোনও মেয়ের দিকেও তাকানো হয়নি ওর। মেলামেশা তো দূরের কথা। শুধু মাথার উপরে তেমন কেউ ছিল না বলে নয়, কোনও মেয়েকে ঘরে তুললে সে খাওয়াবে কী! রাখবে কোথায়? ওইটুকু ঘরে নিজে থাকবে, না বউকে রাখবে! তাই তার কানে বিয়ের কথাও ঢোকায়নি কেউ। দেখতে দেখতে বয়স পেরিয়ে গেছে।

ও যে কারণেই মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটুক না কেন, সবাই ভাবত, নাঃ। ছেলেটা সত্যিই খুব ভাল। ভদ্র। কারও মুখের দিকে তাকায় না। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একেবারে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটে। ওকে ও ভাবে হাঁটতে দেখে পিঠে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়োতে কুড়োতে যাওয়া এই কাগজকুড়ুনি ওকে বলেছিল, তুই কি লোহা কুড়োস?

কার্তিক বলেছিল, না।

—তামা-পেতল?

—না।

—কোল্ডড্রিংকসের বোতল?

—না।

ওকে তখন কাগজকুড়ুনি জিজ্ঞেস করেছিল, তা হলে ও ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে এ দিকে ও দিকে কী খুঁজতে খুঁজতে যাচ্ছিস? তোর কি কিছু হারিয়েছে?

ও বলেছিল, না।

—তা হলে কী খুঁজছিস?

ও বলেছিল, টাকা।

—টাকা!

—না হলে সোনার গয়না।

—সোনার গয়না! ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল কাগজকুড়ুনি। রাস্তায় হয়তো কখনও-সখনও টাকা কুড়িয়ে পাওয়া যায় ঠিকই। এক-আধটা কানের দুল কিংবা অসাবধানতাবশত খুলে পড়া কারও পায়ের তোড়া পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। তা বলে কোনও লোক রাস্তায় বেরিয়ে শুধু টাকা কিংবা সোনার গয়না খুঁজছে, এ রকম লোক তো সে কোনও দিন দেখেনি!

কার্তিক ওকে বলেছিল, ওর সেই ছোটবেলায় গয়না কুড়িয়ে পাওয়ার কথা। কাগজকুড়ুনি সব শুনে বলেছিল, নিশ্চয়ই ওই বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্সের লোকেরা আচমকা হানা দিয়েছিল, তাই ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হিসেব-বহির্ভূত কিছু গয়নাগাঁটি ওরা ওই ব্যাগে তড়িঘড়ি করে ভরে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলেছিল রাস্তায়। আর সেই সময় তুই ওখান দিয়ে যাচ্ছিলি দেখে তুই পেয়েছিলি। আর পয়সা? বুড়োবুড়ি মারা গেলে অনেকেই খইয়ের সঙ্গে পয়সা ছিটোয়। আগে এক নয়া, দু’নয়া ছিটোত। তার পরে পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা। ওগুলো এখন আর পাওয়া যায় না বলে চার আনা, আট আনা, এক টাকার কয়েন ছিটোয়। এর পরে এগুলো অচল হয়ে গেলে দেখবি দু’টাকা, পাঁচ টাকার কয়েন ছিটোবে। ওগুলো পাবি ঠিকই, কিন্তু কখনওই দ্বিতীয়বার আর ও রকম গয়না ভর্তি ব্যাগ তুই পাবি না। এ জীবনে এত টাকা আর কখনওই কুড়িয়ে পাবি না, যা দিয়ে তোর বাকি জীবনটা চলে যেতে পারে।

কাগজকুড়ুনি ও কথা বললেও, ওর বিশ্বাসে সামান্য চিড়ও ধরাতে পারেনি। ও বিশ্বাস করত, ও পাবে। শুধু টাকা-পয়সা নয়, গয়নাগাঁটি নয়, তার চেয়েও অনেক অনেক অনেক মূল্যবান কোনও কিছু ও একদিন পাবে। পাবেই। তাই রাস্তায় পড়ে থাকা দামি জিনিস খোঁজাটাকেই ও জীবিকা করে নিয়েছিল।

দু’জনের মত দু’রকম হলেও ওদের মধ্যে কিন্তু খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সেই বন্ধুত্বের সূত্রেই কার্তিককে অতি সামান্য ভাড়ায় তাদের বস্তিতেই একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল সে। 

সকাল হলে সে কাগজ কুড়োতে বেরিয়ে যেত। খানিক পরে বেরোত কার্তিক। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবত, এই বুঝি সামনের সাত-আট তলা বাড়ির জানালা থেকে তার পায়ের সামনে থুপ করে পড়ল গয়না ভর্তি ভেলভেট কাপড়ের কোনও সুদৃশ্য ব্যাগ! কিংবা বান্ডিল বান্ডিল ঝকঝকে টাকা ভর্তি ছোটখাটো বস্তা! অথবা হঠাৎ পেয়ে গেল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে পাঠানোর জন্য রাস্তায় নামিয়ে বাকিগুলো গাড়িতে তুলে দিলেও, প্রহরীদের অসতর্কতায় ফেলে যাওয়া টাকা বোঝাই একটা মস্ত বড় কালো ট্রাঙ্ক! কখনও সখনও মাথায় হাত দিয়ে হাঁটত। ও রকম একটা গয়না ভর্তি ভারী ব্যাগ যদি তার মাথার ওপরে এসে পড়ে, তা হলে তো তার জীবন একেবারে দফারফা হয়ে যাবে!

না। এ জীবনে সে আর ও রকম কিছুই পায়নি। খিদে পেলে চলে যেত কালীঘাট মন্দিরের কাছে। সেখানে রোজই খানিক বাদে বাদে কেউ না কেউ এসে বিনে পয়সায় ভিখারিদের খাবার বিলি করে। খিচুড়ি, ডাল-ভাত, তরি-তরকারি, লুচি, আলুর দম, বোঁদে, মিষ্টি। এমনকী পায়েসও। কেউ কেউ আবার প্যাকেটে করে চাউমিন, ফ্রায়েড রাইসও বিলি করে। ভিখারিদের সঙ্গে ও-ও লাইন দিয়ে হাত পেতে নেয়। পেট ভরে খায়।

কার্তিক নাকি দিনকতক আগে সেই কাগজকুড়ুনিকে বলেছিল, আমি একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি। কাউকে বলিস না।

—কী? ও জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল, আমরা এখন আর লাখটাখ নয়, কোটিপতি হয়ে যাব। এই কলকাতাতেই বিশাল বড় জায়গা কিনে আকাশ-ছোঁয়া একটা সোনার বাড়ি বানাব…

—সোনার বাড়ি!

—সেই বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল হবে হিরে-চুনি-পান্না দিয়ে কারুকাজ করা। চাকরবাকর থাকবে শয়ে শয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি দামি গাড়ি থাকবে আমাদের।

অবাক হয়ে গিয়েছিল কাগজকুড়ুনি, আমাদের!

—হ্যাঁ, আমাদের। তুই আর আমি কি আলাদা?

—কী বলছিস তুই?

—এই বস্তিতে যারা আছে, তাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা এক-একটা বাংলো বানিয়ে দেব। এমনি বাংলো নয়, রাজসিক বাংলো। প্রতিটি বাংলোয় থাকবে সুইমিং পুল। সবার অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেব দশ কোটি করে টাকা।

—তুই কি স্বপ্নটপ্ন দেখেছিস নাকি?

বেশ জোরের সঙ্গেই কার্তিক বলছিল, না। স্বপ্ন নয়।

—তা হলে?

—আমি একটা জিনিস পেয়েছি। যেটা ছোঁয়ালেই সব সোনা হয়ে যাবে।

কাগজকুড়ুনি জিজ্ঞেস করেছিল, পরশপাথর?

—হতে পারে!

—মানে?

—সোনা না হলে হিরে-জহরত-মণি-মাণিক্যও হতে পারে।

—কী বলছিল তুই? মানেটা কী?

আমতা আমতা করে কার্তিক বলেছিল, না। মানে, আমি এখনও পরীক্ষা করে দেখিনি তো… তাই। তবে আমার মনে হয়, ওটা ওই রকমই কিছু একটা হবে।

—দেখি…

—এখন না। কাল সকালে যখন তুই আমাকে ডাকতে আসবি, তখন দেখাব। তবে এক্ষুনি কিন্তু কাউকে কিছু বলিস না, কেমন?

কাগজকুড়ুনি বলেছিল, ঠিক আছে।

কিন্তু আজ সকালে ডাকতে এসে…


একটু পরেই ওরা দাহ করে ফিরে এলে এ ও সে যে-যাই বলুক না কেন, কারও কথাই ধোপে টিকবে না। কার্তিকের ঘরটা ক্লাবের দখলে চলে যাবে। ঘরের যেগুলো বেচা যায়, সেগুলো একজায়গায় জড়ো করে কিলো দরে বিক্রি করে দেবে। আর যেগুলো বিক্রির অযোগ্য, ফেলে দেওয়ার মতো, সেগুলো জঞ্জাল হিসেবে ফেলে দেবে। কিংবা কোথাও স্তূপীকৃত করে আগুন ধরিয়ে দেবে। ওরা তা-ই করে। আর সেটাই যদি করে, তা হলে আজ যেটা ও তাকে দেখাবে বলেছিল, সেই জিনিসটার কী হবে! এরা তো জানবে না। ফালতু জিনিস ভেবে নির্ঘাৎ ফেলে দেবে। কিন্তু কোথায় ফেলবে সে জানবে কী করে! ফলে তার হাতে কিছুতেই আসবে না। সে মনেপ্রাণে চায়, তার হাতে না এলেও, অন্য কারও হাতে আসুক। তাতে ও যতটা বলেছিল, অতটা যদি নাও হয়, অন্তত কিছুটা তো হবে। আর তা যদি হয়, তা হলে ছিটেফোঁটা হলেও তার ভাগেও কিছু না-কিছু পড়বে। তাই সে সবাইকে বলে দিয়েছিল ওই জিনিসটার কথা।

ওটা শুনেই হইহই করে সবাই ঢুকে পড়েছিল কার্তিকের ঘরে। প্রতিটি জিনিস উল্টেপাল্টে তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল। খুঁজেছিল ঘরের প্রতিটি কোণাও। দেখেছিল চিনির কৌটোর ভিতরে হাত দিয়ে। নুনের বাটি উল্টে। কেরোসিন তেলের জার উপুড় করে। বাদ দেয়নি কোনও পোঁটলা-পুঁটলিও। এমনকী বালিশ-কাঁথাও ছিঁড়েখুঁড়ে খুঁজেছিল। পারলে ঘরের মেঝে খুঁড়ে দেখে আর কী! কিন্তু কোত্থাও ওটা পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি, না কি এই ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে কেউ পেয়েই চোখের নিমেষে লুকিয়ে ফেলেছে! এই সন্দেহ থেকেই ঘর থেকে বেরোবার সময় সবাই সবাইকে তল্লাশি করেছিল। শেষে একটা কথাই সকলে বলেছিল, কাগজকুড়োনি আবার মিথ্যে কথা বলেনি তো! না কি তারা ওই ঘরে ঢোকার আগেই অন্য কেউ ওটা সরিয়ে ফেলেছে!


নাভি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার পরে, ‘তোরা যা। আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি’ বলেই, দশরথবাবু আর থাকতে না পেরে সোজা চলে গেলেন নিবারণ দত্তের দোকানে। এটা এই এলাকার বিখ্যাত জুয়েলারি দোকান। খুব অল্প সোনায় অভিনব এক-একটা নকশার গয়না বানানোর পাশাপাশি এরা আবার পুরনো সোনারুপো, রত্ন কেনাবেচারও কারবার করে। তার কাছে গিয়ে উনি বললেন, দেখুন তো, এটা কী স্টোন…

দোকানদার সেটা হাতে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আলোর সামনে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, কোথায় পেয়েছেন এটা?

—সে পেয়েছি একটা জায়গা থেকে। তার আগে বলুন তো… এই স্টোনটার নাম কী?

দোকানদার বললেন, আগেকার দিনে এগুলো খুব ব্যবহার করা হত।

দশরথবাবু বললেন, মানে? এটা কি খুব মূল্যবান পাথর?

—এ সব তো এখন আর পাওয়া যায় না…

—তার মানে এটা অ্যান্টিক?

—অ্যান্টিক তো অবশ্যই…

দশরথবাবু মনে মনে বললেন, দেখছ, লোকটা ওই রকম একটা ঝুপড়িতে থাকত, অথচ এ রকম একটা অ্যান্টিক জিনিস ও এত দিন ধরে আগলে রেখেছিল! আসলে, পেলেই হল না। সেটা ভোগ করার জন্য কপাল চাই। যেটা ও নিয়ে জন্মায়নি। কী কপাল লোকটার, না! তার পরেই দোকানদারের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, এটার দাম কত হতে পারে?

দোকানদার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দু’টাকা।

—দু’টাকা!

—তা ছাড়া আর কী!

দশরথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী পাথর?

—বহু বহু যুগ আগে এগুলো ব্যবহার করা হত। এটা হচ্ছে এক ধরনের পাথরের পেপার ওয়েট। ভুর্জপত্র বা কাগজপত্র যাতে হাওয়ায় উড়ে না যায়, সে জন্য এ ধরনের সুদৃশ্য পাথর চাপা দিয়ে রাখা হত।

—পেপার ওয়েট!

—তাও আস্ত পেপার ওয়েট নয়। পেপার ওয়েটের ভাঙা একটা টুকরো…

আকাশ থেকে পড়লেন দশরথবাবু। এটা পেপার ওয়েটের টুকরো! আর তিনি কি না ভেবেছিলেন… তার পরই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা শব্দ— সত্যিই, একেবারে ফালতু, আর আমি কিনা… যত্তসব… বলতে বলতে উনি উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics