Indira Mukhopadhyay

Classics

4.8  

Indira Mukhopadhyay

Classics

উড়োচুলের নুড়ি

উড়োচুলের নুড়ি

4 mins
1.1K


উড়োচুলের নুড়ি

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 


তন্দ্রা বসেছিল নিজের মত করে। একবার সেলফোন, একবার খবরের কাগজ কোনোটাতেই মন বসছিল না তার। তন্দ্রা তার বেডরুমের একটি কোচ সোফায় বসে বসে ভাবছিল। ভাবনার পরতগুলো খুলছিল একে একে। কিছুক্ষণ আগেই সে চুল আঁচড়েছে। তার চোখের সামনে দুধ সাদা মেঝের ঝকঝকে ভিট্রিফায়েড টাইলসের ওপর দিয়ে অবলীলায় ধেয়ে আসছিল কিছু একটা। কি সেটা? তন্দ্রার উড়োচুলের নুড়ি একটা। বেডরুমের খাটের তলা, আলমারীর নীচ, ড্রেসিং টেবিলের নীচ হাতড়ে কুচো চুলগুলোকে একে একে জড়ো করতে করতে সেই পরিত্যক্ত চুলের নুড়িটা ক্রমশ‌ই আকারে বড় হচ্ছিল। একবার করে সে পাখার হাওয়ার দাপটে তন্দ্রার সামনে আসে আবার ঘুরতে ঘুরতে ঝরা চুলের খোঁজ করে ঠিক আশ্লেষে সেই চুলগুলো কে জড়িয়ে নেয় নিজের শরীরে। তন্দ্রা ভাবছিল নিজের জীবনের কথা। এলোচুলের নুড়ি দেখে মনে হচ্ছিল অনেকদিন আগে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখা সেই পোকার কথা। ডাং বিটল বলে তাদের। পশুরা মলত্যাগ করলে সেই গোবরের তালে আটকে নেয় নিজেকে। তারপর বেরোয় দেশভ্রমণে। গড়াতে থাকে সেই উপেন্দ্রকিশোরের লাউ গড়গড়ের মত। তারা গড়ায় বলে তাদের রোলার বলে।  

এভবেই গোবরের তাল কে ঘিরেই এই গুবরে পোকাগুলোর বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে। অন্য পোকার সঙ্গে তার সানন্দে দিনযাপন চলতেই থাকে গড়াতে গড়াতে । আহার, নিদ্রা, মৈথুন সব। খুঁজে খুঁজে বন্ধু বের করে সে ঝোপঝাড় থেকে, গড়াতে গড়াতেই । পুরুষ খুঁজে নেয় নারীকে। নারী পুরুষ কে। আটকে নেয় সেই বলের চৌহদ্দি তে। সেই গোবরের তালেই জুটে যায় পোকাদের আহারাদি, উপযুক্ত পুষ্টি।

তন্দ্রা ভাবতে থাকে এসব। তার জীবনেও এভাবে বন্ধুবৃত্ত বেড়ে উঠছিল একদিন। আজ আর কেউ নেই তার পাশে। কত অমলিন শব্দ এই বন্ধুতা। তবুও কালো মেঘে ঢেকে যায় এক এক সময় । 

 তন্দ্রাও বাঁধতে চেয়েছিল বন্ধুদের। সুগন্ধী চা, উদ্বায়ী কফির সুবাসে ভরে যেত বন্ধুত্ব। অনেক বন্ধু এসেছিল তন্দ্রার জীবনে। তারপর সবাই সরে গেছে তার কাছ থেকে। কেউ নেই আর। তারা আছে কিন্তু তন্দ্রার কাছে আসেনা। পোকাদের মত জড়িয়ে নেয়না তাকে। তন্দ্রার জীবনে একসময় কফিহাউজ ছিল। কলেজ ক্যান্টিনে টেবিল বাজিয়ে গান ছিল। গড়িয়াহাটে ফুচকা ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা ছিল। কিন্তু জীবনের একটা ঘটনা তাকে বন্ধুহারা করে দিল। তাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপটা ছিল অনেকটা এই বল গুলোর মত। সারাদিন মেসেজ দিয়ে জড়িয়ে থাকত একে অপরকে। আনন্দে গড়াত দিন। 


তার চোখের সামনে চুলের নুড়ি ক্রমশঃই ধেয়ে আসছে যেন। তার মানে ঐ ঘরের আনাচকানাচ মাড়িয়ে সেই কেশ গোলকের সব চুল কুড়োনো শেষ। অথচ জড় পদার্থের ঘূণাক্ষরে মনে হয়না তার গায়ে আলগা ভাবে লেপটে থাকা চুলকে সে ছেড়ে নিজে একা গড়িয়ে যাক। সেও বোঝে বন্ধুতার অর্থ।  

কিন্তু আপাততঃ ওটা তন্দ্রার দিকে ধেয়ে আসছে। কেন আসছে অমন করে? মনে পড়ে গেল অ্যারিজোনার ধূসর মরুভূমির সেই টাম্বল-উইডের কথা। শুকনো লতাপাতা দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বল বাতাসের দ্বারা চালিত হয়ে গড়াতে গড়াতে বহুদূর চলে যায় । ঠিক এক রকম। চুলের নুড়ি, ডাং-বিটল, টাম্বল-উইড এই তিনজনের মধ্যে কত মিল! এদের ত্রহ্যস্পর্শে তোলপাড় হতে থাকে তন্দ্রার মন । এরাও পারে। গড়তে জানে বন্ধু বৃত্ত। তন্দ্রা মানুষ হয়েও হেরে গেল। 


বন্ধুরা তাকে ভুল বুঝেছিল সেদিন। প্রাণের চেয়েও ভালবাসত সে তুলিকাকে। তুলিকা একটা ভয়ংকর মিথ্যে বলে ফাঁসিয়েছিল অভীক কে। অভীক তাদের সবার খুব ভালো বন্ধু ছিল। নিজে বাঁচতে অভীকের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়েছিল তুলিকা। 

তন্দ্রা বলেছিল, তুই মিথ্যে বলতে গেলি কেন তুলিকা? আসলে তুই অভীককে ভালোবাসতিস। 

অথচ অভীক তখন প্রেম করছে সুতপার সঙ্গে। তোর মেনে নিতে কষ্ট হল এতটাই যে তুই অভীককে ফাঁসিয়ে দিলি তাও আবার মিথ্যে কথা বলে। তোকে বারেবারে সাবধান করেছিলাম আমি। সত্যি করে বল্‌ তো তুলিকা, অভীক সেদিন তোকে ঠিক কি করেছিল? 

তুলিকা, অভীক, সুতপা সবাই তন্দ্রার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে । 


প্রকৃত বন্ধু হতে চেয়েছিলাম আমি। সেদিন অভীক মোটেও তোর গায়ে হাত দেয় নি। হাত দিতে চায়ও নি সে। ওকে সিডিউস করেছিলি তুই। আসল সত্যিটা আমি, হ্যাঁ, শুধু আমি‌ই জানতাম। সাপিওসেক্স্যুয়াল অভীকের সঙ্গে সুতপার প্রেমটা ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। বুঝলি? আসলে আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম দুজন কে । আমাদের প্রেমটা অন্যধরনের ছিল। আমরা একে অপরের ব্যাক্তিত্ব, গাম্ভীর্য আর বুদ্ধিমত্তার ফ্যান ছিলাম। আমাদের প্রেমের অনুভূতিগুলো শুধুই আবর্তিত হত দুজনের মস্তিষ্ককে ঘিরে । আমি তোকেও ভালোবাসতাম ভীষণরকম। তোর ছিল অভীকের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশন। কিন্তু তোদের কাউকেই হারাতে চাইনি, বিশ্বাস কর।  


হোয়াটস্যাপের মেসেজে দুটি টিক পড়ে গেল। অতএব তন্দ্রার পাঠানো মেসেজ তুলিকা দেখেছে। কিন্তু উত্তর আর আসেনি তার কাছ থেকে। অভীক চাকরী নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে। সুতপার বিয়ে হয়ে গেছে মুম্বাইতে। তুলিকারও । তন্দ্রার জীবনটা চলছে ঐ গড়িয়ে যাওয়া বলগুলোর মত‌ই। কিছুটা অসংলগ্ন, এলোমেলো আর গতানুগতিকভাবে। নিজেকে মনে হতে লাগল কখনো চুলের নুড়ির মত। কখনো টাম্বল-উইড কখনও ডাং-বিটলের মত। কিন্তু ওদের মধ্যেও কত বন্ধুতা বেঁচে থাকে প্রতিমুহূর্তে। তন্দ্রা আজ বন্ধুহারা।  


তন্দ্রা নিমগ্ন ছিল হোয়াটস্যাপে মেসেজ টাইপ করতে । এতক্ষণ খেয়াল করেনি সে। সেই চুলের নুড়ি তার দিকে ধেয়ে এসে তার পায়ের আঙুলে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। ইশ্‌! নিজের চুল যদিও তবুও বেশ অস্বস্তির কারণ। সেলফোনে তার টুংটাং নোটিফিকেশন আসতেই থাকল। বিরক্ত হয়ে তন্দ্রা মনে মনে বলে ওঠে, কেউ তো কাজের কথা লেখেনা কিছু। নয় ছবি আর তা না হলে সুপ্রভাত কিম্বা শুভ সন্ধ্যা। 

বহুদিন আর কেউ জিগেস‌ও করেনা তাকে, কেমন আছিস তুই?  

সে যত অন্য পা দিয়ে সেই চুলের গোলা কে সরিয়ে দিতে চায় তত‌ই তা বাঁধতে চেষ্টা করে তাকে। কেন এমন হয়? ভাবতে ভাবতেই হাতের ফোনে পড়ে থাকা মেসেজগুলো সে খোলে একে একে। অজানা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে একটা। আজ আসছি তোর বাড়ি। থাকবি তো? প্রোফাইলে অভীকের ছবি। এতদিন বাদে অভীকের মনে পড়ল তাকে? তন্দ্রার কাছে অভীকের এই নম্বর ছিল না।


আবার তন্দ্রা অ্যাড করে নেয় তাকে। রিপ্লাই দেয় চলে আয়।   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics