STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Others

তুমি যে আমার- ১ম পর্ব

তুমি যে আমার- ১ম পর্ব

6 mins
356

বাংলার মেয়েদের দেখা শোনা করে বিয়েতে একটা চাপ থেকেই যায়, সেটা হল একটা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে আপন করে নেবার। প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম, এত দিনের মেলা মেশায় লোকটা যে মেয়েটির সবচেয়ে আপনার সে একদম একটা পড়ে ফেলা বইয়ের মত। এসব ভাবতে ভাবতে হাতের গাছকৌটো, শাড়ির আঁচল আর মনের অনেকটা দ্বন্দ্ব সামলে যখন কনের সাজে বসলাম, তখন সন্ধ্যে নামছে। নতুন শাড়ী, গয়না, কত উপহার, কত লোকজন, হইহই, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আমি, এটা দেখে মনে মনে যে আনন্দ হচ্ছিল না, সেটা বলা ভুল। কিন্তু অনেক আনন্দের মাঝেও একটা ভীষণ রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। কারন একটাই, যে মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাতে যাচ্ছি, তাকে তো সেভাবে চিনিই না।


**************

আমি রমা, ভবানীপুরের ঘোষ বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্য। বাড়ির পরম্পরা মেনে দাদুর সামনে নিজের পছন্দকে আর দাঁড় করানোর সাহস জোটাতে পারিনি। তাই, প্রেম, ভালোবাসা, এসব কী তা কিছুই বুঝিনি। গ্র্যাজুয়েশন পাশ করতে না করতেই বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু। নাহ, বাড়ির কাউকে বলতে পারিনি, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না, আমার জীবনটাকে আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই, পারিনি বলতে।

 


আর বিয়ের পর আমার জীবন যে আমার নয়, সেই শিক্ষা অনেক ছোট বয়স থেকেই মা কাকীমার থেকে পেয়েছি।

প্রথম যেদিন দেখা করতে গেছিলাম, একটা কফিশপে, বাবার পছন্দ করা এই পাত্রটি আমার যাওয়ার খানিক আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়।


যাদের কাছে সময়ের দাম নেই, তাদেরকে এতটুকুও ভালো লাগে না, যাক, সময়ের মূল্যবোধটা আছে তাহলে।

চোখে সানগ্লাস, টিশার্ট, হাতে ঘড়ি, ব্যাকব্রাশ চুলে, হ্যাঁ, মানছি ভাল লাগছিল, কিন্তু এভাবে কারো সাথে দেখা করে – কী যে বলবো, এটা ভেবেই আমার মাথা খারাপ হচ্ছিল।

শুনেছি এই পাত্রের বাড়ির লোকজনগুলো ভারী ভালো মানুষ, শুধু যার সাথে আজীবন কাটানোর কথা সেটাই বোঝা দরকার, কিন্তু এই দুই ঘন্টার সাক্ষাতে, আর ঠান্ডা ঘরের কফিতে একটা মানুষ মুখোশ পরে নাকি নয়, তা বুঝবে কার সাধ্যি? তার উপর চোখ দুটোও না দেখতে পাওয়ায় আমি সেই অকূল পাথারেই।

হ্যাঁ, ছেলেটি ভদ্র এটা বলতে হবে, চেয়ারটা এগিয়ে দেওয়া, বা রাস্তায় আমায় ভিতর দিকে রেখে হাঁটা, বা ক্যাবে ওঠার সময় দরজা খুলে দেয়া, এই ভদ্রতা বোধগুলো তার চরিত্রে বিদ্যমান দেখে ভাল লাগল।

আমায় সেভাবে কোন প্রশ্নই করল না, আমার কিছু পছন্দ অপছন্দ ছাড়া। একী রে? আমিও জানাতে চাইতে পারিনি কিছু। আপাত দৃষ্টিতে ভদ্র এই ধারণাটুকু নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন।

জীবনটা নিয়ে যে জুয়া খেলতেই যাচ্ছি, এটা ধরেই নেওয়া যায়। তাই একটা মানসিক চাপে রয়ে গেলাম।বাড়ির সকলের পছন্দের শাড়ী, গয়না, সাজ-সরঞ্জাম, ক্যাটারিং, পাত্র, সব মিলিয়ে ভাগ্য নির্ধারণ আমার হয়েই গেছল।

ভবানীপুরের ঘোষ বাড়ি থেকে শোভাবাজারের বিশ্বাস বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার চওড়া রাস্তা থেকে উত্তর কলকাতার অলিগলি, আধুনিকতা থেকে বনেদিয়ানা, আমার রাস্তাটা এই পরিধিটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। পাশের মানুষটা কেমন হবে সেটার উপর সুতোয় বাঁধা আমার ভাগ্য, জীবনটা যন্ত্রের মতো হবে না মানুষের মত।

এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝেই বিয়ের লগ্ন এসে উপস্থিত।

**************

বিয়ের আগে খুব একটা কথাবার্তা, দেখা সাক্ষাৎ কিছুই হয়নি, সামনে সামনি দেখা একবার, ফোনে কথাও হাতে গোনা কয়েকবার। তাই, মানুষটাকে চেনা অসম্ভব।

পানপাতা সরিয়ে যখন ঐ চোখদুটোর দিকে তাকালাম, নাহ, আমার পেটের ভিতর কোনো প্রজাপতি ওড়েনি, বুকের ধুকপুকানি যেন অনেকটা ধীর হয়ে গেল।

কেমন যেন একটা ভরসার আভাস সেই চাহনিতে। মনের ভিতরের দ্বন্দ্বও যেন খানিকটা প্রশমিত হল। জানি না কী আছে সেই চাহনিতে, কিন্তু আমার মনটা এক অজানা কারণেই শান্ত হলো।

**************

হোমের আগুনে খই পোড়ানোর সময়, বা ঘটে রাখা হাতদুটো, প্রথম সেই মানুষটার ছোঁয়ায় উদ্বেলিত হচ্ছিল মনটা। সেই স্পর্শেও অন্যরকম একটা অনুভূতি পাচ্ছিলাম, সত্যিই আশা করিনি সেটা। প্রতিটা মেয়েরই সিঁদুর দানের পরের অনুভুতিটা আলাদা রকমেরই সুন্দর, হ্যাঁ, আমারও হচ্ছিল। চারপাশের আলোর রোশনাই আর সানাইয়ের মাঝে একটা দিনের জন্য এই বিশেষ ‘আমি’কে নিয়ে বিভোর হয়ে যাচ্ছিলাম, তারপরই ফটোগ্রাফারের চাহিদা অনুযায়ী পোজ দিতে গিয়ে সেই মানুষটা যখন তার হাত দিয়ে ধরল আমায়, বারবার তার দিকে তাকিয়ে, তার ছোঁয়ায় একটা কথাই মনে হচ্ছিল, খুব একটা খারাপও না।

।।২।।

গাড়িটা যখন শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে এগোল, পিছনে সমস্ত প্রিয়জন, আমার মা বাবা, সবাইকে ছেড়ে আমি চললাম এক, চোখটা একবারও ঝাপসা থেকে স্বচ্ছ হচ্ছিল না। হঠাৎই আমার হাতের উপর আর একটা হাত,”কষ্ট হচ্ছে জানি, কিন্তু এতো কাঁদলে তো শরীরটা খারাপ হবে, বুঝলে?” বলেই জড়িয়ে ধরল আমার হাতটা, সূর্য ।

হ্যাঁ, বলাই হয়নি নামটা এতক্ষণ, সূর্য , সূর্য বিশ্বাস ।

না, সেই ছোঁয়ায় কোনো কামনার স্পর্শ আমি পাইনি, তাই স্বামীরুপী অজানা পুরুষের ছোঁয়ায় কোন অস্বস্তি আমার হচ্ছিল না। বরং, গাড়ি যখন ছুটছিল তখন মনে হচ্ছিল, না, একা নই।

************** 


বিবাহের অজস্র আচার নিয়ম, বৌভাতের অনুষ্ঠানের পর ক্লান্ত হয়ে বসেছিলাম একটু। বাইরের ঘরে হৈ হট্টগোল তখনও, টুং করে ফোনে এসএমএস টা ঢুকল, “একটু রেস্ট করে নাও, কায়দা করে সকলকে তোমার ঘর থেকে সরালাম, বাই।”

না, নতুন বাড়ি, নতুন মানুষজন, ফুলের গন্ধ, ক্যাটারিং-এর সুবাস, লাল নীল আলো এসবের ভিড়ে নিজেকে সত্যিই আর একটুও একা লাগছিল না।

**************

ফুলশয্যার রাত্রে যখন আমার অস্বস্তিটা বুঝে পুরুষের পৈশাচিক রূপটা দেখাল না সূর্য , সত্যিই শান্তি পেলাম। না, সিনেমার মত, অন্য খাটে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েনি ও, বা এরকমটাও বলেনি, ‘আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি, এই বিয়ে শুধু বোঝাপড়ার’। না, ওসব রিল-লাইফ-এর নাটকের বিন্দুবিসর্গও ছিল না। বরং, অনেকটা বন্ধু পাতানোর গল্প ছিল, একে অপরকে চেনা, একটু একটু করে আবিষ্কার করার গল্প ছিল। আদিত্যর প্রথম ক্রাশ-এর গল্প, আমার প্রথম প্রেমপত্র!!

ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে যাওয়ার গল্প – এভাবেই কাটল রাতটা। বিছানায় সাজানো ফুল, বা ঘরের নিভু নিভু আলোটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মানুষ দুটোর দিকে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটাও আজ খুশী। কোথাও যেন এরেঞ্জড ম্যারেজের প্রথম রাতের শরীর সর্বস্ব মেকী ভালবাসার খেলাটা হার মানছিল একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সূচনার কাছে।

।।৩।।

গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল আমাদের সংসারটা। আমি খুব যত্নে, আস্তে আস্তে চিনছিলাম আমার পাশের মানুষটাকে। ভাল লাগছিল, কোনো দমকা হাওয়া ঝড়ের মত এসে এলোমেলো করে দিয়ে যায়নি আমায়, আমি চাইও নি এলোমেলো হতে, বরং একটু একটু করে তার পাশটাতে গোছাচ্ছিলাম নিজেকে। আমি ওকে নাম ধরে ডাকি না। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্যি। বরং ‘ও’ বলে সম্বোধন করতেই বেশী মিষ্টি লাগে আমার, আগের দিনের মানুষগুলোর মতো, এতে আমি যদি ব্যাকডেটেড, তবে তাই।

রান্নাবান্না যে খুব ভাল করি, তা কোনো কালেই না, কিন্তু কাল যখন আমার বানানো ওর পছন্দের আলু পোস্তটা ও তৃপ্তি করে খেয়ে প্রশংসা করলো সবার সামনে, আনন্দ তো কিছু কম হয়নি।

আমাদের ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় একটা ছোট্ট দোলনা আছে। রোজ খাওয়ার পর কিছুক্ষন হলেও আমরা আকাশের তারাগুলোর সাথে আড্ডা জমাই। সূর্য যখন আমার হাতের উপর আজ হাতটা রেখে বলল, “এইটুকু ছোট্ট হাতে এত সুন্দর রান্না করে মেয়েটা, সত্যি” বলে ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হাসল, একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছিল আমার মধ্যে। রাতের আকাশের মিটমিটে তারাগুলো সাক্ষী ছিল সেই মুহূর্তের, খুবই সাধারণ সেই মুহূর্ত, কিন্তু আমার জন্য সাধারণ ছিল না। এভাবে কখনো কোনো কথা কেউ বলেনি আমায়।

“তোমার ভাল লেগেছে?”

উত্তর কী হবে সেটা জেনেই নিতান্তই বোকার মত প্রশ্নটা করেছিলাম। বাচ্চাদের মত আদিত্য আমার গালটা টিপে বলল, “হ্যাঁ রে পাগলী”। ওর ব্যাকব্রাশ করা চুলে, ওর চোখে, ওর গালের হালকা দাড়ি, ওর হাসি, ওর কঠিন হাতের স্পর্শটা – না, কোনোদিন এভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকাইনি আমি। আজ তাকাতে ইচ্ছে করছিল, চেয়েছিলাম ওর দিকে। ও কথা বলে যাচ্ছিল, আর চাঁদের আভা যখন মুখের উপর পড়ছিল, সেই মায়াবী আলোয় কোথাও যেন মনে হচ্ছিল, এই তো সেই।

- “আচ্ছা, তুমি আমায় ফটো দেখে প্রথমেই পছন্দ করে ফেলেছিলে?”

-“হুম, বলতে পারো, তোমার ফটো দেখে এটাই মনে হয়েছিল, তোমায় জানতে হবে, তোমার?”

-“আমি সত্যি কনফিউজ ছিলাম, একটা ফটো দেখে সত্যি বুঝিনি কিছু, কিন্তু হ্যান্ডসাম।।। হুম, ভাল তো লেগেছিল। তুমি আমায় পছন্দ করবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”

-“কেন তুমি সুন্দরী নও?”

সূর্যর এই প্রশ্নের টানে, আর চোখের চাহনিতে কী যেন একটা নেশা ছিল, বললাম,”জানি না, কেউ কোনদিন সেভাবে বলেনি।”

আমার মুখের উপর পড়া চুলটা সরিয়ে ও বলল, “তুমি নিজে জানোই না তুমি কতটা সুন্দর”।

ওর এই কথা, আর আমার মুখে, ঠোঁটে লেগে থাকা ওর হাতের স্পর্শ – পাগল হচ্ছিলাম আমি। আমার শরীরে শিরা উপশিরায়, যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছিল রক্ত, ওর ছোঁয়ায়। হয়তো আমার চোখ, আমার অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল আমি ওকে কতটা চাই এখন। ওর জন্য, শুধু ওর জন্য অপেক্ষা করতেও এখন আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে। ফোনের ভাইব্রেশনে তাল কাটল। ও ব্যস্ত হয়ে গেল ওর অনেকদিন পর ফোন করা পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে গল্পে আর আমি অনেকটা ভালোলাগা নিয়ে চোখ বুজলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance