arundhati bhattacharya

Classics

5.0  

arundhati bhattacharya

Classics

সমান্তরাল

সমান্তরাল

3 mins
565


আর মাত্র কয়েকটা স্টেশান।তবু দূরত্ব যেন আর কমছে না।আজ বাইশ বছর পর আর্য বাড়ি ফিরছে।বাইশ বছরের বাস্তুহারা জীবন তাকে নানা উপত্যকায় বার বার এনে ফেলেছে...শুধু বাস্তুভিটায় সে অর্থে ফিরতে দেয়নি।ডাক্তারির সূত্রে প্রথমে দিল্লী,তারপর গুজরাটা হয়ে মুম্বাই...এরপর প্রবাস দীর্ঘতর হয় পেনসিলভেনিয়ায় যাবার পর।দিল্লীতে থাকাকালীন সহপাঠিনী রুচিরার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায়।তার দু বছরের মাথায় তিতির,পাঁচ বছরের মাথায় শাক্য আসে তাদের সংসারে।ভরা সংসারে ঘিরে থাকতে থাকতে শাক্যের জন্মের বছর যেন পালা বদল করে চলে যায় মা...তারপর বাবা।নৈহাটির এই বাস্তুভিটায় তখন প্রোমোটারের শ্যেন দৃষ্টি।বাসভূমি বিক্রি হয় না...এ বোধ তার চেতনালব্ধ,বুঝত কাঁকন।পরিচিতরা নানা পরিচয়ে ততদিনে বেশিরভাগই মুখোশ হয়ে গেছে।এমনকি সেও মুখোশ হয়ে গেছে রুচিরার কাছে...তিতির-শাক্যের কাছে।

   সেবার বাড়ির ট্যাক্স ইত্যাদি মেটাতে সে এসেছিল।তিন-চার বছরে একবার আসত ও...এইসব ভৌমিক কাজে।স্টেশন থেকে তাদের বাড়ি হেঁটে মিনিট কুড়ি লাগে।আর্য রিক্সা নিয়েছিল।ভাদ্রের গরম ততদিনে অনভ্যস্ত অস্বস্তিতে কাহিল করে ফেলেছিল ওকে।বাড়ির চাবি,দরকারি কাগজপত্র থাকে বাবার বাল্যবন্ধু প্রমথেশ জ্যাঠার কাছে।এটা তাদের মফস্বল জীবনের বান্ছিত অভ্যেস।তাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই প্রমথেশ জ্যাঠার বাড়ি।রিক্সা থেকে নামতে নামতে আর্য আরও একবার তীব্রভাবে বুঝতে পারল,সে প্রবাসী হয়ে গেছে।তার বাস্তুতে আর কোনো শিকড় হয়ত থাকবে না।থমথমে কান্না,ধূপের গন্ধ,রজনীগন্ধার আয়োজন পার করে জ্যাঠার মৃতদেহের কাছে পৌঁছানোটা খুব সহজ ছিল না আর্যর কাছে।সহজ নয়,কারণ আজ থেকে কাঁকন ঘোষিতভাবে অনাথ হলো।বিয়ে হয়নি, না হয়ে ওঠেনি...এই দ্বন্দ্বে যেতে ভয় পেত আর্য।কাঁকনদের তেমন আত্মীয়স্বজন বিশেষ ছিল না।পাড়া-প্রতিবেশীই দাহকার্যের দায়ভার ভাগ করে নিয়েছিল।মুখাগ্নি করল কাঁকন।চেতনা জুড়ে অন্য এক মুখাগ্নির তাপ ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওকে।গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরতে রাত ভোর হয়ে এলো।বাড়ি ফিরেই আর্যর হাতে ওদের বাড়ির চাবির গোছাটা দিয়ে বলেছিল কাঁকন,

-- ট্যাক্সের কাগজপত্র এদিকটা একটু সামলে...

    আর্য তো সব কথা প্রবাসেই ফেলে এসেছে।সেই ডাক্তারি জীবনের প্রথম থেকেই,কিম্বা কলেজজীবনের ঋতুবদলে...রুচিরার প্রবাস থেকে তো সে মুক্তি চায়নি!তাই কাঁকনের বসতভিটায় চাবি অনেক,কিন্তু তাতে একটা ঘরও খোলা যায় না।হঠাৎ কোনো একটা চাবি দিয়ে ঘর খুললে দমবন্ধ করা রজনীগন্ধা -জুঁই এর গন্ধ শ্বাসরোধ করে আর্যর।

   রুচিরা সেদিন প্রথমবার আর্যকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আগ্রাসী প্রতিফলন ছিল আর্যর চেহারায়।অপছন্দের জীবন তখনও তেমনভাবে স্পর্শ করেনি তাকে।ভাবি বিবাহবাসরের মশগুল মায়ায় নিবিড় ছিল সে সন্ধ্যা...তাই রাত্রির আগমন টের পেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।শেয়ালদায় এসে কোনোরকমে উঠেছিল ভেন্ডার কম্পার্টমেন্টে।রানাঘাট লোকাল...ভেন্ডার কম্পার্টমেন্টে ছানার জলের গন্ধ নেই!!...অবাক হয়ে আর্য দেখেছিল কামরা ভরতি ফুল!অসংখ্য ঝুড়ি আর প্লাস্টিকের খোলা বস্তায় রজনীগন্ধা, জুঁই আর গোলাপের স্তুপ।বোধহয় বিয়ের মরশুমে যোগানে যাচ্ছিল,সেইসব ফুলেরা।বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে।ছাঁটে আধ ভেজা হয়ে কোনোরকমে বসেছিল ও ফুলকারবারিদের পাশে...সাকুল্যে জনা আষ্টেক যাত্রী।ছিল এক মাতাল ডোম...সরকারী ডোম।ট্রেন চলছিল ঢিমেতালে।সুরারোপিত স্নায়ুদেশ...বিহবল হৃদ্কথা...কাব্য রচনা করল সেই ক্ষীণকায় মাতাল....

"খোয়া খোয়া চাঁদ...খুলা আসমান..."...

বৃষ্টি তখন থেমেছে।ভেজা জ্যোৎস্নায় চন্দ্রাহত ওভারহেডের তার পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করেছে...ট্রেন দাঁড়িয়েছে নির্ধারিত মানচিত্রের বহির্ভূমিতে।মাতাল ডোম,ফুলকারবারিদের সঙ্গে আর্যর বিমূর্ত সেতু নির্মাণ করেছিল সেই আবহ।যেখানে কোনো ফুলের কারবারি একটা কথাও বলেনি...নিঃশব্দে দেখছিল মাতাল মানুষটা কীভাবে সব হারিয়ে বসে থাকে " খোয়া খোয়া চাঁদে"...ছেলেবেলায় মায়ের কাছে গানের তালিম পেয়েছে আর্য...সেদিনের সেই স্থবির ভেন্ডার কম্পার্টমেন্টে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের নিয়তি - সজ্জার ফুলের গন্ধে এক বিচিত্র শুদ্ধ চেতনায় আর্য ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছিল আরেক নারীকে...সে নারী তার...তারই...কিন্তু সেখানে তার বসত গড়ে উঠবে না!যমুনার তীরে নীলাম্বরী রাধার কোমরের বাঁকে বর্ষনস্নাত ট্রেনটি দাঁড়িয়ে তখনও...জুঁই এর ঝুড়িতে মাথা এলিয়ে উদাত্ত আর্য গেয়ে উঠেছিল,

"ক্যায়া করু সজনী...আয়ে না বালাম্"...

   ট্রেন সাড়া দিয়েছিল আরও ঘন্টা দেড়েক পরে।ফুলকারবারিদের কমদামী মদে আর্যর চেতনা মগ্ন হচ্ছিল তার তৃতীয় ভুবনে...তার আত্মায় নিমজ্জিত হচ্ছিল কাঁকনের শরীর...মন্থনের অমৃত আর হলাহল সমান্তরাল ভাবে বইতে থাকে আর্যর সত্তা জুড়ে।বাড়ির সামনে পৌঁছাতে প্রায় রাত দুটো বেজে যায়।তার বাড়ি ঢোকার মুহূর্তে মুখোমুখি বারান্দায় কাঁকন দাঁড়িয়ে থাকে...বরাবর।নিঃশব্দ সেই মুহূর্তকে নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠত!প্রাগৈতিহাসিক নৈঃশব্দের কোনো অবয়ব থাকেনা...তাই সেইসব প্রশ্নোত্তর শুধু অনুমানেই থেকে গেছে আর্যর কাছে!সেই রাতে সে এসে দাঁড়িয়েছিল কাঁকনের বারান্দার সামনে। পা টলছিল।গ্রিলের বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছিল কাঁকনের কোমর...ডুবিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট... ফুলকারি গ্রিলের ব্যবধানে ঘটে চলেছিল অন্য এক মন্থন...স্খলিত স্বরে জানিয়েছিল আর্য,

 --রুচিরার সঙ্গে...

বড়ও মমত্বে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিল কাঁকন।নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়নি ওর বাহুডোর থেকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলেনি।শুধু বলেছিল,

 -- এমন অসুখ বাঁধালে কীভাবে?অসুখের কষ্ট সইতে পারবে?

   অন্ধকার ভোরে ফিরে এসেছিল আর্য।পরেরদিন নিয়ম মতোই সব কাজ করেছিল।শুধু পরেরদিন কেন,নিয়মভঙ্গ করেইনি সে...আজীবন অশৌচের ধরা পরেছিল...সেই রাত্রে তার দেহান্তরে ভেন্ডার কম্পার্টমেন্টের এক অলীক ফুলসজ্জায় জন্ম নিয়েছিল এক ভ্রূণ...প্রেম নয়,তার সমান্তরালবোধে সেই রাত্রেই জন্ম নিয়েছিল তার শিকড়...তার ভ্রূণ...যেখানে মাতাল হয় 'খোয়া খোয়া চাঁদ'...যেখানে যমুনাতীরে নীলাম্বরী রাধার 'আয়ে না বালম্'...বুঝি গহন মৃত্যু হয় সেই ভ্রূণের...সেই রাত সমান্তরালবোধে আজও বয়ে নিয়ে চলেছে তার চির অশৌচ...চির তর্পণ...


Rate this content
Log in

More bengali story from arundhati bhattacharya

Similar bengali story from Classics