সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
ঝিলম আড়চোখে দেখল, ছেলেটা তার এগরোলের দোকান থেকে কী একটা হাতে নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে তার দিকে তড়িঘড়ি আসছে।
হ্যাঁ, সে যখন স্কুল থেকে ফেরে, সে খেয়াল করে দেখেছে, ছেলেটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু না, কোনও দিন ও তাকে কিছু বলেনি! এমনকী কোনও দিন কোনও ইশারাও করেনি।
সে শুনেছে, কোনও ছেলে যদি কোনও মেয়েকে প্রোপোস করে আর সেই মেয়ে যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে, তা হলে নাকি এমন অনেক ছেলে আছে, যারা সেটা মেনে নিতে পারে না। ওই প্রত্যাখ্যানটাকে অপমান বলে মনে করে। তাই ছলে বলে কৌশলে তাকে রাজি করানোর জন্য যাতায়াতের পথে তাকে রাস্তার মধ্যে ধরে। কেন সে রাজি নয়, জিজ্ঞেস করে। তার সম্পর্কে কেউ তাকে কোনও আজেবাজে কথা বলেছে কি না, জানতে চায়। নানা রকম ভাবে বোঝায়। কাকুতি-মিনতি করে। তাতে কাজ না হলে তাকে রাস্তায় যেতে দেখলে তার পিছন পিছন যায়। ফোন নম্বর জোগাড় করে বারবার ফোন করে। তাতেও কাজ না হলে ভয় দেখায়। জোর-জুলুম করে। তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এবং শেষ পর্যন্ত যখন আর কোনও পথ খোলা থাকে না, তখন 'আমি না পেলে অন্য কেউ যাতে তার দিকে আর ফিরেও না তাকায়, তার ব্যবস্থা করব', ঠিক করে অ্যাসিড বাল্ব ছুড়ে মেয়েটার মুখ বীভৎস করে দেয়। তা হলে কি ওই ছেলেটা সেই অ্যাসিড বাল্ব মারার জন্যই তার দিকে আসছে! আরও দ্রুত পা চালাল ঝিলম।
ক্লাস এইট পর্যন্ত ওর মা-ই ওকে স্কুলে দিয়ে আসত। নিয়ে আসত। নাইনে উঠার পর ঝিলমই বলেছিল, এ বার থেকে আমি একা-একাই যাতায়াত করতে পারব। ওর বাবাও তাতে সম্মতি দিয়েছিল। বলেছিল, ও তো বড় হচ্ছে! ওকে এ বার একটু একা-একা ছাড়ো। সারা জীবন তো তুমি ওকে এই ভাবে আগলে রাখতে পারবে না। একদিন না-একদিন ছাড়তেই হবে। আর ছাড়তেই যখন হবে, তখন না-হয় একটু আগে থেকেই ছাড়ালে! কতটুকু আর রাস্তা! ও যখন বলছে একা-একা যাতায়াত করতে পারবে, তখন তোমার অসুবিধে কোথায়?
তার পর থেকে ও একা-একাই স্কুলে যায়। আসে। কখনও-সখনও যাওয়ার সময় এবং ফেরার সময় দু'-চার জন বন্ধু পেয়ে যায়। আগে মাঝে মধ্যে বাবিন থাকত। পাশের পাড়ার ছেলে। ওর সঙ্গে কোচিংয়ে পড়ত। প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের গেট থেকে একেবারে বাড়ির দোরগোড়া অবধি পৌঁছে দিত। একদিন যখন ওকে পৌঁছে দিয়ে ফিরছে, তখন নাকি ওই ছেলেটা বাবিনকে মাঝপথে ধরে খুব আস্তে আস্তে অথচ অত্যন্ত কর্কশ গলায় বলেছিল, ও তোর কে হয় রে?
বাবিন বলেছিল, বন্ধু।
ছেলেটা বলেছিল, বন্ধু? তোর চালচলন ওই বন্ধুত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখ। তার থেকে বেশি এগোস না, কেমন? এমন কিছু করিস না, যাতে আমাকে আবার পুরনো রূপ ধরতে হয়, বুঝেছিস?
বাবিন কী বুঝেছিল, ঝিলম জানে না। তবে তার পর থেকে বাবিন আর ওর ধারেকাছেও ঘেঁসেনি। বাবিন না থাকলেও, ওর ক্লাসের না হলেও, ওর স্কুলের কোনও না-কোনও বন্ধু, যাদের বাড়ি ওর বাড়ির দিকে, তারা ওর সঙ্গে প্রায়ই থাকে। কিন্তু আজ ও একা। একদম একা। একা-একাই বাড়ি ফিরছে।
একবার এক বাইক চালক রাস্তা ফাঁকা থাকা সত্বেও ঝিলমের পাশ দিয়ে এমন ভাবে ফুল স্পিডে কায়দা করে গিয়েছিল যে, আর একটু হলেই ঝিলমের গায়ে লাগত। সে দিন সেই বাইক চালক যখন ফিরছিল, তক্কে তক্কে থেকে ও তাকে ধরেছিল। কী বলেছিল, কেউ জানে না। তবে সেই চালক তার পর থেকে চিরজীবনের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল ওই পথ।
ছেলেটার একটা এগরোলের দোকান আছে। ফুটপাথের ওপর। বিকেলের পরে খোলে। কিন্তু দুপুর থেকেই তার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আনাজপাত্র কাটাকাটি, ময়দা মেখে রাখা, মোমো রেডি করা।
না, ও দামি কোনও জিনিস ব্যবহার করে না। বেলার দিকে বাজার উঠে যাওয়ার সময় প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্যাপসিকাম, ফেলে দেওয়ার মতো ছালবাকড় ওঠা গাজর, হলুদেটে হয়ে যাওয়া পাকা-পাকা শশা কিনে আনে। শসও তাই। আগে একটা মাঝবয়সী লোক সাইকেল করে এসে কম দামের টমেটো শস, চিলি শস, কাসুন্দি দিয়ে যেত। এখন আরও অনেক সস্তায় পাউচ প্যাকে যে হাফ কিলো করে শস পাওয়া যায়, ও সেগুলোই কেনে। মাদার ডেয়ারির মতো সেই প্যাকেটগুলোর একটা কোণ দাঁত দিয়ে টান মেরে ছিঁড়ে কিসানের লেবেল লাগানো বোতলে ভরে রাখে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে, ও শস্তার মাল দিচ্ছে।
ছেলেটা আগে আরও খারাপ ছিল। আশপাশের কোনও এলাকায় নতুন কোনও বাড়ি শুরু হলেই দলবল নিয়ে চড়াও হত। বলত, আমাদের কাছ থেকে বালি-সিমেন্ট নিতে হবে। বলত ঠিকই, কিন্তু ওরা তো ইমারতির কারবার করত না। ইনভেস্ট করার মতো অত টাকাও ছিল না। যখন অর্ডার পেত, তখন পাড়ার লুচ্চাদাকে বলে ওর দোকান থেকেই মালগুলো সাপ্লাই দিত। মাঝখান থেকে নিজেরা একটা লামসাম কাটমানি খেত।
ইট, সিমেন্ট, লোহার রড লুচ্চাদার কাছ থেকে নিলেও, সরাসরি বেশি লাভ করার জন্য কিছু দিন পর থেকে ওরা নিজেরাই দামোদর থেকে ট্রাকে করে বালি এনে সাপ্লাই দিতে লাগল। আর যারা ওদের কাছ থেকে মাল নিতে চাইত না, তাদের কাছে ওরা মোটা টাকা দাবি করত। না দিলেই হুজ্জুতি করত। জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দিত।
না, বাড়ি নির্মাতা বা প্রোমোটাররা থানা পুলিশ করে ওদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করতে পারত না। কারণ, ওরা বুঝতে পেরেছিল, এ সব করতে গেলে শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকতে হবে। তাই তত দিনে তারা স্থানীয় কাউন্সিলরকে ফিট করে ফেলেছিল। কাউন্সিলরকে ধরে শুধু লোকালেরই নয়, আশপাশের এম এল একেও কব্জা করে ফেলেছিল। সবাইকেই যে ওরা বখরা দিত, তাও নয়। ওদের হয়ে কাজ করত। কারও কারওকে ভয় দেখাত। চমকাত। ডাকামাত্র দল বেঁধে বাইক নিয়ে হাজির হয়ে যেত। কোথাও কোনও গণ্ডগোল হলেই ওরা ঝাপিয়ে পড়ত। ভোটের সময় জান লড়িয়ে দিত।
একদিন সে রকমই এক প্রমোটারকে চমকাতে গিয়ে সেই প্রোমোটারই যখন উল্টে ওদের চমকাতে লাগল, এই এম এল এ, ওই এম পি দেখাতে লাগল, তখন আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না ওরা। যখন বুঝতে পারল, এর কাছ থেকে টাকা বের করা খুব মুশকিল, তখনই ওরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিল।
না, শুধু টাকা দিচ্ছে না বলে নয়, কেউ তাদের মুখের উপরে 'না' বলার মতো হিম্মত দেখিয়েছে, আর এই হিম্মতের কথা যদি কোনও ভাবে চাউর হয়ে যায়, তা হলে ওদের অবস্থা একেবারে বারোটা। অন্য প্রমোটাররাও এক-এক করে সেই হিম্মত দেখাতে শুরু করবে। তাই তাদের মুখের উপরে আর কেউ যাতে কখনও 'না' বলতে না পারে, বললে তার পরিণাম যে কত ভয়ংকর হতে পারে, শুধু সেই বার্তাটুকু বাকি প্রোমোটারদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই, ওদের মধ্যে থেকেই একজন--- যেটা শুধু ভয় দেখানোর জন্যই ওরা সঙ্গে রাখত, কোমর থেকে সেই পাতি ওয়ান শার্টারটা বের করে ফটাস করে চালিয়ে দিয়েছিল সেই প্রোমোটারের কপালের ঠিক মাঝখানে।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ওই গুলির শব্দে শুধু ওই বিল্ডিংয়ে কাজ করতে থাকা রাজমিস্ত্রি আর হেলপাররাই নয়, ছুটে এসেছিল আশপাশের লোকেরাও। বাকিরা পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে গিয়েছিল ওদের দলেরই একজন। তাকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বেঁধে পাবলিক এমন মার মেরেছিল যে, আর দু'ঘা দিলে বুঝি মরেই যেত। সে দিন লোকজন এতটাই মারমুখী হয়ে উঠেছিল যে, সেই ছেলেটাকে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য লোকাল ওসিকে আশপাশের থানা থেকে ফোর্স আনতে হয়েছিল। চালাতে হয়েছিল লাঠি। ফাটাতে হয়েছিল তিন-তিনটে কাঁদানে গ্যাসের শেল।
তাকে জেরা করেই বাকিদের গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তখনই ওরা জেনেছিল, ওরা আস
লে কোনও প্রোমোটারের নয়, প্রোমোটারের ব-কলমে শাসক দলের এক দাপুটে মন্ত্রীর লেজে পা দিয়ে ফেলেছে।
ভাগ্যিস সে দিন এই ছেলেটি ছিল না! তাই প্রথমে গ্রেপ্তার হলেও সাত দিন পিসিতে কাটালেও, শেষপর্যন্ত প্রমাণের অভাবে ও বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছিল।
তার পর থেকেই ও নাকি একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায়। ঘোরার আর একটা কারণ, যে মেয়েটির সঙ্গে ও মিশত, সেই অপর্ণাকে নিয়ে তার বাবা-মা রাতারাতি এলাকা ছেড়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল! হাজার খুঁজেও ও আর তার হদিশ পায়নি। না, যে মোবাইলটা ও মেয়েটিকে গিফট করেছিল, সেই নাম্বারটায় ফোন করলেও বারবার ভেসে আসছিল রেকর্ডেড ভয়েস--- আপনি যে নম্বরে ফোন করছেন, সেই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই...
তার পরেই ছেলেটা একেবারে পাল্টে গেল। ওই সব মস্তানি-টস্তানি ছেড়ে যেটুকু টাকাপয়সা ছিল তার সঙ্গে বাইক বিক্রির টাকা দিয়ে রাস্তার উপরে একটা এগরোল-চাওমিনের দোকান করে বসল। এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সেটা বেশ রমরম করে চলতেও লাগল।
বিকেলের পর থেকে চালু হলেও দুপুরের অনেক আগেই ও দোকানে চলে আসত। খাবারদাবার তৈরি করত ওরই এক পুরনো বন্ধু। সে নাকি আগে একটা ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করত। তিন বছরেও এক পয়সা মাইনে বাড়ায়নি দেখে কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে এসেছিল। সত্যি কথা বলতে কি, তারই পরামর্শে ও এই এগরোলের দোকানটা খুলেছিল। পুরোটা সে সামলালেও তার হাতে হাতে ও অনেকটা কাজ এগিয়ে দিত।
ঝিলম বুঝতে পারে, সে যখন স্কুল থেকে ফেরে ছেলেটি তখন তাকে হাঁ করে দেখে। আজও দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ কী হল তার? ও ভাবে পড়িমড়ি করে তার দিকে এগিয়ে আসছে কেন! তা হলে কি আজ তাকে ও প্রপোজ করবে! যদি করে, তা হলে কী বলবে সে! কী বলবে!
ও যেতে যেতে না তাকিয়েও বুঝতে পারল, ছেলেটি তার একদম পিছনে চলে এসেছে। সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ালে না-হয় একটা কথা ছিল। পাশে হাঁটতে হাঁটতে আর পাঁচটা ছেলের মতো বিড়বিড় করে, কী বলতে চাইছে, স্পষ্ট করে শোনা যাক, আর না যাক, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তার উদ্দেশ্য কী!
কিন্তু ও পিছনে কেন? তা হলে কি ও পিছন দিক থেকে তার গায়ে অ্যাসিড বাল্ব ছুড়ে মারবে! বা সে রকম কিছু করবে!
যারা খারাপ হয়, যারা একবার খারাপ পথে চলে যায়, অপরাধের খাতায় যাদের নাম একবার উঠে যায়, সাত দিন কেন, একদিনের জন্য হলেও যদি লকআপে থাকে, তারা যতই ভাল হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের ভিতরের সেই 'খারাপ'টা কিন্তু মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তা হলে কি সেই খারাপটাই ওর ভিতরে এখন নড়েচড়ে উঠেছে! কী করতে পারে ও! কী করতে পারে! ও কিছু করার আগেই কি সে চিৎকার করবে! লোকজন জড়ো করবে! নাকি একবার দেখবে, ও কী করতে চায়!
ভাবামাত্র ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ঝিলম। আর ঘোরার আগেই বুঝতে পারল, হাফ কিলোর একটা টমাটো শসের পাউচ দু'হাতে চেপে এমন জোরে ফচাৎ করে ও ফাটাল যে, একেবারে পিচকারির মতো ঝপাৎ করে এসে তার স্কার্টের পেছনটা একেবারে ভরিয়ে দিল।
ছেলেটা যে এ রকম নক্ক্যরজনক একটা কিছু করতে পারে, সে তা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই তার কী করা উচিত সেটা ভেবে ওঠার আগেই, ছেলেটি বলে উঠল, সরি সরি সরি। বুঝতে পারিনি গো। কিছু মনে কোরো না। একটা কাজ করো, বিচ্ছিরি ভাবে শসটা স্কার্টে লেগে গেছে তো, বলেই, নিজের ফুলহাতা জামাটা ঝপ করে খুলে ঝিলমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জামাটা দিয়ে পেছনের দিকের স্কার্টটা ঢেকে জামার হাতা দুটো সামনের দিকে টেনে নিয়ে গিঁট দিয়ে নাও, তা হলে আর কোনও অসুবিধা হবে না। পারলে জামাটা পরে আমাকে ফেরত দিয়ে যেও, কেমন? ওই যে এগরোলের দোকানটা, ওখানে দিলেই আমি পেয়ে যাব।
ঝিলম বুঝতেই পারল না, ছেলেটা এ রকম কেন করল। আর করলই যদি, তা হলে ও কেন ওর জামাটা খুলে তাকে দিল! কাজটা করার সময় ঝোঁকে পড়ে করে ফেলেছে। কিন্তু করার পরেই হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। জানে তো, পাবলিকের মার কাকে বলে। তার এক বন্ধু এক প্রোমোটারকে গুলি করার পর পাবলিকের হাতে ধরা পরে কেমন মার খেয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেছে... নাঃ, এই সব ছেলেদের সঙ্গে কখনও মুখ লাগাতে নেই। কী থেকে কী হবে কিচ্ছু বলা যায় না। তাই ছেলেটার কথা মতোই স্কার্টটা ঢেকে জামাটা পেছন দিকে ঝুলিয়ে হাতা দুটো সামনে টেনে নিয়ে গিঁট দিয়ে নিল। তার পর হনহন করে পা চালাল বাড়ির দিকে।
দোকানে আসতেই ওর দোকানে যে বন্ধুটি কাজ করে, সে বলল, তুই ওটা কী করলি? তোকে এখন এ সব মানায়? একটা বাচ্চা মেয়ে! এ বার তুই আবার একটা বিচ্ছিরি ঝামেলায় জড়াবি।
--- কীসের ঝামেলা?
--- তুই কি ভেবেছিস ও বাড়ি গিয়ে ওর বাবা-মাকে কিছু বলবে না? আর ও যদি ওর বাবা-মাকে বলে, তারা কি চুপচাপ বসে থাকবে?
--- থাকবে।
--- থাকবে? তোর এই গা-জোয়ারি মস্তানির যুগ কিন্তু আর নেই, এটা মনে রাখিস।
--- মনে আছে।
--- মানে?
--- আসলে মেয়েটাকে আমি প্রায়ই দেখি। খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে। একেবারে অপর্ণার মুখটা বসানো...
--- সে কী রে! এখানে আবার অপর্ণা এল কোথা থেকে! আর তা ছাড়া অপর্ণার বয়েস আর এর বয়েস?
--- না, বয়সের কথা বলছি না। বলছি, মুখটার কথা। ভাল করে দেখলে বুঝতে পারবি, এর মুখটা একেবারে অপর্ণার মতো। ওর মধ্যে আমি অপর্ণাকে দেখতে পাই। আমি ওকে রোজ দেখি। আজও দেখছিলাম, হঠাৎ দেখি, ওর স্কার্টের পিছন দিকটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।
--- রক্তে?
--- হ্যাঁ, রক্তে। এটা আজই বোধহয় ওর প্রথম হল। তাই হয়তো ও টের পায়নি। বাচ্চা তো! কিন্তু যারা ওকে দেখছিল, তারা মুখ টিপে টিপে হাসছিল। ওরা হয়তো ভুলেই গেছে, ওদের বাড়িতেও মেয়ে আছে। এবং একটা সময়ের পর প্রত্যেকটা মেয়েরই এটা হয়। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এটা নিয়ে হাসাহাসি করার কিছু নেই। আজ যদি তাদের বাড়ির কোনও মেয়ের এ রকম হত, তা হলে কি ওরা এই ভাবে হাসতে পারত? তাই ওকে দেখে আর কেউ যাতে হাসাহাসি করতে না পারে, সে জন্যই আমি এটা করলাম।
--- এ ভাবে নাটক না করে, সেটা তো ওকে গিয়ে ডাইরেক্ট বলতে পারতিস।
ছেলেটি বলল, ওটা সরাসরি বলতে গেলে যে শিক্ষার দরকার, যে বুকের পাটা দরকার, গুছিয়ে কথা বলার মতো যে যোগ্যতা থাকা দরকার, সে সব আমার নেই। তাই আমি যে ভাবে পেরেছি, সে ভাবেই হাস্যকর হয়ে ওঠার হাত থেকে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আজ হয়তো ও আমাকে খারাপ ভাববে। ভাবুক। কিন্তু আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, ও ঠিকই একদিন না-একদিন বুঝতে পারবে, আমি কেন এটা করেছিলাম।
ওর কথা শুনে দোকানের বন্ধুটা একেবারে থ' হয়ে গেল। আর, যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে ও ফের দোকানের কাজে হাত লাগল।