শামসুদ্দিন জিদান শাহ
শামসুদ্দিন জিদান শাহ
জিদানবাদ পরগণা তখন ছিল সবুজে মোড়ানো এক জলপথের দেশ—চারিদিকে মেঘনার জল, ধানক্ষেত আর ঘন বন। এখানকার মানুষ ছিল শান্ত ও মিতভাষী। এই পরগণার শাসনভার ছিল মাত্র দশ বছরের এক বালক, শামসুদ্দিন জিদান শাহ-এর হাতে। সবাই তাকে ভালোবাসার সাথে 'ছোট নবাব' বলে ডাকতো।
জিদান শাহের বাবা নবাব হায়দার শাহ অকালে মারা যাওয়ার পর, রাজদরবারের বয়স্ক উজির নাদির খাঁ-এর তত্ত্বাবধানে সে সিংহাসনে বসেছিল। উজির খাঁ দেখতে বেশ ধার্মিক হলেও, তার মনে ছিল সিংহাসন দখলের গোপন লোভ।
এক বিষাক্ত ফন্দি
জিদান শাহ ছিল প্রকৃতিপ্রেমী। তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল একটি পোষা ধূসর রঙের শঙ্খচিল, যার নাম ছিল 'বাজ'। বাজ প্রতিদিন নবাবের হাতে খাবার খেয়ে মেঘনার পাড়ে উড়ে যেত এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসতো।
এক রাতে, উজির নাদির খাঁ এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি দরবারকক্ষে গোপনে ষড়যন্ত্র আঁটলো। নাদির খাঁ জিদান শাহকে মেরে নিজেই সিংহাসন দখল করতে চাইল। তাদের ফন্দি ছিল: পরদিন সকালে নবাব যখন নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাবেন, তখন বাজকে ব্যবহার করে একটি বিষাক্ত তীর নবাবের দিকে ছোড়া হবে।
বাজের সতর্কতা
পরদিন খুব ভোরে, জিদান শাহ 'বাজ'কে ডাকলো। বাজ খাবার খেতে আসতেই সে দেখলো, নাদির খাঁ লুকিয়ে বাজের ডানায় একটি অতি সূক্ষ্ম বিষাক্ত কাঁটা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজ কাঁটাটি টেনে ফেলে দিল এবং অত্যন্ত দ্রুত বেগে নবাবের মুখোমুখি এলো। তার চোখে ছিল অস্থিরতা এবং সে তার ঠোঁট দিয়ে বারবার নবাবের হাতের চামড়া আঁচড়ে দিতে লাগলো, যেন কিছু বলতে চাইছে।
নবাবের মন খুবই সংবেদনশীল ছিল। বাজের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে তিনি কিছুটা থমকে গেলেন। তার মনে হলো, কোনো বিপদ আসছে। তিনি তার দেহরক্ষীকে নির্দেশ দিলেন: "আজকের নৌকাভ্রমণ বাতিল করা হোক। তোমরা সবাই প্রস্তুত থাকো, দরবার অভিমুখে নজর রাখো।"
ষড়যন্ত্র ফাঁস
নবাব যখন দরবারকক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে নাদির খাঁকে পাওয়া গেল না। কিন্তু নবাব দেখলেন, নাদির খাঁর সেনাপতি সভাকক্ষের এক কোণে অত্যন্ত অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করছে।
নবাব শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বাজপাখির আচরণ এবং তার ডানায় বাঁধা কাঁটার কথা তুলে ধরলেন। নাদির খাঁর সেনাপতি ধরা পড়ার ভয়ে তৎক্ষণাৎ মেঝেতে পড়ে গিয়ে স্বীকার করলো যে, উজির নাদির খাঁ তাকে বিষাক্ত কাঁটাটি দিয়েছিলেন।
জিদান শাহ বুঝতে পারলেন, উজির খাঁ পালিয়েছে। দ্রুত সেনাদল পাঠানো হলো, এবং জিদানবাদ পরগণার সীমান্ত থেকে নাদির খাঁকে বন্দি করা হলো।
জিদানবাদের ন্যায়বিচার
ছোট নবাব জিদান শাহ তার বিচক্ষণতা ও বিশ্বস্ত পাখি 'বাজ'-এর সাহায্যে তার জীবন এবং তার পরগণাকে রক্ষা করলো। সে উজির খাঁকে কঠোর শাস্তি দিল এবং ঘোষণা করলো:
"কেবল তরবারি আর বয়স দিয়ে নবাব হওয়া যায় না। নবাব হতে হলে চাই ন্যায়ের প্রতি আস্থা এবং মানুষের প্রতি মমতা। আজ থেকে আমার পরগণা কেবল জিদানবাদ নয়, এটি হবে 'ন্যায়-জিদানবাদ'—যেখানে ছোট-বড় সবাই ন্যায় পাবে।"
সেই থেকে শিশু নবাব শামসুদ্দিন জিদান শাহ তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং ন্যায়ের শাসনের জন্য জিদানবাদ পরগণার লোককথায় কিংবদন্তী হয়ে রইলেন।
