Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

স্বপ্নপূরণ

স্বপ্নপূরণ

4 mins
782


করতালিতে ফেটে পড়ছে ইণ্ডোর স্টেডিয়াম। রঙীন আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে অনুষ্ঠান মঞ্চ। চলছে "নতুন কন্ঠ" রিয়েলিটি শোয়ের ফাইনাল, আয়োজক অল ইন্ডিয়া মিউজিক চ্যানেলের বাংলা উইং। কে হবে প্রথম? টানটান উত্তেজনায় সারা বাংলা। কে হতে চলেছে বাংলার "নতুন কন্ঠ", তারপর ছাড়পত্র পাবে ভারতের "নতুন কন্ঠ" মেগা ইভেন্টের ফাইনালে সরাসরি গান গাওয়ার সুযোগ! পুরো অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হচ্ছে। স্টেডিয়ামে যত দর্শক, তার থেকে কয়েকগুন বেশী দর্শক বসে রয়েছে নিজের নিজের টিভি সেটের সামনে। অনুষ্ঠান মঞ্চের জায়ান্ট স্ক্রিনে শুরু হয়েছে কাউন্ট ডাউন। ফলাফল ঘোষণার জন্য সঞ্চালক এবার মাইক্রোফোনের সামনে। দর্শকের উত্তেজনার বাঁধ ভেঙে পড়ছে। টেন - নাইন - এইট - সেভেন - সিক্স - ফাইভ - ফোর -থ্রি - টু - ওয়ান - জিরো। উইনারদের ছবি ভেসে উঠছে স্ক্রিনে। সাথে সঞ্চালকের ঘোষণা। তুমুল হাততালি। সেকেণ্ড রানার আপ.... ফার্স্ট রানার আপ... উইনার বাংলার "নতুন কন্ঠ"... শিল্পী মিন্টু দত্ত।


হাততালির আওয়াজ, দর্শকাসন থেকে মিন্টু দত্তের নামে হৈহৈ করে চিয়ারিং... মিন্টু দত্ত... মিন্টু দত্ত... মিন্টু দত্ত! সঞ্চালকের গলা ছাপিয়ে দর্শকদের উচ্ছ্বাস, উল্লাস। মঞ্চের উইঙের পাশ থেকে এগিয়ে আসছে একটি অবয়ব, হুইলচেয়ারে বসা... আজকের বাংলার "নতুন কন্ঠ" রিয়েলিটি শোয়ের উইনার মিন্টু দত্ত। পেছনে হুইলচেয়ারের হাতল ধরে এগিয়ে আনা আরেক সঞ্চালকের পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা। অল্পবয়সেই সাংসারিক চাকার দাঁতে পিষ্ট হয়ে ক্লান্তি, শ্রান্তি, অবসন্নতার ছাপে বয়স্কা। উনি দীপা দত্ত। মিন্টুর বৌদি বলো, মা বলো, দিদি বলো, দাদা বলো বা বন্ধু বলো। মিন্টু হাত বাড়িয়ে বৌদির হাতটা ধরে কোনোরকমে শুধু বলতে পারলো, "এই জয় বৌদির। আমি জানি না মা কেমন হয়। এই বৌদিই আমার সব, আজকের জয় আমার বৌদির..."! আর কিছু বলতে পারলো মিন্টু। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো। ততক্ষণে মঞ্চ থেকে দর্শকাসনে উপস্থিত কারুর চোখ আর শুকনো নেই।

সবার চোখের কোল ভেজা, কারণ এতোদিন টিভিতে চলতে থাকা ধরে চলতে থাকা রিয়েলিটি শোয়ের জনপ্রিয়তার ফলে সবাই জানে মিন্টু দত্তের জীবন কাহিনী। কী চরম কঠিন বাস্তব সে কাহিনী। কত দুর্গম পথ বেয়ে, তবে আজ মিন্টু দত্ত তার নিজের আর তার পরিবারের স্বপ্নপূরণের এভারেস্টের চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। না, একটু ভুল হোলো, পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় নি, পৌঁছেছে। মিন্টু তখনো আবেগ কাটিয়ে কথা বলার পরিস্থিতিতে আসে নি। বৌদি দীপা দত্তের চোখের জলও বাধা মানে নি।




সবাই জানে মিন্টুর জীবনের কথা। সবাই জানে, সবাই। তবুও আবার বলতে শুরু করেছে সঞ্চালক মিন্টুর জীবন কাহিনী.....




বছর সতেরোর মিন্টু পড়াশোনা তেমন শেখেনি, তবে গানের গলাটি বড়ো মিঠে। যেকোনো গান কানে একবার শুনলেই তুলে নিতে পারে। ভগবান পোলিওয় মিন্টুর পা দুটো নুলো করেছে ঠিকই, তবে এই গানের গলাও ওর ভগবানদত্ত। পিন্টুর বড়ো আদরের এই একমাত্র ভাইটা। বাবা-মা যাবার পর থেকে পিন্টুই ভাইকে এতো বড়োটি করেছে, গায়ে একটু আঁচড়ও লাগতে দেয় নি।




মিন্টুর ট্যাক্সিচালক দাদা পিন্টু, যখন অ্যাক্সিডেন্ট করে জেলে যায়, তখন পিন্টুর বৌ দীপা সতেরো বছরের পঙ্গু বেকার দেওর মিন্টুকে নিয়ে অথৈ জলে পড়লো। তবে পিন্টুর সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে পিন্টুর বৌ..... দীপা একটি ছোট্ট খাবারের দোকান খোলে। এভাবেই দিন কাটছিলো কোনোরকমে। মিন্টুর লেখাপড়ায় তেমন উৎসাহ না থাকলেও গানে খুব উৎসাহ দেখে ওর দাদা পিন্টু ওকে গানের দিদিমণির স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো। অভাবের সংসার বলে ভাইকে গান শেখানোতে কার্পণ্য করে নি পিন্টু। 




ভালোই দিন চলছিলো, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও আনন্দ আর শান্তির অভাব ছিলো না। বৌদি দীপাও মিন্টুকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই মানিয়ে নিয়েছিলো। পিন্টু একটা বাচ্চা কোলে ভিখারিনীকে বাঁচাতে গিয়ে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেললো একটা বাইকের সাথে। বাঁচানো যায় নি বাইক আরোহী বছর বিশেকের ছেলেটিকে। অ্যাক্সিডেন্ট করে পালায় নি পিন্টু, বলতে গেলে একরকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গণপিটুনি খেয়েছিলো। সময়মতো পুলিশ এসে উদ্ধার না করলে সেদিনই হয়তো ঐ বাইক আরোহী তরুণটির মতোই ‌পিন্টুও ছবি হয়েই যেতো মার খেতে খেতেই। তারপর পিন্টু অ্যারেস্ট হোলো, শাস্তি হোলো কয়েক বছরের জেল। তেমন সঙ্গতি নেই ভালো বড়ো নামী উকিল দেবে আলাদা করে। পিন্টু বলেছিলো বৌকে, "শাস্তি আমার হবেই, জেলে থাকতেই হবে। কাজেই অহেতুক পয়সা খরচের দরকার নেই। তার থেকে দেখো, মিন্টুর গান যেন বন্ধ না হয়। ঐ পঙ্গু ভাইটার যেন কোনো অযত্ন না হয়। ও যেন বাবা মায়ের অভাব কখনো বুঝতে না পারে।" দীপা মেনে নিয়েছিলো। ততদিনে মিন্টুকে যে ভাইয়ের স্নেহে, সন্তানের স্নেহে জড়িয়ে ফেলেছে দীপাও। খাবারের দোকান চালিয়েই টানছিলো সংসার।



আর দাদার এই স্বার্থত্যাগ, বৌদির এই কষ্টসাধন... মানতে পারছিলো না কিছুতেই সতেরো বছরের মিন্টু। বৌদি যখন দোকানে চা টোস্ট অমলেট ঘুগনি দিয়ে খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত, তখন একলা ঘরে মিন্টু অবসাদগ্রস্ত। নিজেকে অকর্মণ্য ভাবতে ভাবতেই কখন যেন এক দুপুরে মিন্টু নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলো। শরীরের একাংশ পুড়তে শুরু করেছে। কাপড় জামা আর মাংস চামড়া পোড়া গন্ধে ছুটে এসেছে প্রতিবেশীরা। আগুন নিভিয়েছে। দীপাকে খবর দিয়েছে। মিন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। প্রাণে বেঁচে গেছে। বীভৎস ভাবে পুড়েছে মিন্টুর হাত, পা, মুখের একপাশ। দীর্ঘদিন থেকেছে হাসপাতালে। দীপা মিন্টুকে বাবা মায়ের স্নেহ, দাদার ভালোবাসা... দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে অবসাদ থেকে। মিন্টু আবার গান গাইতে শুরু করেছে। তারপর গানের দিদিমণির সাহায্যে আসা রিয়েলিটি শোতে।



হাঁটতে তো পারতো না আগে থেকেই, এখন হাতদুটো অকেজোই বলা যায় মিন্টুর। তবে গলার দরদ বেড়েছে যেন আরও কয়েকগুন। মিন্টু দত্ত... আজ ওর দাদা বৌদির স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে। আর কোনো কষ্ট হচ্ছে না মিন্টুর, আর কোনো কষ্ট থাকতে দেবে না মিন্টু দাদা বৌদির জীবনে। 




আবার মাইক্রোফোন হাতে সঞ্চালকের গলায় ঘোষণা, "বাংলার প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক তাঁর আগামী সিনেমার প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে এই মঞ্চ থেকে বেছে নিয়ৈছেন বাংলার "নতুন কন্ঠ" উইনার সঙ্গীত শিল্পী মিন্টু দত্তকে। হ্যাঁ, হ্যাঁ... আপনাদের আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী মিন্টু দত্তকে, একটা জোরে হাততালি মিন্টু দত্তের জন্য।

ভাইয়ের সাফল্যের খবর পিন্টু জেলে বসেও পেয়ে গেছে। সজল চোখে বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে তখন পিন্টু... স্বপ্নপূরণের আনন্দে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational