স্বপ্ন;-
স্বপ্ন;-
স্বপ্ন ~
আমার গল্পের ছেলেটার জীবনের সাথে ক্রিকেট এর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত..
মাত্র আড়াই বছর বয়স হবে ছেলেটার, যখন ওকে প্রথম দেখি.....
বায়না করে নিজের থেকে বড় ক্রিকেট ব্যাট কিনেছিল একটা..ব্যাটটা ঠিকঠাক মতো তুলতে না পারলেও, কাছছাড়া করতো না কখনও| রাত্রে ঘুমানোর সময়ও ব্যাটটা বিছানায় নিয়ে ঘুমাতো... ক্রিকেট বুঝতো না ভালোমতোন.. তখন ওর কাছে ক্রিকেট মানে ছিল - "শুধু ছ-ও-কা-কা".....
সারাদিন মাঠে পড়ে থাকতো, বড়োদের খেলা দেখতো| বড় দাদাদের খেলতে নেবার অনুরোধ জানাতো...
~"দাদা খেলতে নেবে গো??"
কিন্তু ওর অনুরোধ সবাই হেসে উড়িয়ে দিত.....
একটু যখন বড় হল ক্রিকেটটা বুঝতে শিখলো.. তখন থেকে ওর স্বপ্নে শুধু একজন -"সৌরভ গাঙ্গুলি "..ওর প্রিয় দাদা..
দাদার প্রতিটা শট, শরিরী ভাষা, জামা খুলে ঘোরানো সবকিছুই কন্ঠস্থ ওর.......
যখন বড় দাদাদের সাথে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেল...দাদার প্রতিটা শটের বিচ্ছুরণ হত ওর ব্যাটে....দাদার মতনই শারীরিক ভাষা ওর হাঁটাচলায়...ক্রমশ পাড়ার সকলের কাছে "ছোট সৌরভ" হয়ে উঠল সে.......
শুধু খেলাতেই নয়..সৌরভকে নিয়ে পাগলামিটা ওর স্কুল বুক,দেওয়াল, খাতা সব্বেতে লক্ষ করা যেত..দাদা ওর আইডল..দাদাকে নিয়ে কেউ কটূ কথা বললে, তার সাথে ঝামেলা লাগতে দুবার ভাবতো না..ভাবতো দাদার মতন হবে সে| স্বপ্ন দেখত দাদার সাথে তার পার্টনারশিপ হচ্ছে... সে আর দাদা মিলে তাবড় তাবড় বোলিং লাইন-আপ ভেঙে দিচ্ছে|
..... কিন্তু সব স্বপ্ন সবার পূরন হয় না| সবাইকে সব স্বপ্ন দেখতে নেই| ছেলেটার মা- বাবা চেয়েছিল ছেলেটা খেলায় নয়,পড়াশোনাতে নাম করুক...খেলাধুলা যে নিম্ন -মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়না --সেটাও বারবার বুঝিয়ে দিত সবাই| পড়ালেখাকে জোর করে চাপিয়ে দিত ওর উপর... তবে পড়ালেখাতে খারাপ ছিল না ও|প্রতিটা ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে ওর ক্রিকেট খেলার প্রতি আসা বাধাগুলো পুল করে মাঠের বাইরে ফেলছিল ও|
কিন্তু সবাই মিলে যেন ওর ক্রিকেট খেলা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলো| পাড়ার লোক ওর পরিবারকে বোঝাল....
~"ছেলেটা রোগা-সোগা ওর দ্বারা ক্রিকেট খেলা হবে না....ক্রিকেট খেলায় খরচ ও প্রচুর.. ওকে যোগব্যায়ামে ভর্তি করো"
একবার পরীক্ষার আগে ওর প্রিয় "sg "ব্যাটটা টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল ওর মা|যাতে পড়ালেখাতে মন বসে, ব্যাটটা ভাঙার সময় ওর যেন মনে হচ্ছিল ওর হৃদয়টাকেও টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছে| পরে ভালো রেজাল্ট করে বাবার কাছে আবদার ছিল " Sg ব্যাটটাই চাই " পরে বড় হবার সাথে সাথে দুইবেলা টিউশনি ওর খেলার সময়ে থাবা বসাল| মাঠের সামনে দিয়ে বিকেলে টিউশনি যাবার সময় মাঠটাও যেন হাত বাড়িয়ে ডাকত ওকে"| খুব ইচ্ছে করত ওর ব্যাগটা ফেলে রেখে একবার ব্যাটটা ধরে স্টান্স নিয়ে দাঁড়াতে| কিন্তু সব "ইচ্ছা " সবার প্রকাশ করতে নেই, বুকে চেপে রাখতে হয়|
পরে যেদিন সৌরভকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ও| আবার দাদার কামব্যাকে ওর মতন খুশি কেউ হয়নি...আর কিছুদিন পর যখন দাদা অবসর ঘোষণা করল...ওর চোখের জলের স্বাক্ষী থেকেছিল ওর বইখাতা, জামাগুলি| তারপর নিজ প্রিয় ব্যাটটা তুলে দিয়েছিল নিজেই| যে ছেলেটা খেলা দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা টিভির সামনে বসে থাকত,সে খেলা দেখাই ছেড়ে দিয়েছিল...এতে ওর পাড়ার লোক, পরিবার খুশিই হল|
এখন ছেলেটা যুবক , কিন্তু দাদাকে নিয়ে পাগলামিটা আজও রয়ে গেছে... এখনো কোনো ক্লাবে দাদা আসার খবর পেলে সব ছেড়ে দিয়ে দৌড় লাগায়,পুজোয় দাদার বাড়ির কাছের ঠাকুর দেখতে গেলে সেখান থেকে পা নড়েনা ওর|
এখনও মাঠগুলো ওকে দেখলে হাত বাড়িয়ে বলে-" আর একটিবার ব্যাটটা তুলে নে,আর একটিবার তোর ভিতরে জমে থাকা না পাওয়ার যন্ত্রণাটাকে আউট করে আমার সীমানার বাইরে ছুঁড়ে ফেল,আর একটিবার তোর স্বপ্নটা ছুঁয়ে দেখ"....
তুই জানিস না, কেবল তোরই স্বপ্ন ভাঙেনি... আমিও আমার প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছিলাম....সবার সব ইচ্ছা পূরণ হয় না|
(বিঃ দ্রঃ -পরিবারের অত্যধিক প্রত্যাশার চাপে বহু ছেলেমেয়ে তাদের স্বপ্নগুলো নিজের মনের ভিতরই শেষ করে দেয়...ছেলেবেলার সহজ সরল খেলাধুলায় থাবা বসায় ব্লু-হোয়েল এর মতন মারণ গেমরা...প্রত্যেক পিতা-মাতার কাছে অনুরোধ,দয়া করে সন্তানের সুন্দর শৈশব নষ্ট করবেন না)