Rubaiya Jesmine

Romance Tragedy Classics

4.9  

Rubaiya Jesmine

Romance Tragedy Classics

স্বেচ্ছামৃত্যু

স্বেচ্ছামৃত্যু

5 mins
116


একটি বাস্তব ঘটনা ও চরিত্র থেকে মর্মাহত হয়ে আমি এই গল্পটি লিখছি। আমার দেখা একটি ঘটনা। আমাদের জীবনে কত ঘটনাই না ঘটে যায়।কিন্তু সবসময় তো সব ঘটনা গল্পের জন্ম দেয়না বা সাহিত্যের অনুপ্রেরণা হয়না।খুব কম ঘটনাই হয়।তেমনিভাবে আজকে শুরু করলাম আমার দেখা এক বৃদ্ধ কাকুর জীবন সংগ্রাম দিয়ে।       


কোনক্রমে একটি রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল রণজয়। ৩০বি.বাসটা যে ধরতেই হবে।ছোটবেলায় দেশের বাড়িতে বাঁশগাছে বাঁদুর ঝুলতে দেখেছে সে তার বাবার সাথে।বাসের যাত্রীদের দেখলেই তার সেই বাঁদুর ঝোলার দৃশ্য ভাসে চোখের সামনে। তানিয়া পৈ পৈ করে বলেছিল "আজ সাদা টি-শার্ট টা পড়ে যাও,বিচ্ছিরি ভ্যাপসা গরম পড়েছে"।উফ কেন যে শুনলাম না তানিয়ার কথা" বিড়বিড় করছে সে।নাগবাজারেই তার অফিস।বাস থেকে নেমে পাঁচমিনিটের হাটা পথ।দেরী হলেই বসের খিটখিট শুরু।কিন্তু এসব আর গায়ে লাগে না রণজয় এর।এই মন্দারবাজারে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই ঈশ্বরের পরম কৃপা বলে মনে করে রনজয়।তিনজনের খাওয়া,ছেলের স্কুল খরচ,।সংগ্রামশক্তি তার মধ্যে দিতে ঈশ্বর কোন কার্পণ্য করেনি।তা নাহলে সেই দশবছর বয়সে বাবা চলে গেল। আর সেই থেকেই লড়াইটা শুরু। একদিন তানিয়াও এই লড়াইয়ে সামিল হল তার সাথে।লেলিন সরণি তে দু কামরার একটি বাড়ি কিনে নেওয়ার ইতিহাস রণজয় অফিসের বন্ধুদের বলতে ভালোবাসে।খুব যে একটা অফিসে আড্ডার সুযোগ থাকে তা নয়। অফিসের ছুটির পর তারা বেড়িয়েই গেটের মুখের নেপুদার চায়ের দোকানে বসে একটু গল্পকরে।সিগারেট খায়না সে।পকেটে টান পড়ে নেশা করলে।তবে কেউ দিলে ফেরায় না।অরুণের বয়স পঁয়তাল্লিশ হবে,চুলগুলো সব বাদামী রঙের,পরনে দামি নাহলেও বেশ ফিটফাট পোষাক,দারুণ ঠাটঠমক তার।ব্রান্ডি সিগারেট তার কানে গোঁজা থাকে।সে মাঝেমধ্যে সিগারেট অফার করে।


             (২)


রাকা এখন ক্লাস টেন।বড় হয়েছে।তার তো খরচাদিও বেড়েছে।কোনক্রমে তিনখানা টিউশন দিয়েছে তাকে।আর এই টিউশনির টাকা যে কিভাবে জোগাড় করতে হয় তানিয়া আর রণজয় কে, সেটা এই দুজন প্রানীই জানে।অফিসের টিফিন বন্ধ করেছে রণজয় ছয়মাস হল,অফিস ছুটির পরও কাজ করে।বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটা বাজে।শিবু,অরুণ এদের সাথে আর চায়ের আড্ডা দেয় না সে।আজ প্রায় দশটা তিরিশ বেজে গেল রণজয় ফিরল না।তানিয়ার চিন্তার শেষ নেই,তানিয়ার বয়স চল্লিশ কিন্তু দেখলে বোঝার উপায় নেই,ঝরঝরে শরীর,সুডৌল বক্ষদেশ, আর চোখদুটো যেন বর্ষার আকাশ,সারাক্ষণ হাসির একটা মোলায়েম আভা তার মুখে লেগে থাকে।কে বলবে যে এই প্রানীটি পুষ্টিকর খাবারদাবার বছরের পর বছর মুখেও তুলে না।কিন্তু তানিয়ার কোন দুঃখ নেই,খেদ নেই মনে।এগারোটা বাজতে দশ রণজয় ফিরল।"আজ মুখটা বড্ড ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে যে তোমার?" ও হুম একটু কাজের চাপ বেড়েছে",আর কথা না বাড়িয়ে তানিয়া কলের জল ঘো ঘো শব্দে ঝাঁকিয়ে একটি বহুদিনের পুরনো শ্যাওলা জমানো বালতিতে ভাঙাচোরা বাথরুমে রেখে দিল রণজয়ের জন্য জল।রাকা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে,সে বাবার জন্য অপেক্ষা করে না,সকালে অংকের মাস্টারমশাই এর কাছে যেতে হয় অলিদের বাড়িতে।অলি তার ছোটবেলার বন্ধু,এক পাড়াতেই বাড়ি।

ছেলে বড় হবার পর তারা রান্নাঘরেই ঘুমায় একটা সস্তাদরের ঘুণপোকা ধরা চকিতে।দুটো রুমের মাঝখানে একহাত পা ফেলার জায়গা। অফিস থেকে কেউ কোনদিন এলে রাকার ঘরেই বসতে দেয়।তার ঘরটিও প্রায় মরচেধরা লোহার মতো কিন্তু তবুও বেশ পরিপাটি করে গোছানো, একজনের বিছানা,তাতে একটু পুরনো চাদর টান টান করে পাতা,বিছানার পাশেই একটি জানালা,যা দিয়ে রাকা প্রায় গলির ছেলেমেয়েদের দেখে পড়াশুনোর ফাঁকেফাঁকে। বিছানার পাশেই একটি টেবিল তাতে রাকার বইপত্র ছড়ানো। রনজয় শুয়ে কি যেন একটা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়।তানিয়া কাছে এসে বুকে মাথা দিয়ে চুপ করে থাকে, কথা বলে না।তানিয়ার স্পর্শে তার চিন্তা যেন মাটিতে ধপাস করে পড়ে তারাখসার মতো। তাকে আরো কাছে টেনে নেয় সে।তানিয়ার শরীরে ডুবে যায় তার সারাদিনের ক্লান্তি।রাকা পড়াশুনোতে বরাবর ভালো।ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। সে বাবার বড্ড ন্যাওটা।টিউশন থেকে ফিরেই রাকা নিজের ঘরের দিকে এগোয়, পিছন থেকে রণজয় ডেকে উঠল " এই নে তোর টিফিনের টাকা,পাশ থেকে তানিয়া গর্জে উঠল রোজ রোজ এত যে টাকা দিচ্ছ ছেলেকে তা সে খাচ্ছে নাকি অন্য.....রণজয় মাঝেই থামিয়ে দিয়ে বলল "ওহ তুমিও আজকাল বেশীই খ্যাটখ্যাট করো ছেলের সাথে"।তানিয়া অভিমানে ফেঁপে ওঠে।সে তাকে বুকে জড়িয়ে অভিমান ভাঙায়।আদরে আহ্লাদী হয়ে তার চোখ ভেঙে জল আসে।রাকা ঘর থেকে ডেকে ওঠে"মা আমার খাবারটা দাও"।



            (৩)


চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল রাকার মাধ্যমিক এর রেজাল্ট, খুব ভালো ফল করেছে সে।রণজয় আজ অফিসে গেলনা আনন্দে।মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টি আনিয়েছে রাকাকে দিয়ে।হঠাৎ শিবু এল বাড়িতে। শিবু রণজয় এর বন্ধুর মতো তার অফিসেই কাজ করে।সকাল থেকেই অফিসের কর্মচারীরা কাজ স্ট্রাইক করেছে বেতন বৃদ্ধির জন্য।খবরটা শোনার পর রণজয় কেমন যেন বাড়িতে পড়ে থাকা টেবিল চেয়ারের মতো চুপচাপ হয়ে গেল।যেভাবেই হোক কাজটা বাঁচাতে হবে তাকে।সকাল সকাল বেড়িয়ে গেল ৩০.বি ধরে।অফিসের গেটে একটা বড় তালা ঝুলছে।ভীড় ঠেলে যেতে যেতে পায়ের তলার মাটিগুলো একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল তার।শবদেহকে নিয়ে গেলে মানুষ যেমন ফুল ছিটিয়ে যায় চারিদিকে, তেমনিভাবে অফিসের কর্মচারীরা ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে যেন। সাতদিন কেটে গেল কোন মীমাংসা হলনা বরং অনির্দিষ্টকালের জন্য সিল মেরে দিল কোম্পানি অফিসে।রাকার ভর্তির দিন চলে আসছিল।তার বরাবরের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বড় স্কুলে ভর্তি করাবে।নিজে জীবনে যেসব করতে পারেনি সব ছেলেকে দিয়ে করাবে।বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে রণজয়, পা টিপেটিপে তানিয়া কখন কাছে এসে বসেছে সে খেয়াল করেনি।একটা নিস্তব্ধতার আবরণ দুজনকে ছেয়ে থাকে।

রাকার দরজা খোলবার শব্দে রণজয় দেখল তানিয়া তার পাশে বসে,রাকা হঠাৎ বাবার পাশে এসে বলল "বাবা ভর্তির দিন তো পেড়িয়ে গেল প্রায় সব স্কুলে, ভবানীপুর বয়েজ স্কুলে শুনেছি এখনো ভর্তি নিচ্ছে কিন্তু শুনলাম ওই একটু রেফারেন্স দিতে হবে।"থাকার মধ্যে শুধু এই দুইরুমের বাড়িটি।রণজয় আর দেরী না করে সিদ্ধান্ত টা নিয়ে নিল। বুকফুলিয়ে বাড়ি ফিরে যুদ্ধজয় করার মতো চিৎকার করছিল "তানিয়া,রাকা কোথায় তোমরা সবকিছু গুছিয়ে নাও এ বাড়ি আমরা ছেড়ে দেবে "রাকার স্কুলের সব টাকা জোগাড় হয়ে গেছে"।তানিয়া বাধা দিতে গিয়েও পারল না,সে জানে ছেলের জন্য রণজয় আকাশ মাটি এক করে দিতে পারে।বাড়ি ছাড়ার আগে একবারমাত্র তিনজনে মুখোমুখি হল।তানিয়া স্বামির মুখের দিকে তাকিয়ে আচঁলে লুকিয়ে জল মুছে নিলো।পাড়ার সরু গলিটা দিয়ে মালবাহী গাড়িটা বিকট শব্দে বেরুচ্ছে।অলি বাড়ির ছাদে ভিক্টোরিয়া পরীর মতো দাঁড়িয়ে,কি যেন বলবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।রাকাও একদৃষ্টে অলির দিকে তাকিয়ে।একবার অলিকে চুমু খেয়েছিল রাকা ফাঁকা ক্লাসে পেয়ে।

অলির সাথে এই লাষ্ট দেখা রাকার।

 ডি.এম সাহেব কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সম্বোর্থনা দেওয়ার জন্য বিশেষ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করল।আর এখানেই রণজয় ডি.এম সাহেবকে অনুরোধ করে বলল ছেলের ভর্তির বিষয়টা।পরদিন যথাসময়ে একটি সাদা পৃষ্ঠায় কালো কালির কলম দিয়ে চিঠি লিখে দিয়ে আসল ডি.এম সাহেবের দপ্তরে।জীবনে কোনদিন কারোর কাছে ছোট হয়নি সে।রাতদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করেছে তবুও নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়নি।আজ যেন ভেতরের রণজয় চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল। 



           (৪)


রণজয়ের চুল সব সাদা হয়েছে।তানিয়া তাকে এই পৃথিবীতে একা ফেলে চলে গেছে।শরীর ভেঙে পড়েছে কুড়ি বছর আগের সেই পরিশ্রমী রণজয়ের। অস্ট্রিম্যালিশিয়ায় চলাচলের সব ক্ষমতা হারিয়েছে।রাকা এখন বিদেশের একটি কোম্পানিতে নামী পদে আছে।ওখানেই বিয়ে এথেলা মুলারকে।এথেলা একটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দিয়েছে একবছর আগে।



বহুক্ষণ ধরে একজন বয়স্কভদ্রলোক বাইরে অপেক্ষা করছে ডি.এম সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য।সাথে একজন মধ্যবয়সী লোক,দেখে মনে হচ্ছে রিক্সাওয়ালা,বারবার তাড়া দিচ্ছে।বহুক্ষণ আগে স্লিপ গেছে ভেতরে।দরজার বাইরেই একটি টবে একটা পাতাবাহার নুইয়ে পড়েছে রোদ না পেয়ে।সে একদৃষ্টে তাকিয়ে পাতাবাহারের দিকে।ভেতরের হালকা হাওয়ায় সাদা পর্দাটা একটু নড়েচড়ে উঠছে মাঝে মাঝেই।এবার নাম ডাকল পিয়ন,রণজয় হাটতে পারে না ঠিকভাবে তাই একটু সময় লাগল ভেতরে যেতে... "স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি" জানিয়ে সাদা পৃষ্ঠাজুড়ে কাঁপা হাতের লেখায় একটি চিঠি ডি.এম সাহেবের টেবিলে দিয়ে ধীরেধীরে মিশে গেল রিক্সাটি জনস্রোতে..........






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance