সাধ পূরণ
সাধ পূরণ
আজ মাথার উপরের আকাশটা ঘন নীল। মফস্বল এই ছোট্ট শহরটার বুকে নেমে আসছে অদ্ভুত নীরবতা, কারন আজ শনিবার।
এখন সময় দুপুর ১২.৩৫। আর এই ভরদুপুরে বিনা কারণে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাটা একদম যুক্তিযুক্ত না। তবু বনানী দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক এই শহরের এককোনে তাদের বাসার ছাদে। ছাদে ফুলের বাগান করেছে বনানী, মনেহয় ওর নামের সার্থকতা বজায় রাখার জন্য ।
নীচ থেকে ঈশানী এমনভাবে
চেঁচাচ্ছে যেন বাড়িতে হুলস্থুল
কান্ড বেধে গেছে। ওরা বনানী ও
ঈশানী দুই বোন। তাদের বাবার
বিরাট ফিসারির ব্যবসা । মা মারা গেছেন অনেক আগেই। ঈশানী চার বছরের এক ছেলে নিয়ে প্রায়শই বেড়াতে আসে, বাপের বাড়ি কাছে থাকার কারনে। ঈশানী আবার চেঁচাল। তবে এবারের চিৎকার উপেক্ষা করার মত না বলেই বাগানবিলাসী সেই
বনানী নেমে এলো নিচে।
বনানী নিচে নেমে এসেই ঈশানীকে বলল, - কি হল কি!ভর দুপুরে পাগলীর মত চিল্লাচ্ছিস কেন?
-দ্যাখ, বাবু না দুধ খাচ্ছে না।
মেজাজটা সপ্তমে চড়ল বনানীর ।
সাতের উপরে যদি গননা করা সম্ভব হতো তাহলে সেখানেও চড়ত ওর মেজাজ। ঘন্টায় কয়বার খাওয়ানো যায় একটা বাচ্চাকে ?
বনানী : দ্যাখ, এবিষয়ে আমি তোকে
দুটো সমাধান দিতে পারি।
সমাধান নং ১ঃ তুই বাবুকে উল্টো
করে ধরে তার পিছনে ফানেল
ঢুকিয়ে দুধ ঢাল। দেখবি যে বৃহদান্ত্র
ক্ষুদ্রান্ত্র সব বেয়ে দুধ পাকস্থলী তে
পৌছে যাবে।
সমাধান নং ২ঃ দুধটা সাইকেলের
পাম্পারে ভরে বাবুর মুখে
সাইকেলের নল ঢুকিয়ে পাম্প মার।দুধ
পেটে চলে যাবে।
ঈশানী : তুই বাবুকে দেখতে
পারিস না কেন?
বনানী : কারন এতে মানুষ বলবে
মার থেকে মাসির দরদ বেশি।
ঈশানী : কি!
বনানী : হ্যাঁ । আর বাবার সামনে
জ্ঞানদা গিরি করবি না।
-আমি জ্ঞানদা !
-হা। তুই জ্ঞানদা। মাও জ্ঞানদা
ছিলো। একজনের কথা আরেকজনের
কাছে লাগাতো। এগুলো
জ্ঞানদার স্বভাব।চমৎকার হল। জ্ঞানদা মায়ের জ্ঞানদা কন্যা।
-তুই আমার সামনে থেকে দূর হ।
-ডেকেছিলি তুই। আমি ইচ্ছা করে
আসিনি।
এই কথা বলে সেই জায়গা ত্যাগ
করল বনানী ।
আমার আর বোনটার সম্পর্ক কি আদায় কাঁচকলায় টাইপ? তবে যে যাই বলুক না কেন, বোনটার সাথে খুনসুটি
করতে ভালো লাগে।
বনানী এসব চিন্তা করতে করতে
বাথরুমে ঢুকল। শাওয়ার ছেড়ে দিল।
মনের আনন্দে কিছুক্ষন ভিজল। সে
ভাবছে শাওয়ারের জলটা যদি
বৃষ্টির জলের মত হতো তাহলে যে
কি ভালো হত।স্নান সেরে রেডি
হতে লাগল বনানী । প্রতি শনিবার
বিকেলে সে কিছু কেনাকাটা
করতে বের হয়। আজও সে সেজেগুজে বের হল। বের হতেই দেখে একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে ৩২
পাটি দাঁত বের করে দিয়েছে।
বনানী মনে মনে ভাবল “আজ মনে হয়
ছেলেটা প্রথম ব্রাশ করে এসেছে।” তার
দিকে একদম দৃষ্টিপাত করল না
বনানী । কারন তার ছেলেদেরকে
একদমই সহ্য হয় না।এ দোকান ও দোকান ঘুরে হালকা কিছু কেনাকাটা করল সে। তারপর কাছের পার্কটার উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। কাকার দোকানে ফুচকা খাবে। তবে সেই লোকটা আসলে তার কাকা না। কাকা ডাকতে ডাকতে লোকটার নামই কাকা হয়ে গেছে। ফুচকার দোকানি তাকে দেখেই হেসে বলল,
-চটপটি খাবা না ফুচকা?
-ফুচকা দেন।
বনানী সবসময় ফুচকা খায়। তবুও তাকে জিগ্যেস করা চাই।
পিছন থেকে রিনরিনে একটা
কন্ঠস্বরের অধিকারিনী বলে উঠল
-একটু সরবেন প্লীজ!
বনানী আস্তে আস্তে পিছনে ঘুরল।
ঘুরে যা দেখে তাতে তার মাথা
ঘুরে যাবার দশা। খুব সুন্দরী একটা
মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে ।
সত্যিই যেন বনলতা সেন। বিশেষ
করে মুখশ্রীটা। এত্তো সুন্দর! ঠোঁটের
কোনে ধরে রেখেছে একচিলতে
মেঘমুক্ত হাসি।
হঠাৎ মেয়েটি বলল
-হাই, আমি প্রিয়া ।
-আমি বনানী ।কেমন আছো।
-ভালো। তুমি?
-খারাপ থাকলে অবশ্য শপিং এ
বেরুতাম না।
-অনেকের মন খারাপ থাকলে ঘুরে
এসে মন ভালো করে। তুমি তো
তাদের মধ্যে পড়তেও পারতে।আচ্ছা
বাদ দাও ।
কোথায় থাক?
-মেঘপুর বটতলা।তুমি?
-আরে! আমি তো সেখানেই থাকি
তারা জানতে পারল যে তারা
মাত্র দুটি বাসা আগে পরে থাকে।
প্রিয়া : বাসায় কে কে আছে?
বনানী: বাসায় বাবা আছে।
প্রথমে বাবা একজনকে বিয়ে
করেছিলো। তার থেকে বোনের
জন্ম।তিনি মারা গেলেন । তারপর
বাবা তার শালীকে বিয়ে করেন।
তার থেকে আমার জন্ম। কিন্তু আফসোস। বাবা আর বিয়ে
করতে পারল না!
-কেন?
-কারন বাবার আর কোন শালী নেই!
-হি হি হি। তুমি কি সবসময় এভাবেই
কথা বল!
-কেন? তা কি অস্বাভাবিকতার
মাঝে পড়ে?
-তা না। তবু কেমন যেন হাস্যকর আর
অদ্ভুত টাইপ।
হঠাৎ আকাশটা মেঘলা হয়ে গেল । যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। তারা তাই একটা রিক্সা খুঁজতে লাগল।
রিক্সায় উঠে বসল। তারা রিক্সা
করে বাসার দিকে রওনা হল ।
প্রিয়ার শরীরে সুমিষ্ট এক ঘ্রান আছে
যা কি না মন মাতাল করে দেয়। আবার
তার শরীরটাও একদম স্লীম।
মেয়েদের গায়ের মিস্টি গন্ধটা
তার কাছে ভালোই লাগে। অন্তত
আর যাই হোক, ছেলেদের মত তার গা
থেকে পাঁঠার মত বোটকা গন্ধ
বের হয় না। ছেলেদের উৎকট ঘামে
ভেজা গন্ধ তার কাছে বিশ্রী
লাগে। বমি বমি আসে। তার থেকে
মেয়েদের ঘামের গন্ধই ভালো।
রাস্তায় জ্যাম শুরু হয়েছে । বৃষ্টি
হচ্ছে। রিক্সাওয়ালা পলিথিন
দিয়েছে তাদের। বনানী দুজনকেই
প্রায় পলিথিনে মুড়ে নিল। কেন জানিনা মনে হল মফস্বল শহরের বুকে নেমে আসছে আরেকটি অলিখিত বৃৃস্টি।
***
দিনগুলো যেন কেমন করে গড়িয়ে
যাচ্ছে। প্রথম দেখার পর ফোনে কথা
বলা, তারপর দুজনে মিলে ঘুরতে
যাওয়া ও আরো অনেক কিছুই। বন্ধন টা ক্রমশ শুধু শক্তই হচ্ছে। বান্ধবী ছেড়ে যে এই সম্পর্ক টা কত আগেই অন্যদিকে মোড় নিয়েছে তারা তা নিজেই জানে না। বনানী প্রায়ই ভাবে “আমি কি সমকামী”। একটা লেসবিয়ান?একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি?
তবে যাই হোক না কেন, ওকে
নিয়ে সুন্দর স্বপ্নীল দিনের
অধিকারিণী আমি।
বনানীদের বাসায় আজ প্রিয়ার
নিমন্ত্রণ ।অনেক আয়োজন আজ বনানী করেছে।ওদিকে ঈশানী ছুটছে বাবুকে খাওয়ানোর জন্য।
প্রিয়া এলো। সে খেতে বসেছে।
অবশ্য তার চাপাচাপিতে বনানীকেও খেতে বসতে হল। হঠাৎ
প্রিয়া বলল, -ওফ। এত্তো কাঁটা। ইলিশ মাছ আমি খেতেই পারি না।
-আমার বোনকে ত মাছ খেতে
দেখনি! সে কাঁটাসুদ্ধ মাছ চিবিয়ে
একসাথে গিলে ফেলে।
তার কাটা খাওয়ার ধরন দেখলে
সিওর বিড়ালও হার্টফেল করবে।
প্রিয়া তো হাসতে হাসতে
গড়াগড়ি খাচ্ছো। কি সব কথা যে
বলে না বনানী । খাওয়া শেষ করে
প্রিয়া বলল, -চল বনানী , তোমার রুমে যাই। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
-চলো।
পিছন পিছন বাবুও চলে এলো। বাবু
বলল
-বনি মাসী,আমরা খেলি।
-এই, তুই বের হ। পরে আদাদারসিস
-আহা বনানী , ধমকাচ্ছ কেন? বাবু চল
খেলি।
বনানী : আপাতত আমার সামনে থেকে যা।
বাবু চলে গেলো।
বাইরে ঝড়ো হাওয়া। দমকা বাতাস
পরপর ছুটে যাচ্ছে।ঘরের জানালার
পর্দা পতপত করে উড়ছে। ঘরময় এক
মায়া বিরাজমান। কেমন যেন
ঘোরের মধ্য আছে দুটো মেয়ে। অদৃশ্য
সেই মায়ার জাল হতে ছিন্ন হওয়ার
নিস্ফল চেষ্টার পর আরো
কাছাকাছি হলো বনানী ও
প্রিয়া।
বনানী: কিছু বলতে ইচ্ছে করছে।
-কি বলব?
-বলব কি তা তুমি জানো।
-কিন্তু যা বলতে চাও তার তো কোন
ভবিষ্যৎ নেই। এটা মোহ। আমরা
দুজনেই মোহাচ্ছন্ন। আমি একটা
মেয়ে। আর তুমিও। একটা মেয়ের
অনেক রকমের বাধ্যবাধকতা থাকে
সমাজে।আমরা এতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ না।
আমরা যতই সম অধিকার বলে গলা
ফাটাই না কেন সামাজিকতার
লোক দেখানো চাপটা আমাদের
ঘাড়ে বেশী। যেই কারনে আমরা
মুক্তমনা না।একটা ছেলের পক্ষে ঘর
ছেড়ে বাইরে থাকাটা খুব সহজ।
তারা তাদের মনের মানুষকে নিয়ে
পালাতে পারেরে। কিন্তু আমরা
পারি না। আমাদের লোকের ভয়
আছে। অনেক লোক বিরক্ত করবে।
কিন্তু দ্যাখো, দুটো ছেলে
একসাথে থাকলে এরকম হওয়ার
সম্ভবনাই নেই। আজ খুব ইচ্ছে করছে
ছেলে হতে। তুমিও ছেলে হলে কি
যে ভালো হত। দুজনে মিলে
পালাতাম।আর যা হয়েছে তা
আমাদের ভুলে থাকা উচিত।
বনানী: পারবে?
-জানি খুব কষ্ট হবে তবুও করতে হবে।
সমাজের সেই গৎ বাঁধা শৃঙ্খল। পালন
করতে হবে।
আমার পরশু বিয়ে। জানি অবাধ্য
হতে পারব না, কিন্তু তোমার মত
বান্ধবী শুধু তুমিই থাকবে।
তুমি কি কিছু বলবে?
ঘরময় পিনপতন নীরবতা। আকাশের
বিষাদনীলিমা ঢেকে আছে
কালো মেঘে।প্রতিটি বাতাসে
জানান দিচ্ছে তাদের বেদনার
রংগাঁথা।
বনানী : সুখে থাকো এটাই চাই।
প্রিয়া: পারব কি না তা জানি
না। তবে ভালো থাকার চেষ্টা
করতে হবে।
দুইদিন পর।
প্রিয়াদের বাসার সামনে একটা
ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ি দেখা
যাচ্ছে। সবাই চিৎকার করছো
জামাই এসেছে বলে। বনানী
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছে।
আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ভর্তি ।হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে।
বনানী নড়ছে না। বৃষ্টির জল তার
চোখেমুখে পড়ছে। ভালো হল। তার
চোখের জল কেউ দেখতে পাবে না।
বিশ বছর পর।
মা ও তার ১৮ বছর বয়সী এক ছেলে
দাঁড়িয়ে আছে একটা পার্কে।
মা ফুচকা খাচ্ছে।
ছেলে : মা ওদিকে গেলাম।
প্রয়োজন হলে ফোন করো।
হঠাৎ একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর, চেনা চেনা লাগলো।
-একটু সরুন প্লীজ।
বিশ বছর পর আবার দেখা হল প্রিয়া ও বনানীর। কত কথা হল। তাদের
দুজনেরই ছেলে আছে। বনানীর
ছেলের বয়স ১৮। নাম বরুন । আর
প্রিয়ার ছেলের বয়স ১৬। নাম কৃষ্ণ।
বনানী: চল না। সেই গাছটার
কাছে নীরব জায়গাটাতেই যাই। আমরা
কত সময় সেই জায়গায় কাটিয়েছি।
প্রিয়া: চল।
তারা সেই জায়গায় গিয়ে রীতিমতো আশ্চর্য হলো।
দেখে যে দুটো ছেলে একে অপরকে
কিস করছে। তাদের দেখে দ্রুত
স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। কিন্তু
যা দেখার তা তারা দেখে
নিয়েছে। তারা আশ্চর্য হল এই কারনে
যে ছেলেদুটো তাদেরই ছেলে ছিলো!
*****(সমাপ্ত)*****

