রাধারানী মুর্মু
রাধারানী মুর্মু
রাধারাণী মূর্মু
ডাঃ সত্যব্রত মজুমদার
২৫/০৭/২০২২
---------------------
" হ্যালো" ভালো আছিস তো, কত যুগ পরে ফেস্ বুকের সাহায্যে তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম, " ম্যাকলক্সিগঞ্জ" থেকে, ভালো আছিস নিশ্চয়ই, তোকে খুব দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমাদের স্বর্ণালী স্মৃতিতে থাকা " মা" রাধারাণী মুর্মূ আর নেই, প্রায় একশোর কাছাকাছি বয়সের ভার নিয়ে চলে গেলেন, পরিপূর্ণ হৃদয়ে। সত্যি স্বরূপ আমি খুবই ব্যথিত হলাম, দেখ, সেই অমর কথা," জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা কবে? কিন্তু রাধারাণী মুর্মূ অমর থাকবেন বনবাসীদের কাছে চিরদিন, চিরকাল, তাঁর আত্মত্যাগ আর সহিষ্ণুতার , মানবজাতির কল্যাণকার্যের জন্য।
এই খবরটি শোনার পর দুই চোখ দিয়ে জলের অবিরত ধারা বইতে লাগল, স্মৃতি যেতে লাগল পিছনের দিকে, সেই সত্তর দশকের প্রথমদিক, পুরুলিয়া সীমানার কাছেই ঝাড়খন্ড রাজ্যের, ধানবাদ জেলার মধ্যে থাকা দারিদ্র্যপূর্ণ আদিবাসী গ্রাম" দলমা, মহুল, দলদলি, শালতোড় ইত্যাদি। ঘন জঙ্গল, টিলা, পাহাড়, বেষ্টিত রুক্ষ, অনুন্নত, সভ্যতার পরশ থেকে দূরে থাকা দূর্গম এই গ্রামগুলি ছিল, আর ছিল অনেক অভিশাপের সাথে দূরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যাধির ভয়াল আক্রমণের করুন শিহরন পূর্ণ রূপ। আধুনিক চিকিৎসার অভাব, সরকারি উদাসিনতা, স্হানীয় মানুষের অশিক্ষা আর চেতনার অভাবে এই কুষ্ঠব্যাধি গ্রামের অনেকের মাঝে " রাধারাণী মূর্মু কেও ছোবল বসিয়েছিল, তখন তাঁর বয়স মাত্র পনের, ষোল, তরতাজা আদিবাসী মেয়ে, ফুটন্ত যৌবনভরা , নিটোল কালো, রূপসী মেয়ে, গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে এক খ্রীষ্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশুনো করছিল, মিশনারির সাহায্যেই।
কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়ার অর্থই হল, সে মানবজীবনে অভিশাপের বলি হয়েছ, একে সত্বর পরিত্যাগ কর, কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্তের শরীরের কিছু অংশ খসে যাবে, লালমাংসপিন্ড দেখা যাবে, দিনে দিনে ক্ষত- বিক্ষত হতে থাকবে, তাই ঘরের বাইরে ভিক্ষাজীবনে ঠেলে দাও, নয়তো বাড়ির সবারই এই পাপের গ্রাসে শেষ হয়ে যাবে।
এই আতঙ্ক আর শিক্ষা আর চেতনার অভাবের কারনে মায়া, মমতা, রক্তের টান সব মন থেকে শেষ হয়ে যায়, সেই রকম রাধারাণীও করাল কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বিতারিত হয়ে গেল, পথে পথে অন্যান্য আক্রান্তের মতোন পেটের জ্বালায় ভিক্ষাবৃত্তিই হলো সম্বল। কিন্তু না, রাধারাণী মুর্মূর রক্তে ছিল অন্য চেতনার স্পুলিঙ্গ,
সে শত কষ্ট আর বাঁধা সয়ে " মহুল" গ্রামের আরো আটজন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মহিলাকে নিয়ে সঠিক বাঁচার দিশা দেখানোর জন্য গ্রামের মিশনারি স্কুলের প্রধান সিষ্টার " মরিয়ম" ম্যাডামের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো, " দিদিমণি আপনি মহান, আমাদের করুনা করুন, একটু আশ্রয় দিয়ে, বাঁচার পথ দেখান, আমি এদের সেবা শুশ্রুষা করবো, আমিও তো এই মারণ রোগের শিকার, এই দেশের বর্বর অশিক্ষিত সমাজ আমাদের বাঁচার দিশা না দেখিয়ে পরিত্যাগ করেছে, কিন্তু আমরা কি এর জন্য অপরাধি? এর বিচার আমাদের মূর্খ সমাজ করতে পারবে না, আমরা নাকি পাপি? এর জবাব আমাদের সংঘবদ্ধ হয়ে দিতে হবে, আমি এদের নিয়ে আপনাদের একান্ত সহযোগিতায় কুষ্ঠ ব্যাধির আধুনিক চিকিৎসা আর আশ্রম কেন্দ্র গড়ে তোলার আকুল আবেদন করছি। রাধারাণী মুর্মূর অসহায় আর্তনাদে, মিশন কর্তপক্ষের প্রধান সিষ্টার মরিয়ম দিদিমণি মিশন কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে এই স্কুলের মেধাবী ছাত্রী রাধারাণীর আকুল মনের ইচ্ছাকে মান্যতা দিলেন, এবং এই রোগের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্হার জন্য সুদুর ইংল্যান্ড থেকে বিখ্যাত সমাজসেবক চিকিৎসক ডাঃ প্যাট্রিক্ ডনিগ্যানকে আনার ব্যবস্হা করলেন।
একটি লম্বা খাপরার ঘরে রাধারাণী খ্রীষ্টান্ মিশনারির সহায়তায় আটজন কুষ্ঠ আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে পথ চলা শুরু করলো, নিজের হাতে তাদের সেবা করত, দিন, রাত, নিজে আক্রান্ত রোগী হয়েও সাথীদের সেবা, ঔষুধ পত্র, ড্রেসিং করা নিজের হাতে, তাদের খাওয়া দাওয়ার দিকে সর্বদা নজরে রাখত, নিজের কথা না ভেবে, মিশনের সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে, প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির রাতে ওপরের পুরোনো খাপরা চুয়ে জল পড়ে মেঝে ভেসে যেত, তখন রাধারাণী অন্ধকারে রোগীদের ঘরের এককোনে নিয়ে আগলে বসে থাকত, রাতের পর রাত, কনকনে ঠান্ডার সময়ে নিজের কম্বল প্রয়োজনে অন্য কুষ্ঠ রুগীকে দিয়ে দিত, নিজে ঠান্ডায় কষ্ট করতো, তখনো এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্হা কিছুই ছিল না । ডাঃ প্যাট্রিক্ ডনিগ্যান মিশনের অনুরোধে , এই অনুন্নত ছোটনাগপুরের কুষ্ঠপ্রবণ মিশনের এই কেন্দ্রে এসে রাধারাণীর কর্মকান্ড, আর আত্মত্যাগ দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন, এবং স্হির করলেন এখানেই জীবনের বাকি সময় রাধারাণীকে সামনে নিয়ে কুষ্ঠ আরোগ্য নিকেতন তৈরী করে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্হার মাধ্যমে কুষ্ঠ আরোগ্যের ব্যবস্হা করবেন, আর মানুষের চেতনা বৃদ্ধির জন্য প্রচারের ব্যবস্হা করবেন।
ধীরে ধীরে ডাঃ প্যাট্রিক ডনিগ্যান জীবনের আয়,উপার্জনের সমস্ত অর্থ এই কুষ্ঠ আরোগ্য নিকেতনের জন্য মিশনের সহায়তায় ব্যয় করতে লাগলেন, এই আদিবাসি মেয়ে রাধারাণী মূর্মূর কষ্ট সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগ, আর মৃত্যুমুখে থাকা এই অঞ্চলের কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত অপর নারীদের নিয়ে নিরাময়ের আদর্শ সেবা কেন্দ্রে নিজের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতাকে নিয়োজিত করলেন রাধারাণীর নিষ্ঠা, উন্নত চিন্তাকে মর্যাদা দিতে। পরবর্তী কালে মিশনের তরফে এর নামকরণ করা হয়েছিল ," রাধারাণী কুষ্ঠ আরোগ্য নিকেতন" ।
স্বরূপের সকালের ফোনটি আমাকে রাধারাণীর সহিষ্ণুতার অসাধারণ স্মৃতিকে জাগরিত করলো , চোখের জলের সাথে, আজ মহুল আর আশেপাশের গ্রামে কুষ্ঠ রুগীর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছ, আরোগ্য লাভ করছে " রাধারাণী কুষ্ঠ আরোগ্য নিকেতনের মাধ্যমে, আর এই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে রাধারাণী মুর্মূ হয়ে রইলেন , মহামানবী আলোর দিশারী রূপে ।
