পুজোর উপহার
পুজোর উপহার
কর্মরত মানুষদের বাড়িতে থাকার সময়টুকু ছাড়া জীবনের একটা বড় অংশ কেটে যায় তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং দীর্ঘ দিন একসাথে কাজ করার সূত্রে একটা অলিখিত আত্মিক বন্ধন তৈরী হয়ে যায়। সেই বন্ধন কিন্তু হয় খুবই শক্ত, সহজে সেটা ভাঙা যায় না। সেই রকম যারা দূর থেকে কলকাতায় কর্মসূত্রে আসেন তাদেরও একটা বড় সময় কেটে যায় রাস্তাতেই এবং ফলে বহু দিন এক সাথে যেতে যেতে তাদের মধ্যেও একটা ভালো বন্ধন তৈরী হয়ে যায়। এই সব যাত্রীরা নিত্য যাত্রী বা ডেইলি প্যাসেঞ্জার নামে পরিচিত। এরকম এক দল যাত্রী ছিল সকাল ৯.০৮ এর ডাউন নৈহাটি লোকালে । তিন নম্বর কামরার প্রথম দরজা ছিল এদের যাত্রার জন্য নির্দিষ্ট ।
আপ ট্রেনটা নৈহাটি স্টেশনে ঢোকামাত্রই হুড়মুড় করে উঠে পড়া , অন্তত গোটা পনেরো সিটে রুমাল ব্যাগ চিরুণি লাইটার ফেলে জায়গা রাখা, শুধু নিজের নয় গোটা পরিবারের জন্য। পরিবারই বটে। ভিন্ন পেশার, ভিন্ন আয়ের, ভিন্ন চেহারার, ভিন্ন লিঙ্গের, ভিন্ন ধর্মের যেন গোটা একটা ভারতবর্ষ।
তারপর সবাই একসাথে যাওয়া শিয়ালদহ অবধি। সেখান থেকে যে যার নিজ নিজ অফিসের পথে। এটা হয়ে গেছে গত দশ বছরের রোজকার সকালের রুটিন।শনিবারে সংখ্যাটা কিছু কম হলেও অন্য পাঁচটা দিন উপস্থিতি মোটামুটি একইরকম থাকে, গড়ে চল্লিশ জন।
ঠিক কবে থেকে এই পরিবারের সাথে নিজেকে যে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেই মনে করতে পারিনা। কারণ এই বন্ধন বলে কয়ে একদিনে হয়নি, বহু দিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে । সকাল দশটা পনেরোর মধ্যে অফিসে পৌঁছানোর তাগিদে এই ট্রেনটা ধরা অবধারিত ছিল। একই কমপার্টমেন্টে রোজ যেতে যেতে ঘোষদা, বোসদা,গুহদা তরুদি, শর্মিলাদি বলে ডাকতে ডাকতে কবে যে একটা পরিবার হয়ে গেছি খেয়ালই ছিল না।
তপন ঘোষ ব্যাঙ্ক কর্মী, যতীন সেন ফেয়ারলির রেলের কেরাণি, সুবর্ন দত্ত ব্যাঙ্কশাল কোর্টের উকিল থেকে ক্যাবলা, পচা, মন্টু শিয়ালদার হকার, কত পেশার নানান বয়সের মিলনস্থল এই নটা আটের ডাউন নৈহাটি লোকালের তিন নম্বর কামরা। সবাই যেন কত কাছের দিনের ঐটকু সময়ের জন্য। চেনা থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে একটা নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠা। না জানিয়ে কেউ কিছুদিন না আসলে, তার খোঁজ নেওয়া।কেউ বিপদে পড়লে তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া, একসাথে পিকনিকে যাওয়া এর ওর বাড়ির বিয়ে পৈতেতে নিমন্ত্রণে অতিথি হয়ে যাওয়া। একটা অটুট পারিবারিক বন্ধন।
আমাদের এই নিত্যযাত্রী সমিতিতে একটি বৃদ্ধ দম্পতিও ছিলেন। আজকের এই গল্পের মূখ্য চরিত্র তারাই। নিত্যানন্দ বোস ও মিতা বোস । ওনারা দুজনেই উঠতেন শ্যামনগর থেকে। ষাটোর্দ্ধ বোসদা ডাক বিভাগে কাজ করতেন, রিটায়ারমেন্টের পরে স্ট্র্যান্ড রোডের কোন একটা প্রাইভেট ফার্মে খাতা দেখার কাজ করেন । মিতাদি কাজ করেন ভারতীয় রেলে, চাকুরীর স্থল ফেয়ারলি প্লেসে । বোসদা ছিলেন একজন সুবক্তা, মিষ্টভাষী মানুষ । নীচু গলায় মজার মজার কথা বলেন,খুব শান্ত প্রকৃতির।
বরং দিদি একদম উল্টো ।বেশ হইচই করেন, মিষ্টি মিষ্টি করে এর ওর পিছ্নে লাগেন, মাঝে মাঝে ভাল ভাল গান শোনান। দিদির খুব ভাল গানের গলা ছিল ।কিন্তু একটাই ব্যাপার যা সবাইকে খুব ভাবায়, তা হল, এই দম্পতিকে ট্রেনের এই সময়টুকু ছাড়া আর কোন সময় পাওয়া যায়না। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কোন বাড়ির নিমন্ত্রণ হোক বা পিকনিকে যান না। কোন না কোন একটা অজুহাতে ওরা নিজেদের সরিয়ে নেন। পরিবর্তে বোসদা ফাইন দেন, সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে। তাতেই যেন সাত খুন মাফ।
আজ মহাষষ্ঠী, কাল থেকে পুজোর জন্য অফিস ছুটি। আজ আবার মিতাদির অফিস জীবনের শেষদিন। ওনার রিটায়ারমেন্ট পুজোর পরেই । আগামীকাল থেকে উনি আর আসবেন না। সবার মন খুব খারাপ। একজন নিকট আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথার মত বুকে বিঁধছে তার কাল থেকে না আসার বাস্তব খবরটা। আসলে এতদিন একসাথে থাকার সময় এই সব বিচ্ছেদের চিন্তাগুলো মাথায় আসেনি, শুধুই হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে গেছে। আমাদের এই পরিবারের কেউ অবসর নিলে তাঁকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়। দিদির ক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। চাঁদা তুলে দিদির পছন্দের বটুয়া ব্যাগ, ফুল, মিষ্টি আনা হয়েছে। শ্যামনগরে ওনারা ট্রেনে উঠতেই প্রতিদিনকার অভ্যাসমত বাবাই আর মন্টু সীট ছেড়ে বসতে দিল। এরপরই শুরু হল সভার কাজ।
সবার আগে সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হল । তারপর একে একে প্রত্যেককে বলতে হল দিদির সম্বন্ধে। আমিও বললাম। দিদি সেরকম কিছু বলতে পারলেন না। তার গলা ভারি হয়ে এল। সবশেষে বলার ভার পড়ল শ্রীমান নিত্যানন্দ বোস মশায়ের।
আমার স্নেহের বন্ধুরা, খুব ভাল লাগছে তোমাদের আয়োজনে ডাকা এই অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে। আজ মিতার সন্মানে যে অনুষ্ঠান তোমরা করছ, তা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার দাবী রাখে। আজ সত্যিই খুব মন খারাপের দিন, কাল থেকে ও আর এইভাবে সবার সাথে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হইহই করতে করতে অফিসে যাবে না। কাল থেকে কেউ আর জগু,বাবাই, মন্টুর পিছনে লাগবে না, গান শোনাবে না। সবাই মিস করবে মিতাকে।
সবাই মাথা নীচু করে বোসদার কথা একমনে শুনছে। ওনার গলার আওয়াজের মাদকতায় সবাই বুঁদ হয়ে আছে।
ওকে কাল থেকে আমিও খুব মিস করব।
চমকে সবাই এ ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,“মানে?”
উনি সেই কথার উত্তর না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে চললেন..শুধু মিতাকে নয় তোমাদের সবাইকে খুব মিস করব। কাল থেকে আমিও আর আসব না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা তোমাদের এই প্রথমবার জানচ্ছি, মিতা আমার স্ত্রী নয়, প্রেমিকাও নয়। বন্ধু বলতে যা বোঝায়, তাও হয়ত নয়। কারণ একে অপরের বিপদে আপদে, ভালয় মন্দয় আমরা একে অপরের পাশে যদি না থাকতে পারি. তাহলে তাকে কি আর বন্ধু বলা যায়? সবার মনে তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, সম্পর্ক টা আসলে কি? উত্তর হবে কিছুই না। একদম নিত্য সহযাত্রী। ঠিক তোমাদের সাথে যেমন দেখা হয় রোজ সকালের এই এক ঘন্টা, ওর সাথেও তাই হয়। কোনদিন কথা হয়, কোনদিন হয়না।
তোমরা পাশাপাশি বসতে দিলে কোনদিন গায়ে গায়ে একটু ছোঁয়া লাগে। তার বেশি কিছু নয়। প্রায় বছর পনের আগে তোমাদের মত এইরকম একটি গ্রুপে যাতায়াত করতে করতে আমাদের প্রথম দেখা হয়। তখন ওর পঁয়তাল্লিশ আর আমি পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই । বেশ কিছুদিন পর থেকেই বুঝতে পারি, ওর সাথে দেখা করার এক তীব্র আকুতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। গত পনেরো বছর আমরা একসাথে যাতায়াত করেছি। তবে ঐ শিয়ালদহ স্টেশন অবধি। আমি পাঁচ বছর আগে অবসর নিয়েছি চাকরি থেকে, দিনটা ছিল শনিবার। তোমরা ঘটা করে ফেয়ারওয়েল দিয়েছিলে। কিন্তু পরের সোমবারেই আবার এই ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
তোমরা জিজ্ঞেস করাতে, প্রাইভেট ফার্মের চাকরির মিথ্যে গল্প বলেছি। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে কি করা যায় ভেবেছি। তারপর কিছু না পেয়ে ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরেছি। আর এই রুটিন কাজ করে গেছি গত পাঁচ বছর। তোমাদের মত আমিও জানি মিতা বিবাহিতা, স্বামী আর দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। ব্যস আর কিছু অতিরিক্ত কখনোই জানতে চাইনি। জানতে চাইনি সে সুখী কিনা। সে আমাকে ভালবাসে কিনা। তাকে স্পর্শ করা দুর, কোনদিন হাতটাও ছুঁয়ে দেখিনি, তা কতটা ঠান্ডা বা কতটা গরম। কোন চাহিদা নেই, কোন যৌনতা নেই, কোন লালসা নেই, শুধু একটু চোখের দেখা। মিতা প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিলেও পরে আমার এই পাগলামো মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য ওর বরাদ্দ ছিল এই অফিস যাওয়ার সময়টুকু।
দুটো মন কারো ক্ষতি চায়নি। চেয়েছিল বাঁধা সময়ের একটু সঙ্গ। আর তার জন্য শীত গ্রীষ্ম বরষা সব বাধাকে উপেক্ষা করে ট্রেন ধরতে আসা। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস যে করেনি, তা নয়। করেছে। মিথ্যে বলেছি। বলেছি সকালের দুঘন্টার কাজ।
বোসদা কিছুক্ষণ থেমে দম নিলেন। তারপর ধরা গলায় আবার শুরু করলেন, কাল থেকে এই ব্যস্ততা আর থাকবে না। থাকবেনা সকালে উঠেই ট্রেন ধরার তাড়া। তোমাদের সাথে কাটাতে পারার এই মূল্যবান মূহুর্ত। সব কিছু থেকে ছুটি। আমি যেন এই প্রথম অবসর নিলাম। কাল থেকে তোমাদের সাথে আর দেখা হবেনা । সবাই ভাল থেকো সুস্থ থেকো।
মিতার বাকি জীবন ভাল কাটুক এই কামনা করি। যেখানেই থাকো যেভাবেই থাকো হেসে খেলে কাটিও। তোমরা সবাই ভাল থেক।
আমি আমার তরফ থেকে একটা ছোট্ট উপহার মিতাকে দিতে চাই।
মিতাদি উঠে দাঁড়িয়ে বোসদার হাত থেকে পাওয়া উপহারের মোড়ক খুলে ফেলতেই, বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট পকেট ডায়েরি। পাতা উলটে দেখা গেল, বোসদার মিতাদির সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত কি রঙের শাড়িতে কেমন লাগছিল, লেখা আছে। ডায়েরি টা শেষ হয়েছে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে..
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা........
মিতাদি সবার জন্যই রিটার্ণ গিফট নিয়ে এসেছিলেন। কারোর জন্য পেন, কারার জন্য গ্যাস লাইটার। বোসদার হাতেও একটা ছোট্ট গিফট প্যাক তুলে দিলেন। খুলে বার হল, একটা ডিজিটাল ঘড়ি। এলার্ম দেওয়া। সময় ৯.০৮। এলার্মে সেট করা গান ভেসে উঠল..
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে ম'ম।
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমায়
নিশীথিনী সম।...
সারা কম্পার্টমেন্ট বাকরুদ্ধ। পাশের লোকের নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।কারো আর কথা বলার ক্ষমতা নেই।
ট্রেন খুব ধীরে শিয়ালদহ স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্ম ছুঁল। ঘড়িতে দশটা বেজে দু মিনিট।
ট্রেন থেকে নেমে যন্ত্রচালিতের মতো হেঁটে চলেছি। ভাবছি এই সম্পর্ককে কি বলা যায়? পরকীয়া, অবৈধ না কি প্লেটোনিক। যাইহোক, এটা একটি অমূল্য ভালোবাসা যা আমরা সচরাচর দেখতে পাই না। এরকম সুন্দর একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে পারে কত জন ? বিচ্ছেদের বেদনা থাকলেও এরকম একটি স্বর্গীয় ভালোবাসার সাক্ষী থাকতে পারাটা আমার কাছে এবারের পুজোর সবচেয়ে বড় উপহার প্রাপ্তি ।

