Sougat Rana Kabiyal

Inspirational

3  

Sougat Rana Kabiyal

Inspirational

প্রজন্ম সাধ

প্রজন্ম সাধ

6 mins
785


জয়ী কর্মকে অতিক্রম করার ইচ্ছে সকলের থাকে, মল্লিক বাবুর ও তার ব্যতিক্রম নয় ! সময়কে জানার খুব শখ ছিলো যে কিশোরের, আজ তার সায়াহ্ন উঁকি দিচ্ছে অনেকটা হতাশার আলোকচ্ছটায় ! অবশ্য জীবনে মল্লিক বাবু কখনো আক্ষেপ না করে চলতে পারেননি, হয়তো শেখা হয়ে ওঠেনি সেই মহার্ঘ্য বিদ্যেটা ! ছেলেবেলায় এক পাল ভাই- বোনের মধ্যে মায়ের কাছে লক্ষী ছেলে হতে গিয়ে যে নকল হাসিটা শেখা হয়ে যায়, সেটা আজও চলছে পথ ঘাট প্রান্তর পেড়িয়ে ! খুব সাধ ছিলো নিজেকে আয়নায় দেখে সুখী হওয়ার, কিন্তু সেটা আর হলো কই? মধ্যবিত্ত সংসারে গড়পড়তা পড়াশুনোতে যতোটুকু প্রতিষ্ঠা ভাগ্যে জোটে, ঠিক ততোটুকুই পেয়েছেন মল্লিক বাবু, তথাপি সময়টাকে হয়তো মেলাতে পারেননি কারো চোখের কোনের রঙ্গিন আরশিতে ! একদিন স্কুল থেকে ফিরে যখন শুনলেল, জন্মদাতা পিতা অনন্যা এক নারী সঙ্গমে প্রকাশ্যে ধরা পড়ে তথাকথিত সমাজ তরুনদের হাতে মৃত হয়ে ঘরে ফিরেছেন, সেদিন আর ঘরে ঢোকেননি মল্লিক বাবু ! পিতার মুখাগ্নি করার অনেক আছে সংসারে, এক মল্লিক বাবু যদি না থাকেন তবে অভিশ্যির ফলাহারে কিছুটা সঞ্চয় হবে বৈ কি ! সেই যে ফুটপাতে অভিমানি যুবকের রাত্রিযাপন শুরু, তারপর অনেক দিন গেছে উপোষী উদোম অঙ্গ প্রদর্শনে অদ্ভুত এক আনন্দ সুখ পেয়েছেন মল্লিক বাবু ! তারপর অনেক বছর গেছে, একটা ফটোগ্রাফি দোকানে ঝাড়ামোছা থেকে শুরু করে আজ সেই ফটোগ্রাফির একটা দোকানের মালিক হয়েছেন লোকের চোখে সংগ্রামী প্রতিষ্ঠিত মল্লিক বাবু !

কথায় কথায় পাড়ার এক সুন্দরী বারবনিতা যখন একদিন একদিন চলতি অটোতে বলে বসলো, "মল্লিক, তুই কি আমাকে বিয়ে করবি ?" আচমকা এক ঝটকায় সেই বারবনিতার বুকের থেকে লুকিয়ে দেয়া হাতটা সরিয়ে নিয়ে মল্লিক বাবু সেদিন মাথা নিচু করে ছিলেন দীর্ঘক্ষন ! সেই দিন কিছু না বলে বাড়ী ফিরে রাজ্যের হিসেব করে পরেরদিন সেই বারবনিতা, কল্পনার বাসায় হাজির হয়েছিলেন মল্লিক বাবু ! কল্পনার বাবা মা কেও ছিলেন না, একাকি কল্পনা কলেজ জীবনে এক ছেলেকে খুব ভালোবেসে একদিন সমুদ্র সঙ্গমে গিয়ে হয়েছিলো গন ধর্ষিতা, তারপর থেকে কল্পনা সমাজের অতি পরিচিত এক বারবনিতা ! 

এলাকার সুধী শাল গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে মল্লিক বাবু সেদিন হাজারো শর্ত শুনতে শুনতে মাঝ পথে মল্লিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলো, "আমারও কিছু কথা ছিলো" ! থমকে গিয়ে সেদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কল্পনা শুনেছিলো মল্লিক বাবুর ঘামে ভেজা মুখের কথা ! মল্লিক বাবু সেদিন খুব সুন্দর করে কল্পনাকে বুঝিয়েছিলো কল্পনা কেন তাকে বিয়ে করবে ! মাত্র প্রায় মিনিট দশের কথায় কল্পনা বুঝেছিলো মল্লিক বাবু মানুষ ততোটা খারাপ নন ! দুজনেরই দরকার ছিলো সমাজের সিকৃতি, তাই দুজনেই খুব খুশী মনে সাত পাঁকে নিজেদের বেঁধেছিলো ফানুস সংসারে ! এলাকা থেকে খুব দূরে গিয়ে মল্লিক আর কল্পনা ঘর বেঁধেছিলো সেদিন ! খুন ছিমছাম সেই সংসারে ঘর আলো করে এসেছে দুটো কন্যা সন্তান । মল্লিক বাবু কখনো কল্পনাকে প্রশ্ন করেননি, মেয়েদের বাবা কে? যখন কল্পনা অন্য পুরুষের সাথে বিদেশ ঘুরে বাড়ী ফিরে মল্লিকের জন্য দামী দামী সেন্ট ঘড়ি নিয়ে আসতো, মল্লিক বাবু সেদিন চোখ ছলছল কৃতজ্ঞতায় কল্পনার উপহার গ্রহন করতো ! আজকাল মল্লিক বাবুর সমাজে পরিচয় হয়েছে, প্রথম যেদিন কল্পনা বলেছিলো যে সে মা হতে চলেছে, সন্তানটা সে রাখবে কিনা? সেদিন মল্লিক বাবু এক আকাশ আনন্দ নিয়ে বলেছিলো," কেন নয়? এটা তোমার সন্তান, তার মানে এটা আমার ও সন্তান"! তারপর জীবনে প্রথম ভালোবাসা চুম্বনে মল্লিক বাবুকে কল্পনা আদর করে বুঝিয়েছিলো তার কৃতজ্ঞতা ! অনভ্যস্ত মল্লিক বাবুর মন সেদিন খুব স্বামী হতে চেয়েও পারেনি ! বিধাতা খুব রসিক বটে, আপন মনে কতো কি ভাবার অধিকার দিয়েছেন কিন্তু পূর্ন করার অধিকারের পায়ে পড়িয়ে দিয়েছেন সোনার শেকল !

আজ বাড়ীতে খুব হৈহুল্লোর, মল্লিক বাবুর ছোট মেয়েটার আজ বিয়ে ! বড় মেয়ে সংসার করবে না বলে ঘোষনা দিয়েছে, এখন দিল্লিতে বড় মাইনের চাকরি নিয়ে নিজের মতো করে থাকে । এই ছোট্ট মেয়েটাই মল্লিক আর কল্পনার সংসার আঁকড়ে রেখেছিলো এতোদিন ! বর, ছেলে খুব ভালো, বিমানবাহিনীর বড় পদে চাকুরে ! আজ মল্লিক-কল্পনার খুব সুখের দিন, তারপরও মল্লিকের বুকটা হাউমাউ করে কাঁদছিলো,

চুপিচুপি ছাদে গিয়ে একটু শান্তি খুঁজছিলো অস্থির মনটার জন্য ! 

হঠাৎ পেছন থেকে হলুদ মাখা হাতে মেয়েটা জড়িয়ে ধরলো মল্লিক বাবুকে,

" বাবা তুমি একদম কাঁদবে না বলে দিচ্ছি, ছেলেবেলায় যখন তুমি বাড়ীর দূরে যেতে আমি কি কাঁদতাম বলো?" জলভরা চোখে মল্লিক বাবু সেদিনের দেই ছোট্ট মেয়েটিকেই যেন দেখতে পাচ্ছিল ! হুট করে একটা সাদা খাম মেয়েটা মল্লিক বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কঁপালটা জোড় করে কাছে টেনে চুমু খেয়ে এক ছুটে নিচে নেমে গেলো ! মল্লিক বাবু পেছন থেকে চিৎকার করেও জানতে পারলো না কাগজে কি লেখা আছে? পাগলি মেয়ে একটা ! 

জল চোখে খাম খুলে মল্লিক বাবু যেন এক দিগন্ত সুখ পেল, মেয়েটার সেই গুটি গুটি হাতের মিষ্টি লেখা,

  প্রিয় বাবা,

জানি খুব অবাক হচ্ছো তুমি, তবুও তোমার এই পুচকি আজ চিঠি লিখছে তোমাকে ! জানো বাবা, আমি যেদিন মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে তোমাকে জানাতে এসেছিলাম, সেদিন থেকেই আমার খুব ইচ্ছে আমি তোমাকে চিঠি লিখবো ! ছেলেবেলা থেকেই তুমি ছিলে আমার রাজকুমার ছেলে, সেই বেলায় যখন তুমি আমার সাথে নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে আমার বন্ধু হয়ে আমার সাথে মিশে যেতে,তখন আমি তোমাকে আমার সবচাইতে ভালো বন্ধু ভাবতাম ! একদিন কথায় কথায় মা একদিন গল্প করে বলেছিলো," জানো অরিত্রী, তোমার বাবার মা হচ্ছো তুমি"! আমি সেদিন কি যে খুশী হয়েছিলাম, ভাবতাম তুমি আমার এই ছোট্ট পেটে হয়েছো, আমার রাজকুমার ছেলে তুমি ! আচ্ছা বাবা, তুমি কি জানো তুমি কতোটা ভালো মানুষ? সেদিন আমার গোপালের উপর খুব রাগ হয়েছিলো, যেদিন বুঝেছিলাম তুমি আমার জন্মদাতা নও ! যেদিন কথায় কথায় ঝগড়াতে মা তোমাকে পুরুষত্বহীন বলে ভর্ৎসনা করেছিলো, সেদিন আমি ঠাকুর ঘরে খুব কেঁদেছিলাম বাবা ! কি করে তুমি আমার বাবা নও, তুমিই বলো? আমি ছোট মানুষ, বুঝি কম, কিন্তু এটা বুঝি যে তোমার চাইতে ভালো বাবা কেও হতে পারে না ! শারিরীক ক্ষমতা অক্ষমতায় মানুষের চরিত্র প্রকাশ পায় না ! জম্মদোষে অক্ষমতায় যে ক্লিবত্ব, তাতে যদি কোন অপরাধ থেকে থাকে তবে সেটা বিধাতার সৃষ্টিতে , তোমাতে নয় বাবা ! আমি কখনো ভুলেও আমার জন্মদাতাকে খুঁজিনি ! দিদির সাথে এটা নিয়ে আমার অনেক ঝগড়া হয়েছে, দিদি তোমার আর মার উপর অভিমান করে দূরে সরে গেছে, আমিও দিদিকে কিছু বলিনি, এটা ওর ব্যক্তি স্বাধীনতা ! আমি জীবিত মৃত পিতা চাইনি কখনো, চেয়েছিলাম ঠিক তোমার মতো একটা বাবা, তুমি আমার সত্যিকারের রাজকুমার ছেলে ! অনেক ভেবেছি, তোমাকে লিখবো কিনা? কিন্তু বিশ্বাস করো বাবা, তোমার এই লুকিয়ে কান্নাটাকে আমি জাস্ট নিতে পারছিলাম না, পিতৃত্ব শুধু শরীরেই হয় না, আসল পিতৃত্ব হচ্ছে পুরুষের মননে ! তাই আমি চেয়েছি তোমার ভেতরের অপরাধ বোধ থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে বাবা ! জানো বাবা, আমার খুব ইচ্ছে আমার ঘরে যখন একটা শিশু আসবে, তার সাথে ঠিক মানুষের চলন্ত ভিড়ে তুমি তেমনটাই বন্ধু হবে যেমনটা হয়েছিলে আমার ! খুব খুব ভালো থেকো আমার রাজকুমার বেটা ! না, একদম না, একদম কাঁদবে না, তারাতারি ফ্রেশ আমার কাছে এসো ! আজ উপবাসের মাঝেও বাপ বেটি মিলে তোমার প্রিয় বিড়িয়ানি খাবো লুকিয়ে লুকিয়ে ! চিলেকোঠায় প্যাকেট দুটো রাখা আছে, সেগুলো নিয়ে তুমি তারাতারি চলে এসো আমার ঘরে, খুব ক্ষিদে পেয়েছে ! আর হ্যাঁ, মাকে ক্ষমা করে দিও, দিদিকেও, আমি অবশ্য জানি তুমি সেটা আগেই করেছো ! খুব ভালো থেকো আমার রাজকুমার বেটা । 

                                ইতি - তোমার কুট্টি মেয়ে রাজেশ্বরী 

মাথার উপর মেঘলা আকাশটা হঠাৎ ঊজ্জল হয়ে গেলো, গাছের পাতা, বাতাসের নাচন, বিয়ের বাজনা, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব সব মিলে একাকার হয়ে গেলো মল্লিক বাবুর চোখে ! এক মুঠো ভালোবাসা লুকিয়ে নিয়ে পাগলের মতো রাজেশ্বরীর রাজকুমার বেটা ছুটে চললো এক হিমালয় মৌন কষ্ট পেছনে ফেলে তার মায়ের কাছে ! 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational