পরিবেশেপ্রেমী নারীর গল্প
পরিবেশেপ্রেমী নারীর গল্প
পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার জন্য পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে আমরা অনেকেই সেই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাই। পৃথিবীর বহু দেশে উন্নয়নের নামে নেয়া অনেক উদ্যোগ সেসব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনলেও সেখানকার পরিবেশকে করেছে বিপর্যস্ত। আর তাই আজ সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন ফোরাম থেকে প্রবল দাবি উঠছে।
এই পরিবেশকে রক্ষার জন্য কত মানুষের নিরলস চেষ্টা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কেউ গাছ কাটা ঠেকানোর জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদ করেছেন, কেউ পরিবেশের ক্ষতি রুখতে জনমত গঠনের জন্য দিনের পর দিন অনশন করে গেছেন, আবার কেউ তার লেখনীর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন পরিবেশ দূষণ ও তার ক্ষতিকর প্রভাব। এমনই একজন অসামান্য নারীর নাম কিঙ্করী দেবী।
কিঙ্করী দেবী , পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে “ঝাঁসি কি রানি লক্ষ্মীবাঈ স্ত্রী শক্তি” পুরস্কারে সম্মানিত এক নারীর নাম। এই নারীর জন্ম হিমাচল প্রদেশের ঘাতন গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো পৌঁছয় না এইরকম পরিবারে, তাই স্বভাবতই পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত হয়নি তাঁর; প্রয়োজনের তাগিদে সইটুকুই শিখে নিয়েছেন কেবল। অল্প বয়সে বিয়ে এবং মাত্র ২২ বছর বয়সেই বৈধব্য – এক দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের নারীর ছকে বাঁধা জীবন। কিন্তু জীবনের শুরুটা চেনা ছকে আঁকা হলেও, সেই ক্যানভাসে ছকভাঙা রং মিশিয়েছিলেন কিঙ্করী দেবী।
বৈধব্য-পরবর্তী জীবন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটলেও সে দুঃখকে তিনি জয় করে নিচ্ছিলেন নিজের পথেই। সামাজিক বিদ্যালয়ের পাঠ তাঁর কাছে না পৌছালেও পরিবেশের পাঠ গ্রহণে ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতির কাছে আগ্রহী ছিলেন তিনি। স্বামীকে হারানোর পর পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে পরিবেশ-প্রকৃতিকে আগলে রাখার দায়িত্ব তুলে নেন তিনি নিজের কাঁধে। পরিবেশই প্রকৃত বন্ধু। সকলে মিলে সেই বন্ধুকে সুস্থ রাখার স্বপ্ন দেখতেন কিঙ্করী দেবী।
কিঙ্করি দেবী (30 জানুয়ারী 1925 - 30 ডিসেম্বর 2007) ছিলেন একজন ভারতীয় কর্মী এবং পরিবেশবাদী, যিনি তার নিজ রাজ্য হিমাচল প্রদেশে অবৈধ খনন ও খননের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত । তিনি কখনই পড়তে বা লিখতে জানতেন না এবং তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কীভাবে তার নাম স্বাক্ষর করতে হয় তা শিখেছিলেন।
তিনি তার দারিদ্র্যের জন্য সুপরিচিত হয়ে ওঠেন, যা শেষ পর্যন্ত হিমাচল প্রদেশের মার্কিন ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা দ্বারা তার জীবনযাত্রার অবস্থার একটি পাঞ্জাবি সংবাদপত্রের বিবরণ পড়ার পরে সহজ হয়েছিল।
শৈশবের শুরুতে:
দেবী 1925 সালে সিরমাউর জেলার ঘাটন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা ছিলেন দলিত বা অস্পৃশ্য বর্ণের একজন ভ্রাতা চাষী । তিনি তার শৈশবকালে চাকর হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৪ বছর বয়সে বন্ড মজুর শামু রামকে বিয়ে করেন ।
কিন্তু বাস্তব তাঁর সামনে নিয়ে এল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। হিমাচল প্রদেশের দুন উপত্যকাটির চুনাপাথরের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল। আর সেই নাম-ডাক-খ্যাতিই হয়ে উঠল এই অঞ্চলের কাল। এমন জিনিস তো শুধু শুধু ফেলে রাখা যায় না! একে উপযুক্তভাবে ব্যবসায় লাগাতে পারলে লাভ হবে বিপুল। আর তাই সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীদের ভিড় জমতে থাকে উপত্যকা জুড়ে। ১৯৮৫ সালে ব্যবসার পথ সুগম করতে শুরু হল খনি থেকে চুনাপাথর তুলে আনার কাজ। চলতে লাগল খননকার্য আর ব্যবসা বিস্তার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার কুপ্রভাব এলাকাবাসীর চোখে পড়তে থাকল। হিমাচল প্রদেশের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়ে চলা জলপ্রবাহের স্বাভাবিকতার উপর প্রভাব ফেলতে থাকে এই খননকার্য। চুনাপাথর তুলে আনার খননকার্য চালানোর জন্য এই অঞ্চলের জলের স্রোত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলত খুব দ্রুত এই অঞ্চলের জলের স্তর অনেক কমে যেতে থাকে এবং পর্যাপ্ত জল না পাওয়ার কারণে এই এলাকায় বিপুলভাবে চাষের ক্ষতি হতে শুরু করে,পরিবেশ প্রকৃতি প্রায় শুকিয়ে যেতে থাকে।
ঝাড়ুদার হিসাবে তার নতুন চাকরিতে কাজ করার সময়, দেবী হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ের কিছু অংশে বিশাল খনন, জল সরবরাহের ক্ষতি এবং ধানক্ষেত ধ্বংস করার বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন।
কিঙ্করী দেবী স্পষ্টতই বুঝতে পারেন, প্রকৃতির এই শুকিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে জলের অভাব, যার উৎস চুনাপাথরের জন্য চালানো খননকার্য। এই সময়ে দেবী নিজেই খনির দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়টি চোখের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই সম্পর্কের স্থানীয় মানুষজনকে সচেতন করতে তৎপর হন, এবং সেই স্থানীয় মানুষজন ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাশে নিয়েই তিনি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন খননকার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
সক্রিয়তা:
একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী, পিপলস অ্যাকশন ফর পিপল ইন নিড, দেবীকে সমর্থন করেছিল কারণ তিনি 48 জন খনি মালিকের বিরুদ্ধে [শিমলার] হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন৷ তিনি অভিযোগ করেন যে কোয়ারিয়াররা তাদের চুনাপাথর খননে বেপরোয়া ছিল, যদিও দলটি তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে, দাবি করেছে যে সে কেবল তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে।
তার মামলা কার্যত কোন সাড়া পায়নি, তাই দেবী আদালতের বাইরে 19 দিনের অনশনে গিয়েছিলেন। আদালত যখন বিষয়টি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দেবী জাতীয় সেলিব্রিটি হয়ে ওঠেন। আদালত 1987 সালে খনির উপর স্থগিতাদেশ দেয় এবং তার প্রিয় পাহাড়ে ব্লাস্টিংয়ের উপর কম্বল নিষেধাজ্ঞা জারি করে। খনি মালিকরা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন, যারা তাদের আবেদন 1995 সালের জুলাই মাসে প্রত্যাখ্যান করে। তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন তার প্রতি আগ্রহ নিয়েছিলেন এবং সেই বছরই দেবীকে আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বেইজিং এ তাকে অনুষ্ঠানের শুরুতে বাতি জ্বালাতে বলা হয়েছিল, এবং তিনি যে কারণের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়ে কথা বলেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও, পাহাড় ও বন সংরক্ষণে অবৈধ খনি এখনও অব্যাহত রয়েছে, যদিও হ্রাস পেয়েছে। তার পরিবেশবাদের পাশাপাশি, দেবীর অন্য একটি প্রচেষ্টা ছিল সাংগ্রায় একটি ডিগ্রি প্রদানকারী কলেজ
তৈরির জন্য প্রচার চালানো । তিনি দাবি করেছিলেন যে লেখাপড়া করা তার পক্ষে ঠিক ছিল না, তিনি চান না "শিক্ষার অভাবের জন্য আমি যেভাবে ভুগেছি অন্যরা সেভাবে ভুগুক।"
মৃত্যু:
দেবী 30 ডিসেম্বর 2007 সালে ভারতের চণ্ডীগড়ে 82 বছর বয়সে মারা যান।
পুরস্কার:
1999 সালে, দেবী ভারত সরকার কর্তৃক নারী শক্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।
জাতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি হয়ত সেইভাবে হেডলাইন হয়ে উঠতে পারেননি, পরিবেশ বাঁচাতে চেয়ে জেলে যাওয়ার যুগে তিনি এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়; তবু তাঁর জীবন আমাদের বুঝতে শেখায় কেতাবি শিক্ষার বাইরেও প্রকৃতিশিক্ষার বোধ থাকা জরুরি, সেই শিক্ষার অস্ত্রে এই নীলগ্রহ ভালো রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়া দরকার। কিঙ্করী দেবীর কাহিনি তাই আমরা ফিরে ফিরে দেখি প্রতিবার।
তথ্য : আন্তর্জাল, উইকিপেডিয়া ও পত্র পত্রিকা।
