ফেরারী মন
ফেরারী মন


বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই জানালায় চলে আসেন পৃথ্বীশ বাবু। অপেক্ষায় থাকেন ভাই স্বরূপ প্রতিবেশী তাপস বাবুর। সেই কবে তাস খেলার আসর গেছে ভেঙে, এখন কেবল একাকীত্বের সাথে দাবা ঘুঁটি চালাচালি চলে । তবুও মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম ঘটে যায় যখন জিমন্যাস্টিক দেখায় শরীরের বুড়ো হাড় আর তার কলকব্জারা। বিনোদন বলতে চলতে থাকা টিভি চ্যানেলের ফেনা তোলা দৈনন্দিন জীবনের কুৎসিত কিছু ধারাবাহিক আর তাপসের মতোন বন্ধু কাম ভাইয়ের সাথে একটু আই লিগ বা ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলার দেখার সময়টুকু।
এক সময় পুলিশ অফিসের দাপুটে বড় বাবু হয়ে থাকা মানুষটাকে এখন দেখলে কেউ চিনতেই পারবেনা। বাড়়িতে সকলেই যেন তাকে ব্রাত্য রাখে সকল কাজে। স্ত্রী কে হারিয়েছেন তাও নেই নেই করে বছর পঁচিশ হলো। আজকাল নাতি নাতনীরা আসেনা কাছে, চাকরী পেয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। মাঝে মধ্যে ফোনে তারা যা প্রশ্ন করে তার অর্ধেক উত্তর মনে করতেই পারেন না পৃথ্বীশ বাবু। অ্যালঝাইমার রোগ---বেশ কিছু দিন হলো নিজের নাম, বাথরুম, ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবার খেয়েই ভুলে যাচ্ছেন তিনি ।
পিসির বাড়িতে ঘুরতে আসা আরণি, পৃথ্বীশের ঘরের দেওয়াল আলমারির ভর্তি বইগুলোতে চোখ বোলাতেই সরাসরি প্রশ্ন হাঁকিয়ে বসলো!
"দাদু তুমি কার্ল মাক্সের ক্যাপিটালের সব পার্টটা পড়েছো? শেক্সপীয়ারের হ্যামলেট? কোন বইটা শেষ পড়েছো দাদু ?"
প্রশ্নটা শোনা মাত্র পৃথ্বীশ বাবু সুর করে গাইলেন,
'ছোট খোকা বলে অ আ / শেখেনি সে কথা কওয়া'
তারপরেই বললেন,
"নৌকাডুবি পড়েছি মনে হয় শেষ।"
আরণি বলে,
"রবীন্দ্র নাথের লেখা?"
খানিকটা চুপ করে থেকে পৃথ্বীশ বাবু উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়াল আলমারি থেকে হাতিয়ে বের করেন রবীন্দ্র রচনাবলী। পাতা উল্টাতে উল্টাতে শেষের কবিতা উপন্যাসের কাছে আসতেই একটা হলদে হয়ে যাওয়া চিঠির খামের মধ্যে একটা হলদেটে কাগজ, যাতে হাতে লেখা চিঠি, খুলে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন,
" নীলাম আজও তোমার অপেক্ষায় আমি! নীলিমা আমাকে ছেড়ে গেছে বহুদিন, আজ শুধু তোমার পথ চেয়ে থাকি আমি!"
অ্যালঝাইমার রুগীর স্মৃতির মণি কোঠায় ফেরারী মন আজও হাতড়ে বেড়ায় ফেলে আসা হলুদ চিঠির ভাঁজে পুরনো বইয়ের পাতার গন্ধে ফেলে আসা অজস্র স্মৃতির উপন্যাস !