ওপার থেকে
ওপার থেকে
খাদের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় জয়িতা। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এই খাদটা। ওর প্রথম প্রপোজ পাওয়া, প্রথম প্রেম, ওর বিচ্ছেদ, আর তারপর একদিন খাদের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করা। সেদিন এমনই একটা নতুন বছরের সুচনা ছিল। সৌরাসিসের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল কলেজে। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল জয়িতা। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। কলেজের জি.এস ছিল সৌরাসিস। সাধারন বাড়ির মেয়ে জয়িতা ভর্তি ফি তে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করছিল। তখনই সৌরাসিসের সঙ্গে আলাপ। ওকে হেল্প করেছিল সৌরাসিস। ভর্তি ফি কমাতে সাহায্য করেছিল। সেই থেকে সৌরাসিসের প্রতি একটা ভাললাগা তৈরি হয়ে গিয়েছিল জয়িতার মনে। সৌরাসিসের হ্যান্ডসাম লুক, ঘোলাটে চাউনি আর স্মার্টনেস যেকোনো মেয়েকে ফিদা করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার উপর সায়েন্সের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল সৌরাসিস, আগের বছরের কলেজের টপার, তাই সাদামাটা চেহারার জয়িতার মনে খুব সহজেই সৌরাসিসের জন্য জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পারতপক্ষে ওকে কিছুটা এড়িয়েই চলত সৌরাসিস। কিম্বা আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ওকে এক করে দেখত। খানিকটা মুখচোরা স্বভাবের ছিল জয়িতা। সৌরাসিস কে গিয়ে নিজের মনের কথা বলার ক্ষমতা ওর ছিলনা। কিন্তু একদিন মুখ ফস্কে ওর বান্ধবী অনুরিমাকে কথাটা বলে ফেলেছিল। কলেজ পার্টিতে যাতায়াত করার সুবাদে অনুরিমার সঙ্গে সৌরাসিসের আলাপ ছিল, তাই অনুরিমা সৌরাসিসের কানে গিয়ে কথাটা লাগায়, তারপর সৌরাসিস নিজে এসে জয়িতার সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করে। সময় খুবই কম পেত সৌরাসিস, কিন্তু যেটুকু পেত জয়িতাকে দেওয়ার চেষ্টা করত, আর এইভাবেই ওদের বন্ধুত্বের সূচনা হয়।
জীবনে একটা বয়স পর্যন্ত গুটিয়ে থাকার পরে সবারই পিঠে দুখানা পাখনা গজিয়ে যায়। তখন মানুষ ডানা মেলে উড়তে চায় মুক্ত বাতাসে। জীবনের অনুশাসন গুলোকে টপকে নিজেকে বন্য আবেগে ভাসিয়ে দিতে চায়। ঝিঁঝি ডাকা প্রান্তিক এক গ্রামের সাধারন মেয়ে জয়িতার শহরের ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা কলেজে এসে পৌঁছালেই মনে হত সে একটা আলাদা স্বপ্নের দুনিয়ায় পৌঁছে গেছে। তার সঙ্গে ছিল ওর স্বপ্নের পুরুষ সৌরাসিস। যার জন্য সে প্রতিটা দিন ছটফট করত। কখনো কলেজ ক্যান্টিনে, কখনো কলেজ চত্বরে গাছের তলায় আবার কখনো ছাত্র সংসদের রুমে বসে সৌরাসিসের জন্য অপেক্ষা করত জয়িতা। কখন ওর স্বপ্নের পুরুষ ওর পাশটিতে এসে বসবে। ওকে আধোআধো স্বরে জিজ্ঞেস করবে, "ভাল আছো তো?"
আর সে বলবে, "আমি খুব খুব ভাল আছি।"
সৌরাসিসকে ঘিরে সব সময় একটা ফ্যান্টাসি কাজ করত জয়িতার মনে। ও কি ভাবে হাঁটে, কিভাবে কথা বলে, কথার মধ্যে কি কি বিশেষণ ইউজ করে সব কিছুই মনে রাখত জয়িতা। পড়তে বসলেও মাঝেমাঝে বইয়ের উপরে ওর ছবিখানা ভেসে উঠত। জয়িতা বুঝতে পারছিল সে ধীরে ধীরে সৌরাসিসের সঙ্গে এক গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, যেখান থেকে ওর মুক্তি নেই।
তারপর এল সেই দিনটা। কলেজের দু'কিমির মধ্যেই একটা ছোট জলপ্রপাত ছিল। ঝরণার জল উপর থেকে গড়িয়ে পড়ত একশো ফুট নিচে। শাল আর কাজুর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা জায়গাটা সত্যিই খুব মনোরম ছিল। কলেজের অনেক ছেলে মেয়েই ওখানে আড্ডা দিতে যেত। সেদিন সকাল থেকে কলেজে আসেনি সৌরাসিস। বিকেলে কলেজ থেকে বেরিয়ে স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল জয়িতা, হঠাৎ একটা ছেলে বাইক নিয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়াল। হেলমেট খুলতেই সৌরাসিস কে দেখে অবাক হয়ে গেল জয়িতা। বলল, "আজ কলেজে এলেনা যে?"
সৌরাসিস বলল, "বাইকে চাপ, সব বলছি।"
বিনা বাক্যব্যয়ে সৌরাসিসের বাইকের পিছনে চেপে পড়ল জয়িতা। সৌরাসিস বলল, "তোর বাড়ি ফিরতে একটু লেট হলে প্রবলেম নেই তো? আমি তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব।"
জয়িতা বলল, "সন্ধ্যের আগে ফিরে যেতে পারলে কোনো প্রবলেম নেই।"
"আচ্ছা," বলে বাইক স্টার্ট করল সৌরাসিস। এসে থামল ঝরণার কাছে। বাইক থেকে নেমে খাদের পাশে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ল সৌরাসিস। জয়িতাও ওর পাশটিতে গিয়ে বসল। জিজ্ঞেস করল, "বলো কি বলবে?"
সৌরাসিস বলল, "আমার আর কলেজে পড়া হবে কিনা জানিনা। তবে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করব, আর কয়েকটা মাস, তারপর এই জীবনের মতো পড়াশুনা এখানেই সমাপ্ত।"
জয়িতা চমকে উঠল, "এ কি বলছ! এতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে তুমি! পড়াশুনা ছেড়ে দেবে?"
সৌরাসিস বলল, "আমার বাড়িতে কোটিটাকার ব্যবসা। বাবা অসুস্থ। একটা স্ট্রোক আগেই হয়েছিল আজ আবার সেকেন্ড স্ট্রোক হয়ে গেল। এই জাস্ট বাবাকে হাসপাতালে এ্যাডমিট করে আমি বাড়ি ফিরছি। ডাক্তার বলেছে এবারের মতো বেঁচে গেলেও বাবা আর কোনো দিনও চলা ফেরা করতে পারবেনা। এবারে পুরো ব্যবসা সামলাবার সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। এসব সামলে আমি কি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারব?"
চুপটি করে শুনতে লাগল জয়িতা। বলল, "আমি আর কী বলব তুমি যেটা ভাল বুঝবে করবে।"
সৌরাসিস বলল, "এবার থেকে তোকেও অনেক কিছু বুঝতে হবে, আমি তোকে আমার জীবনের সঙ্গী করতে চাই, রাজী আছিস তো?"
মাথা নিচু করল জয়িতা। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, "আমি আর কী বলব, যা ভাল বোঝ কর।"
সৌরাসিস বলল, "আজ খুব ক্লান্ত আছি, একটু আদর করবি আমায়?"
মাথা তুললনা জয়িতা। একই ভাবে মাথা নিচু করে থেকে বলল, "আমি আর কী বলব, যা ইচ্ছে হবে করো।"
ওকে দু'হাতে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিল সৌরাসিস। বলল, "পাগলি আমার! তোর নিজের ব্যাপারে কিচ্ছু বলার নেই?"
সৌরাসিসের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল জয়িতা। বলল, "আমি কতদিন ধরে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি জানো? কবে তুমি আমাকে মুখ ফুটে বলবে যে তুমিও আমাকে ভালবাসো।"
ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে সৌরাসিস বলল, "কাঁদিস কেন পাগলি? বলেছি তো নাকি? হয়তো একটু লেট করেছি এর বেশি তো কিছু নয়?"
আনন্দে জয়িতার বুকটা সেদিন খুব ফাঁকাফাকা লাগছিল। ওর কান্না কমেনি বরং বেড়ে গিয়েছিল। ওকে আদর করে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল সৌরাসিস। সান্ত্বনা দিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু সৌরাসিস কিভাবে বুঝবে এই কান্না ওর দুঃখের নয়, আনন্দের কান্না। নিজের মানুষকে একান্ত ভাবে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ।
কিন্তু মানুষের জীবনে আনন্দ বোধহয় বেশি দিন টেঁকেনা। কিছু কিছু ফুল ফোটার আগেই ঝরে পড়ে যায়। কিছু কিছু নদী মোহনায় মেশার আগেই ফল্গু হয়ে হারিয়ে যায় মাটির গভীরে, তেমনি এক বিকেলে রোদ তখন গাছের পাতায় আলতো চুমু দিতে দিতে ঢলে পড়ছে পশ্চিমের দিকে হঠাৎ আবার জয়িতার সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়াল সৌরাসিস। বলল, "তাড়াতাড়ি বাইকে চাপ, কথা আছে..."
বাইকে চেপে পড়ল জয়িতা আবার সেই ঝরণার পাশে এসে দাঁড়াল বাইক। বাইক থেকে নেমে সৌরাসিস বলল, "পারলাম না রে... আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারলাম না৷ বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসছে,আমি তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে চাইনা। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা, কিন্তু আমার জীবন যে ধ্বংস হয়ে গেছে।"
জয়িতা চমকে উঠল, "কি বলছ এসব?"
সৌরাসিস বলল, "এবছর ব্যবসায় কয়েক লক্ষ টাকা লোন করে ফেলেছি,এখন হাত একেবারেই খালি।মা বলছে একটা ভাল সম্বন্ধ আসছে, ওরাও ব্যবসায়ী ফ্যামিলির.. মেয়েটাকে বিয়ে করলে ওদের ফ্যামেলি আমাদের ফ্যামেলিটাকে বাঁচিয়ে দেবে। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা!ফ্যামিলিকে বাঁচাতে বিয়ে করব, নাকি তোর সঙ্গে কোথাও পালিয়ে যাব..."
জয়িতা বলেছিল, "মানুষের কাছে সবার আগে ফ্যামিলি। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে আমারও কষ্ট হবে, কিন্তু আমি মেনে নেব।তোমার ভালর কথা ভেবে আমি সব দুঃখকে স্বীকার করে নেব, শুধু তুমি ভাল থেকো।"
ধুমধাম করে সৌরাসিসের বিয়ে হয়ে গেল। আর জয়িতা ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে ধুঁকতে লাগল। সব চেয়ে খারাপ লাগল বিয়ের আগে বা পরে জয়িতার কোনো খোঁজ খবর নিলনা সৌরাসিস। হতাশায় ভেঙে পড়তে পড়তে আবার সেই খাদের পাশে এসে দাঁড়াল। আজ যদি সে ডানা মেলে এই খাদের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর কেউ কোনো দিন ওর কোনো খোঁজ না পায়...? ভাবতেই ওর বুকের ভিতরে একটা শিহরন খেলে গেল।
"কি করছেন ম্যাডাম? মরবেন নাকি? খাদের এত পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন?"
পিছন থেকে কারো একটা ডাকে চমকে পিছনে তাকাল জয়িতা। দেখল একটা ছেলে খাদে বেড়াতে এসেছে। এই ছেলেটাকে এর আগেও দু'একবার দেখেছে। খাদের পাশে একাই এসে বসে। একটা সিগারেট খায়, তারপর উঠে চলে যায়। খাদের সামনে থেকে পিছিয়ে এল জয়িতা। বলল, "আমি মরি বা বাঁচি তাতে আপনার কী?"
ছেলেটা বলল, "প্রেমে ধোঁকা খেয়েছেন মনে হচ্ছে। আমিও খেয়েছিলাম ম্যাডাম। প্রায় ছ'বছর আগে। সেদিন থেকে প্রতিদিনই সুইসাইড করার কথা ভেবে এই খাদের কাছে আসি, একটা সিগারেট খাই, তারপর ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যায়।"
জয়িতা বলল, "আপনাদের তো তবু মন ভাল করার জন্য সিগারেট আছে, আমাদের কি আছে বলুন?"
ছেলেটা বলল, "আপনাদের জন্য তো আমি আছি। আসুন বসুন একটু গল্প করি।"
ছেলেটাকে খুব সুবিধের বলে মনে হলনা জয়িতার। তবু ছেলেটার ডাকে কিছু একটা ছিল যেটা সে এড়াতে পারলনা। ছেলেটার পাশে গিয়ে বসে বলল, "এভাবে কত মেয়েকে নিয়ে ফ্লার্ট করেছেন?"
ছেলেটা ফ্র্যাঙ্কলি বলল, "আপনাকে নিয়ে তেত্রিশ নম্বর। এর আগেও আরো তেত্রিশ জন আপনার মতো সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে, আর আমার সঙ্গে কথা বলার পরে তাদের সুইসাইডের ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে।"
জয়িতা বলল, "আপনার মধ্যে ম্যাজিক আছে নাকি যে আপনার সঙ্গে কথা বললেই মানুষের সুইসাইড করার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়?"
ছেলেটা বলল, "তা বলতে পারেন। যাইহোক আপনি তো জয়িতা রায়, সেকেন্ড ইয়ার ইংলিশ নিয়ে পড়েন, সৌরাসিস নামে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করতেন, প্রেমে কোঁতকা পেয়ে সুইসাইড করতে এসেছেন, তাই তো?"
জয়িতা বলল, "একেবারে হাঁড়ির খবর নিয়ে এসেছেন দেখছি, তা আপনার নাম জানতে পারি?"
ছেলেটা বলল, "আমার নাম নিলাদ্রি, নিলাদ্রি সেন। আর হাঁড়ির খবর মানে আমি আপনাদের ভুত,ভবিষ্যৎ সব কিছুই দেখতে পাই। ভাল কথা, বাড়িতে অসুস্থ মাকে ফেলে চলে এলেন। আপনার বাবা তো বাইরের কোম্পানীতে জব করে, মাকে দেখার মতো কেউ নেই, আপনার মা'র এতক্ষনে কী অবস্থা হয়েছে জানেন কি?"
নিলাদ্রির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল জয়িতা। বলল, "কি হয়েছে মায়ের? প্লিজ বলুন।"
নিলাদ্রি বলল, "দু'মিনিট অপেক্ষা করুন, একটা এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পাবেন। ওই
এ্যাম্বুলেন্সে করে আপনার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে আপনার কাকু-কাকিমা। হাসপাতালের পনেরো নম্বর কেবিনে আপনার মা'কে ভর্তি করা হবে। আপনি এত স্বার্থপর ম্যাডাম, নিজের কথা ভেবে নিজের জন্মদাত্রীকে ভুলে গেলেন?"
দু'মিনিট অপেক্ষা করতে হলনা। ঠিক দেড় মিনিটের মাথায় এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পেল জয়িতা। আর বসে থাকতে পারলনা সে, ছুটতে ছুটতে সোজা রাস্তায় চলে এল। কলেজ থেকে হাসপাতালের দুরত্ব খুব বেশি নয়, একটা অটো পেতেই তাতে চড়ে সোজা হাসপাতালে চলে এল। হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতে ঢুকতে কাকু,কাকিমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাকুর দিকে তাকিয়ে জয়িতা বলল, "মায়ের কি হয়েছে কাকু?"
ওর কাকু বলল, "খুব ঠান্ডা লেগে বুকে কফ বসে গেছে, শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল, তাই হাসপাতালে নিয়ে এলাম। পনেরো নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে, অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, এখন অনেকটাই সুস্থ।" তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই কোথা থেকে খবর পেলি? তুই তো কলেজে ছিলি?"
জয়িতা বলল, "একটা বন্ধুর মুখে জানতে পারলাম। মা এখন ভাল তো?"
ওর কাকু বলল, "এত চিন্তা করার কিচ্ছু নেই, ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তোর মা।"
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জয়িতা। গাছের তলায় বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আজ সে কি করতে যাচ্ছিল? ওর ফ্যামিলির কারো কথা না ভেবে, একটা স্বার্থপরের জন্য নিজের জীবনটাকে শেষ করে ফেলতে যাচ্ছিল? ছি! ছি! নিজের উপরে নিজের ঘৃনা হতে লাগল জয়িতার।
পরপর তিনদিন ঝরণাতে গিয়ে ঘুরে এল জয়িতা। নিলাদ্রির দেখা পেলনা। ছেলেটা কে, কি করে, কোথায় থাকে, কিভাবে ওর ব্যাপারে এত কিছু জানল, সে কি সত্যিই ভবিষ্যত দেখতে পায়, নাকি পুরোটাই ভুয়ো? সব কিছু জানার একটা ঝোঁক চেপে গেল জয়িতার মনে। কিন্তু নিলাদ্রির দেখা পেলনা।না, নিলাদ্রি সব দিন আসতনা এখানে। মাঝেমাঝে আসত, আর এলে খুব বিরক্ত হত জয়িতা। ওদের একান্তে কাটানো খানিকটা সময় নষ্ট হত বলে ওর মনে হত। আজ সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করার খুব কৌতূহল হচ্ছে জয়িতার মনে। কিন্তু সে কবে আবার আসবে?
সেদিন ছিল শনিবার৷ কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ঝরণার কাছে আসতেই এ
কটা পাথরের উপরে নিলাদ্রিকে বসে থাকতে দেখতে পেল জয়িতা। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিলাদ্রির দিকে এগিয়ে গেল জয়িতা। বলল, "যাক! অনেকদিন পরে এলেন?"
নিলাদ্রি বলল, "হুম, আমার সব দিন ছুটি মেলেনা। যেদিন ছুটি পাই একমাত্র সেদিনই আসতে পারি৷ তবে আপনাকে প্রতিদিনই দেখতে পাই৷ আপনি আসেন, এসে এই পাথরটার উপরে বসে দাঁতে করে অনেকক্ষন ধরে ঘাস কাটেন, তারপর ফিরে যান। বুঝতে পারি আমার জন্য ওয়েট করছেন, কিন্তু আমার কিচ্ছু করার থাকেনা, আসতে চাইলেও আসা যায়না।"
জয়িতা অবাক হল। বলল, "আপনি সব কিছু জেনেও আসতে পারেন না? কোথায় থাকেন আপনি? আর কিই বা করেন?"
নিলাদ্রি বলল, "আমি আপনাদের কাছাকাছি যে থাকিনা বস। আমার অনেক কাজ থাকে, তাই জলে, স্থল্ সব জায়গাতেই আমাকে মিশে থাকতে হয়।"
নিলাদ্রির হেঁয়ালি বুঝতে পারলনা জয়িতা। বলল, "আচ্ছা, কিন্তু কিভাবে আপনি ভবিষ্যত দেখেন সেটা বলবেন?"
"প্রিগনিশন! এন্ড রেট্রোগনিশন! জানিনা কীভাবে যেন হয়ে যায়! আমার মন বলে আর মিলে যায় সব। এই যেমন আমি দেখতে পাচ্ছি সাতদিনের মধ্যে আপনার কলেজের রেজাল্ট বেরুবে, আর আপনি ফার্স্টক্লাস পেয়ে পাশ করবেন।"
জয়িতা বলল, "মিললনা, এখোনো রেজাল্টের কোনো ডেটই দেয়নি, আর আমার পরীক্ষা মোটামুটি হয়েছে, ফার্স্টক্লাস পাবার মতো নয়। এমনিতেই খুব ভেঙে পড়েছি সৌরাসিসের ব্যাপারটা নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে একজাম হলে গেছি, কী পরীক্ষা দিয়েছি কে জানে? তাতে ফার্স্টক্লাস! ইম্পসিবল।"
নিলাদ্রি বলল, "জানিনা ম্যাডাম। আমার ভুল হতে পারে। আমার মনে হল তাই বললাম। আচ্ছা, আমার যাবার সময় হয়ে গেল। আমি এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা। খুব কষ্টহয়। এলাম এখন। ভাল থাকবেন।"
"আচ্ছা, আসুন!" বলল জয়িতা। না, কোনো প্রশ্নের উত্তরই সে ছেলেটার কাছ থেকে আদায় করতে পারলনা, আর কেউ না চাইলে জোর করাও সম্ভব নয় ওর পক্ষে। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, ছেলেটা ওকে ফেলে কাজুর জঙ্গলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা রাস্তার বাঁক ঘুরতেই পিছনে দৌড়াল জয়িতা। ছেলেটাকে ফলো করার একটা জিদ চেপে গিয়েছে ওর মনে। কিন্তু বাঁক পেরোতে অবাক হয়ে দেখল, কোথায় বা কে? রাস্তা পুরো ফাঁকা। ছেলেটা বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেছে।
দিন তিনেক পরে খবর এল এই সপ্তাহেই গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরুচ্ছে। আর দিন সাত পরে রেজাল্ট বেরুতে দেখা গেল এবারে কলেজ থেকে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছ'টা ফার্স্টক্লাস পেয়েছে। জয়িতা তাদের মধ্যে একজন। খুব অবাক হল জয়িতা। খোঁজ নিয়ে জানল এবারে ইউনিভার্সিটি সবাইকেই একটু বেশি নম্বর দিয়েছে। গত বছর কম নাম্বার পাওয়ার জন্য আন্দোলন হয়েছিল এটা তারই রিএ্যাকশন। এই সাতদিন খাদের ধারেকাছেও যেতে পারেনি জয়িতা। নিলাদ্রির সঙ্গেও দেখা করতে পারেনি। কিন্তু আজ মনেহচ্ছে ছেলেটার ব্যাপারে ওকে জানতেই হবে। কে এই ছেলেটা? কি করে? কোথায় থাকে? সব কিছু ওকে জানতে হবে। সেদিন ছেলেটাকে মিথ্যুক বলে অপমানও করে দিয়েছিল হয়তো। ছেলেটা ওকে কি ভাবছে কে জানে! কিন্তু ছেলেটা একটা কথাও যে ভুল বলেনি তার প্রমান তো সে হাতে নাতে পেয়েছে। কিন্তু কার কাছ থেকেই বা সে ছেলেটার খোঁজ নেবে? ছেলেটার নাম নিলাদ্রি সেন। আচ্ছা, এই কলেজেই কি পড়ত ছেলেটা? অনুরিমাকে বলে যদি কলেজের রেজিস্টার ঘাঁটা যায় তাহলে কি খোঁজ মিলতে পারে ছেলেটার? অনুরিমা এখন কলেজ পার্টিতে ভাল পোষ্টে আছে, চাইলে হেল্প করতেই পারে।
পরদিন সকালেই অনুরিমার সঙ্গে দেখা করল জয়িতা। অনুরিমাকে গোটা ঘটনাটা খুলে বলতেই অনুরিমা বলল, "নিলাদ্রি সেন। ওয়েট! ওই নামে একটা ছেলের কথা আমি শুনেছি। আমাদের কলেজে কেমেস্ট্রির পার্টটাইম করত। প্রায় ছ'বছর আগে। কলেজের একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়, তারপর থেকে ছেলেটার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা যদি ডিপার্টমেন্টাল হেড প্রদোষ বাবুর কাছে খোঁজ নিই, হয়তো কিছু হলেও জানতে পারব, উনি এই কলেজে বহুদিন আছেন।"
সেদিন বিকেলে প্রদোষ বাবুর সঙ্গে ওরা দেখা করল। হঠাৎ এতদিন পরে নিলাদ্রির ব্যাপারে কেউ জানতে চাইছে এটা শুনে উনি বেশ অবাক হলেন। বললেন, "খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল নিলাদ্রি। পার্টটাইমের পাশাপাশি রিসার্চ করছিল। ওর রিসার্চের বিষয় ছিল ইউরেনিয়ামের রেয়ার আইসোটোপ আলফা ইউরেনিয়াম নিয়ে। কথিত আছে আলফা ইউরেনিয়াম নাকি মারাত্মক এক আইসোটোপ, যা যেকোনো বস্তুকে তৎক্ষণাৎ কণিকায় পরিনত করতে পারে। জিনিসটা প্রথম কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে রিসার্চ করতে করতে ম্যাক্স প্লাঙ্ক লক্ষ্য করেন, কিন্তু ইউরেনিয়াম ২৩৫ ইউজ করে পরমানু বোমা আবিষ্কারের পরেই ওই জিনিসটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে রিসার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, নাহলে আলফা ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে কোনো বোমা তৈরি হলে একমুহূর্তে সারা পৃথিবীর সব কিছু কণিকায় পরিনত হত। ইউনিভার্সিটির স্পেশাল পার্মিশন নিয়ে এই আইসোটোপ নিয়ে রিসার্চ করছিল নিলাদ্রি, কিন্তু রিসার্চ শেষ হবার আগেই সে যে কোথায় চলে গেল কে জানে। পুলিশে ফাইল হয়েছিল, অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দু'একজন বলে ওকে নাকি ঝরণার উপরের খাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখেছে, কিন্তু আজ অবধি খাদের নিচে ওর বডি পাওয়া যায়নি। তোমাদের হঠাৎ ওকে নিয়ে এত কৌতুহল?"
জয়িতা বলল, "না স্যার। আমি একজন নিলাদ্রির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, আমার মনেহয় উনিই এই নিলাদ্রি। সম্ভবত উনি কোনো কারনে কোনো আঘাত পেয়ে বাস্তব জগত থেকে দূরে থাকতে চাইছেন, তাই জানতে চাইলাম। আচ্ছা আমি যদি ওনাকে এই কলেজে ফিরিয়ে আনতে পারি, ওনাকে আবার নিজের চাকরিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে কি?"
প্রদোষ বাবু বললেন, "হুট করে বললেই তো চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়না, তার কিছু প্রসিডিওর আছে, তবে নিলাদ্রির যা কোয়ালিফিকেশন খুব সহজেই এইসব হার্ডল ও টপকে যাবে, কিন্তু নিলাদ্রি কি সত্যিই আছে! যদি ওকে ফিরিয়ে আনতে পারো, তাহলে খুব উপকার হয়।"
জয়িতা মাথা নাড়ল। রাতে বাড়ি ফিরে জয়িতা ভাবল, একটা মানুষ জীবনে কতটা আঘাত পেলে বাস্তব পৃথিবী থেকে দূরে যেতে পারে। সে যেমন একদিন ভেবেছিল এই জীবন রেখেই বা কী হবে, তেমনি ভাবে নিলাদ্রিও নিশ্চই আঘাত পেয়ে ছ'বছর ধরে তার চার পাশের প্রিয় মানুষগুলোর থেকে দূরে সরে গেছে। কিন্তু ওকে যে মানুষটা ওর জীবন ফিরিয়ে দিল সেই মানুষটাই নিজের জীবনের আঘাত সামলাতে পারেনি, এটা ভাবতেই ওর খুব অবাক লাগল। নিলাদ্রির প্রতি মনের মধ্যে একটা দুর্বলতা অনুভব করল জয়িতা। সে তো সৌরাসিস কে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবেসেছিল তা সত্বেও এই দুর্বলতা কেন বুঝতে পারলনা, সঙ্গে এটাও বুঝতে পারলনা মানুষটা ওর ব্যাপারে এত কিছু জানল কীভাবে? তবে মানুষটা যাই করুক ওকে আবার বাস্তব পৃথিবীতে বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে আনার একটা জিদ চেপে গেল জয়িতার মনে।
আবার ঝরণার কাছে এল জয়িতা। এসেই দেখল নিলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। মনে একটা অদ্ভুত স্বস্তি পেল জয়িতা। যে মানুষটাকে দেখার জন্য গত কয়েকদিন ছটফট করেছে, আজ সেই মানুষটাকে আবার দেখতে পেল। নিলাদ্রির কাছে এগিয়ে যেতেই নিলাদ্রি বলল, "আমার ব্যাপারে সব কিছু জেনে ফেলেছেন মনে হচ্ছে?"
জয়িতা বলল, "সব কিছু না, আপনি কোথায় থাকেন আর এখন কি করেন জানতে পারিনি, তবে আপনার অতীতের ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনেছি।"
নিলাদ্রি বলল, "জেনেই বা কী হবে? আপনি যেটা চাইছেন সেটা কোনো দিনও হবেনা।"
জয়িতা বলল, "কী চাইছি আমি কিভাবে বুঝলেন?"
নিলাদ্রি বলল, "আমি সব বুঝতে পারি। আপনি আমাকে এই পৃথিবী থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু হয়তো সেটা কোনো দিনও সম্ভব হবেনা।"
জয়িতা বলল, "কেন? কি হয়েছে আপনার? আমাকে সব কিছু খুলে বলুন।"
নিলাদ্রি বলল, "আমি যে এখন আর মানুষ নেই। আমি যে কণিকা হয়ে গেছি।"
জয়িতা চমকে উঠল। বলল, "মানে? কিভাবে?"
নিলাদ্রি বলল, "আমি হিউম্যান বডির উপরে আলফা ইউরেনিয়ামের এফেক্ট নিয়ে গবেষনা করছিলাম। আমার রিসার্চের জন্য প্রায় মৃত বডি কিনে আনতাম, তারপর তাদের শরীরে আলফা ইউরেনিয়াম ইনজেক্ট করতাম, ম্যাক্সিমাম বডিই ঝলসে অ্যাশে পরিনত হত। কিন্তু আমি জানতাম একদিন না একদিন মানুষকে পার্টিক্যালে পরিনত করতে পারবই। আমি তখন সাফল্য পাবার নেশায় প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। কলেজে একটা মেয়ের সঙ্গে রিলেশন হয়েছিল আমার, কিন্তু সাফল্য পাওয়ার নেশায় আমি তখন এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে ওর কথা খেয়াল রাখতে পারিনি, যদিও ও সব সময় আমার সঙ্গে কনটাক্ট রাখার চেষ্টা করত। কলেজে ওকে দেখেও এড়িয়ে যেতাম। ওকে দেখা করতে বলতাম না, সব মিলিয়ে ওর সঙ্গে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর ফাইন্যাল ডিসিশন নেওয়ার জন্য যেদিন ও আমার বাড়িতে এল সেদিন আমি একটা বডির উপরে রিসার্চ চালাচ্ছি, গোটা ঘটনাটা নিজের চোখে দেখে এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে আমার সঙ্গে আর কোনো রিলেশনই রাখলনা। তারপর ব্যর্থ হতে হতে হতাশ হয়ে আমি যখন নিজের জীবনের দিকে তাকালাম ততদিনে আমার জীবন থেকে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আমার বাবা হঠাৎই স্ট্রোকে মারা গেছে, মা' শোক সামলাতে না পেরে পাগল হয়ে গেছে, আর আমার জীবনের শেষ সম্বল আমার ভালবাসাও আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। আমার কাছে তখন বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া দুইই সমান হয়ে গিয়েছিল। তাই একদিন এই খাদের পাশে এসে নিজের শরীরে আলফা ইউরেনিয়াম ইনজেক্ট করলাম, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার আমি মারা গেলাম না, তখন এই খাদের উপর থেকে নিচে ঝাঁপ দিলাম, নিচে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম আমার জীবনের ফার্স্ট টাইম রিসার্চ সাকসেসফুল হয়ে গেছে, আমি আর মানুষ নেই, ধীরে ধীরে পার্টিক্যালে পরিনত হচ্ছি। জীবনে সেই প্রথম বার যুগপৎ আনন্দ আর দুঃখ পেলাম, আমার রিসার্চ সাকসেসফুল হওয়ার আনন্দ, আর সেই রিসার্চের ব্যাপার কেউ জানবেনা, এই দুঃখ। প্রায় পাঁচবছর পার্টিক্যাল হয়ে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবার পরে বুঝতে পারলাম, আমার মধ্যে কিছু একটা চেঞ্জ হচ্ছে, আমি ধীরে ধীরে নিজের শরীর ধারণ করতে পারছি, আলফা ইউরেনিয়ামের হাফ লাইফটাইম পাঁচবছরে হয়, আর কোনো তেজস্ক্রিয় পরমানু কখনোই শেষ হয়না, চিরকাল ধরে চলতে থাকে। কিন্তু হাফ লাইফটাইম বেশি দিন থাকেনা, মাত্র এক বছর। তাই গত একবছর মাঝে মাঝে শরীর ধারণ করে আমি এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পেরেছি, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি, কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাকে আবার পার্টিক্যাল হয়ে বাতাসে মিশে যেতে হয়েছে।" এতটা বলার পরে নিলাদ্রি থামল। বলল, "জয়িতা তোমার মতো মানুষ না হয়েও আমি তোমাকে কিছুটা ভালবেসে ফেলেছি, কিন্তু আজ আমার আর কোনো উপায় নেই, আমার হাফ লাইফ টাইম শেষ এবারে আমাকে চিরকালের জন্য পার্টিক্যাল হয়ে যেতে হবে। আর হয়তো তোমার সঙ্গে কখনোই কথা হবেনা।"
জয়িতা বলল, "কখনোই না? কোনো উপায়ই কি নেই?"
জয়িতা দেখতে পেল নিলাদ্রির শরীরটা ওর চোখের সামনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, ওর গলার আওয়াজ ক্ষীন হয়ে আসছে। বহুকষ্টে বলল, "যদি টেকনোলজি কোনো দিন আমাকে ধরতে পারে, তাহলে হয়তো আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসতে পারব" বলতে বলতে হাওয়ার মিলিয়ে গেল নিলাদ্রি।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। পৃথিবীতে টেকনোলজি অনেক পাল্টে গেছে। ইন্টারনেট ছিল, মার্ক তার সঙ্গে ফেসবুক এনেছে। হাতে হাতে মোবাইল এসেছে, মোবাইল পাল্টে এন্ড্রয়েড হয়েছে, মোবাইলে মোবাইলে ইন্টারনেট এসেছে। আজো স্কুল টিচার মিস জয়িতা রায় সময় পেলেই ঝরণার কাছে পাথরটার উপরে এসে বসে। বসে বসে মোবাইলে নেট খুলে ফেসবুকে চ্যাট করে। জয়িতা জানে, ওর উল্টোপাশে যে প্রোফাইলটা ওর মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে চলেছে সে কোন মানুষ নয় সে শুধুই পার্টিক্যাল, যে আজ প্রোফাইল হয়ে ওর মোবাইলের ভিতরে বন্দি। তবু জয়িতা মানুষটাকে খুব ভালবাসে। সব কিছু জেনেও ভালবাসে। সারাটা বিকেল জুড়ে ওর সঙ্গে গল্প করে। কে বলল, চোখে না দেখলে মানুষকে ভালবাসা যায়না! এই তো জয়িতা বেশ পারে। নিলাদ্রি আর কোনো দিনও স্বাভাবিক মানুষ হতে পারবেনা জেনেও বেশ ভালবাসতে পারে। তবে আগের মতো এখন আর তত তাড়াতাড়ি রিপ্লাই দিতে পারেনা নিলাদ্রি। এখন রিপ্লাই দিতে লেট হয়। জয়িতা বুঝতে পারে নিলাদ্রির শরীরের আলফা ইউরেনিয়ামের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। রিপ্লাই দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে নিলাদ্রির। কিন্তু নিলাদ্রি তো অমর হয়ে গেছে, নিলাদ্রির রিপ্লাই হয়তো ক্রমশ লেট আরো বেশি লেট হয়ে থাকবে, কিন্তু কখনোই সে ওকে ভুলে যাবেনা। আর ওই একটা রিপ্লাই পাওয়ার জন্য জয়িতা সারা জীবন অপেক্ষা করবে।
(সমাপ্ত)
#Love