Sankha Subhra Nayak's Video

Drama

3  

Sankha Subhra Nayak's Video

Drama

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

12 mins
16.5K


"এই যে মশাই হাতটা একটু ধরুন না?" প্লাটফর্ম বরাবর ছুটন্ত একটা মেয়ের ডাকে হুঁশ ফিরল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা শুভমের। সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। গায়ের রঙ ফর্সা। গোল ধরনের মুখ। দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। মেয়েটা আবার তাড়া দিল, "হাঁ করে দেখছেন কি, আমাকে টানুন, নাহলে আছড়ে পড়ব যে।"

হাত ধরে টেনে মেয়েটাকে উপরে তুলল শুভম। বলল, "একটু আগে আসতে পারেন না? এই ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তেই আসতেই হয়।"

মেয়েটা বলল, "কি করব বলুন? সবার চোখ এড়িয়ে প্লাটফর্মে আসতে হয়েছে যে।"

শুভমের চোখ কপালে উঠে গেল। বলল, "সবার চোখ এড়িয়ে মানে? আপনি বাড়ি থেকে পালাচ্ছেন নাকি?"

অপরাধী গলায় মেয়েটা বলল, "আর কি করি বলুন? যদি বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে পালাতে তো বাধ্য।"

শুভম ভ্যাবাচ্যাকা খেল। বলল, "দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি তো খুব হাঁফাচ্ছেন দেখছি? চলুন, আগে সিটে গিয়ে শান্ত হয়ে বসুন। একটু জল-টল খান তারপর আপনার কথা শুনব।"

মাথা নেড়ে শুভমের পিছনে পিছনে সিটে এসে বসল মেয়েটা। সাবধান করে বলল, "বেশি হৃদ্যতা দেখানোর চেষ্টা করবেন না কিন্তু। আমার যেটুকু ইচ্ছে বলব, যেটুকু ইচ্ছে হবেনা বলবনা, আর হ্যাঁ, হেল্প করার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ।"

শুভম মাথা নাড়ল। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, "এতে বিষ টিষ নেই, নিশ্চিন্তে খেতে পারেন।"

মেয়েটা হাসল। ঢক ঢক করে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, "নিচে যখন ফেলে দেননি তখন এটুকু বিশ্বাস করতে রাজি আছি।"

শুভম বলল, "আচ্ছা, এবারে বলুন হঠাৎ বাড়ি থেকে পালাচ্ছেন কেন?"

মেয়েটা বলল, "দেখুন আপনার বাড়ির লোক যদি আপনাকে একটা ঢ্যাঁড়শ কিম্বা পটলের সঙ্গে বিয়ে দেয় আপনি কি করবেন?"

চোখ গোল গোল করে মেয়েটার দিকে তাকাল শুভম। বলল, "আপনার ঢ্যাঁড়শের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে নাকি?"

মেয়েটা বলল, "আরে ধুর! আপনিও তো একখানা ঢ্যাঁড়স দেখছি। আমার একটা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা একটা ঢ্যাঁড়শ।"

শুভম বলল, "আচ্ছা, তা ঢ্যাঁড়শ কিভাবে বুঝলেন? খুব রোগা নাকি?"

মেয়েটা বলল, "ধুর! ধুর! আজ পর্যন্ত ওকে চোখেই দেখিনি। ওই দু'চারবার কথা বলেছি, আমার কত স্বপ্ন ছিল প্রেম করে বিয়ে করব, একটা স্মার্ট ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, আর ওই মালটাকে একদিন বললাম আচ্ছা কিভাবে মেয়েদের প্রোপোজ করতে হয় জানো? তো কি বলল জানেন? জীবনে কখনো কোনো মেয়েকে প্রপোজই করিনি কিভাবে জানব? এরকম ছেলের সঙ্গে বিয়ে করা যায়? হাজব্যান্ড হবে বয়ফ্রেন্ডের মতো। মাঝরাতে চুপি চুপি ছাদে নিয়ে গিয়ে কিস করবে, স্পিড বোটের সামনে বসিয়ে ঢেউয়ের উপরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তা না কিভাবে প্রপোজ করতে হয় তাই বাবু জানেনা।"

শুভম হাসল। বলল, "মেয়েদের কাছে নিজের ইমেজটা ফ্রেশ্ রাখতে অনেক ছেলেই ওরকম বলে। আমার উড বি কে আমিও তো ওরকম বলেছি, তা বলে কি আমি কি কম বাউলামি করেছি জীবনে? মাঝরাতে গার্লস হোস্টেলে ঢুকে হোস্টেল সুপারের মেয়েকে কিস করে এসেছি, গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে নৌকায় বসে মদ খেতে নৌকার দড়ি খুলে দিয়ে ঢেউয়ের তালে লুটোপুটি খেয়েছি, সব কথা কি আর উড বি কে বলা যায়?"

অবাক হয়ে মেয়েটা শুভমের দিকে তাকাল। বলল, "আপনি তো হেব্বি লোক মশাই। আচ্ছা, কখনো একটানে সিগারেট শেষ করেছেন?"

শুভম হাসল। বলল, "আমাদের হোস্টেলের র‍্যাগিং এর সময় আমি একসঙ্গে সাতটা সিগারেট একটানে শেষ করেছিলাম।"

চোখ বড়ো বড়ো করে শুভমের দিকে তাকাল মেয়েটা। বলল, "উরিব্বাস! আপনি তো একটা চিজ দেখছি। আর আমার উড বি সিগারেট খেতেই জানেনা। জানেন আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি আমার একটা বয়ফ্রেন্ড সিগারেট খেতে গিয়ে হেঁচকি খেয়েছিল বলে আমি ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।"

হা হা করে হাসল শুভম। বলল, "আপনি সিগারেট খান নাকি?"

মেয়েটা মাথা নাড়ল। বলল, "আরে না না, নেশা কিছু নেই। তবে শীতের বিকেলে নদীর পাড়ে বসে একটা ক্লাসিক কিম্বা গোল্ডফ্লেক মন্দ লাগেনা।"

শুভম মাথা নাড়ল বলল, "আমারও সেভাবে নেশা কিছু নেই। ওই মাঝেমাঝে বন্ধুরা পার্টি করলেই যা দু'চারটা খাওয়া হয়ে যায়। লিকুইডের সঙ্গে ধোঁয়াটা মন্দ লাগেনা, একটা আলাদা আমেজ আসে।"

চোখ টিপে মেয়েটা বলল, "জানেন আমি না বিয়ার খেয়েছিলাম। বড্ড ঝাঁঝালো, কিভাবে খান যে আপনারা?"

শুভম বলল, "প্রথম প্রথম ওরকম লাগে তারপর সব ঠিক হয়ে যায়।"

"বাদাম ভাজা, ভাজা বাদাম..." একটা ফেরিওয়ালার ডাকে সামনে দিকে তাকাল শুভম। বলল, "বাদাম খাবেন?"

মেয়েটা বলল, "নিন না, তবে বিলটা কিন্তু আমি দেব।"

শুভম বলল, "না, এটা আমার ট্রিট, আমিই বিলটা দেব। পরের বিলটা নাহয় আপনিই দেবেন।"

"আচ্ছা," মেয়েটা মাথা নাড়ল। দু'প্যাকেট বাদাম ভাজা কিনে একটা মেয়েটার হাতে দিয়ে চিবোতে চিবোতে শুভম বলল, "আপনি সত্যিই খুব মজার মেয়ে। আমার উড বি যদি আপনার মতো হত!"

মেয়েটা বলল, "আপনার উড বি কেমন?"

শুভম বলল, "কি জানি কেমন? সাকুল্যে দু'তিনবারই কথা বলেছি। কথা শুনে খুব গম্ভীর বলে মনে হয়েছে।"

মেয়েটা বলল, "তাই? তবে কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ না করে, তাহলে সে মজাদার হলেও খুব গম্ভীর ভাব দেখায়। এই যেমন আমি; আমার উড বি কে এমন গম্ভীর ভাব দেখাই, কথা শুনলে ওর যেন মনে হয় সে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে কথা বলছে।"

শুভম বলল, "এটা কিন্তু খুব বড়ো দুষ্টুমি। আচ্ছা, আপনি আপনার উড বি কে চোখে দেখেননি কেন?"

মেয়েটা বলল, "কিভাবে দেখব বলুন? বললাম ওর একখানা ছবি 'হোয়াটস আপে' পাঠাতে, বলে কিনা আগে তোমার ছবি দাও তারপর আমার ছবি দেব। আমি বলি মরগে যা, ছবি দেখতে হবেনা।"

শুভম হাসল। বলল, "আমিও আমার উড বি'কে চোখে দেখিনি। আসলে কোনো মেয়ে সং সেজে বসে রইবে আর আমাকে তার ইন্টার্ভিউ নিতে হবে, এরকম ভাবে বিয়ে করতে আমি ইন্টারেস্টেড নই, তাই সম্বন্ধ দেখার কাজটুকু আমার মা বাবাই করেছে, আমি কেবল বিয়ে করতে যাব তাহলেই আমার ডিউটি খতম।"

মেয়েটা হাসল। বলল, "আপনার সঙ্গে আমার অনেক মিল আছে দেখছি। কেন যে আপনার সঙ্গে আগে পরিচয় হোলনা?"

শুভম বলল, "আমাকে দেখে আর ঢ্যাঁড়শ লাগছেনা?"

মেয়েটা বলল, "আপনি তো একখানা চিজ মশাই। নিম কিম্বা উচ্ছে বললে মন্দ হয়না, আপনার মতো একখানা আইটেম পেলে আমি অনায়াসে বিয়ের পিঁড়িতে বসতাম। দাঁড়ান একটু মজা করি।"

শুভম বলল, "কি মজা?"

শুভমের গা ঘেঁসে বসে মেয়েটা বলল, "আমার কাঁধে মাথা রাখুন।"

শুভম অবাক হল, "কেন?"

মেয়েটা বলল, "যা বলছি করুন তো, তারপর দেখতে পাবেন।"

মেয়েটার কাঁধে মাথা রাখতেই মেয়েটা খচ করে একখানা সেলফি তুলে বলল, "এবারে এই সেলফি খানা আমার বাগদত্তা বেচারাকে পাঠাব। এটা দেখে ওর মুখের অবস্থা যা হবে ভাবতেই পারছি।"

পিং শুভমের হোয়াটস আপে একটা মেসেজ ঢুকল। মেসেজখানা খুলে হোহো করে হেসে উঠল শুভম। মেয়েটা বলল, "কি হল? এত হাসছেন কেন? পাগল হলেন নাকি?"

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শুভম বলল, "তোমার নাম কুহেলী সেনশর্মা? এবছর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ কমপ্লিট করেছ?"

অবাক হয়ে শুভমের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল, "আপনি কিভাবে জানলেন?"

হাতের মোবাইলটা দেখিয়ে শুভম বলল, "আমিই তোমার হতভাগ্য বাগদত্ত। যাক, আমার ভাগ্য ভাল, নিমন্ত্রণ করতে যাওয়ার পথেই বউকেই পেয়ে গেলাম, নাহলে বিয়ে করতে গিয়ে যদি দেখতাম বউ পালিয়েছে তাহলে লজ্জা রাখতে জায়গা থাকত না।"

লজ্জায় মাথা নিচু করে কুহেলী বলল, "আপনি একটা যা তা লোক। এতক্ষণ ধরে কথা বলছেন, অথচ আমার নামটুকুও জানার প্রয়োজন বোধ করেন নি।"

শুভম বলল, "শর্তটাতো তোমারই দেওয়া, তুমি যতটুকু বলবে আমাকে সেটুকুই শুনতে হবে, তার বেশি কৌতূহল দেখানো আমার চলবেনা।"

কুহেলী বলল, "ইস! ছি ছি! না জেনে আপনার ব্যাপারে কত কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেললাম।"

শুভম বলল, "তাও ভাল, আমাকে আর ছারপোকাদের সঙ্গে ফুলশয্যা করতে হবেনা। নাহলে তুমি যা প্ল্যান নিয়েছিলে তাতে আমার আছোলা হয়ে যেত।"

কুহেলী বলল, "আপনি একটা যাচ্ছেতাই লোক, এতটুকুও সেন্স নেই, একটা মেয়ের সঙ্গে কিভাবে কথা বলছেন দেখুন? ভালই করছিলাম পালিয়ে যাচ্ছিলাম।"

শুভম হাসল। বলল, "যাবেন কোথায়? চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি।"

কুহেলী বলল, "আমার যেখানে ইচ্ছে যাব, তাতে আপনার কি?"

শুভম বলল, "আচ্ছা, আচ্ছা, তাই হোক, তথাস্তু। তাহলে আমি মাকে ফোন করে বিয়েটা ক্যানসেল করতে বলছি।"

কুহেলী বলল, "আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন।"

ফোনটা হাতে তুলে নিল শুভম। মাকে ফোন করে, "হ্যালো মা..." বলতেই কুহেলী ফোনটা ছিনিয়ে নিল। ফোন কেটে দিয়ে বলল, "এক্ষুনি এসব নিয়ে ডিসিশন নিতে তোমাকে কে বলেছে বুদ্ধুরাম? চলো, সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলে পেট ভরে বিরিয়ানি খাওয়া যাবে।"

শুভম মাথা নাড়ল। ঠিক তখনই একটা বিকট শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক একটা ঝাঁকুনি। কি হয়েছে বোঝার আগেই ওর গায়ের উপরে ছিটকে পড়ল কুহেলী। ওকে সে দু'হাতে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা ঝাঁকুনি। উপরে তাকিয়ে শুভম দেখতে পেল আলোগুলো কাঁপতে কাঁপতে নিভে যাচ্ছে।

"আমার ছেলে কেমন আছে ডাক্তার বাবু?" উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন শুভমের মা।

ডাক্তার বাবু বললেন, "মাথার উপর দিয়ে চোট গেছে। কন্ডিশন নর্মাল, তবে অনেক স্মৃতিই ব্রেন থেকে ইরেজ হয়ে গিয়েছে।"

শুভমের মা বললেন, "আচ্ছা, ওর সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?"

ডাক্তার বাবু বললেন, "এখন তো ও ঘুমোচ্ছে, ঘুম ভাঙলে দেখা করবেন। তবে ওর যদি কোনো কিছু মনে না পড়ে সেটা মনে করানোর জন্য চাপ দেবেন না, তাতে ওর ব্রেনের আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে।"

"আচ্ছা," শুভমের মা মাথা নাড়লেন।

ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল শুভম। দেখল ওর মা ওর বিছানার পাশে বসে আছেন। জড়ানো গলায় বলল, "মা আমার কি হয়েছিল?"

শুভমের মা বললেন, "কিছু না বাবা। সামান্য একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।"

শুভম অবাক হল। বলল, "কোথায় এ্যাকসিডেন্ট মা ?"

শুভমের মা বললেন, "ট্রেনে। তোর ট্রেনটা লাইন থেকে ছিটকে গিয়েছিল, তাই এই এ্যাকসিডেন্ট। তোর কি কিছুই মনে পড়ছেনা?"

শুভম বলল, "না মা। আমার কেবল মনে আছে, কাল রাতে তুমি আমাকে ফোন করে বাড়ি ফিরতে বলেছিলে, আমাকে নাকি কিছু একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।"

শুভমের মা বললেন, "আচ্ছা, বাবা, আর মনে করতে হবেনা। তুই ঘুমো।"

"আচ্ছা মা," বলে শুভম চোখ বুজতেই শুভমের মা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। ডাক্তার বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "ডাক্তার বাবু, ওর তো শেষ স্মৃতি দশদিন আগের, ওইদিন আমি ওকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলেছিলাম। তারপর মাঝের দশদিনের ঘটনা তো ওর আর কিছুই মনে নেই।"

ডাক্তার বাবু বললেন, "জীবনের এতদিনের মাঝে দশদিনের স্মৃতি খুব বেশি ম্যাটার করেনা। ওকে ওই দশদিনের কথা মনে করানোর জন্য চাপ দেবেন না। যদি নিজে থেকে মনে পড়ে ভাল, নাহলে ছেড়ে দিন।"

শুভমের মা বললেন, "কিন্তু ও যে একজনের বাগদত্ত। এই দশদিন হল তাদের সঙ্গে আমার ছেলের সম্বন্ধ হয়েছে, সামনেই ওদের বিয়ে, তাদের কি জবাব দেব?"

ডাক্তার বাবু বললেন, "এই মুহূর্তে মোটেই ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওদের সিচুয়েশনটা খুলে বলুন, আশা করি ওরা বুঝবে।"

ফোনটা তুলে নিয়ে কুহেলীর বাবার নম্বরে ডায়াল করলেন শুভমের মা। ফোন তুলে কুহেলীর বাবা বললেন, "হ্যালো, আমি এই জাস্ট আপনার কথাই ভাবছিলাম। আমার একটা খারাপ খবর দেওয়ার আছে..."

শুভমের মা বললেন, "হ্যাঁ বলুন।"

কুহেলীর বাবা বললেন, "দেখুন, বলতে কেমন বাধোবাধো ঠেকছে, তবু বলি, আপনার ছেলের সঙ্গে কুহেলীর বিয়ে দিতে আমরা অপারক।"

শুভমের মা বললেন, "কেন বলুন তো?"

কুহেলীর বাবা বললেন, "আসলে ও আপনার ছেলেকে পছন্দ করেনা, তাই কাল রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল। মাঝ রাস্তায় ওর একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়। এমনিতে কোনো ক্ষতি না হলেও সম্ভবত ওর সামনে সাতটা মৃত্যু ও নিজের চোখে দেখেছিল৷ সেই ট্রমায় ওর ব্রেনটা একটু ডিসব্যালেন্স হয়ে গেছে।"

"ও মাই গড," চমকে উঠলেন শুভমের মা।

কুহেলীর বাবা বললেন, "এই সিচুয়েশনটা যতদিন না কাটছে ততদিন তো বিয়ে দেওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া এই ট্রমা কাটলেও যদি ওর অপছন্দের কারুর সঙ্গে ওর বিয়ে দিই, তাহলে ওর তো আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে।"

শুভমের মা বললেন, "হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন, আপনার মেয়ে তো আমার মেয়ের মতোই, তাই ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক এই কামনাই করি।"

মাঝেমাঝে এই স্বপ্নটাই দেখে শুভম। সে একটা ঘরের কোনায় পড়ে আছে, আর একটা জলপাইরঙা আকাশ এসে ছাতার মতো ওকে আগলে ধরছে। আর তার সঙ্গে একটা মেয়ে যেন ওর নাম ধরে বার বার আর্তনাদ করছে 'শুভম' 'শুভম'... গত দু'বছরে এই স্বপ্নটার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। কেন যে স্বপ্নটা বার বার দেখে তা শুভম জানেনা। কিন্তু স্বপ্নে বার বার ওই মেয়েটার গলা শুনতে শুনতে মেয়েটাকে সে ভালবেসে ফেলেছে। কে ওই মেয়েটা! কেন ওর নাম ধরে এরকম ভাবে চিৎকার করছে,তা শুভম জানেনা। মাঝেমাঝে ভেবেছে হয়তো কোথা থেকে ঘুরে এলে এই স্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তাই সমুদ্রের তীরে ঘুরতে এসেছে সে।

আজ ঘুম থেকে উঠেই সে ঝাউবন পেরিয়ে সমুদ্রের কাছে ঘুরতে চলে গেল। সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, তীরে ভিড় সেভাবে কিছু নেই, কেবল দুটো মেয়ে তীরের কাছে দাঁড়িয়ে ঢেউ গুনছে। গুটি গুটি পায়ে সে জলের কাছে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই শুনতে পেল কেউ যেন জোর গলায় বলে উঠল, "শুভম..."

চমকে সে মেয়েগুলোর দিকে তাকাল। দেখতে পেল একটা মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর অন্য মেয়েটা ওকে টানতে টানতে সমুদ্রের ধার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুভম বেশ অবাক হল। ওর নাম যে শুভম তা ওই মেয়েটা জানল কিভাবে? 

লজের গেটে ঢোকার মুখেই সেই দুটো মেয়ের একজনকে আবার দেখতে পেল শুভম। মেয়েটার দিকে সে এগিয়ে গেল। বলল, "এক্সকিউজ মি, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?"

মেয়েটা বলল, "অফকোর্স। আমি কেয়া। আপনি?"

শুভম বলল, "আমি শুভম। আচ্ছা, সকালে আপনার সঙ্গে একটা মেয়ে ছিল ও কে হয় আপনার?"

কেয়া বলল, "ও আমার দিদি, ওর নাম কুহেলী। ও একটু অসুস্থ তাই ওকে নিয়ে আমি ঘুরতে এসেছি।"

শুভম মাথা নাড়ল। বলল, "সকাল বেলায় আপনার দিদি আমাকে শুভম বলে ডাকল, কিন্তু ও আমার নাম জানল কিভাবে?"

কেয়া বলল, "সরি, আমি বলতে পারবনা। দু'বছর আগে ওর একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তারপর থেকেই ওর ব্রেনটা একটু ডিসব্যালেন্স হয়ে গেছে। এমনিতে জেনারেলি সেভাবে কারুর সঙ্গে কথা বলেনা, কিন্তু সকালে এরকম রিএ্যাক্ট করল কেন কে জানে! আই এম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট।"

শুভম বলল, "ইটস ওকে। আই ডোন্ট মাইন্ড। আসলে আমি জানতে চাইছিলাম ওর সঙ্গে আমার আগে কোথাও পরিচয় হয়েছিল কিনা।"

কেয়া বলল, "আমি সত্যিই এ নিয়ে কিছু বলতে পারবনা। আমি লন্ডনে ছিলাম, কিছুদিন আগেই ফিরেছি। মাঝখানে দিদির বিয়েতে একবার আসার কথা ছিল, কিন্তু ওর এ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে তা আর হয়নি।"

শুভমের মুডটা একটু খারাপ হল। বলল, "আপনারা এই লজেই উঠেছেন?"

কেয়া বলল, "হ্যাঁ, দোতলার একুশ নম্বর রুম। আজ রাতটুকুই থাকব, কাল সকাল হলেই আমি ভোকাট্টা। এবারে যাবার সময় দিদিকেও সঙ্গে করে লন্ডনে নিয়ে যাব, আই হোপ ওখানের ডাক্তাররা ওকে ভাল করে দিতে পারবে।"

শুভম মাথা নাড়ল। বলল, "আচ্ছা, আপনার দিদির সঙ্গে একবার কথা বলা যেতে পারে?"

কেয়া বলল, "সরি, ও রুমে আছে। আর আমরা দু'জন মেয়ে, আমাদের রুমে কোনো ছেলেকে এ্যালাও করতে আমি পারবনা।"

"ইটস ওকে," শুভম মাথা নাড়ল। উপরে তাকিয়ে দেখল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সকালের মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল শুভম। গত প্রায় দু'বছর ধরে ওর বার বার মনে হয়েছে ওর মন থেকে কিছু একটা মিসিং। কিন্তু জিনিসটা কি সে কখনোই বুঝতে পারেনি। আজ হঠাৎ ঘুম ধরতেই সেই জলপাই রঙের আকাশের স্বপ্নটা আবার ফিরে এল, তবে একটু স্পষ্ট ভাবে। দেখতে পেল, সে একটা ট্রেনের কামরায় পড়ে আছে, ওর মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে আর একটা মেয়ে দু'হাতে ওকে আগলে ধরে 'শুভম' 'শুভম' করে চিৎকার করছে। মেয়েটার গায়ের পোশাকটা জলপাই রঙের। হঠাৎ একঝলক আলোয় মেয়েটার মুখ সে স্পষ্ট দেখতে পেল। এই মেয়েটাই তো কুহেলী। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল শুভম। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সে দোতলায় চলে গেল। ওর এ্যাক্সডান্টের পর হারিয়ে যাওয়া দশদিনের স্মৃতি ধীরে ধীরে ওর মনের মধ্যে ফুটে উঠতে লাগল। একটা ভয় আর একটা দুঃসাহস ভর করল শুভমের মনে। একুশ নম্বর রুমে গিয়ে দরজায় কয়েকবার ধীরে ধীরে টোকা দিল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল কুহেলী। ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওর হাত ধরে টেনে নিচে নিজের রুমে নিয়ে এল শুভম। ফিসফিসিয়ে বলল, "কেমন আছো কুহেলী?"

নিজের হাত দিয়ে ওর মুখ, হাত স্পর্শ করে ডুকরে কেঁদে উঠল কুহেলী। অবাক গলায় বলল, "শুভম, তুমি বেঁচে আছো? তা সত্বেও গত দু'বছরে একবারও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে না, আমাকে এতটাই পর ভাবলে?"

শুভম বলল, "এ্যাকসিডেন্টে আমার স্মৃতি হারিয়ে গিয়েছিল কুহেলী, আমি ওই দিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।"

ওর বুকের উপরে আছড়ে পড়ে কুহেলী বলল, "তুমি যদি ওই এ্যাকসিডেন্টের দিন আমাকে তোমার বুকে আশ্রয় না দিতে তাহলে আমি বাঁচতাম না। অথচ তার আগে আমি তোমাকে নিয়ে কত খারাপ কথা বলেছি। তুমি জানোনা সেদিন চোখের সামনে তোমার এ্যাকসিডেন্ট হতে দেখার পর থেকে গত দু'বছর আমি কেবল তোমার কথাই ভেবেছি। তোমাকে আমি পাগলের মতো ভালবেসে ফেলেছি শুভম। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা।"

দু'হাতে কুহেলীকে জড়িয়ে ধরল শুভম। বলল, "না আমি আর তোমাকে ছেড়ে যাবনা।"

কুহেলী বলল, "জানো, আমি ট্রমা কাটিয়ে ওঠার পরে যখন শুনলাম আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার বাবা মা আমার বিয়ে দেবেনা, তখন আর মুখফুটে বলতে পারিনি, আমি তোমাকে ভালবাসি। সে যে কি যন্ত্রনা বলে বোঝাতে পারবনা। এদিকে তোমারও ব্যাপারেও কোনো খবর পাচ্ছিলাম না, ভেবেছিলাম হয়তো তুমি আর নেই... যদি আজ তোমাকে সৈকতে দেখতে না পেতাম তাহলে হয়তো আমি সত্যিই পাগল হয়ে যেতাম।"

শুভম বলল, "গত দু'বছর ধরে আমারও প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে আমার ব্রেন থেকে কিছু একটা মিসিং, কিন্তু সেই ফাঁকটা আমি পূরণ করতে পারিনি, আজ হঠাৎ তোমাকে দেখেই সেই ফাঁকটা পূরণ হয়ে গেল। আমিও তোমাকে ভালবাসি কুহেলী। আমার এ্যাকসিডেন্টের মুহূর্তে তোমার আর্তচিৎকার প্রতি মুহূর্তে আমার কানে বাজে।"

কুহেলী বলল, "আমি জানতাম শুভম তুমি ঠিক আসবে। তাই তোমার অপেক্ষায় সারা রাত জেগে বসেছিলাম। এভাবেই আমাকে বুকে আগলে রাখবে তো শুভম?"

শুভমের চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বলল, "রাখব কুহেলী।"

শুভমকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কুহেলী বলল, "জানো গত দু'বছর ধরে আমার প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে একটা ঝড় আমাকে গোড়া থেকে উপরে ফেলতে চাইছে, আমি বার বার ভেবেছি তোমার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করব, কিন্তু কি যেন একটা বাধা আমাকে আটকে দিয়েছে। আমার কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম, আজ তোমাকে দেখেই হঠাৎ কোথা থেকে আমার জোর ফিরে এল। আমি তোমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলাম।"

কুহেলীকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল শুভম। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল, "আজ তো আর কোনো বাধা নেই। আর কোনো পালিয়ে যাওয়া নেই। তাহলে কেন চোখের বারিধারায় নিজেকে সিক্ত করছ? চলো এই ভরা বৃষ্টিতে আমাদের এতকালের যত কষ্ট, না পাওয়ার যন্ত্রনা সব ভাসিয়ে দিই।"

কুহেলী বলল, "চলো শুভম, আজ আমারও তোমার সঙ্গে ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে।"

কুহেলীকে নিয়ে বেরিয়ে এল শুভম। সকালে টিপটিপ বৃষ্টি এখন ঝমঝমিয়ে মাটির উপরে ভেঙ্গে পড়ছে, ঝাউবনের ফাঁকে আঁধার কখন যেন মিলিয়ে গিয়েছে। যখন সারাটা শহর তাদের শেষ রাতের আধোঘুমে স্বপ্ন দেখছে, তখন ঝাউবনের আড়ালে বালিয়াড়ির উপরে শুয়ে দুটো শরীর পরষ্পরকে আদর করে চলেছে অমলিন আনন্দে।

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama