নীরব কর্মকান্ড
নীরব কর্মকান্ড
আমাদের বাংলা দেশের একটা অলিখিত নিয়ম ছিল যে গ্রামের যে সব ভালো ছাত্র কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসতো, তারা ঐ গ্রামেরই শহর নিবাসী কারোর বাড়িতে আশ্রয় পেত আর পড়াশোনা চালিয়ে যেত। এতে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতাও বজায় থাকত আর এসব নিয়ে কেউ কিছু মনে করত না। এরকম ভাবেই গ্রামের ছেলে
অমল, যে কিনা মা বাবার একমাত্র ছেলে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে তাই তার গ্রামতুতো মাসীর বাসায় উঠেছে । মাসীর ছেলে নেই একটা মেয়ে আছে আসার সময় শুনে এসেছে, মেয়েটা যে কলেজে উঠেছে সেটা জানেনা সে । সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত অমল তাই প্রেম নামক শব্দটা তার আশেপাশে আসেনি কিন্তু মীরাকে দেখে তার চোখে যেন দুনিয়ার সব চাইতে গুরুত্ব পূর্ণ জিনিসটা যে প্রেম সেটা মনে পরে গেল মানে লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে। আসলে সে যা পড়াশোনা করেছে তার সবই বয়েজ স্কুলে আর যেহেতু গ্রামের ছেলে তাই তার বড় হবার পরে মেয়েদের সাথে মেলামেশারও সুযোগ ছিল না।
ইউনিভার্সিটিতে শুরুর পড়াশোনা তাই একটু কমিয়ে দিল অমল । সারাদিন মাসীর বাসায়
বসে থাকে মীরাকে দেখার আশায়। এদিকে মীরার
কোন বিকার নেই কলেজে আসছে যাচ্ছে দেখা হলে কথাবার্তা বললে বলছে এই টাইপ।
এভাবে প্রায় তিন মাস কেটে গেল মীরা কথাবার্তা সামান্য বাড়ালেও অমল সাহস পাচ্ছেনা তাকে কিছু বলার পাছে যদি মাসীকে বলে দেয় তাহলে সব শেষ ।
একদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল তার, মীরার
সাথে কি একটা কাজে তাকে বাইরে যেতে বলেছেন
খালা। এক রিকশাতে পাশাপাশি সে আর মীরা,
ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল অমলের
আসলে সে অপেক্ষা করতে করতে এতই অস্থির
হয়ে উঠেছিল যে ছোট এই ঘটনাটাও তাকে আনন্দ দিচ্ছে।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সে রিকশাতে প্রস্তর মূর্তি হয়ে বসে শব্দটি মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। অবশেষে মীরাই মুখ খুলল।
-অমল ভাই, কি ব্যাপার আপনি এমন জবুথবু
হয়ে আছেন কেন?
-না, এমনি!!
-শরীর খারাপ?? বাসায় চলে যাবেন??
-না না শরীর খারাপ হতে যাবে কেন?(এবার ঠিক
হয়ে বসল সে পাছে না আবার মীরা সত্যি সত্যি তার শরীর খারাপ মনে করে)
-তাহলে নিশ্চয় মন খারাপ আপনার!!!
-হুমম, তা বলা যায় ।
-মানে, আপনার সত্যিই মন খারাপ!!! আমি জানি!!!!
-আসলে মীরা আমার একটা কথা বলার ছিল!!
-কাকে???
-না, মানে!! কাউকে না!!
-আচ্ছা আপনি যে একটা ভীতুর ডিম সেটা আপনি জানেন??
-না, মানে তোমাকে আমার একটা কথা বলার ছিল!!!!
-বলতে হবে না আমি জানি!!!!!!!!
মীরার ফর্সা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিল, অয়ন
আর কোন কথা বাড়ায় নি আস্তে করে মীরার হাত
ধরল সে। সামান্য কেঁপে উঠল মীরা, চোখ
দিয়ে জল পরছিল তার...........................
মীরার বাবার অফিসে বসে আছে অমল ।
কি কারনে জানি তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন অমলকে।
অমলের চোখে এখন খালি আগামীর চিন্তা,
মীরাকে নিয়ে যে মীরা ইউনিভার্সিটি ভর্তি হবে এবার। সে পাশ করে ভাল জব করবে মীরাকে নিয়ে সুন্দর একটা আগামী ভবিষ্যত গড়বে............।।
- অমল , বাবা তোমার জন্য একটা চাকরির খবর
এনেছি আমি। বেতন ভাল , থাকার জন্য
বাসা দেবে তোমাকে তোমার পড়া শোনার ও
কোন অসুবিধা হবে না, বাবা তোমাকে একটা কথা বলব???
-হ্যাঁ , বলেন মেসো !!
-ক্যারিয়ার সবার আগে,জীবনের বাকি সব পরে, তাছাড়া জীবনের এখনও অনেক বাকি।
-হ্যাঁ , মেসো আমি চাকরিটা করব।
-কালকে থেকেই জয়েনিং ।
-আচ্ছা, আমি কালকে থেকে যাব।
মেসোর কথার ইঙ্গিতটা ধরে ফেলেছে অমল তাই
চাকরিটা করবে বলে দিয়েছে সে । উনি যা করছেন
হয়তবা ভালর জন্য করেছেন
এটা ভেবে সে বেরিয়ে পরল। আজকেই কাপড় চোপড় গুছিয়ে মাসীর বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে সে। মীরা কাঁদছে তার রুমে একা একা, অমল এসেছিল কাপড় চোপড় ,বই পত্র নিয়ে যেতে ওর রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে তারপর সব শুনে পাথর, যতক্ষন অমল ছিল সে অমলের দিকে তাকিয়ে ছিল সে যেন আর দেখবেনা তাকে। অমল চলে যেতেই মার কাছে গেল সে
- মা, অমলদা চলে গেল কেন?
-সে একটা চাকরি পেয়েছে, তোর
বাবা চাকরিটা করে দিয়েছেন।
-চাকরিটা কি ওনার খুব দরকার ছিল???
-সেটা তোর বাবা ভাল জানেন!! আমার কাছে এসব বলতে আসবি না, তোর বাবার থেকে জিজ্ঞেস করে নিস। মেয়ের সাথে এই প্রথম রাগ দেখালেন তিনি। নীরার মনটা একেবারে ভেঙ্গে গেল। নিজের রুমে কাঁদতে কাঁদতে পুরনো দিন গুলোর কথা মনে পরে গেল তার । অমল ইউনিভার্সিটি থেকে কখন আসবে সে অপেক্ষায় থাকত সে,কখনও বের হত একসাথে এইখানে ওইখানে বেড়াতে যাওয়া আর সেই সময়ের খুনসুটি গুলো বড্ড মনে পরছে তার । অমলের সাথে যেদিন প্রথম রিকশায় করে গিয়ে ছিল, সেদিন রাতে ছাদে একসাথে বসে ছিল দুজনে । মীরা আর অমল ছাদে বসে ছিল একটু দূর
করে পাছে মাসী এসে পড়েন এই ভেবে, মীরার
চোখে চাঁদের আলোয় অমলকে যেন কোন মায়াময়
যুবকের মত লাগছিল যাকে সে যেন বহু বছর
ধরে খুঁজছিলো । কেন জানি লাগছিল তার জন্যই
অমলের কলকাতায় আসা তাদের পরিচয় হওয়া যেন কোন অমোঘ বিধির নিয়মে বাঁধা ছিল। অমলকে তার অবশ্য প্রথম দেখাতেই ভাল লাগেনি কেমন যেন বোকা বোকা টাইপ কিন্তু দেখতে দেখতে সে কেমন করে যেন স্বপ্নের রাজপুত্র হয়ে যায় তার কাছে - যাকে সে আপন করে পাবেই। অমলটার হাবভাবে বেশ বোঝা যেত তাকে সে পাগলের মত ভালবাসে কিন্তু মীরা পাত্তা না দেওয়ার ভাণ করত,আসলে ওকে খুঁচিয়ে বের করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বেচারা ভীতুর ডিমটা সেটা কখনই পারবেনা বলে একদিন মাকে বলে সে অমলকে নিয়ে বের হয়। মা খুশি মনেই
অমলকে ডেকে দিয়েছিল। আবার ডুকরে কাঁদতে লাগল সে..................।।
বাবা কয়েকদিন ধরে ফোন করছেন বারবার বলছেন একটা ভাল দেখে সুট বানাতে, কিন্তু অফিসের ব্যস্ততায় একদম সময় করতে পারছে না অমল ।আজকে ফোন করার পর সে বাবাকে বলতেই বাবা বললেন সময় নেই,চারদিন পর মীরার এনগেজমেন্টে তুই থাকবি। বলেই
বাবা কেটে দিলেন! অমলের মাথায় যেন বজ্রপাত হল । চার বছর ধরে যার জন্য এত পরিশ্রম করছে চারদিন পর তার এনগেজমেন্ট!!!!!!! নাঃ,এখন আর কিছুই করার নেই!!!!!
নিয়তি তাকে নিয়ে এত বড় একটা খেলা খেলবে সে তা বুঝতেই পারেনি। সব হারানোর শোক তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল , কিন্তু মনকে শক্ত করল সে। ভাবলো আমার কিছুই করার নেই আর আজ আমি এক পরাজিত ব্যর্থ মানুষ .........। মীরাদের বাসায় তার আগের রুমটাতেই বসে আছে সে, তার মা বাবা আসবেন এটা তারা আগে জানাননি। যাইহোক অতিথি নেই তেমন একটা , আর মনে হয় বর আসেনি এখনও । মাথা ধরেছে বলতেই মাসী তার আগের রুমে গিয়ে শুতে বলল।
এসে শোয়নি সে বসে আছে আর বিষাদের
সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। কতক্ষন এভাবে ছিল
বলতে পারবেনা,শুধু দরজা খোলার আওয়াজ
পেয়ে মাথা তুলল। তারপর যা দেখল তার মাথায় আরেকবার বজ্রপাত হল, মীরা তার সামনে দাঁড়ানো। মীরার চোখে বিস্ময় সে টের পাওয়ার আগেই দেখে মীরা তার বুকে । এই মেয়ে করে কি? তার মান ইজ্জত আজ ধুলোয় মিটবে। বিহিত
করতে হবে থাকে একটা,
-মীরা!!!! কি ব্যাপার?? তুমি এখানে কেন???
-কেন?? আমার আসতে মানা আছে নাকি(কান্না আর আনন্দ মিশ্রিত কন্ঠ মীরার)??
খটকা লাগল অয়নের,
-মেসো - মাসী আছেন, সঙ্গে আমার বাবা মাও। ওরা দেখলে কেলেংকারি হয়ে যাবে !!!!!!!!!
-মা পাঠিয়েছেন আমাকে এখানে!!!!!
-কেন?????
-বললেন, যা তোর বর আগে অমল যে রুমে থাকত
সে রুমে আছে...।
অমল এবার বুক থেকে তুলে নিয়ে চোখের
সামনে দাঁড় করাল মীরাকে ,ওর মনে হতে লাগলো যেন আকাশ থেকে যেন একটি পরী নেমে এসেছে। বিয়ের সাজে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে।
- এগুলো আমার জন্য সাজোনি তুমি????
( দুস্টুমি হাসি অমলের মুখে)
-না, আমার বরের জন্য সেজেছিলাম। কোন ভীতুর
ডিমের জন্য না।(মীরার চোখে কপট রাগ)
-তাহলে আমি দেখব না তোমাকে!!
(অন্যদিকে ফিরে গেল অমল )
-না দেখলে আমার বয়েই গেছে( হাসিটা কোন
মতে চাপল মীরা।)
অমল - মীরা দুজনেই মনে মনে খুব খুশী যে তাদের ভালবাসার পরিণতি যে মধুর হল তাদের বিনা উদ্যোগে তার জন্য তারা ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে এর জন্য দুজনের বাবা - মার অসীম ভালোবাসা দায়ী, ওরা কখনও বুঝতে পারেনি তাঁদের নীরব কর্মকান্ড।

