নীরা আর্য
নীরা আর্য
- নীরা আর্য
✍️পুলক দাশগুপ্ত
আমি আর আমার একাকিত্ব চিরে যে নদীটা বয়ে চলে তার নাম নিশি।
বললাম কি পড়ছিস, আজকাল। স্কুলে হোমটাস্ক দিয়েছে সুভাস চন্দ্র বসুর জীবনের উপর।
নিশিতা আমার পাশের বাড়ির একটা বাচ্চা মেয়ে। বোধহয় ক্লাশ ফাইভে পড়ে।
আমি বললাম ওকে জানিস সুভাষ চন্দ্র বসু র মহিলা গোয়েন্দা বিভাগ ছিল। তাহলে পুরো গল্পটা বলি।
আসলে গল্পটা আমি নেট থেকে পেয়েছি ও পরে যাচাই করে নিয়ে অবাকই হয়েছি। তখনকার দিনে মহিলা যোদ্ধারা এতো কষ্ট সহিষ্ণু ছিল।
একটা গল্প বলি তোমায়, নেতাজীকে হত্যা করার জন্য ব্রিটিশ একবার সরকারী গোয়েন্দা লাগিয়ে ছিল। ব্রিটিশ ভারতের সিআইডি ইন্সপেক্টর ছিলেন শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ইংরেজ প্রভুভক্ত অফিসার। ব্রিটিশরা শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে গুপ্তচরবৃত্তি করে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে হত্যা করার দায়িত্ব দিয়েছিল | একসময় সুযোগ পেয়ে শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নেতাজিকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করে। সেখানেই সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ’রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর সদস্যা নীরা আর্য।জয়রঞ্জনকে তিনি দ্বিতীয় সুযোগ দেননি। চোখের পলকে নীরা আর্য শ্রীকান্ত জয়রঞ্জনের পেটে বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করে।
শুধু এটুকুই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখানে একটা অভাবনীয় চমক আছে। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন ছিলেন নীরা আর্যের স্বামী। হ্যাঁ, নেতাজি ও দেশের জন্যে নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি নীরা আর্য। এই ঘটনার পর নেতাজি নীরাকে অভিহিত করেছিলেন ‘নাগিনী’ নামে।
নীরা আর্য ১৯০২ সালের ৫ মার্চ ভারতের তৎকালীন ইউনাইটেড প্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা শেঠ ছজুমল ছিলেন সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর পিতার ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তাই কলকাতাতে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। নীরা আর্য হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে বিবাহ করেন। স্বামীর সঙ্গে মতাদর্শগত কোনও মিল ছিল না নীরার। নীরা আর্য নেতাজির ডাকে সাড়া দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টে যোগ দেন।
নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর ছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেই নীরাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন।এই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মনবতী আর্য,সরস্বতী রাজামণি,দুর্গা মল্লা গোর্খা এবং যুবক ড্যানিয়েল কালে |
নিশিতা প্রশ্ন করে তারপর?
তারপরেও অনেক গল্প খুব রোমাঞ্চকর, কঠিন বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে, শুনতে চাও?
সহ্য করতে লাগবে।
তারপরে গল্প বীরত্ব আর ত্যাগের।
নীরা আর্যের আত্মজীবনীতে বর্ণিত গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত একটি অংশ যা নেট থেকে পড়েছি বলি তাহলে তোমায়।
“আমার সাথে আরও একটি মেয়ে ছিল, নাম সরস্বতী রাজামণি। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল এবং তাঁর জন্ম বার্মায়। সে এবং আমি একসময় ইংরেজ অফিসারদের গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমরা মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরি এবং ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি এবং সামরিক শিবিরে কাজ শুরু করি। আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য এভাবে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমাদের কাজটি ছিল কান খোলা রাখা,সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা, তারপরে নেতাজীর কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। কখনও কখনও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিও বহন করতে হত। যখন মেয়েদের গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল,আমাদের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে,ধরা পড়লে নিজেরাই নিজেদের গুলি করতে। একটি মেয়ে তা করতে মিস করেছে এবং তাকে ইংরেজরা জীবন্ত গ্রেপ্তার করেছিল। এতে আমাদের সংগঠনের সমূহ বিপদ ও ক্ষতি হবে বুঝে আমি এবং রাজামণি স্থির করেছিলাম যে, আমরা আমাদের সঙ্গীকে যে কোনভাবে মুক্ত করব। আমরা নপুংসক নর্তকীর পোশাক পরে যেখানে আমাদের সঙ্গী দুর্গাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে পৌঁছেছিলাম। আমরা অফিসারদের মাদক খাওয়ালাম এবং আমাদের সঙ্গীকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলাম। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার পথে পাহারায় থাকা এক সেনা গুলি চালায় এবং তাতে রাজামণির ডান পা গুলি বিদ্ধ হয়। কিন্তু তা স্বত্বেও সে কোনক্রমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এদিকে ধড়পাকড়ের জন্য অনুসন্ধান শুরু হলে আমি এবং দুর্গা একটা লম্বা গাছের উপরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনুসন্ধান নীচে অব্যাহত ছিল, যার কারণে আমাদের তিন দিন ধরে গাছের উপরে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। তিন দিন পরে আমরা সাহস করে সুকৌশলে সঙ্গীদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ঘাঁটিতে ফিরে আসি। রাজামণির সাহসিকতায় নেতাজি খুশী হয়ে তাকে আইএনএর রানি ঝাঁসি ব্রিগেডে লেফটেন্যান্ট এবং আমাকে অধিনায়ক করেছিলেন।”
আজাদ হিন্দ ফৌজের সমস্ত বন্দীকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে স্বামী হত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জেলে বন্দীদশায় তাঁকে অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল নীরা আর্য- কে। স্বাধীনতার পরে, ফুল বিক্রি করে জীবনযাপন করেছিলেন । তবে কোনও সরকারী সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি নীরা আর্য।
শেষ জীবনে হায়দরাবাদের ফালকনুমার একটি কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন নীরা আর্য। সরকারি জমিতে থাকার কারণে তার কুঁড়েঘরটিও শেষ মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বার্ধক্যজনিত অবস্থায়, চারিমিনারের নিকটে ওসমানিয়া হাসপাতালে ১৯৯৮ সালের ২৬ শে জুলাই, রবিবার তিনি দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব অবস্থায় প্রয়াত হন। স্থানীয় মানুষেরা তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে।
কি বর্বরচিত অত্যাচার করেছিল বৃটিশ তা কল্পনাতীত। মধ্যযুগীয় অত্যাচার তার কাছে কিছুই নয়। 'ব্রেস্ট রিপার' দিয়ে উপরে ফেলা হয়েছিল তার স্তন, কদর্যতা-পাশবিকতায় হার মেনেছিল মানুষের সামান্যতম বোধ।
কিন্তু সব থেকে খারাপ লাগে স্বাধীনতার পরে আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ।
নীরা আন্দামানে আসার একবছর পর, স্বাধীন হয়েছিল ভারত। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। অভিমানে সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণ নীরা। বহু দশক পরে, নীরা আর্য্যকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল হায়দ্রাবাদের ফলকনুমা এলাকায়। স্বাধীন ভারতে ফুল বেচে পেট চালাতেন তিনি। থাকতেন বস্তির এক চালাঘরে। বস্তির লোকেরা তাঁকে ডাকতেন পেডাম্মা (ঠাকুমা) বলে। পরবর্তীকালে তাঁর পরিচয় জানার পর, তাঁকে সরকারি পেনসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নীরা।
সকলের অলক্ষ্যে, ১৯৯৮ সালে ২৬ জুলাই, হায়দ্রাবাদের উসমানিয়া হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছিলেন ৯৬ বছরের বীরাঙ্গনা নীরা আর্য্য। না, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য হয়নি তাঁর। জোটেনি গান স্যালুট। এক সহৃদয় সাংবাদিক তাঁর শেষকৃত্য করেছিলেন। তিনিই দিয়েছিলেন ফুলের মালা, ফেলেছিলেন দু’ফোঁটা চোখের জল। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে, যে কুঁড়েঘরে নীরা থাকতেন, সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেটি দাঁড়িয়ে ছিল সরকারি জমির ওপর। সেদিনই নীরা বুঝতে পেরেছিলেন, যে মাটির জন্য তিনি রক্ত ঝরিয়েছিলেন, সেই মাটিও তাঁর নিজের ছিল না।
বললাম জানি সবার জায়গা ইতিহাসের পাতায় হয়না, কিন্তু তুমি তো আজকের মেয়ে বাকিটা এই ইন্টারনেটের যুগে নেট ঘাটলে অনেক আরো জিনিষ পাবে পড়তে।
😢