Komolika Ray

Tragedy

2  

Komolika Ray

Tragedy

মুখোশের আড়ালে

মুখোশের আড়ালে

7 mins
433


আয়নার সামনে বসে গায়ের গয়নাগুলো খুলছিল মালবিকা. শাশুড়ির দেওয়া বিয়ের সরু সরু নিরেট সোনার বারো গাছা চুড়ি. মানতাসা, বাউটি. গলার দু ভরির হাঁসুলী, ললন্তিকা,মাথার মুকুট.. সব পরতে হয়েছিল আজ. ভারী বেনারসি. সেটাও লাল পরার কথা বলেছিলেন শাশুড়ি মা. শুধু সেইটুকুই আপত্তি করেছিলো . আজ মালবিকা, শুভজিতের বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি . পঁ.চি.শ ব ছ র.... একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মালবিকার.প্রথম প্রথম মনে হোত দিন বুঝি আর কাটবেনা. তারপর কেমন দিব্য কেটে গেলো. প্রাচুর্য, গয়না, দামি শাড়ি, দামি গাড়ি সব কিছুর তলায় কি সুন্দর হারিয়ে ফেললো দুটো বিনুনি বাঁধা, ছটফটে , সাইকেল চালানো মেয়েটা কে. চন্দননগরে নিতান্ত মধ্যবিত্ত বাড়িতে জন্ম মালবিকার. বাবার একটা বই খাতার দোকান ছিলো. তখন সবে পার্ট ওয়ান দিয়েছে. পলিটিকাল সায়েন্স অনার্স ছিলো. বাবার বড় মাসির ছোট ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলো সবাই pp মিলে. বড় লোকদের বিয়ে বলে কথা! তুলিকা কাকিমা, অর্থাৎ প্রাণের বন্ধু পাপড়ির মা, নিজের মেরুন কাঞ্জিভরম টা দিয়েছিলেন পরতে. তার সঙ্গে হাল্কা ক্রিস্টাল এর দুল আর লকেট. কাকিমার কাছে তাদের দুজনের তো কোনো তফাৎ ছিলোনা. সেখানেই মালবিকা কে দেখে পছন্দ হয়ে যায় তার শ্বশুর মশায়, প্রসাদ সেনের. কলকাতার নাম করা ব্যবসায়ী. চামড়ার প্রোডাক্ট এ বলা যেতে পারে সেন 'স একটা ব্র্যান্ড. প্রস্তাব টা আসে দিন পনেরো বাদে. বাবার বড় মেসো বাবা কে ডেকে পাঠান . কলকাতার বুকে একাধিক বাড়ি, বিরাট ব্যবসা. মালবিকার বাবা যেন কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন. ঠাকুমা তখনও বেঁচে. জেঠু, পিসি সকলে তাঁকে বোঝালো এতো ভালো সম্বন্ধ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার. মা শুধু বার বার বলেছিলো, 'আমরা এত সাধারণ, এত অবস্থার ফারাক, পারবে মানাতে মিলি? 'কিন্তু কে শুনেছিলো সেদিন মায়ের আপত্তি, মালবিকার কান্না!. পাপড়ি, শ্রীতমা, দুই প্রাণের বন্ধু বাবার কাছে দরবার করতে এসেছিলো. কিছু লাভ হয়নি. তারপর সবাই কে ছেড়ে, চন্দননগরের চেনা পরিবেশ ছেড়ে এক অসম সামাজিক অবস্থানের বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করেছিলো মালবিকা পঁচিশ বছর আগে. তার বাপের বাড়ির দেওয়া তত্ত্ব তার চোখের সামনেই অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখেছে সে. মায়ের চারগাছি সোনার চুড়ি, গলার সরু হার, ঠাকুমার কানের ঝুমকো এইটুকু দিয়ে তাকে সাজানো হয়েছিল বা ঐ টুকুই জোগাড় করতে পেরেছিলো তার মধ্যবিত্ত বাবা এবং সেগুলো যে কত তুচ্ছ হাড়ে হাড়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হত নতুন শ্বশুর বাড়িতে. ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হতো তখন. মনে হতো ছুটে চলে যায়, আবার তিন বন্ধু সাইকেল চালিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে. কলেজে ক্লাস করে.! পার্ট 2 পরীক্ষা আর দেওয়াই হলোনা. ঋভু এসে গেলো পেটে. 'প্রথম সন্তান বাপের বাড়ি থেকেই হোক 'খুব কিন্তু কিন্তু করে বাবা প্রস্তাব দিয়েছিলেন. খুব ভদ্ৰ ভাবে শ্বশুর মশায় ' না 'বলে দিয়েছিলেন. আর সেই না এর মধ্যে যে কতোটা দম্ভ ছিলো, তা মালবিকা ভালোই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো. তারপর ধীরে ধীরে সব কেমন হজম হয়ে গেলো.. তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, ছোট করে দেখার অপমান. শুভজিতের কাছে যদি বা কখনও অভিযোগ করতে গেছে, পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছে' বাবা মার অংশীদারী ব্যবসা. আমার নিজস্ব কিছু নেই, মানিয়ে চলতে পারলে থাকো, নাহলে চলে যাও '. কোথায় যেত মালবিকা? অস্বীকার করে কি করে সে, যে চন্দননগরের বাড়ির ঘর গুলো তার চাপা লাগত ওখানে গিয়ে থাকলে. বাথরুম টা ভিজে ভিজে লাগতো. সেও বদলাচ্ছিলো. ঋভু থাকতেই চাইতোনা. পরে রিয়া হওয়ার পর থেকে যাওয়া কমতে কমতে বছরে দু বার কি তিনবারে এসে ঠেকলো.যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছিল হৈ হৈ করে দুই ভাই বোন, বাবা মা, ঠাম্মা. প্রাচুর্য ছিলোনা, কিন্তু প্রাণ ছিলো সেই বেঁচে থাকায়. কতকগুলো অভ্যাস সেই চেনা জায়গাটার সঙ্গেও কত দূরত্ব তৈরী করে দিলো. বান্ধবী দের টানে প্রথমদিকে ছুটে ছুটে যেত. কিন্তু পাপড়ি, শ্রীতমা দুজনেই তখন মাস্টার্স করছে. গল্প করার বিষয় গুলোই কেমন বদলে যাচ্ছিলো. মালবিকা গ্রাজুয়েশন শেষ করতে না পারার হীনমন্যতা ঢাকতে নিজের বড়লোক শ্বশুর বাড়ির গল্প করতো, ওরা ওদের কলকাতার ইউনিভার্সিটি, কফিহাউসের গল্প করতো. কিছুতেই আর সুর টা মিলতোনা. মালবিকা বুঝতে পারতো সেও যেমন স্বস্তি পায়না, তার উপস্থিতিতেও সবাই কেমন আড়ষ্ঠ হয়ে যায়. তার শ্বশুর বাড়ির বড় গাড়িটা তাদের গলিতে ঢুকতো না. দাদা একবার বলেই ফেললো কি দরকার তোর এত লোক দেখিয়ে এত বড়ো গাড়ি নিয়ে আসার ! সেদিন ফেরার সময় সারা গাড়ি চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছিলো. কাউকে কোনোদিন বোঝাতেই পারেনি, বা বোঝাতেই চায়নি, নিজের সত্বা টা কে বিকিয়ে দেওয়া টা কি যন্ত্রণার. ভালো থাকার সংজ্ঞা টাই সে ভুলে গেছে. এই পঁচিশ বছরে সে অনেক কিছু যেমন হারিয়েছে, শিখেওছে তেমনি অনেক কিছু . নিজেকে কি ভাবে উপস্থাপনা করতে হয়, কত কিছু চেপে নিতে হয় বৈভব নামক মোড়কে. সে কিটি পার্টি করতে শিখেছে, চড়া মেকআপ করতে শিখেছে, মদের গ্লাসে চুমুক দিতে শিখেছে. শুভজিৎ একাই আকণ্ঠ মদ্যপান করেনা, সেও করে. ফেসবুকে ছবি দেয় বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার. হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে. আজও মালবিকা খেয়াল করেছে দাদা কেমন অবাক হয়ে ওকে দেখছে. বৌদির চোখের ঈর্ষার ভাষাও সে পড়তে পারে. এই ঈর্ষারও দৃষ্টি সে ঋভু রিয়ার বন্ধুদের মায়েদের চোখেও দেখেছে অনেকবার. মালবিকা জানে বাইরের জগতের কাছে এই কাঁচের আলমারির সাজানো পুতুল অস্তিত্ব টা দেখাতে নেই. বুঝতে দিতে নেই পঁচিশ বছরেও এই সংসারে তার কোনো মূল্য নেই, মতামতের দাম নেই, এমনকি তার ছেলে মেয়ের ব্যাপারেও. সে খুব ভালোই বোঝে শুভজিৎ ব্যবসার কাছে বাইরে যাওয়ার নামে অন্য নারী সঙ্গ করে. জানতে পেরে প্রথম প্রথম রাগারাগি করেছিলো. একবার শাশুড়ি মার কাছে ও এই নিয়ে নালিশ জানিয়েছিল. স্থির চোখে শুধু বলেছিলেন তিনি দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যেতে পারো. অবাক হয়ে মালবিকা ভেবেছিলো একজন নারী, আর একজন নারীর যন্ত্রনা টা এক বিন্দুও বুঝতে পারেনা কি করে? সেও আজ কতদিন হয়ে গেলো ! খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া তার হয়নি. সাহসও ছিলোনা, সেই আত্মবিশ্বাসও তার ছিলোনা. রিয়া তখন তিন.সেই রিয়া এখন আঠারো. বাড়ির ধারা অনুযায়ী অহংকারী স্বভাবই পেয়েছে. তার জন্য মালবিকা কাউকে দোষ দেয়না. সেও তো পারেনি ছেলে মেয়ের সামনে কোনো স্বতন্ত্র উদাহরণ হয়ে উঠতে.

পাপড়ি আর শ্রীতমার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে তার ভেতরে এই মোচড়ান ব্যথাটা নতুন করে শুরু হয়েছে. বিয়ের আগে তারা তিনজন অভিন্ন হৃদয় ছিলো. জীবন তার সঙ্গেই এই রসিকতা টা করলো. বেশ কয়েকবছর আগে একবার নিউ মার্কেটের সামনে পাপড়ি আর পাপড়ির স্বামী রণজয় কে দেখে ছিলো গপ গপ করে ফুচকা খাচ্ছে. নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছিলো মালবিকা. কিন্ত কি যে হলো, বোকার মতো বলে চললো তার স্বামী তাজ বেঙ্গল ছাড়া কলকাতার কোথাও তাকে নিয়ে ডিনারে যায়না. রাস্তার খাবার তো দূরের কথা ! অথচ মালবিকা জানে পাপড়ি আর রণজয় দুজনেই কলেজে পড়ায়, তারাও অর্থনৈতিক ভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল. তফাৎ জীবনটা কে দেখার দৃষ্টি ভঙ্গির. নিজের মুখের ওপর কবে যে এই সুখে থাকার মুখোশ

টা পরে নিয়েছে, নিজেও জানেনা মালবিকা.

এত বছর বাদে যোগাযোগ হওয়ার পর একদিন পাপড়ি আর শ্রীতমা কে বাড়িতে ডেকেছিল মালবিকা. ভেবেছিলো অনেক গল্প করবে, নিজেকে একটু হাল্কা করবে. কিন্তু সারাক্ষন শাশুড়ি মা উপস্থিত রইলেন. তাঁর ঠান্ডা উপস্থিতিতে মালবিকার অকিঞ্চিৎকর অবস্থান আরোই প্রকট হয়ে থাকলো. কোনোক্রমে খাওয়া শেষ করে বাড়ি যাওয়ার সময় চিরকালের মুখরা শ্রীতমা বলেই ফেললো ' মিলি তু্ই ভালো নেই, আমরা বেশ বুঝতে পারছি '. হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো মালবিকা ' তু্ই কি বুঝবি, বিয়ে থা করিসনি, শ্বশুর শাশুড়ি থাকলে একটু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়. ' কিন্তু ধরা যে পড়ে গেছে বুঝতে পেরেছিলো মালবিকা. তাই হয়তো সুখে থাকার বিজ্ঞাপনটাও বেড়ে গেছে আজকাল . এই যে আজ সাড়ম্বরে বিবাহ বার্ষিকী পালন, মালবিকার এতে কি ভূমিকা? তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তুমি কিভাবে পালন করতে চাও. আজ সে কিছুতেই মনে করতে পারলোনা কত বছর আগে শেষ শুভজিত তাকে কিংবা সে শুভজিত কে আশ্লেষে চুম্বন করেছে . আগে ছিলো ঠান্ডা দূরত্ব, সে তবু শান্তির ছিলো. এখন আবার ক্যামেরার সামনে বেঁচে থাকা. এই নকল বেঁচে থাকাতে সে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে. তবু মাঝে মাঝে দম আটকে আসে. আজ মা আসেই নি. সকালে ফোনে মা শুধু বললো 'ভালো থেকো '. মালবিকা জানে মা সব বোঝে.বাবা চলে যাওয়ার পর কত বার মনে হয়েছে মা কে কদিন এনে রাখে নিজের কাছে. জায়গার তো অভাব নেই. মা ও আসতে চায়নি. এবাড়ির কেউ বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখায়নি. মনের ইচ্ছে মনেই মরে গেছে.

পাপড়ি আর শ্রীতমা.. ওরা নিশ্চয় তাকে নিয়ে হাসে, মনে হলো মালবিকার. দুজনেই স্বাবলম্বী. শ্রী বিয়েই করেনি. একটা স্কুল চালায়. কত স্বাধীন, মুক্ত..

হঠাৎ কি মনে করে মালবিকা পাশের ঘরে তাগাড় করে রাখা উপহার থেকে একটা বড়ো প্যাকেট বার করলো. এই প্যাকেটটাই তো পাপড়ি রা তার হাতে দিয়েছিলো. কৌতূহল রাখতে না পেরে খুলে ফেললো প্যাকেট টা. অবাক হয়ে দেখলো আঠারো/উনিশ বছর বয়সের উচ্ছল, প্রাণবন্ত মালবিকার একটা ছবি. মনে পড়লো পাপড়ির মামার আকাই পেন্টাক্স ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল. কি সাধারণ, অথচ কি অসাধারণ. এত দিন আগের একটা ছবি লামিনেশন করে ওরা দিয়েছে. তলায় শ্রীতমার খুব চেনা, গোটা গোটা ছাপা অক্ষরের মতো হাতের লেখায় লেখা ' তু্ই আজও এমনটি আছিস আমাদের কাছে '. বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো মালবিকার. নিজের ওপর একটা অক্ষম রাগ হলো ' কেন পারেনি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ! এখনো তো পারে. খুব কি দেরি হয়ে গেছে? ছবির মালবিকা যেন তেমনটাই বলছে তাকে. হাত বাড়িয়ে ছবিটা কে ছুঁলো মালবিকা. কিংবা ছুঁতে চাইলো সেই সময় টাকে.পলি পড়ে যাওয়া সময়টাকে. তৃষাতুর হয়ে সে নিস্পলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো. পরমুহূর্তেই আজকের মালবিকা, পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মালবিকা, প্রসাদ সেন, রোহিনী সেনের পুত্রবধূ, শুভজিৎ সেন এর স্ত্রী উপলব্ধি করলো তার ডানাদুটি অনেকদিন আগেই ওড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে. পায়ের শেকল টা অনেক আগেই চেপে বসে গেছে পায়ে. ঝটপট করাই তার একমাত্র নিয়তি. একরাশ উপহারের মাঝখানে উৎসব শেষের ক্লান্ত, বিধস্ত , নিঃসঙ্গ মালবিকা স্থবিরের মতো বসে রইলো, বসেই রইলো.


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy