STORYMIRROR

Priyadarshini Banik

Tragedy Inspirational

4  

Priyadarshini Banik

Tragedy Inspirational

মৃন্ময়ী আজ চিন্ময়ী

মৃন্ময়ী আজ চিন্ময়ী

11 mins
248


© কপিরাইট সংরক্ষিত

কলমে ~ প্রিয়া...


"৩৩২১০ আপ ক্যানিং লোকাল ১ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে!"

প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটতে থাকে কমলা। সাড়ে নয়টার মধ্যে আজ পৌঁছাতেই হবে কারখানায়,নয়ত আবারও মাহিনা কাটা যাবে।এমনিতেই বেশি মাহিনা পায় না,যেটুকু জোটে নিজের মাস চালানোর মত কিছুটা রেখে বাকিটা ওই বস্তির বাচ্চাগুলোর পড়াশুনা,আঁকা,গান এসবের পিছনেই খরচ হয়ে যায়।

ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে,সামনের লেডিসে উঠলে স্টেশনে নেমে কম হাঁটতে হবে,দৌড়াতে থাকে ও।বেশ ভিড় হয়ে আছে ট্রেনটা,সামনে লোকজনেরা ঝুলেঝুলে যাচ্ছে।শাড়িটা খামচে ধরে উপরে তুলে প্রাণপণে ছুটতে থাকে।ওর সামনে একজন মা তার কোলের সন্তানটিকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে।নিজের শাড়ি সামলে ওই শিশুটিকে নিয়ে ঐ মহিলার পক্ষে চলন্ত ট্রেনে ওঠা প্রায় অসম্ভব।যেকোনো মুহূর্তে দুজনেই পড়ে আঘাত পেতে পারে, পড়েও যাচ্ছিল মহিলাটি প্রায়।

ও ছুটে গিয়ে পিছন থেকে ধরে ওনাকে।ভাগ্যক্রমে পড়ে যায়নি,ট্রেনটা ধীরগতিতে স্টেশন ছাড়ায় মহিলাটি নিজেকে সামলে নিয়ে লেডিস কম্পার্টমেন্ট এ উঠে পড়েন।বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো ধুর বরঞ্চ কমলার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন কোনো অছুঁত কেউ ওনাকে স্পর্শ করেছে।এটা রোজকার ঘটনা হলেও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কমলা।ট্রেনটা বেরিয়ে যায় হুশ করে।

ট্রেন থেকে নামা নিত্য যাত্রীরা ছুটে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যে।কেউ কেউ কমলাকে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে তো কেউ কেউ আবার ওর ছোঁয়া বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ জোড়ে ধাক্কা লাগে।

"আরে সাইডে সরুন! রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে!অসহ্যকর!!!"

আরো হাজারো গালমন্দ করতে করতে এগিয়ে গেলেন যাত্রী।কিছুটা ধাতস্থ হয়ে কমলা সরে আসে। আচ্ছা ওই যে বাচ্চাটা দেখলো,আজ যদি সব ঠিক থাকত তাহলে ওরও একটা ওই বাচ্চাটার বয়সী বাচ্চা থাকত।মাঝে মাঝে ভারী ইচ্ছা হয় বাচ্চা দেখলেই জড়িয়ে ধরতে আদর করতে,,কিন্তু পারে না, বড়ো অসহায় যে ও।

স্টেশনের বাইরে সিঁড়ি দিয়ে আনমনে নামতে নামতে এগিয়ে চলে বাস স্ট্যান্ডের দিকে।ভাঙা রাস্তার এলোমেলো ভাবে ছড়ানো খোয়ায় পায়ে বেঁধে পা মুচকে যায় ওর।যন্ত্রণায় নিচু হয়ে বসে পা চেপে ধরে।কিন্তু বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারলো না,বাস ধরে দ্রুত ব্যাগের কারখানায় পৌঁছাতে হবে।

পথচলতি একটা বাস পেয়ে উঠে পড়ে,ভিতরে যেতেই লোকজনের মুখে অসন্তোষের ছাপ।

"এই উঠলো!নাও সকাল সকাল মশলা খসাও!"

"সত্যি বাবা!এই তালি মেরে পয়সা চাইতে এলো!আরে বাবা খেটে খা!না খালি তারা নেওয়ার ধান্দা!"

মুহূর্তের মধ্যে কমলা হয়ে হয় ওদের আলোচনার বিষয়।কমলা ওসবের ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে যায়।একটা সিট এর পাশে দাঁড়িয়ে ওপরের হ্যান্ডেলে হাত রাখে। ও যেই সিটের সামনে দাঁড়িয়েছিল সেখানে ধারে বসা ছেলেটা উঠে ওকে বসার জন্য ইশারা করলে ও হালকা হাসে।সত্যি পাটা খুব ব্যাথা করছিলো,মনে হচ্ছিল বসতে পারলে ভালো হতো।হয়তো এত অপমানের মাঝে এইটুকু শান্তি বুঝি প্রাপ্তির খাতায় ছিলো।

ছেলেটা উঠতে একটু ঠিক ভাবে বসে নিল ও।পাশের জানলার ধারে সিটে একজন বয়স্ক বৃদ্ধা একটা ছোটো বাচ্চা মেয়ে কোলে নিয়ে বসেছেন।মেয়েটা খুব দুরন্ত,আর বৃদ্ধা বেশিক্ষন ওকে নিজের কোলে রাখতেও পারছেন না।কমলা ওনার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলে উনি মেয়েটিকে ঠিক করে কোলে নিয়ে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেন।

কোলের বাচ্চাটি কমলার কানে ঝলমলে কানের দুলটা নিয়ে খেলা করছে আর খিলখিল করে হাসছে, বৃদ্ধা বারবার বাচ্চাটির হাত টেনে নিচ্ছেন।কমলা ভাবলো বুঝি ওনার বয়সের জন্য ছোট্ট শিশুটিকে ধরতে অসুবিধা হচ্ছে,তাই গলার স্বর খানিকটা কোমল করে বলে ওঠে,

"আপনার অসুবিধা হলে দিতে পারেন ওকে,আমি কোলে নিচ্ছি!"

"না বাপু ঠিক আছে!আমার কষ্ট হলেও আমি রাখবো, যার তার কোলে ওকে দেই না বাপু!"

কমলা তো ভুলেই গেছিল, ও যে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।তাই দুটো স্টপেজ বাকি থাকতেই সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে সামনের মেয়েটিকে বসার জায়গা দিল। মেয়েটি বসে নিজেই আগ বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়।কমলা নির্বাক চিত্তে তাকিয়ে থাকে।বাচ্চাটি মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে নির্মল হাসি হাসছে, ওটুকুই ওর কাছে অনেক।

সামনের স্টপেজে নামার জন্য এগিয়ে যায় কমলা। চিরেচ্যাপটা ভিড়ে যাত্রীদের কোলাহল, কন্ডাক্টরের চিৎকার।পিছনের কেউ ওর পেটের উন্মুক্ত অংশে হাত দিল একবার।বাসের ঝাঁকুনিতে লেগে গেছে ভেবে গুরুত্ব দিল না।

কিন্তু না আবারও সেই একই ঘটনা,একবার,দুবার,তিনবার......

পিছন ঘুরে দেখলো একটা মধ্যবয়স্ক লোক অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে। ও তাকাতেই লোকটাও তাকালো,কিন্তু ভাবটা এমন যেন নিতান্ত অসহায় হয়ে ওর মতো মানুষের পিছনে দাঁড়াতে হয়েছে।কমলা মুখে ঘুরিয়ে আরেকটু সামনে চেপে দাঁড়ায়।

স্টপেজ আসার কিছুক্ষন আগে আবারও সেই ঘটনা।এবার যেন লোকটার অংশগ্রহণ আরো খোলামেলা স্বতস্ফূর্ত,হাতটা ময়াল সাপের মত কমলার শরীরের ভাঁজ পেরিয়ে বুকে উঠে আসছে।ভিড়ের চাপে নড়তে পারছে না কমলা।লোকটা মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে সজোরে চেপে ধরে কমলার কোমল বুক।

কমলা আর সহ্য করলো না,ভিড়ের মধ্যে নিজের হাতটা পিছনে নিয়ে লোকটার পুরুষাঙ্গটা দেহের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে।লোকটা ভিড়ের মাঝে চেচিয়ে ওঠে,কিন্তু স্টপেজ এসে যাওয়ায় সবাই নামার তাড়ায় ওনাকে গুরুত্ব দেয়না।বাস থেকে নেমে যায় কমলা।ওর পিছনের সেই শয়তানটা ভিড়ের ধাক্কায় আছড়ে পড়েছে রাস্তায়,ওকে মাড়িয়েই লোকে এগিয়ে চলছে নিজের গন্তব্যে।কিন্তু কমলার চোখে ওই শয়তানের শরীর নয় ওর পুরুষত্বটাকে মাড়িয়ে দিচ্ছে সবাই,যা নিয়ে ওর এত দম্ভ!

কমলা এগিয়ে চলে,মনে মনে ভাবতে থাকে কে যেন বলেছিল ওদের মতো বৃহন্নলারা নাকি সমাজে সুরক্ষিত,ওদের দিকে নাকি পুরুষের কি নজর পড়ে না!হাহ্! হায় রে সমাজ!

রাস্তায় রাস্তায় প্যান্ডেল তৈরি চলছে,কুমারপাড়া মৃন্ময়ী গড়া।পুজো এলো বলে,মা আসবে আসবে করে এসেও চলে যায়,বছর ঘুরে আবার আসেন।প্যান্ডেলের সাজ,প্রতিমার সাজ বদলায়,মানুষের জীবন বদলায় কিন্তু ওর মত হাজারো কমলা আজ পাঁকে আটকে দাঁড়িয়ে গেছে।এই পাঁকে পদ্ম ফোটা দুঃস্বপ্নেও সম্ভব নয়।মা নাকি মঙ্গলময়ী,সবার জীবন আলো করে দেয়,কই ওদের জীবনে ত আলো নেই।তবে কি মা আজও চিন্ময়ী হতে পারেনি,মাটির প্রতিমাতেই আবদ্ধ তিনি।


পাশ দিয়ে একদল কলেজ পড়ুয়া যাচ্ছে।তারা হাসাহাসি করতে করতে এগিয়ে চলেছে,বিষয়?

ওরা হাতে তালি দিতে দিতে ওর দিকে নির্দেশ করছে!!ছেলেগুলো পর্যন্ত হাসছে।পিছনের লাল জিন্স,টপ পরা সুন্দরী মেয়েটাও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে যোগ দিচ্ছে ওদের হাসাহাসিতে।

আজকাল এসব দেখলে ওর আর চোখ ছলছল করে না,মন কাঁদে না।শুধু মনের ওপর মরচে ধরে পরতের পরতে।সেই কোন ছোটবেলায় বাবা কাকারা বাড়ি থেকে ওকে মাসী বাড়ি রেখে চলে যায়,মা অনেক কেঁদেছিল সেদিন।সেটা ওকে যতটা না আঘাত করেছে তার থেকে বেশি আঘাত করেছে ওকে রেখে ফেরার পথে বাবার মুখে লেগে থাকা মুক্তির হাসিটা,যেন ভার মুক্তি ঘটেছে।মাসীর বাড়িতেও মেসো, পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে কোনমতে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর সতেরো বছরে ঘর ছাড়ে, বস্তিতে এসে ওঠে।তারপর থেকে এই বারো বছরে কতো লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ও,আগে প্রতিবাদ করতো এখন আর করে না।কেউ শোনেই না ওর কথা, অথচ কিছু কিছু বুদ্ধিজীবীরা নাকি ওদের নিয়ে সাহিত্য করে,ওদের পাশে দাঁড়ানোর আর্জি জানায়।কই তাদের মত একজন কেও তো দেখতে পেলনা ও,তবে কি তারা ভগবান!?

*********************************************

এভাবেই কেটে যায় কয়েকদিন।চলে এসেছে পুজো।চারধারে সাজো সাজো রব, ঢাকের বাদ্য,শিউলির সুবাস।পঞ্চমীর দিন যেখানে সবাই আনন্দে মত্ত,বুকে পুজোর গন্ধ ভরে শারদীয়ার খুশিতে গা ভাসাচ্ছে,সেদিন কমলা চামড়ার গন্ধ বুকে নিয়ে ব্যাগ বানাতে ব্যস্ত।এবার বোনাস খুব বেশি পায়নি, আজকে অনেক ছুটি নিলেও একটু বেশি বোনাসের আশায় বেশিক্ষন কাজে আছে ও।ওর মত তিন চারজন ছেলে মেয়ে কাজ করছে।

কাজ শেষ করে যখন বেরোলো তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমলা। প্যান্ডেল এ পুজোর গন্ধ,আলোর রোশনাই ওকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।কোথাও বেশিক্ষন দাঁড়ায় না, মানে দাঁড়িয়ে ওর পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে বিব্রত করতে চায়না ও।একটা বাচ্চা ছেলের হাতে রঙিন চরকা দেখে নিজে কতগুলো নেয় বস্তির বাচ্চাগুলোর জন্য, বাচ্চাটাকে টেনে নিয়ে আদর করে।ছেলেটি মিষ্টি করে হেসে ওর সাথে আলাপ জুড়ে দেয়।ছেলেটার হাতে একটা গরম গরম রোল ধরিয়ে বাড়ির পথে ধরে কমলা।

রাত বড়জোর দশটা কি সাড়ে দশটা।বড়ো রাস্তা থেকে একটা ছোটো নিঝুম গলিতে ঢুকতেই ধাক্কা খায় একজনের সাথে।ধাক্কা খেয়ে নিজে সামলে গেলেও সামনের জন মাটিতে পড়ে যায়।কমলা তড়িঘড়ি ওকে টেনে তোলে।একটা মেয়ে,নীল ক্রপ টপ আর আঙ্কেল লেন্থ জিন্স পড়া, ঘাড়ের কাছে লাল হয়ে আসা খামচির দাগে বিন্দু বিন্দু রক্ত লেগে।মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগলেও সেটা মনে পড়ার আগেই মেয়েটা ওকে সজোরে জাপটে ধরে।

"আমাকে বাঁচাও! ওরা মেরে ফেলবে!আমাকে ছিঁড়ে খাবে বলেছে ওরা!আমাকে বাঁচাও!!"

"কে বলেছে এসব!আর তোমার ঘাড়ে রক্ত কেন!?"

তখনই সামনের গলায় থেকে কয়েকজন মদ্যপ যুবক টলমল পায়ে দৌড়ে আসে।মেয়েটাকে এখানে দেখে কেমন যুদ্ধ জয়ের হাসি হাসে।

"ঐ যে ওরা করেছে!আমাকে মেরে ফেলবে ওরা!"

কমলা মেয়েটার হাতটা ধরে ওকে নিজের পিছনে নিয়ে আসে।মেয়েটাকে ইশারায় পালিয়ে বড়ো রাস্তায় যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে কমলা নিজের জরাজীর্ণ ব্যাগটা থেকে ধারালো ভাঙা ছুরিটা বের করে।ছেলেগুলো এগোতেই ওদের দিকে রণচন্ডী রূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও।মেয়েটা বড়ো রাস্তার দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকায় বারবার। ওর মস্তিষ্ক ওকে পালাতে বললেও ওর মন বলছে লোক জড়ো করতে নয় ওনাকেও ওই ছেলেগুলো মেরে ফেলতে পারে।

দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ একটা আর্তনাদে পিছন ফেরে মেয়েটা। পেটে হাত চেপে টলমল পায়ে বসে পড়েছে কমলা।সামনে মদ্যপ যুবকটির হাতে ভাঙা মদের বোতল।মেয়েটা দৌড়ে সামনের প্যান্ডেলে গিয়ে লোক ডেকে আনে।ছেলেগুলো মেয়েটাকে ধরতে সামনে যাওয়ার আগেই কয়েকজন লোককে এদিকে ছুটে আসতে দেখে চম্পট দেয়।

"দিদি দিদি! শুনতে পাচ্ছ!?আপনারা অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন না!ওনার খুব ব্লিডিং হচ্ছে!একটু জল দিন না কেউ!? ও দিদি শুনছো!?"

মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে কমলার। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, চাপ চাপ রক্তের সিক্ততা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর কেনা রঙিন কাগজের চরকা গুলো।তাও মুখে হাসি ফুটে ওঠে ওর,সেই হাসিটা মেয়েটাকে সুরক্ষিত দেখে নাকি ওর বহু প্রতীক্ষিত দিদি ডাক শুনে তা বোঝার আগেই জ্ঞান হারায় ও।


********************************************


"ওনার অবস্থা এখন অনেকটা স্টেবল!আমরা ওনার পেট থেকে সব কাঁচ বের করে দেওয়া হয়েছে! ক্ষত খুব গভীর নয়,আর ঠিক সময় আপনি ব্লাড দিয়েছেন বলে অনেকটা হেল্প হয়েছে!এখন জ্ঞান ফিরতে যা সময় লাগবে।"

ডাক্তার চলে যেতে বহ্নি চেয়ারে আবারও বসে পড়ে।সামনে দাঁড়ানো তরুণ এস পি অফিসার দেবাংশু রায় ওর দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তারের কেবিনের দিকে চলে যান।মেয়েটা থানায় ডাইরি করার পর ও কেসটার দায়িত্ব নিয়েছে। বহ্নির সাথে কমলাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা জনৈক লোকেরা সামান্য একজন বৃহন্নলার জন্য ওকে থানায় এফ আই আর না করতে বললেও ও রাগে ফেটে পড়েছিল,,

"কেন উনি কি মানুষ না!?ওনার বিচার পাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে,আপনাদের মানুষিকতাটা না আগে ঠিক করুন!তারপর নিজেদের মানুষ বলতে আসবেন!"

ওর সাথে আসা লোকজনেরা মুখ ভেংচে সরে পড়লেও ও নির্ভীক ভাবে সব দায়িত্ব সামলে নেয়।

হঠাৎ একজন বছর ৩৫ এর মহিলা একটা শিশু নিয়ে দৌড়ে আসে বহ্নির কাছে।ওকে দেখে কান্নায় ভেংগে পড়ে বহ্নি।

"আমার জন্য ওনাকে এভাবে আঘাত পেতে হলো বৌদিভাই আমার জন্য।"


***********************************************


আজ সপ্তমী,কিছুক্ষন আগে জ্ঞান ফিরেছে কমলার। নিভু নিভু চোখে বুঝতে পারছে ও নিজের ভাঙা টালির ঘরে নয় কোনো হাসপাতালে আছে।ডাক্তার এসে দেখে যাওয়ার পরে দুজন ওর কেবিনে ঢোকে।ওকে কেউ হাসপাতালে ভর্তি করবে সেটাই যেখানে ওর কাছে কল্পনার অতীত ছিলো সেখানে কেউ দেখে করতে আসবে সেটা ও ভাবতেও পারেনি।দুজনকেই কেমন চেনা চেনা লাগে ওর।

অল্পবয়সী মেয়েটা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে ফুঁফিয়ে ওঠে।কমলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে পেটে সেলাইতে টান লাগে যন্ত্রণায় ওর মুখ কুঁচকে ওঠে।বহ্নি ওকে উঠিয়ে পিছনে বালিশে হেলান দিতেই কমলা হালকা হাসে।

"তুমি...."

"আমি...আমি বহ্নি!সেদিন আমাকে বাঁচাতে গিয়েই আপনার আঘাত লেগেছে!"

পিছনে দাঁড়ানো মহিলাটি এগিয়ে আসে। ইতস্তত ভাবে বলে ওঠেন,

"অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!আমার ননদটিকে বাঁচিয়ে আপনি যে আমাদের কতবড় উপকার করেছেন বলে বোঝাতে পারব না!"

"না না !একই করছেন!?? ও তো আমার বোনের মত!আজ ওর জায়গায় আমার বোন থাকলে.."

"আমায় ক্ষমা কোরো দিদিভাই!"

কমলা চোখ তুলে বহ্নির দিকে তাকায়।বহ্নি অপরাধীর মতো মুখ করে মাথা নিচু করে বলে,

"সেদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে নিয়ে আমার আর আমার বন্ধুদের মজা করা উচিত হয়নি!আমার ভুল হয়ে গেছে!"

কমলা আলতো হাসে,

"শুনলাম তুমি নাকি আমায় রক্ত দিয়েছ! মানে তোমার রক্ত এখন আমার শরীরে বইছে,,আর তুমি তো আমায় দিদিভাই বলে ডেকেছ!ছোটবোন ভুল করে ক্ষমা চাইলে দিদি কি আর রাগ করে থাকতে পারে!?"

কমলা পিছনে বহ্নির বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে,

"ছেলে ভালো আছে তো বৌদি!?"

বহ্নির বৌদি চোখ বড় বড় করে তাকায় কমলার দিকে,,

"আপনি কি করে জানলেন আমার ছেলে আছে!."

কমলা আবারও হাসে,,

"ওভাবে আর কোনোদিন ট্রেনে উঠবেন না বাচ্চা নিয়ে,,পড়ে গেলে আপনার সাথে সাথে তো ছোট্টটিরও ব্যাথা লাগত!পারলে পরের ট্রেনে যাবেন।"

বহ্নির বৌদি মাথা নামিয়ে নেন।কিছুক্ষনের মধ্যে উনি বেরিয়ে যেতে এস পি দেবাংশু ভিতরে আসেন।বহ্নি তখন হেসে হেসে কমলার সাথে গল্প করছিল। দেবাংশুর সাথে চোখাচুখি হতে ও আলতো সৌজন্যমূলক হাসি হাসে, দেবাংশু ও ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কমলার দিকে এগিয়ে আসে,,

"কেমন আছে এখন শরীর!?"

"ভালো ভাই!বসো না তুমি!"

"না না উত্তেজিত হবেন না!আপনার সাথে দেখা করতে কয়েকজন এসেছেন!"

কমলা অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যায়।এতদিন ধরে পরিবার পরিজন হারা কমলার চোখ ভিজে যায়।কেবিনের দরজা খুলে তখন কয়েকজন খুদে দর্শক ভিড় জমিয়েছে।

"আপনার বাড়ি গিয়েছিলাম,ভেবেছিলাম কেউ পরিবার পরিজন থাকলে তাদের খবর দিতে,বস্তির সবাই জানালো আপনি নাকি একা থাকেন!কিন্তু এরা আবার আপনার পরিবারের সদস্য হওয়ার দাবি নিয়ে আপনার সাথে দেখা করার আর্জি জানিয়েছে।"

ছোটো পাঁচ বছরের ভোলা ছুটে আসে হাতে একটা প্লাস্টিকের পকেট নিয়ে।

"এ দেখো কমুমাসী আমাদের গাছের শিউলি ফুল,সেই কোন সক্কালে উঠে তোমার জন্য কুড়িয়েছি!"

সাত বছরের পরী হাতে ট্যাপ পরা স্টিলের টিফিন বাড়ি হাতে ছুটে আসে।

"এ দেখো মা সকালে তোমার জন্য তোমার প্রিয় কচু শাক বানিয়ে পাঠিয়েছে।তুমি খাবে তো!"

ছয় বছরের গুড্ডু কতগুলো কাঁচের গুলি হাতে এগিয়ে আসে।

"আমার তো মা নেই যে তোমার জন্য রেঁধে দেবে,আবার শিউলি গাছও নেই!তাই আমার এই প্রিয় গুলি গুলো তোমায় দিলাম।খব্বদার!বিল্টু দাদাকে দেবে না কিন্তু!"

এমনি সাত আটজন খুদের নানা উপহার ভরিয়ে দেয় কমলার হাত,না না,,কমলার এত বছরের অপূর্ণতার দহনে পুড়তে থাকা হৃদয়।এদের মাঝে নিজের অপূর্ন মাতৃত্বের হতাশাটা যেন মুহূর্তে মুছে যায়।খানিক ক্ষণ বাদে কচিকাঁচাদের তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে কথা দিয়ে বিদায় দেয় কমলা।

আজ না চাইতেও যেন অনেক প্রাপ্তি ঘটেছে ওর।বাচ্চাদের বাইরে জিপে তুলে বস্তিতে দিয়ে আসার নির্দেশ দিয়ে দেবাংশু আবারও কমলার কাছে ফেরে।

"আমি বলছিলাম কি, আমার মা একটা প্রাইমারি স্কুল খুলেছে,আমি শুনেছি আপনি ওই বাচ্চাগুলোকে পড়ান,আমি চাই আপনি জেন ওদের ওই স্কুলে পাঠান,হ্যাঁ,বিনা বেতনে ওরা পড়বে!"

"সে তো অনেক সৌভাগ্য ভাই!অনেক ধন্যবাদ তোমায়!"

"আরে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন,আর একটা আবদার যদিও আছে! মানে মা চাইছিলেন,আপনি যাতে ওখানে বাংলা পড়ানোর দায়িত্বটা নেন,,শুনেছি আপনি খুব ভালো নাকি সাহিত্যে!"

"আরে সেসব না! উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি, রেজাল্ট ভালো হলেও ভালো কলেজে পড়ার ভাগ্য আমার ছিলো না,আর মাতৃভাষা তো আমার রক্তে মিশে,আমি যদি এমন সুযোগ পাই তবে...."

আর বলতে পারে না কমলা।চোখ উপছে জল বেয়ে পড়ে।পাশে বসা বহ্নি যত্ন করে ওর চোখের জল মুছে দেয়। দেবাংশু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে।মেয়েটা যেদিন অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে নিজের ভুল স্বীকার করেছিল,কমলার চিকিৎসার জন্য সারাদিন হাসপাতালে পড়েছিল,ওর দোষীদের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল সেদিন এক অনন্য তেজ লক্ষ্য করেছিল ওর মধ্যে।বহ্নিও মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে ওর পাশে দাঁড়ানো তরুণ এস পি সাহেবকে।চোখাচুখি হতেই হালকা শিহরণে কেঁপে উঠছে বারবার।

"এই আজ সপ্তমী না!তুই ঘুরতে বেরোস নি কেন!?আমার জন্য এখানে পড়ে আছিস,না!?এখনই বেরও যা!পুজোর সব নতুন জামা বুঝি এই বুড়ি দিদিটার জন্য নষ্ট করবি!?"

"আরে না দিদি,তুমি সুস্থ হলে একসাথে বেরোব!তোমাকে নিয়ে অনেক ঠাকুর দেখব এবার!"

"সে দেখিস খানে!এখন যা! কিরে!?"

দেবাংশু গলা খাকারি দিয়ে বলে,,

"হ্যাঁ উনি তো ঠিকই বলেছেন,,আমি এখন বেরিয়ে যাবো!আপনি চাইলে আপনার বাড়ি অবধি লিফট দিয়ে দেব নাহয়!"

শরতের সকালে যেন এক চিলতে বাসন্তী রোদ উঁকি মারার চেষ্টা করছে বারবার।সেই রোদের উত্তাপে লাল হচ্ছে বহ্নির ফর্সা গাল দুটো।ভালোবাসার আঁচে যে দুই মন নিজেদের সেঁকে নিতে চাইছে সেটা নজর এড়ালো না কমলার।

"হ্যাঁ হ্যাঁ ভালই হয় ভাই!তুমি ওকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিও!"

বহ্নি কমলাকে জড়িয়ে ধরে,,

"না আমি যাবো না বলছি তো!আর আমার জ্যান্ত দুর্গা দর্শন তো সেই পঞ্চমীর রাতেই হয়ে গেছে, যে আমাকে রক্ষা করেছে ওই শয়তান অসুর গুলোর হাত থেকে।"

"জানো দিদি আমি না ঠিক করেছি একটা ক্যারাটে ক্লাসে জয়েন করব!আর আমার বন্ধুদেরও বলবো! পরে আমি নিজেও একটা ট্রেনিং সেন্টার খুলবো,,ওখানে সব মেয়েদের ট্রেনিং দেব সেলফ ডিফেন্সের! ছেলেরাও চাইলে ট্রেনিং নিতে পারে,, দেখো একদিন অন্য কেউ নয় মেয়েরা নিজেই নিজেদের দুর্গা হয়ে উঠবে!"

বহ্নির কথায় সায় দিয়ে দেবাংশু বলে,

"যদি আপনি সত্যি সত্যি এটা করেন তো আমাকে আপনি পাশে পাবেন মিস বহ্নি!আমি এরকম একটা ভাবনার বাস্তবায়নে আপনার পাশে আছি!"

কমলা মৃদু হেসে বহ্নির মাথায় হাত বুলায়।শেষে অনেক জোরাজুরির পর দেবাংশুর সাথে বহ্নিকে পাঠিয়ে দেয় কমলা।বহ্নি বারবার লজ্জায় যেতে না চাইলেও কমলার কাছে হার মানে শেষে।

কমলা কেবিনের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে এক নারী অবয়ব যেন হাসছে,,তাকে ঘিরে সূর্য সাত রঙের মেলা সাজিয়েছে, ত্রিনয়নী সেই অবয়ব যেন বলছে,,

কিরে তোর মৃন্ময়ী মা কি চিন্ময়ী হলো!?





সমাপ্ত........!



Rate this content
Log in

More bengali story from Priyadarshini Banik

Similar bengali story from Tragedy