Partha Pratim Guha Neogy

Romance Classics

4.2  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance Classics

মেঘে ঢাকা মন

মেঘে ঢাকা মন

8 mins
1.4K


জীবনের চলার পথে একে অন্যের সাথে মিলিত হয় নানা কারনে - কর্মসূত্রে, লেখাপড়া, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। এর মধ্যে কারো কারো ভিতর গড়ে ওঠে একের অন্যের প্রতি একটা ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু বাস্তবতার চাপে তা সবসময় ধরে রাখা যায় না। যারা পারেন তাঁরা ভাগ্যবান - বাকিরা ঐ ভালোসময়ের স্মৃতি নিয়ে বাকী জীবনটা বাঁচে।


টিং টং... টিং‌ টং...


"উফ্... এই অসময়ে আবার কে এলো..." ঘুম-ঘুম পায়ে দরজা খুলতেই একরাশ চমক লাগলো হিয়ার।


"কিরে একেবারে তো হাঁ হয়ে গেলি... কেমন দিলাম বল... জানতাম তো... তুই এখন নাক ডেকে নির্ঘাত দুপুরের ভাত ঘুম দিচ্ছিস...তাই আর ফোন না করেই সটান চলে এলাম..." এই বলে হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো অম্বর।


সেই style... বেপরোয়া, বিন্দাস। কোনও মেয়েকেই খুব একটা পাত্তা দেয় না। দুনিয়া কি ভাবল, তাতে কোনও যায় আসে না... মাঝে-মাঝে আবার নিরুদ্দেশও হয়ে যায় কাউকে কিছু না জানিয়েই। মাঝে-মাঝে খুব রাগ হয় হিয়ার। ভাবে, একটা কিছু করতেই হবে... সবসময় এতো কাঁদায় অম্বর... এবার হিয়া এমন কিছু করবে যার জন্যে অম্বর কাঁদবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, পারে না হিয়া অম্বর কে কাঁদাতে। যতই হোক, অম্বর তো হিয়ার best friend...অম্বরের কষ্ট হলে যে হিয়ারও খুব কষ্ট হয়। তবে এটা ঠিক যে, অম্বরের এই উড়নচণ্ডী -বাউণ্ডুলে স্বভাব, এলোমেলো - অগোছালো থাকা, পাগলের মত কথা বলা, এই সবই হিয়াকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে।


চলতে থাকে হিয়া আর অম্বরের খুনসুটি মেশানো বন্ধুত্ব, বাড়তে থাকে ওদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু বলতে পারে না কেউ কাউকেই। এরই মধ্যে একদিন অম্বরের জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ দেখে অম্বরের বাবা-মা। খুব পছন্দ হয় তাদের অম্বরের জন্যে দেখা পাত্রী বৃষ্টিকে। কিন্তু অম্বর বিয়ের বিষয়ে রাজি নয়। ও চায় না বৃষ্টিকে বিয়ে করতে।

হঠাৎই একদিন অম্বরের মা ফোন করে হিয়াকে, আর বলে, "হিয়া তুমি তো অম্বরের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তুমি অম্বরকে একটু বোঝাও please... বৃষ্টি মেয়েটা খুব ভালো। আমাদের পরিবারের সাথে খুব ভালো মানাবে বৃষ্টিকে । তুমি অম্বরকে একটু বোঝাও যে, ও যেন বৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।"


কথাটা শুনে হিয়ার চোখ ভিজে যায়। সে শুধু বলে, "হ্যাঁ কাকিমা, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক অম্বরকে বিয়ের জন্যে রাজি করে দেবো।"


তারপর হিয়া অম্বরকে ফোন করে আর বলে, সে অম্বরের সাথে দেখা করতে চায়, সেদিনই বিকেলবেলা ওদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, সেই গঙ্গার ধারে। বিকেল ৫ টা বাজে ঘড়িতে। পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় চারিদিক মায়াময় হয়ে উঠেছে। অম্বর এলো সেই গাঢ় নীল শার্টটা পড়ে যেটাতে হিয়ার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ওকে। এসেই বলল অম্বর , "কিরে পাগলি, এতো জরুরি তলব কেন?"


হিয়া : অম্বর আজ একটা জিনিষ চাইবো, দিবি?


অম্বর : তোর আবার কি লাগবে? তুই তো কিছু চাস না! তবে আবার এখন বলিস না, তোর জন্যে boyfriend খুঁজে দিতে হবে, আমি কিন্তু পারবো না।


হিয়া : উফ্ অম্বর! আমি মোটেও ওইসব চাইবো না। অন্য কিছু চাইবো। বল আগে, দিবি...


অম্বর: আরে বাবা... হ্যাঁ রে... দেবো। বল, কি চাস? তুই চাইবি আর আমি দেবো না, সেটা হয় কখনো?


হিয়া : সত্যি দিবি? Promise কর।


অম্বর : সত্যি... সত্যি... সত্যি... তিন সত্যি করছি। এবার তো বল।


হিয়া : অম্বর, কাকু কাকিমার পছন্দের মেঘাকে বিয়ে করে নে...


অম্বর রেগে বলল : তুই কি করে জানলি এসব?


হিয়া : তুই আমাকে কথা দিয়েছিস অম্বর , আমার এই চাওয়াটা তুই পূরণ করবি...


অম্বর অভিমানী স্বরে বলল : তুই কি বলতে চাস আমি তোর কোনও ইচ্ছেই বুঝি না ?

অম্বরের চোখ তখন হিয়ার চোখে আটকে গেছে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে হিয়ার মনে আসলে কি ইচ্ছা আছে। হিয়াও বুঝতে পারছে এই দৃষ্টিতে তার সর্বনাশ নিশ্চিত। এই দৃষ্টির সামনে কিচ্ছু লুকানো যাবে না। খুব ইচ্ছে করছে হিয়ার তলিয়ে যেতে ভালোবাসার গভীর সমুদ্রে , ঢেউ-এর মতো আছড়ে পড়তে আকাশের বুকে, হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ওই মাতাল করা চোখে। বলে দিতে চাইছে, ও ভালোবাসে অম্বরকে। কিন্তু তাহলে তো হিয়া হেরে যাবে, রাখতে পারবে না সে অম্বরের মা'কে দেওয়া কথাটা। হিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অম্বরের কথার উত্তরে বলল : আমার এটাই চাওয়া অম্বর, Please তুই এই চাওয়াটা পূরণ কর... You promise me.


অনিচ্ছা সত্ত্বেও অম্বর রাজী হল। অম্বরের বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্যে সবাই খুশি। অম্বরের পরিবার থেকে নিমন্ত্রণ পত্র এসেছে হিয়ার কাছে।

—--------------------

14 th February


অম্বরের বিয়ে


সকালেই ফোন করল অম্বর হিয়াকে। বলল, "কিরে কখন আসবি আমার বিয়েতে? তোর তো কাল আসার কথা ছিল, এখনো আসিস নি কেন তুই?"


হিয়া : যাবো এক্ষুনি, তুই ঠিক করে নিয়ম-বিধিগুলো পালন কর। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো।


এরপর সন্ধ্যা নেমে গেল কিন্তু হিয়া এলো না অম্বরের বিয়েতে। আবার অম্বর ফোন করল আর বলল, "তুই কখন আসবি ? বিয়ে হয়ে গেলে?"


হিয়া : না রে, একটু কাজ ছিল। তুই বিয়ে করতে যা, আমি বৃষ্টির বাড়ি পৌঁছে যাবো তুই ঠিক করে নিয়ম মেনে বিয়েটা করতো আগে, এতো চিন্তা করিস না।


হিয়া যায়নি বৃষ্টির বাড়ি, যায়নি অম্বরের বাড়িতেও। Mobile switch off করে দিয়েছে, অম্বর বারবার ফোন করেছে হিয়াকে, কিন্তু যোগাযোগ করতে পারেনি। বিয়ের হাজারটা নিয়মের মধ্যে বেরোতে পারেনি বাড়ি থেকে, চিন্তা করেছে হিয়াকে নিয়ে, কিন্তু বলতে পারেনি কাউকে। এইভাবেই কেটে গেছে ফুলশয্যার রাত পর্যন্ত। ফুলশয্যার পরের দিনই সকালে অম্বর বেরিয়ে গেছে হিয়ার বাড়িতে ...আবার টিং টং...


হিয়া দরজা খুলতেই অম্বর প্রশ্ন করল, "কি হয়েছে? তোর ফোন switch off করে রেখেছিস কেন? আসলি না কেন আমার বিয়ে তে?"


হিয়া : আমার এই কদিন ধরে শরীর খুব খারাপ ছিল। তাই যেতে পারিনি তোর বিয়েতে, আর ফোনটাও switch off করে দিয়েছিলাম সেই জন্য।

অম্বর : তুই আমাকে মিথ্যে কথা বলছিস হিয়া 


হিয়া : না, আর এখন থেকে তুই আমার সাথে যোগাযোগ করার কোনও চেষ্টা করবি না, বৃষ্টিকে নিয়েই ভালো থাকবি। আমার এতো খোঁজ খবর নেওয়ার দরকার নেই। আমি চাই না তোর সাথে কোনও সম্পর্ক রাখতে।


কথা গুলো বলে রীতিমত হিয়া হাঁপাচ্ছে, চোখ-কান লাল হয়ে গেছে, বোধ হয় নিজেকে বেশি করেই শক্ত রাখতে চেয়েছে হিয়া । কথাগুলো নির্বাক শ্রোতার মতো শুনে এক বুক অভিমান নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে হিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল অম্বর। রাখেনি সে আর হিয়ার খোঁজ, করেনি সে হিয়ার সাথে কোনও যোগাযোগ।

—---------------------------

এরপর কেটে গেছে সাতটা বছর। অম্বর বাবা হয়েছে। তার এখন যমজ সন্তান, প্রভাত আর প্রভাতী ।


15 th April


অম্বর ঘুরতে এসেছে বৃষ্টি আর তার যমজ সন্তানদের নিয়ে তার সেই বহুদিনের পরিচিত হিয়ার শহরে। প্রতিটা মুহূর্তে আজ হিয়াকে খুব মনে পড়ছে, অম্বরের ইচ্ছে করছে কথা বলতে হিয়ার সাথে। হিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো আজও স্মৃতিতে খুব স্পষ্ট। খুব কষ্ট হচ্ছে অম্বরের , নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসছে তার। শহর ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ এই সময় অম্বরের চোখে পড়ে রাস্তার একপাশে বসে থাকা একটি মেয়ে, অগোছালো একটা ময়লা শাড়ী তার গায়ে, এলোমেলো চুল, কিন্তু মেয়েটার মুখটা খুব চেনা। অম্বর মনে করতে পারছিল না কোথায় দেখেছে সে মেয়েটাকে। হঠাৎ মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই অম্বরের মনে পড়ে গেল বিয়ের আগে গঙ্গার ধারে হিয়ার চোখে একদৃষ্টে তাকানোর কথা। সঙ্গে-সঙ্গে আকাশ চিনতে পারলো মেয়েটাকে। এই মেয়েটা তো তার খুব পরিচিত, তার best friend হিয়া , যাকে সে সারাজীবন নিজের পাশে চেয়েছিল।


সঙ্গে-সঙ্গে অম্বর দৌড়ে গেল হিয়ার কাছে। জিজ্ঞেস করল, "হিয়া , এই হিয়া , কি হয়েছে তোর? তুই এখানে কেন? এই অবস্থা তোর কি করে হল?"

কিন্তু কোনও উত্তর পেল না সে। হিয়া তখন সম্পূর্ণ রূপে মানসিক ভারসাম্যহীন। হিয়ার মুখে তখন শুধু একটাই কথা, "সে আসবে, ঠিক আসবে। আর এসে আমাকে অনেক ভালবাসবে..."


অম্বর কাঁদতে-কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো হিয়াকে। নিজেকে সামলাতে না পেরে জোর করে হিয়াকে তুলে নিল নিজের গাড়িতে। বৃষ্টি , অম্বর আর তাদের যমজ সন্তানদের সাথে হিয়াও এলো অম্বরের বাড়িতে। অম্বর চাইলো হিয়াকে নিজের বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাতে, কিন্তু তার ইচ্ছেতে বাধা দিল বৃষ্টি । সে অম্বরকে বোঝাল সন্তানরা বড়ো হচ্ছে, তাই একটা পাগলিকে বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। আর তাছাড়াও পাগলি কখন কি করবে, কে তাকে সামলাবে? তাই পাগলিটাকে কোনও মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাই ঠিক হবে।


অম্বর মনে-মনে হাসল, বলল, "বেশ-বেশ। যে মেয়ের জন্য তুমি এই বাড়িতে এলে, সেই মেয়েটাকেই এখান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?" কিন্তু মুখে কিছু না বলে অম্বর নিজের শহরেই ভালো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিল হিয়াকে। চলতে থাকলো হিয়ার চিকিৎসা। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অম্বর যায় সেই মানসিক হাসপাতালে, ডাক্তারের সাথে কথা বলে। হিয়ার সমস্ত খোঁজ খবর নেয়। অসুস্থ হিয়াকে একবারও দেখতে পায় নি ঠিকই, কিন্তু মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার সময় এক বুক আশা নিয়ে যায়। ভাবে, আজ তার সাথে সুস্থ হিয়ার দেখা হবে।


এইভাবে কেটে যায় আরও ছ'টা মাস। হিয়া ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে মানসিক হাসপাতালে। আজ অম্বর আবার অনেক আশা নিয়ে যায় মানসিক হাসপাতালে হিয়াকে দেখার জন্য। অবশেষে আজ অম্বরের হিয়ার সাথে দেখা হয়। লোহার জালের একদিকে দাঁড়িয়ে আছে হিয়া , আর একদিকে অম্বর । অম্বর প্রশ্ন করে, "কি হয়েছিল হিয়া তোর? কিভাবে হল এসব?"


হিয়া : জানি না...


অম্বর : কে আসবে, কে তোকে ভালবাসবে বলছিলিস? বল..


হিয়া : কেউ আসবে না কেউ আর আমাকে ভালবাসবে না।


অম্বর : কে বলেছে তোকে কেউ ভালবাসবে না? আমি তো আছি নাকি, তোর best friend. আমি তোকে ভালবাসবো। যাবি হিয়া আমার সাথে আমার বাড়ি? আমি তোকে আমার কাছে রেখে দেবো।


হিয়া আর কোনও কথা বলে না, তাকিয়ে থাকে চুপচাপ অম্বরের চোখের দিকে। গড়িয়ে পড়তে থাকে হিয়ার দুই গাল বেয়ে অশ্রু। কিছুক্ষণ পর মন অম্বরকে বলে, "একটা প্রশ্ন করবো?

অম্বর : হ্যাঁ কর।


হিয়া : জানিস অম্বর যতদিন আমি পাগল হয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলাম আমাকে অনেক নরপশু ভোগ করেছে, কিন্তু আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিলাম বলে কিছু বুঝতে পারতাম না, বলতেও পারতাম না । কিন্তু এখন আমি সুস্থ, আর এই সময়ে যখন এই হাসপাতালের মধ্যে আমাকে নরপশুগুলো খুবলে খায়, ‌‌ নিজেদের যৌনাঙ্গের খিদে মেটায় তখন আমি বুঝতে পারি, আমার খুব কষ্ট হয়, যন্ত্রণায় মরে যাই। তুই কেন আমাকে সুস্থ করলি অম্বর ? কেন আমাকে নিয়ে আসলি এই নরকে? আমি তো পাগল হয়ে গেলেও তোকে ভালোবেসেই ভালো ছিলাম! আমার তো সুস্থ হওয়ার দরকারই ছিল না, এ জীবনে যখন তুই-ই নেই আমার কাছে... তুই কি আমাকে পাগল হয়েও বাঁচতে দিবি না? আমি যাবো না অম্বর তোর সাথে তোর বাড়ি। এখন আমাকে তোর সাথে আর মানায় না। আমার ছায়া আমি আর তোর জীবনে ফেলতে দিতে পারবো না অম্বর । তুই চলে যা, তোর পরিবারকে নিয়ে তুই ভালো থাক। এখানে আর আসবি না কখনো। মনে রাখবি, এই মানসিক হাসপাতালে তোর মন থাকে না।"


এই বলে হিয়া লোহার জালের ঘর থেকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল মানসিক হাসপাতালের ভিতরে , আর লোহার জালের উল্টো দিকে পাথরের মূর্তির মত অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অম্বর।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance