মানবতার মূল্য
মানবতার মূল্য
বর্তমান সমাজের এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাধারণ মেধার সোজা সরল মানুষদের পক্ষে জীবনধারণ করা খুবই কষ্টকর। কারণ ছল চাতুরীতে ভরা এই কঠিন সমাজ জীবনে যদি যথেষ্ট চালাক চতুর না হয় তাহলে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখনকার সমাজে সুচতুর মানুষের অরন্যে একজন ভোলাভালা মানুষের পক্ষে বিনা লড়াইয়ে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের অসহয়তা, পরাজয় তাকে একটা হতাশার সমুদ্রে ফেলে দেয়, এই অসম্ভব মানসিক কষ্টের হাত থেকে বেরিয়ে আসা সহজসাধ্য কাজ নয়।কিন্তু, এই সব মানসিকতার মানুষগুলো যেন অন্য ধাতে গড়া - এরা বার বার হেরে গিয়েও তারা তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয় না। হাজার কঠিন আঘাত পাবার পরেও তারা তাদের নিজের পথে অবিচল থাকে।
অনেক দিন আগে এই শহরে একটি ছেলে ছিল - সে ছিল খুবই সাদাসিদে ও সৎ। দারিদ্র ছিল তার জীবন সঙ্গী। একে অর্থাভাব তার উপরে ছিল তার ব্যক্তিগত নীতি ও আদর্শ যা তাকে কোন ভাবেই অসততার পথে ঠেলে দিতে পারতো না। শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও সে চেষ্টা করত অন্যের বিপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার। নিজের দুঃস্থ পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য
সে একটি দোকানে চাকুরি করতো। সামান্য শিক্ষার জোরে কোন বিশাল বড় চাকুরী তার ভাগ্যে ছিল না। তাই
ছেলেটির মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। ছেলেটি যে দোকানে কাজ করত,সেই দোকানের সামনে দিয়ে প্রতিদিন একটি মেয়ে স্কুলে যেত। মেয়েটি ছিল ভদ্র ও লজ্জাশীল। যদিও সে এক উচ্চবিত্ত পরিবারের তবুও তা সে মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দিত না । ছেলেটির মত সেও বিশ্বাস করে মানবতা ধর্মে।এভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ ছেলেটির নজর পড়লো মেয়েটির দিকে।তারপর বেশ কদিন যাবার পর একদিন মেয়েটি বুঝতে পারলো ছেলেটি তাকে লুকিয়ে লক্ষ্য করে । মেয়েটিও আড় চোখে
ছেলেটিকে দেখতে শুরু করলো। ছেলেটি মেয়েটির চলাফেরা দেখে মুগ্ধ হয়ে আফসোস করতে লাগলো । সে মনে ভাবতে লাগলো - ইস যদি আমিও আজ পড়াশুনা করতে পারতাম। তাহলে সাহস করে মেয়েটির সাথে কথা বলতে পারতাম । এদিকে মেয়েটিও বুঝতে পারলো ছেলেটি তাকে ভীষণ পছন্দ করে । তাই একদিন বুক ভরা কৌতূহল নিয়ে মেয়েটি ছেলেটির দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে, ছেলেটিও দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বের হলো ।সে তার স্বল্প আয়ের ব্যাপার বোঝে, তাই সে একটি চায়ের দোকানে গিয়ে পাঁচ টাকার মধ্যে কিছু খাবার খেয়ে জল পান করে কাজের জায়গায় ফিরে আসতে লাগলো। তখন মেয়েটি একটু এগিয়ে তার কাছে গেলো। মেয়েটি বললো তুমি ভাত খেলেনা। ঐটুকু রুটি দিয়ে কি পেট ভরবে । তখন ছেলেটি মেয়েটিকে হঠাৎ দেখে অবাক হয়ে গেলো। ছেলেটি বললো আমি রোজ ভাত খেলে যে টাকা খরচ হবে, তারপর আমি কিভাবে আমার মা,আর ছোট বোনকে কি খাওয়াবো । মেয়েটি শিক্ষিত তাই অল্পতেই বুঝে গেলো। সে ছেলেটির হাত ধরে বলতে লাগলো তাহলে তুমি যে আমাকে পছন্দ করো।তাহলে আমাকে কি খাওয়াবে । তখন ছেলেটি বললো আমিতো তোমাকে আপন করে পাওয়ার জন্য দেখি না । কারন সে যোগ্যতা আমার নেই । তবে এটা সত্য যে তোমায় দেখলে আমার খুব ভালো লাগে। তাই দেখি ।আসলে কি জান, সব ভালো লাগাই কিন্তু ভালোবাসায় পরিণত করা যায় না। মেয়েটি ছেলেটির কথা শুনে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলোনা ।সে বুঝে গেলো ছেলেটির চরিত্র, যে মনের দিকে থেকে সে কতটা সৎ, শুধু তাই নয় এমনকি মানসিকতাও কত সুন্দর।
এরপর সেদিন মেয়েটি চলে গেলো। বাসায় ফিরে গিয়ে রাত্রিবেলা মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরেরদিন তাকে ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তারখানায় ওর অনেক রকম ক্লিনিকাল পরীক্ষা করা হল, পরীক্ষার ফলাফল দেখার পর বলা হলো তার দুটো কিডনিই নশ্ট।
সব শুনে তখন মেয়ের বাবা ফোন করল তার বন্ধুর ছেলেকে। যার সাথে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটির বাবা পাগল।কিন্তুু মেয়েটি বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি নয়।কারন ছেলেটির টাকা থাকলে কি হবে তার চরিত্র খারাপ। সে ছিল নারী ও অর্থ লোভী । এদিকে মেয়েটির কোন লোভ ছিলনা। যাইহোক হবু জামাই আসার পর তাকে সব বলা হলো। এখন কোথাও কিডনিও মিলছেনা। তখন মেয়ের বাবা তাকে বললো তোমার থেকে একটা কিডনি আমার মেয়েটিকে দাও । তুমিতো বলেছো আমার মেয়েকে তুমি অনেক ভালবাসো । ওকে জীবনে পেলে তুমি একটা সুন্দর জীবন পেয়ে যাবে। তাহলে আজ পরীক্ষা দাও।তখন ছেলেটি বললো, আচ্ছা আমি আপনার অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে করবো কেন?
আমার কি সুস্থ মেয়ের অভাব নাকি? এই বলে সে চলে গেলো। বাবা তখন কেঁদে কেঁদে মেয়ের কাছে গিয়ে সব খুলে বললো। মেয়েটি সব শুনে বলল, বাবা তুমি কান্নাকাটি কর না । একটা পথ এখনও খোলা আছে।তুমি এখন একটা কাজ করো। আমাদের বাড়ীর সামনের মোড়ে একটা বড় গ্যারেজ আছে না। তুমি সেখানে যাও আর গিয়ে তরুণ নামে একটা ছেলে আছে,
তাকে নিয়ে আসো। আমার কথা বলো । দেখ ও ঠিক চলে আসবে। তখন ওর বাবা গিয়ে ছেলেটির সাথে দেখা করলো এবং সব কথা শোনার পর ছেলেটি ওনার সঙ্গে চলে আসলো। অসুস্থ মেয়েটিকে দেখে ছেলেটির চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো।কারন মেয়ের বাবা তাকে সব খুলে বলেছে। তখন ছেলেটিকে মেয়েটি বললো,- তুমি আমাকে একটা কিডনি দেবে? ছেলেটি বললো,- কিডনি দেবার জন্যই আমি এসেছি। মেয়েটি তাকে বললো,- এরজন্য তুমি কি চাও? ছেলেটি বললো তুমি সুস্থ হয়ে আমার দোকানের সামনে দিয়ে স্কুলে যাবে। আর আমি শুধু তোমাকে দুর থেকে তাকিয়ে দেখবো।
এই অনুমতি টুকুই চাই । এ কথা শুনে মেয়ে এবং বাবা দুজনেই চোখের জল ধরে রাখতে পারলোনা । অবশেষে মেয়েটি বিছানা থেকে উঠে ছেলেটির দু হাত জড়িয়ে ধরে বললো,- এ জীবনে তোমার থেকে আমাকে একমাত্র মৃত্যুই আলাদা করতে পারবে। আর কেহ পারবেনা।
তারপর মেয়েটি বললো আমার কোন কিডনি নষ্ট হয়নি।
এ সব ছিল আমার সাজানো নাটক। আমি যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে।
তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম একমাত্র তুমি আমার যোগ্য।
মেয়েটির বাবাও মেয়েটির বুদ্ধিতে চমৎকৃত এবং খুশিমনে দুজনের সম্পর্ক মেনে নিলেন।

